বিধি তৈরি না করেই ভারতে নাগরিকত্ব আইন!

’৭১ নয়, আসামে ’৫১-কে ভিত্তি বছর চায় বিজেপি, বিরোধীদের আপত্তি

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে তড়িঘড়ি করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট নাগরিক আইন বিল পাস করালেও এখনও বিধি তৈরি করতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। এখনও কার্যকর হয়নি এ আইনটি। এবার বিধি তৈরির জন্য আরও তিন মাস সময় চেয়ে নিল কেন্দ্রীয় সরকার। এর আগেও বেশ কয়েকবার সময় চাওয়া হয়েছে সংসদীয় কমিটির কাছে। সংসদের সাব-অর্ডিনেট লেজিসলেসনের স্থায়ী কমিটির কাছে ক্যা-র বিধি তৈরি করে দাখিল করা প্রয়োজন এবং তা নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিধি প্রস্তুত করতে পারেনি। উল্লেখ্য, লোকসভার এই কমিটি গত ৯ এপ্রিল এবং রাজ্যসভার কমিটি ৯ জুলাই পর্যন্ত সময়সীমা ধার্য করেছিল কিন্তু বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে লোকসভার কমিটি তা প্রস্তুত করতে পারেনি। ফলে অতিরিক্ত তিনমাসের সময় চেয়ে আবেদন করেছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। পরিপ্রক্ষিতে সংশোধিত নাগরিক আইন ক্যা-র বিধি প্রস্তুতের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে অতিরিক্ত তিনমাসের সময় দিয়েছে সংসদীয় কমিটি।

ক্যা-নিয়ে বিজেপির মনোভাব প্রসঙ্গে কংগ্রেসের কটাক্ষ, অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্যে এরই মধ্যে ৫ রাজ্যের ১৩ জেলায় নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে তা নিয়ে অমুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসেই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে শরণার্থী হয়ে আসা হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন ও পার্সিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য নতুন বিল আনে মোদি সরকার। দেশজুড়ে বিরোধিতার মধ্যেই বিজেপি সরকার দ্রুত সেই বিল পাস করায় কিন্তু বিধি তৈরি না করায় তা কার্যকর করা যায়নি। আসাম বিধান সভার বিরোধী দল নেতা দেবব্রত শইকিয়ার অভিযোগ, মান্যুকে বিভ্রান্ত করতেই এই আইন। বিজেপি আসলে শরণার্থী সমস্যা জিইয়ে রেখে বিভাজনের রাজনীতি করতে চায়। তিনি বলেন, উদ্বাস্তুদের পুরনো আইন বলেই নাগরিকত্ব দেয়ার বিধান রয়েছে। এর জন্য নতুন আইনের প্রয়োজন নেই। পাশাপাশি তিনি ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিক দেয়ার কড়া বিরোধিতা করেন। উল্লেখ্য, ক্যা-র বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে কয়েকটি মামলা হয়েছে। কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেসসহ অন্য বিরোধীদের অভিযোগ, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেয়া সংবিধানের মূলধারার বিরোধী। ক্যা-র পাশাপাশি এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি) ইস্যুতেও বিজেপির কড়া সমালোচনা করেছে কংগ্রেস। এ ব্যাপারে বিরোধী দলনেতা দেবব্রতর অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা খরচ করে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে এনআরসি প্রক্রিয়া শেষ হলেও এখনও তা কার্যকর হচ্ছে না কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকায় ২০ শতাংশ নয়, এবার ১০০ শতাংশ নতুন করে পরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন এনআরসির কো-অর্ডিনেটর হিতেশ দেব শর্মা। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে তিনি আসামে ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। নাগরিক অধিকার রক্ষাসমন্বয় কমিটি (সিআরপিসিসি)-র মতে আসাম রাজ্যের ভাষা ও ধমীয় সংখ্যালঘু জনগণকে নাগরিকত্বহীন করার চক্রান্ত হিসেবেই হিতেশ দেব শর্মা এই হলফনামা জমা দিয়েছেন। সিআরপিসিসির চেয়ারম্যান তপোধীর ভট্টাচার্য্যরে দাবি, এনআরসি তৈরি সঠিক না হলে তালিকা তৈরির কাজ যে সব আধিকারিক যুক্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। তার আশঙ্কা, উগ্র প্রাদেশিকতাবাদীদের অন্যায় দাবিকে মেনে নিয়ে ৭০/৮০ লাখ অ-আসামিয়া জনগণকে নাগরিকত্বহীন করার নয়া নকশা তৈরি হয়েছে।

