টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম

পানি ঢুকে পড়েছে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও

মৌসুমের প্রথম একটানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা। জলাবদ্ধতায় নগরীর প্রধান সড়কসহ শাখা সড়কগুলো ডুবে যাওয়ায় পথে পথে যানবাহন অচল হয়ে পড়ে। এতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়ে বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। অবশ্য বৃষ্টিতে সৃষ্টি হওয়া এ জলাবদ্ধতাকে জলাবদ্ধতা বলতে নারাজ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। তারা একে বলছেন জলজট। আকস্মিক বৃষ্টিতে এ জলজট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। খুব শীঘ্রই জমে থাকা জল নিষ্কাশন হবে বলেও জানিয়েছেন তারা। এদিকে গত ৩ জুন চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লায় পুরোনো নগর ভবনের কেবি আবদুচ ছত্তার মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আসন্ন বর্ষায় চট্টগ্রাম নগরী গলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

সম্মেলনে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় নগরীর বিভিন্ন খালে দেয়া অস্থায়ী বাঁধ অপসারণের পক্ষে মত দিয়েছেন মেয়র। রোববার দিনভর বৃষ্টিতে মেয়রের কথাই সত্য প্রমাণিত হলো।

জানা গেছে, গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টিপাত শুরুর আধাঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যেই পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃষ্টি শুরুর পর এত কম সময়ের মধ্যে জলাবদ্ধতা অতীতে দেখা যায়নি। এজন্য তারা বাস্তবায়নাধীন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নগরীর বিভিন্ন খালে যে বাঁধ দিয়েছে, তাকে দায়ী করেছেন।

তবে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সেনাবাহিনী নিযুক্ত প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী বলেন, হঠাৎ অতিবৃষ্টি হয়েছে। তীব্রতা বেশি ছিল। পানি সাময়িকভাবে জমে গেলেও দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এজন্য এটাকে আমরা জলাবদ্ধতা বলছি না। ড্রেন এবং খালের প্রশস্ততা আমরা বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। এজন্য পানি দ্রুত নামছে। খালের যেসব স্থানে বাঁধ দেয়া হয়েছিল, সেগুলো কেটে দিয়েছি। আমাদের কুইক রেসপন্স টিম, ইমার্জেন্সি টিম আটকে থাকা পানি সরাতে কাজ করছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বছর তিনেক আগে অর্থাৎ বিগত ১৪২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখেই শ্রাবণধারায় আগাম বর্ষার এক ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেই বছর মধ্যবৈশাখ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা বিগত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে এবার কালবৈশাখী মৌসুমে প্রত্যাশিত স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়নি। কর্মকর্তারা আরও বলেন, জুনের শেষ থেকে আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম ধরা হয়।

দেশের নদ-নদীর পানির ৯৩ শতাংশই আসে উজানের দেশ নেপাল, ভারত এবং কিছুটা ভুটান থেকে। বহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ওপরই বাংলাদেশে বন্যা হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে। উজানের পাশাপাশি দেশে অতিবৃষ্টি হলে জুনের শেষ দিকে ক্রমাগতভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। আর নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শহীদুল ইসলাম বলেন, প্রাক মৌসুমি বায়ু ও লঘুচাপের প্রভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তবে তা থেমে থেমে হবে। চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হবে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বৃষ্টিতে নগরীর বিভিন্ন এলাকার কোথাও হাঁটুর সমান, আবার কয়েকটি স্থানে কোমর সমান পানি উঠেছে। নগরীর ষোলশহর, কাপাসগোলা, চাক্তাই, বাকলিয়া, ডিসি রোড, রাহাতারপুল, রহমতগঞ্জ, হালিশহর, চান্দগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। রাহাত্তারপুল এলাকার বাসিন্দা মো. সোলায়মান বলেন, নিচু এলাকা হওয়ায় সবসময় বৃষ্টি হলে এখানে পানি ওঠে। এবার বেশি পানি উঠেছে। আসকার দিঘীরপাড় এলাকা কিছুটা উঁচু হওয়ায় সচরাচর এখানে পানি উঠে না। কিন্তু জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজের কারণে বড় নালায় বাঁধ দেয়ায় নালার পাশের নিচু স্থানগুলো প্লাবিত হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

আসকার দিঘীর দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ের ছালাম বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা পুতুল দাশ বলেন, নালার পাড়েই ভবন। বাসার নিচে কোমর সমান পানি হয়েছে। অফিসে যাবার জন্য বের হয়েও যেতে পারিনি। নগরীর ডিসি রোডে হাঁটু পরিমাণ পানি উঠেছে। সেখানে সড়ক সংস্কারের কাজ চলছে। বৃষ্টির পানি, কাদায় স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

