দিনাজপুর মধ্যপাড়া পাথরখনি

জিটিসির হাত ধরে তৃতীয়বারের মতো লাভের মুখ দেখছে

দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের পার্বতীপুর মধ্যপাড়া পাথরখনি টানা ৩য় বারের মতো লাভের মুখ দেখছে। ফলে খনির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রফিট বোনাসও পাচ্ছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল (১৯৭৩-১৯৭৫) সালে বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া এলাকায় ১২৮ মিটার গভীরতায় কঠিন শিলা আবিষ্কার করে। উত্তর কোরিয়ার মেসার্স কোরিয়া সাউথ কোঅপারেশন কপোরেশন (নাম নাম) সঙ্গে পাথর খনি উন্নয়নের ১৯৯৪ সালের ২৭ মার্চ মূল চুক্তি হয়।

কয়েক দফা ব্যয় বৃদ্ধির পর ২০০৭ সালের ২৫ মে পাথর খনির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পাথর উত্তোলন কাজ শুরু হয়। প্রতিদিন এক শিফটে পাথর উত্তোলন ছিল ৩০০-৪০০ মেট্রিক টন। বাণিজ্যিকভাবে পাথর উত্তোলন হলেও ছিল না খনির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ। সেই সময়ে খনিটি প্রায় কয়েক শত কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে পুরোপুরি বন্ধের উপক্রম হয়। দেশের অর্থনীতিতে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় উন্নতমানের এই শিলা খনিটি। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল সম্ভাবনাময় মধ্যপাড়া পাথর খনিটির ভবিষৎ।

খনিটিকে সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে মধ্যপাড়া পাথর খনির খনি ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন, উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং পরিষেবার জন্য জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) এবং মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) মধ্যে ২০১৩ সালে ২ সেপ্টম্বের ৬ বছর মেয়াদি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিগত ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুক্তিটি কার্যকর হয়।

২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি খনিতে পাথর উৎপাদন শুরু হয়। সে সময়ে জিটিসি খনিটির বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি অচল অবস্থায় পায়।

খনিতে জিটিসি পাথর উৎপাদন শুরুর পরে, এমজিএলসি কর্তৃপক্ষ খনি কাজে অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ সময়মতো আমদানি করার অনুমোদন না দেয়া অর্থাৎ দুই বছর বিলম্ব করায় খনি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপরিহার্য ড্রইং ডিজাইন অনুমোদনে এমজিএলসি কর্তৃপক্ষ ২ বছর বিলম্বের কারণে খনির কাজ দীর্ঘ প্রায় ৩ বছর সময় ব্যাহত থাকে।

বিদেশি মেশিনারিজ ও যন্ত্রাংশের অভাবে খনিটির উন্নয়ন ও উৎপাদন ব্যাহত না হয়ে গেলে পুরো চুক্তির মেয়াদ পযর্ন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে খনির উন্নয়ন ও পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসি তাদের চুক্তির মেয়াদে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী স্টোপ নির্মাণসহ পাথর উত্তোলন করতে সক্ষম হতো। কিন্তু এতো সব বাধা অতিক্রম করে জিটিসি তিন শিফট চালু করে প্রতিদিন খনি থেকে পাথর উত্তোলন করে খনির উৎপাদন ইতিহাসে নয়া রেকর্ড সৃষ্টি করে।

প্রতিদিন তিন শিফটে সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলনের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পাথর খনিটি চালু করা হয়েছিল, একমাত্র জিটিসিই সেই লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে একদিনে তিন শিফটে ৬ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত পাথর উত্তোলন করে তাদের সক্ষমতার পরিচয় দেয়। শতাধিক বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞ ও অর্ধশত দেশি প্রকৌশলী এবং সাড়ে ৭শ’ দক্ষ খনি শ্রমিক দিনে-রাতে রেকর্ড পরিমাণ পাথর উত্তোলন করার কারণে মধ্যপাড়া পাথর খনি কর্তৃপক্ষ ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে লোকসানের কলঙ্ক ঘুচিয়ে প্রথম লাভের মুখ দেখে।