সিআরপিসির কেন্দ্রীয় কমিটি আসাম রাজ্যের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনসহ সমভাবাপন্ন সংগঠনগুলোকে এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনের পক্ষে হিল্লোল ভট্টাচার্য্য এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ২০১৫ সাল থেকে এনআরসির নামে আসামে বাঙালিদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। তবে সমন্বয়ক হীতেশ দেব শর্মার আদালতে এই হলফনামার পেছনে আসাম রাজ্য সরকারের স্পষ্ট যে অনুমোদন রয়েছে সেকথা স্বীকার করে নিয়েছে রাজ্যের আসাম চুক্তি রূপায়ণ মন্ত্রী অতুল বরা। ভোটের প্রতিশ্রুতি মেনেই রাজ্য সরকার নতুন করে তালিকা তৈরি করতে চায়।

১৯৫১ সালের পর সীমান্তের ওপার থেকে যারা ভারতে এসেছেন সরকারের দৃষ্টিতে তারা সবাই বিদেশি। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে ভিত্তি করে নাগরিকত্বের বর্তমান আইন বাতিল করে এমনই সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে আসামের বিজেপি সরকার। তাই তারা নতুন করে এনআরসি করতে চাইছে। এমনই আশঙ্কার কথা জানালেন মহাজোটের শরিক এআইইউডিএফের বিধায়ক আমিনুল ইসলাম।

আর আসামে এটা কার্যকর হলে ভবিষ্যতে বাংলা ও ত্রিপুরার বাঙালিরাও বিপাকে পড়বেন। কারণ, গোটা দেশে এনআরসি বা এনপিআর কার্যকর করার সিদ্ধান্ত থেকে এখনও পিছু হটেনি কেন্দ্রীয় সরকার। বিভিন্ন অসোমিয়া আধিপত্যবাদী সংগঠন বহুদিন ধরেই ১৯৫১-কেই ভিত্তি বছর করার দাবি করে আসছে বিজেপি ও তাদের শরিক দল অনেক নেতা, সুর মেলাচ্ছেন এই দাবির পক্ষে। রাজ্য বিজেপি অবশ্য সরকারিভাবে এখনও কিছু বলেনি, তবে প্রশ্রয় দিচ্ছে বাঙালি বিরোধী দাবিকে।

হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর নতুন করে শুরু হয়েছে ৫১-কে নিয়ে জল্পনা। কংগ্রেস অবশ্য এখনও বলছে, ভোটার তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের সবাইকেই নাগরিকত্ব দিতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বাঙালি সংগঠনের কটাক্ষ, আসামে বিজেপি নয়, চলছে উগ্র আসামিয়া আধিপত্যবাদীদের সরকার। উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ও তার পূর্বসূরি সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সর্বনন্দ সোলায়ন আগে ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনে ‘কুখ্যাত’ ছাত্র সংগঠন আসুর নেতা ছিলেন। আসুর প্রতি তাদের দুর্বলতা সর্বজনবিদিত।

পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় অনেক বাঙালি দেশ ভাগের পরও ভারতে আসেন। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনার পৈশাচিক অপারেশন সার্চলাইট শুরুর আগে ভারতে আসা প্রত্যেককে নাগরিকত্ব দিতে সম্মত হয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার চুক্তিও হয়। সেই মতে, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার লাখ লাখ মানুষ ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বহুকাল ধরেই অধিকার ভোগ করছেন, এদের মধ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজনও রয়েছে। আছেন ত্রিপুরায়ও অনেক মান্যু। এমনকি সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও ১৯৫১ সালের পরই ত্রিপুরায় আসেন। এখন আসামে ১৯৫১ সালকেই ভিত্তিবছর ধরার তৎপরতা শুরু হয়েছে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বিধানসভা অধিবেশনের প্রথম ভাগেও অগ্রাধিকার পেয়েছে এনআরসি বিষয়টি। আসাম সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হলেও সেটা মানছে না বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তেরও আপত্তি রয়েছে। এই তালিকা তৈরি হয় ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে ভিত্তি করে। হিমন্ত শর্মা অবশ্য মুখে বলছেন তালিকাভুক্তদের প্রকাশিত তথ্য ফের যাচাইয়ের কথা কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছে, তথ্য যাচাই নয়, বিজেপি সরকার চাইছে ভিত্তি বছরটাকেই পিছিয়ে দিতে।