ডিসি রোডের বাসিন্দা সাহেদ মুরাদ সাকু বলেন, বাসার নিচে এক হাঁটু পানি উঠেছে। বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানিও বাড়ছে। নালা ও খাল দিয়ে পানি যেতে পারছে না।

এদিকে নগরীর বিভিন্নস্থানে পানি উঠে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। এছাড়া বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতে কর্মস্থলের উদ্দেশ্য বের হওয়া মানুষের মধ্যে আতঙ্কও তৈরি হয়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ টানা বৃষ্টি, জোয়ার এবং বিভিন্ন খালে বাঁধ দেয়ার কারণে জলাবদ্ধতা হয়েছে। নগরীর অন্তত ২০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে। এর চেয়েও কিছুটা বেশি হতে পারে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে শহরের অধিকাংশ নিচু এলাকা তলিয়ে যাবে।

এদিকে জনদুর্ভোগের আরেক নাম বহদ্দারহাট। একটু ?বৃষ্টি হলেই অলি-গলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক তলিয়ে যায় বৃষ্টির পানিতে। এই এলাকায় রাস্তা আর ফুটপাত আলাদা কিছু নেই। পথচারীরা রাস্তা পারাপার হতে পারছেন না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও পাচ্ছেন না গণপরিবহন।

অল্প কিছু গণপরিবহন পাওয়া গেলেও ছেড়ে যাচ্ছে না নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কেবল বহদ্দারহাট নয়, একই চিত্র মুরাদপুরেও। সাধারণ মানুষ উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে গণপরিবহনের জন্য। কিন্তু দেখা মিলেনি গণপরিবহনের। গণপরিবহন না পেয়ে অনেকেই হাঁটতে শুরু করেছেন। এই সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণে চট্টগ্রামের প্রধান সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ থাকে কয়েক ঘণ্টা ধরে।

বহদ্দারহাটে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলারে সঙ্গে। ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, বহদ্দারহাট এখন বহদ্দার খালে রূপ নিয়েছে। বাসার সামনে হাঁটু পরিমাণ পানি থেকে এখন এক কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছি। এতো উন্নয়ন!’ এটি সত্যিই আমাদের অক্ষমতা আর মেধাহীনতার পরিচয়।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা মাকসুদুর রহমান বলেন, প্রতিদিন সিএনজিতে করে অফিসে যাই। কিন্তু পানি ওঠার কারণে প্রায় সব ধরনের যানবাহনে পানিতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা। বাধ্য হয়ে দ্বিগুণ ভাড়ায় রিকশা নিয়েছি। এতেও দুর্ভোগের শেষ নেই। ছোট-খাটো গর্তে চাকা ঢুকে আটকে থাকতে হচ্ছে প্রায় ১৫-২০ মিনিট। জলাবদ্ধতায় শুধু রাস্তাঘাটে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এমন নয়। নিম্নাঞ্চলের বাসা-বাড়ি, হাসপাতালে ঢুকে পড়েছে পানি। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বাসা-বাড়ির মানুষজনকে। দুপুর থেকে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের নিচের তলায় পানিতে টইটম্বুর। সেবা প্রার্থীদের এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অন্যদিকে জলাবদ্ধতায় আর বৃষ্টিতে চরম বেকায়দায় পড়েছেন নিম্নআয়ের লোকজন। জলাবদ্ধতার কারণে তারা কাজে বেরুতে পারেননি।

চসিকের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এই মৌসুমে প্রথম টানা মাঝারি মাত্রার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি শুরুর ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই জলাবদ্ধতা হয়েছে। এটা আমরা অতীতে দেখিনি। খালে বাঁধ দেয়ার কারণে এ পরিস্থিতি হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এ প্রকল্পের আওতায় নগরীর বিভিন্ন খালের ভেতরের অংশে অস্থায়ী বাঁধ দিয়ে জলকপাট ও প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। খালে দেয়া বাঁধের কারণে ব্যাপক জলাবদ্ধতার আশঙ্কার কথা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।

অন্যদিকে টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় ধসের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সতর্ক অবস্থায় আছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, আমাদের ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট বিভিন্ন পাহাড়ে গেছেন। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যারা বসবাস করছেন, তাদের সরানোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আমাদের ১০০টা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতির কাজ চলছে। পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে।

সোমবার, ০৭ জুন ২০২১ , ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৫ শাওয়াল ১৪৪২

টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রাম

পানি ঢুকে পড়েছে বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও

নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম

image

চট্টগ্রাম : বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে নগর। বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি থৈ থৈ করছে। চরম দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ। যান চলাচল ব্যাহত -সংবাদ

মৌসুমের প্রথম একটানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা। জলাবদ্ধতায় নগরীর প্রধান সড়কসহ শাখা সড়কগুলো ডুবে যাওয়ায় পথে পথে যানবাহন অচল হয়ে পড়ে। এতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়ে বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। অবশ্য বৃষ্টিতে সৃষ্টি হওয়া এ জলাবদ্ধতাকে জলাবদ্ধতা বলতে নারাজ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। তারা একে বলছেন জলজট। আকস্মিক বৃষ্টিতে এ জলজট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। খুব শীঘ্রই জমে থাকা জল নিষ্কাশন হবে বলেও জানিয়েছেন তারা। এদিকে গত ৩ জুন চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লায় পুরোনো নগর ভবনের কেবি আবদুচ ছত্তার মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আসন্ন বর্ষায় চট্টগ্রাম নগরী গলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

সম্মেলনে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় নগরীর বিভিন্ন খালে দেয়া অস্থায়ী বাঁধ অপসারণের পক্ষে মত দিয়েছেন মেয়র। রোববার দিনভর বৃষ্টিতে মেয়রের কথাই সত্য প্রমাণিত হলো।

জানা গেছে, গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টিপাত শুরুর আধাঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যেই পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃষ্টি শুরুর পর এত কম সময়ের মধ্যে জলাবদ্ধতা অতীতে দেখা যায়নি। এজন্য তারা বাস্তবায়নাধীন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নগরীর বিভিন্ন খালে যে বাঁধ দিয়েছে, তাকে দায়ী করেছেন।

তবে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সেনাবাহিনী নিযুক্ত প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী বলেন, হঠাৎ অতিবৃষ্টি হয়েছে। তীব্রতা বেশি ছিল। পানি সাময়িকভাবে জমে গেলেও দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এজন্য এটাকে আমরা জলাবদ্ধতা বলছি না। ড্রেন এবং খালের প্রশস্ততা আমরা বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। এজন্য পানি দ্রুত নামছে। খালের যেসব স্থানে বাঁধ দেয়া হয়েছিল, সেগুলো কেটে দিয়েছি। আমাদের কুইক রেসপন্স টিম, ইমার্জেন্সি টিম আটকে থাকা পানি সরাতে কাজ করছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বছর তিনেক আগে অর্থাৎ বিগত ১৪২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখেই শ্রাবণধারায় আগাম বর্ষার এক ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেই বছর মধ্যবৈশাখ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা বিগত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে এবার কালবৈশাখী মৌসুমে প্রত্যাশিত স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়নি। কর্মকর্তারা আরও বলেন, জুনের শেষ থেকে আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম ধরা হয়।

দেশের নদ-নদীর পানির ৯৩ শতাংশই আসে উজানের দেশ নেপাল, ভারত এবং কিছুটা ভুটান থেকে। বহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ওপরই বাংলাদেশে বন্যা হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে। উজানের পাশাপাশি দেশে অতিবৃষ্টি হলে জুনের শেষ দিকে ক্রমাগতভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। আর নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শহীদুল ইসলাম বলেন, প্রাক মৌসুমি বায়ু ও লঘুচাপের প্রভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তবে তা থেমে থেমে হবে। চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হবে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বৃষ্টিতে নগরীর বিভিন্ন এলাকার কোথাও হাঁটুর সমান, আবার কয়েকটি স্থানে কোমর সমান পানি উঠেছে। নগরীর ষোলশহর, কাপাসগোলা, চাক্তাই, বাকলিয়া, ডিসি রোড, রাহাতারপুল, রহমতগঞ্জ, হালিশহর, চান্দগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। রাহাত্তারপুল এলাকার বাসিন্দা মো. সোলায়মান বলেন, নিচু এলাকা হওয়ায় সবসময় বৃষ্টি হলে এখানে পানি ওঠে। এবার বেশি পানি উঠেছে। আসকার দিঘীরপাড় এলাকা কিছুটা উঁচু হওয়ায় সচরাচর এখানে পানি উঠে না। কিন্তু জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজের কারণে বড় নালায় বাঁধ দেয়ায় নালার পাশের নিচু স্থানগুলো প্লাবিত হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