সে অর্থবছরে খনি কর্তৃপক্ষের প্রায় ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা লাভ হয় এবং মধ্যপাড়া পাথর খনি প্রথমবারের মতো লাভের মুখ দেখার পুরো কৃতিত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসির। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে প্রায় ২২ কোটি টাকা মুনাফা করে দ্বিতীয়বার লাভজনক প্রতিষ্ঠানের ধারা অব্যাহত রাখে পাথর খনিটি। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরেও খনিটি লাভজনক হবে। সেই সঙ্গে পাথর বিক্রি থেকে ভ্যাট ও ট্রাক্সসহ কয়েক কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হয়েছে।

বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম. হাসান, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামনুদ্দীন চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক খনিতে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানপূর্বক একটি নিদের্শনার মাধ্যমে জিটিসিকে ১ বছরের জন্য সময় বৃদ্ধি করা হয়।

ইতোমধ্যে নির্ধারিত সময়ের ৩ মাস আগেই জিটিসি বৈশ্বিক মহামারী করোনার ভয়াবহতা সত্ত্বেও বর্ধিত সময়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১.১ মিলিয়ন টন পাথর উৎপাদন ও আরও দুইটি নতুন (স্টোপ) নিমার্ণ কাজ সমাপ্ত করে তাদের সক্ষমতা ও খনি কাজের সাফল্য প্রমাণ করেছে ও জিটিসি চুক্তির বর্ধিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও ২০% পাথর বেশি উৎপাদন করবে। করোনার এই মহামারীতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে জিটিসি সব শ্রমিকদের নিয়ে পাথর উৎপাদন অব্যাহত রেখে মধ্যপাড়া পাথর খনির অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে।

মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবু দাউদ মুহম্মদ ফরিদুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনার মধ্যে দেশের অন্যান্য খনি প্রকল্পগুলো জনবল অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। পক্ষান্তরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মধ্যপাড়া পাথর খনির উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে। পাথর উত্তোলন হয়েছে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টন। এ হিসাবে অন্তত ২০ শতাংশ বেশি পাথর উৎপাদন হয়েছে। বর্ধিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই আরও দুটি স্টোপ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।

কেননা এই উপজেলারই পার্শ্ববর্তী উৎপাদনে থাকা বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ঠিকাদারি চায়না প্রতিষ্ঠান অধিকাংশ শ্রমিককে ছুটি দিয়ে স্বল্প পরিসরে উৎপাদন চালু রেখেছে। ফলে বেকার হয়ে বসে আছে দুই তৃতীয়াংশ কয়লা খনি শ্রমিক। এখানে লক্ষণীয়, জিটিসি তার কারিগরি দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে খনির উৎপাদন ও উন্নয়ন ব্যয় কোন প্রকার বৃদ্ধি ব্যতিরেকেই বিগত ৭ বছর যাবত খনি পরিচালনা করে যাচ্ছে। যেখানে পার্শ্ববর্তী খনিতে দফায় দফায় উৎপাদন ও উন্নয়ন ব্যয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একমাত্র জিটিসিই মধ্যপাড়া পাথর খনিতে দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করে খনিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।

জিটিসির এ কাজের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে খনিটি সবসময়ই লাভজনক থাকবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যপাড়া পাথর খনি পৃথিবীর একমাত্র ভূগর্ভস্থ গ্রানাইট মাইন, যার লাভজনক পরিচালনা, উৎপাদন ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র জিটিসির রয়েছে।

হরিরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহবুদ্দীন শাহ বলেন, খনিটিতে প্রতিদিন পাথর বহন ও ক্রেতাদের পদচারণায় মুখোরিত হয়ে উঠেছে খনি এলাকা। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দোকানপাট। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক পাথর নেয়ার জন্য খনিতে আসে, সেখানে পাথর লোড আনলোড করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে কয়েকশ’ শ্রমিক। এতে সেখানকার অর্থনীতি ও জীবন-যাত্রার মান উন্নয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।

এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, একমাত্র জিটিসির মাধ্যমে দেশের এই সম্ভাবনাময় খনিটির উৎপাদনের চাকা সচল রাখবে। তারা বলেন, এই খনি সচল থাকলে তাদের জীবিকা ও অর্থনীতি সচল থাকবে। একমাত্র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসিই মধ্যপাড়া পাথর খনিতে দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করে খনিটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে এবং জিটিসি’র এই কাজের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে খনিটি সব সময়ই লাভজনক থাকবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যপাড়া পাথর খনি পৃথিবীর একমাত্র ভূ-গর্ভস্থ মাইন, যার লাভজনক পরিচালনা, উৎপাদন ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র জিটিসির রয়েছে। পাথর উৎপাদন ও খনি উন্নয়নের পাশাপাশি খনির সম্মুখে ‘জিটিসি চ্যারিটি হোম’ স্থাপন করে খনি শ্রমিকদের উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত সন্তানদের মাঝে শিক্ষা বৃত্তি, এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং এলাকার আর্থ-সামাজিক নানা কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করে এলাকাবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ।

চ্যারিটি হোমে অভিজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে প্রতিদিন খনি এলাকার ৪০/৫০ জন রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ সেবা দিচ্ছে। প্রতিমাসে খনি শ্রমিকদের সন্তানদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তি, ননএমপিভুক্ত মধ্যপাড়া মহাবিদ্যালয়কে মাসিক আর্থিক সহায়তা এবং এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছে। এলাকার মানুষ বলছে, জিটিসি’র এই সেবামূলক কর্মকা- একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

image

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অবস্থিত মধ্যপাড়া পাথরখনি থেকে উত্তোলিত পাথরের স্তূপ -সংবাদ

আরও খবর
বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার টোল আদায় সেতুমন্ত্রী
অর্থ পাচারে সরকারি দলের এমপির ক্ষোভ
ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস আজ
বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষা আর্মি স্টেডিয়ামে
টিকা নিয়ে নয়ছয়, জনজীবন হুমকির মুখে সংসদে রুমিন ফারহানা
সীমান্ত নিরাপত্তা দুর্বলতায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আসছে হারুনুর রশীদ
রেকর্ড পাচার, নষ্ট বা হ্যাক করলে জেল-জরিমানা
বিধি তৈরি না করেই ভারতে নাগরিকত্ব আইন!
নদী খননে দুর্নীতি ও প্রতারণা হচ্ছে বাপা
হল বন্ধ, ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার ঢাবি ছাত্রীর লাশ
কেরামত হুজুরের কেরামতির নামে ধর্ষণ, মামলা, গ্রেপ্তার
সামান্য বৃষ্টিতেই নগরী প্লাবিত

সোমবার, ০৭ জুন ২০২১ , ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৫ শাওয়াল ১৪৪২

দিনাজপুর মধ্যপাড়া পাথরখনি

জিটিসির হাত ধরে তৃতীয়বারের মতো লাভের মুখ দেখছে

চিত্ত ঘোষ, দিনাজপুর

image

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অবস্থিত মধ্যপাড়া পাথরখনি থেকে উত্তোলিত পাথরের স্তূপ -সংবাদ

দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের পার্বতীপুর মধ্যপাড়া পাথরখনি টানা ৩য় বারের মতো লাভের মুখ দেখছে। ফলে খনির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রফিট বোনাসও পাচ্ছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল (১৯৭৩-১৯৭৫) সালে বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া এলাকায় ১২৮ মিটার গভীরতায় কঠিন শিলা আবিষ্কার করে। উত্তর কোরিয়ার মেসার্স কোরিয়া সাউথ কোঅপারেশন কপোরেশন (নাম নাম) সঙ্গে পাথর খনি উন্নয়নের ১৯৯৪ সালের ২৭ মার্চ মূল চুক্তি হয়।

কয়েক দফা ব্যয় বৃদ্ধির পর ২০০৭ সালের ২৫ মে পাথর খনির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পাথর উত্তোলন কাজ শুরু হয়। প্রতিদিন এক শিফটে পাথর উত্তোলন ছিল ৩০০-৪০০ মেট্রিক টন। বাণিজ্যিকভাবে পাথর উত্তোলন হলেও ছিল না খনির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ। সেই সময়ে খনিটি প্রায় কয়েক শত কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে পুরোপুরি বন্ধের উপক্রম হয়। দেশের অর্থনীতিতে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় উন্নতমানের এই শিলা খনিটি। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল সম্ভাবনাময় মধ্যপাড়া পাথর খনিটির ভবিষৎ।

খনিটিকে সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে মধ্যপাড়া পাথর খনির খনি ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন, উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং পরিষেবার জন্য জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) এবং মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) মধ্যে ২০১৩ সালে ২ সেপ্টম্বের ৬ বছর মেয়াদি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিগত ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুক্তিটি কার্যকর হয়।

২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি খনিতে পাথর উৎপাদন শুরু হয়। সে সময়ে জিটিসি খনিটির বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি অচল অবস্থায় পায়।

খনিতে জিটিসি পাথর উৎপাদন শুরুর পরে, এমজিএলসি কর্তৃপক্ষ খনি কাজে অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ সময়মতো আমদানি করার অনুমোদন না দেয়া অর্থাৎ দুই বছর বিলম্ব করায় খনি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপরিহার্য ড্রইং ডিজাইন অনুমোদনে এমজিএলসি কর্তৃপক্ষ ২ বছর বিলম্বের কারণে খনির কাজ দীর্ঘ প্রায় ৩ বছর সময় ব্যাহত থাকে।

বিদেশি মেশিনারিজ ও যন্ত্রাংশের অভাবে খনিটির উন্নয়ন ও উৎপাদন ব্যাহত না হয়ে গেলে পুরো চুক্তির মেয়াদ পযর্ন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে খনির উন্নয়ন ও পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসি তাদের চুক্তির মেয়াদে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী স্টোপ নির্মাণসহ পাথর উত্তোলন করতে সক্ষম হতো। কিন্তু এতো সব বাধা অতিক্রম করে জিটিসি তিন শিফট চালু করে প্রতিদিন খনি থেকে পাথর উত্তোলন করে খনির উৎপাদন ইতিহাসে নয়া রেকর্ড সৃষ্টি করে।

প্রতিদিন তিন শিফটে সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলনের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পাথর খনিটি চালু করা হয়েছিল, একমাত্র জিটিসিই সেই লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে একদিনে তিন শিফটে ৬ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত পাথর উত্তোলন করে তাদের সক্ষমতার পরিচয় দেয়। শতাধিক বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞ ও অর্ধশত দেশি প্রকৌশলী এবং সাড়ে ৭শ’ দক্ষ খনি শ্রমিক দিনে-রাতে রেকর্ড পরিমাণ পাথর উত্তোলন করার কারণে মধ্যপাড়া পাথর খনি কর্তৃপক্ষ ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে লোকসানের কলঙ্ক ঘুচিয়ে প্রথম লাভের মুখ দেখে।

সে অর্থবছরে খনি কর্তৃপক্ষের প্রায় ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা লাভ হয় এবং মধ্যপাড়া পাথর খনি প্রথমবারের মতো লাভের মুখ দেখার পুরো কৃতিত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসির। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে প্রায় ২২ কোটি টাকা মুনাফা করে দ্বিতীয়বার লাভজনক প্রতিষ্ঠানের ধারা অব্যাহত রাখে পাথর খনিটি। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরেও খনিটি লাভজনক হবে। সেই সঙ্গে পাথর বিক্রি থেকে ভ্যাট ও ট্রাক্সসহ কয়েক কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হয়েছে।

বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম. হাসান, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামনুদ্দীন চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক খনিতে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানপূর্বক একটি নিদের্শনার মাধ্যমে জিটিসিকে ১ বছরের জন্য সময় বৃদ্ধি করা হয়।

ইতোমধ্যে নির্ধারিত সময়ের ৩ মাস আগেই জিটিসি বৈশ্বিক মহামারী করোনার ভয়াবহতা সত্ত্বেও বর্ধিত সময়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১.১ মিলিয়ন টন পাথর উৎপাদন ও আরও দুইটি নতুন (স্টোপ) নিমার্ণ কাজ সমাপ্ত করে তাদের সক্ষমতা ও খনি কাজের সাফল্য প্রমাণ করেছে ও জিটিসি চুক্তির বর্ধিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও ২০% পাথর বেশি উৎপাদন করবে। করোনার এই মহামারীতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে জিটিসি সব শ্রমিকদের নিয়ে পাথর উৎপাদন অব্যাহত রেখে মধ্যপাড়া পাথর খনির অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে।

মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী আবু দাউদ মুহম্মদ ফরিদুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনার মধ্যে দেশের অন্যান্য খনি প্রকল্পগুলো জনবল অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। পক্ষান্তরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মধ্যপাড়া পাথর খনির উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে। পাথর উত্তোলন হয়েছে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন টন। এ হিসাবে অন্তত ২০ শতাংশ বেশি পাথর উৎপাদন হয়েছে। বর্ধিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই আরও দুটি স্টোপ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।

কেননা এই উপজেলারই পার্শ্ববর্তী উৎপাদনে থাকা বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ঠিকাদারি চায়না প্রতিষ্ঠান অধিকাংশ শ্রমিককে ছুটি দিয়ে স্বল্প পরিসরে উৎপাদন চালু রেখেছে। ফলে বেকার হয়ে বসে আছে দুই তৃতীয়াংশ কয়লা খনি শ্রমিক। এখানে লক্ষণীয়, জিটিসি তার কারিগরি দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে খনির উৎপাদন ও উন্নয়ন ব্যয় কোন প্রকার বৃদ্ধি ব্যতিরেকেই বিগত ৭ বছর যাবত খনি পরিচালনা করে যাচ্ছে। যেখানে পার্শ্ববর্তী খনিতে দফায় দফায় উৎপাদন ও উন্নয়ন ব্যয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একমাত্র জিটিসিই মধ্যপাড়া পাথর খনিতে দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করে খনিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।

জিটিসির এ কাজের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে খনিটি সবসময়ই লাভজনক থাকবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যপাড়া পাথর খনি পৃথিবীর একমাত্র ভূগর্ভস্থ গ্রানাইট মাইন, যার লাভজনক পরিচালনা, উৎপাদন ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র জিটিসির রয়েছে।

হরিরামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহবুদ্দীন শাহ বলেন, খনিটিতে প্রতিদিন পাথর বহন ও ক্রেতাদের পদচারণায় মুখোরিত হয়ে উঠেছে খনি এলাকা। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দোকানপাট। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক পাথর নেয়ার জন্য খনিতে আসে, সেখানে পাথর লোড আনলোড করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে কয়েকশ’ শ্রমিক। এতে সেখানকার অর্থনীতি ও জীবন-যাত্রার মান উন্নয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।

এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, একমাত্র জিটিসির মাধ্যমে দেশের এই সম্ভাবনাময় খনিটির উৎপাদনের চাকা সচল রাখবে। তারা বলেন, এই খনি সচল থাকলে তাদের জীবিকা ও অর্থনীতি সচল থাকবে। একমাত্র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসিই মধ্যপাড়া পাথর খনিতে দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করে খনিটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে এবং জিটিসি’র এই কাজের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে খনিটি সব সময়ই লাভজনক থাকবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্যপাড়া পাথর খনি পৃথিবীর একমাত্র ভূ-গর্ভস্থ মাইন, যার লাভজনক পরিচালনা, উৎপাদন ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র জিটিসির রয়েছে। পাথর উৎপাদন ও খনি উন্নয়নের পাশাপাশি খনির সম্মুখে ‘জিটিসি চ্যারিটি হোম’ স্থাপন করে খনি শ্রমিকদের উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত সন্তানদের মাঝে শিক্ষা বৃত্তি, এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং এলাকার আর্থ-সামাজিক নানা কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করে এলাকাবাসীর পাশে দাঁড়িয়ে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ।

চ্যারিটি হোমে অভিজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে প্রতিদিন খনি এলাকার ৪০/৫০ জন রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ সেবা দিচ্ছে। প্রতিমাসে খনি শ্রমিকদের সন্তানদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তি, ননএমপিভুক্ত মধ্যপাড়া মহাবিদ্যালয়কে মাসিক আর্থিক সহায়তা এবং এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছে। এলাকার মানুষ বলছে, জিটিসি’র এই সেবামূলক কর্মকা- একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।