এদিন বিধান সভা অধিবেশনের ফাঁকে সাংবাদিকদের এমন আশঙ্কার কথা শোনান বিধায়ক আমিনুল ইসলাম। তার অভিযোগ, ধর্মীয় বিভাজনকেই গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তার দাবি, বিভাজনের পথ ছেড়ে সরকার রাজ্যের উন্নয়নে মনোনিবেশ করুক।

সাবেক মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের আমল থেকেই কংগ্রেস ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবছর ধরার পক্ষে ছিল। সেই সঙ্গে তাদের দাবি, ভোটার তালিকাভুক্ত সবাইকেই ভারতের নাগরিক বলে বিবেচনা করতে হবে, কারণ তাদের ভোটেই সরকার নির্বাচিত হয়। বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শাইকিয়া বলেন, ভোটাররা বৈধ নাগরিক না হলে সরকারও তো বৈধ নয়। তাই নতুন করে ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবছর করার দাবি অযৌক্তিক কিন্তু ১৯৫১-কে ভিত্তিবছর করার দাবি নতুন নয় আসামে।

বিজেপির এর আগের সরকার এবং বর্তমানে নতুন সরকার ৫১-কেই ভিত্তিবছর হিসেবে সওয়াল করছে। তারা কয়েকদিন আগেই একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন বলে জল্পনা চলছে। এই অবস্থায় আসাম রাজ্য নাগরিক অধিকার সমিতির পক্ষে সাধন পুরকায়স্থ বলেন, বাঙালিদের তো ওরা মানুষ বলেই মনে করে না। তিনি বলেন, আসামে যদি ১৯৫১ সালকে ধরা হয়, তবে অন্য রাজ্যের বাঙালিদেরও বিপাকে পড়তে হবে। কেননা গোটা দেশে এনআরসি করার এজেন্ডা বাদ দেয়নি বিজেপি।

সোমবার, ০৭ জুন ২০২১ , ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৫ শাওয়াল ১৪৪২

বিধি তৈরি না করেই ভারতে নাগরিকত্ব আইন!

’৭১ নয়, আসামে ’৫১-কে ভিত্তি বছর চায় বিজেপি, বিরোধীদের আপত্তি

দীপক মুখার্জী, কলকাতা

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে তড়িঘড়ি করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট নাগরিক আইন বিল পাস করালেও এখনও বিধি তৈরি করতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। এখনও কার্যকর হয়নি এ আইনটি। এবার বিধি তৈরির জন্য আরও তিন মাস সময় চেয়ে নিল কেন্দ্রীয় সরকার। এর আগেও বেশ কয়েকবার সময় চাওয়া হয়েছে সংসদীয় কমিটির কাছে। সংসদের সাব-অর্ডিনেট লেজিসলেসনের স্থায়ী কমিটির কাছে ক্যা-র বিধি তৈরি করে দাখিল করা প্রয়োজন এবং তা নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিধি প্রস্তুত করতে পারেনি। উল্লেখ্য, লোকসভার এই কমিটি গত ৯ এপ্রিল এবং রাজ্যসভার কমিটি ৯ জুলাই পর্যন্ত সময়সীমা ধার্য করেছিল কিন্তু বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে লোকসভার কমিটি তা প্রস্তুত করতে পারেনি। ফলে অতিরিক্ত তিনমাসের সময় চেয়ে আবেদন করেছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। পরিপ্রক্ষিতে সংশোধিত নাগরিক আইন ক্যা-র বিধি প্রস্তুতের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে অতিরিক্ত তিনমাসের সময় দিয়েছে সংসদীয় কমিটি।

ক্যা-নিয়ে বিজেপির মনোভাব প্রসঙ্গে কংগ্রেসের কটাক্ষ, অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্যে এরই মধ্যে ৫ রাজ্যের ১৩ জেলায় নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে তা নিয়ে অমুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসেই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে শরণার্থী হয়ে আসা হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন ও পার্সিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য নতুন বিল আনে মোদি সরকার। দেশজুড়ে বিরোধিতার মধ্যেই বিজেপি সরকার দ্রুত সেই বিল পাস করায় কিন্তু বিধি তৈরি না করায় তা কার্যকর করা যায়নি। আসাম বিধান সভার বিরোধী দল নেতা দেবব্রত শইকিয়ার অভিযোগ, মান্যুকে বিভ্রান্ত করতেই এই আইন। বিজেপি আসলে শরণার্থী সমস্যা জিইয়ে রেখে বিভাজনের রাজনীতি করতে চায়। তিনি বলেন, উদ্বাস্তুদের পুরনো আইন বলেই নাগরিকত্ব দেয়ার বিধান রয়েছে। এর জন্য নতুন আইনের প্রয়োজন নেই। পাশাপাশি তিনি ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিক দেয়ার কড়া বিরোধিতা করেন। উল্লেখ্য, ক্যা-র বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে কয়েকটি মামলা হয়েছে। কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেসসহ অন্য বিরোধীদের অভিযোগ, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেয়া সংবিধানের মূলধারার বিরোধী। ক্যা-র পাশাপাশি এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি) ইস্যুতেও বিজেপির কড়া সমালোচনা করেছে কংগ্রেস। এ ব্যাপারে বিরোধী দলনেতা দেবব্রতর অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা খরচ করে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে এনআরসি প্রক্রিয়া শেষ হলেও এখনও তা কার্যকর হচ্ছে না কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকায় ২০ শতাংশ নয়, এবার ১০০ শতাংশ নতুন করে পরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন এনআরসির কো-অর্ডিনেটর হিতেশ দেব শর্মা। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে তিনি আসামে ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। নাগরিক অধিকার রক্ষাসমন্বয় কমিটি (সিআরপিসিসি)-র মতে আসাম রাজ্যের ভাষা ও ধমীয় সংখ্যালঘু জনগণকে নাগরিকত্বহীন করার চক্রান্ত হিসেবেই হিতেশ দেব শর্মা এই হলফনামা জমা দিয়েছেন। সিআরপিসিসির চেয়ারম্যান তপোধীর ভট্টাচার্য্যরে দাবি, এনআরসি তৈরি সঠিক না হলে তালিকা তৈরির কাজ যে সব আধিকারিক যুক্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। তার আশঙ্কা, উগ্র প্রাদেশিকতাবাদীদের অন্যায় দাবিকে মেনে নিয়ে ৭০/৮০ লাখ অ-আসামিয়া জনগণকে নাগরিকত্বহীন করার নয়া নকশা তৈরি হয়েছে।

সিআরপিসির কেন্দ্রীয় কমিটি আসাম রাজ্যের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনসহ সমভাবাপন্ন সংগঠনগুলোকে এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনের পক্ষে হিল্লোল ভট্টাচার্য্য এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ২০১৫ সাল থেকে এনআরসির নামে আসামে বাঙালিদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। তবে সমন্বয়ক হীতেশ দেব শর্মার আদালতে এই হলফনামার পেছনে আসাম রাজ্য সরকারের স্পষ্ট যে অনুমোদন রয়েছে সেকথা স্বীকার করে নিয়েছে রাজ্যের আসাম চুক্তি রূপায়ণ মন্ত্রী অতুল বরা। ভোটের প্রতিশ্রুতি মেনেই রাজ্য সরকার নতুন করে তালিকা তৈরি করতে চায়।

১৯৫১ সালের পর সীমান্তের ওপার থেকে যারা ভারতে এসেছেন সরকারের দৃষ্টিতে তারা সবাই বিদেশি। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে ভিত্তি করে নাগরিকত্বের বর্তমান আইন বাতিল করে এমনই সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে আসামের বিজেপি সরকার। তাই তারা নতুন করে এনআরসি করতে চাইছে। এমনই আশঙ্কার কথা জানালেন মহাজোটের শরিক এআইইউডিএফের বিধায়ক আমিনুল ইসলাম।

আর আসামে এটা কার্যকর হলে ভবিষ্যতে বাংলা ও ত্রিপুরার বাঙালিরাও বিপাকে পড়বেন। কারণ, গোটা দেশে এনআরসি বা এনপিআর কার্যকর করার সিদ্ধান্ত থেকে এখনও পিছু হটেনি কেন্দ্রীয় সরকার। বিভিন্ন অসোমিয়া আধিপত্যবাদী সংগঠন বহুদিন ধরেই ১৯৫১-কেই ভিত্তি বছর করার দাবি করে আসছে বিজেপি ও তাদের শরিক দল অনেক নেতা, সুর মেলাচ্ছেন এই দাবির পক্ষে। রাজ্য বিজেপি অবশ্য সরকারিভাবে এখনও কিছু বলেনি, তবে প্রশ্রয় দিচ্ছে বাঙালি বিরোধী দাবিকে।

হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর নতুন করে শুরু হয়েছে ৫১-কে নিয়ে জল্পনা। কংগ্রেস অবশ্য এখনও বলছে, ভোটার তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের সবাইকেই নাগরিকত্ব দিতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন বাঙালি সংগঠনের কটাক্ষ, আসামে বিজেপি নয়, চলছে উগ্র আসামিয়া আধিপত্যবাদীদের সরকার। উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ও তার পূর্বসূরি সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সর্বনন্দ সোলায়ন আগে ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনে ‘কুখ্যাত’ ছাত্র সংগঠন আসুর নেতা ছিলেন। আসুর প্রতি তাদের দুর্বলতা সর্বজনবিদিত।

পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় অনেক বাঙালি দেশ ভাগের পরও ভারতে আসেন। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনার পৈশাচিক অপারেশন সার্চলাইট শুরুর আগে ভারতে আসা প্রত্যেককে নাগরিকত্ব দিতে সম্মত হয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার চুক্তিও হয়। সেই মতে, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার লাখ লাখ মানুষ ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বহুকাল ধরেই অধিকার ভোগ করছেন, এদের মধ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজনও রয়েছে। আছেন ত্রিপুরায়ও অনেক মান্যু। এমনকি সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও ১৯৫১ সালের পরই ত্রিপুরায় আসেন। এখন আসামে ১৯৫১ সালকেই ভিত্তিবছর ধরার তৎপরতা শুরু হয়েছে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বিধানসভা অধিবেশনের প্রথম ভাগেও অগ্রাধিকার পেয়েছে এনআরসি বিষয়টি। আসাম সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হলেও সেটা মানছে না বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তেরও আপত্তি রয়েছে। এই তালিকা তৈরি হয় ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে ভিত্তি করে। হিমন্ত শর্মা অবশ্য মুখে বলছেন তালিকাভুক্তদের প্রকাশিত তথ্য ফের যাচাইয়ের কথা কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছে, তথ্য যাচাই নয়, বিজেপি সরকার চাইছে ভিত্তি বছরটাকেই পিছিয়ে দিতে।

এদিন বিধান সভা অধিবেশনের ফাঁকে সাংবাদিকদের এমন আশঙ্কার কথা শোনান বিধায়ক আমিনুল ইসলাম। তার অভিযোগ, ধর্মীয় বিভাজনকেই গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তার দাবি, বিভাজনের পথ ছেড়ে সরকার রাজ্যের উন্নয়নে মনোনিবেশ করুক।

সাবেক মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের আমল থেকেই কংগ্রেস ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবছর ধরার পক্ষে ছিল। সেই সঙ্গে তাদের দাবি, ভোটার তালিকাভুক্ত সবাইকেই ভারতের নাগরিক বলে বিবেচনা করতে হবে, কারণ তাদের ভোটেই সরকার নির্বাচিত হয়। বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শাইকিয়া বলেন, ভোটাররা বৈধ নাগরিক না হলে সরকারও তো বৈধ নয়। তাই নতুন করে ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবছর করার দাবি অযৌক্তিক কিন্তু ১৯৫১-কে ভিত্তিবছর করার দাবি নতুন নয় আসামে।

বিজেপির এর আগের সরকার এবং বর্তমানে নতুন সরকার ৫১-কেই ভিত্তিবছর হিসেবে সওয়াল করছে। তারা কয়েকদিন আগেই একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন বলে জল্পনা চলছে। এই অবস্থায় আসাম রাজ্য নাগরিক অধিকার সমিতির পক্ষে সাধন পুরকায়স্থ বলেন, বাঙালিদের তো ওরা মানুষ বলেই মনে করে না। তিনি বলেন, আসামে যদি ১৯৫১ সালকে ধরা হয়, তবে অন্য রাজ্যের বাঙালিদেরও বিপাকে পড়তে হবে। কেননা গোটা দেশে এনআরসি করার এজেন্ডা বাদ দেয়নি বিজেপি।