আসকার দিঘীর দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ের ছালাম বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা পুতুল দাশ বলেন, নালার পাড়েই ভবন। বাসার নিচে কোমর সমান পানি হয়েছে। অফিসে যাবার জন্য বের হয়েও যেতে পারিনি। নগরীর ডিসি রোডে হাঁটু পরিমাণ পানি উঠেছে। সেখানে সড়ক সংস্কারের কাজ চলছে। বৃষ্টির পানি, কাদায় স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

ডিসি রোডের বাসিন্দা সাহেদ মুরাদ সাকু বলেন, বাসার নিচে এক হাঁটু পানি উঠেছে। বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানিও বাড়ছে। নালা ও খাল দিয়ে পানি যেতে পারছে না।

এদিকে নগরীর বিভিন্নস্থানে পানি উঠে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। এছাড়া বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতে কর্মস্থলের উদ্দেশ্য বের হওয়া মানুষের মধ্যে আতঙ্কও তৈরি হয়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ টানা বৃষ্টি, জোয়ার এবং বিভিন্ন খালে বাঁধ দেয়ার কারণে জলাবদ্ধতা হয়েছে। নগরীর অন্তত ২০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে। এর চেয়েও কিছুটা বেশি হতে পারে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে শহরের অধিকাংশ নিচু এলাকা তলিয়ে যাবে।

এদিকে জনদুর্ভোগের আরেক নাম বহদ্দারহাট। একটু ?বৃষ্টি হলেই অলি-গলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক তলিয়ে যায় বৃষ্টির পানিতে। এই এলাকায় রাস্তা আর ফুটপাত আলাদা কিছু নেই। পথচারীরা রাস্তা পারাপার হতে পারছেন না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও পাচ্ছেন না গণপরিবহন।

অল্প কিছু গণপরিবহন পাওয়া গেলেও ছেড়ে যাচ্ছে না নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কেবল বহদ্দারহাট নয়, একই চিত্র মুরাদপুরেও। সাধারণ মানুষ উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে গণপরিবহনের জন্য। কিন্তু দেখা মিলেনি গণপরিবহনের। গণপরিবহন না পেয়ে অনেকেই হাঁটতে শুরু করেছেন। এই সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণে চট্টগ্রামের প্রধান সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ থাকে কয়েক ঘণ্টা ধরে।

বহদ্দারহাটে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলারে সঙ্গে। ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, বহদ্দারহাট এখন বহদ্দার খালে রূপ নিয়েছে। বাসার সামনে হাঁটু পরিমাণ পানি থেকে এখন এক কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছি। এতো উন্নয়ন!’ এটি সত্যিই আমাদের অক্ষমতা আর মেধাহীনতার পরিচয়।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা মাকসুদুর রহমান বলেন, প্রতিদিন সিএনজিতে করে অফিসে যাই। কিন্তু পানি ওঠার কারণে প্রায় সব ধরনের যানবাহনে পানিতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা। বাধ্য হয়ে দ্বিগুণ ভাড়ায় রিকশা নিয়েছি। এতেও দুর্ভোগের শেষ নেই। ছোট-খাটো গর্তে চাকা ঢুকে আটকে থাকতে হচ্ছে প্রায় ১৫-২০ মিনিট। জলাবদ্ধতায় শুধু রাস্তাঘাটে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এমন নয়। নিম্নাঞ্চলের বাসা-বাড়ি, হাসপাতালে ঢুকে পড়েছে পানি। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বাসা-বাড়ির মানুষজনকে। দুপুর থেকে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের নিচের তলায় পানিতে টইটম্বুর। সেবা প্রার্থীদের এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অন্যদিকে জলাবদ্ধতায় আর বৃষ্টিতে চরম বেকায়দায় পড়েছেন নিম্নআয়ের লোকজন। জলাবদ্ধতার কারণে তারা কাজে বেরুতে পারেননি।

চসিকের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এই মৌসুমে প্রথম টানা মাঝারি মাত্রার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি শুরুর ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই জলাবদ্ধতা হয়েছে। এটা আমরা অতীতে দেখিনি। খালে বাঁধ দেয়ার কারণে এ পরিস্থিতি হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এ প্রকল্পের আওতায় নগরীর বিভিন্ন খালের ভেতরের অংশে অস্থায়ী বাঁধ দিয়ে জলকপাট ও প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। খালে দেয়া বাঁধের কারণে ব্যাপক জলাবদ্ধতার আশঙ্কার কথা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।

অন্যদিকে টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় ধসের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সতর্ক অবস্থায় আছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, আমাদের ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট বিভিন্ন পাহাড়ে গেছেন। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যারা বসবাস করছেন, তাদের সরানোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আমাদের ১০০টা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতির কাজ চলছে। পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে।