পান গাছ না থাকলে খাসিয়ারা বাঁচবে কী করে

মিথুশিলাক মুরমু

আদিবাসী খাসিয়ারা সবচেয়ে বেশি বসবাস করে মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। কর্মসূত্রে কয়েকটি খাসিয়া পুঞ্জি ও পান চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে চাষীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও হয়েছিল। কুলাউড়া উপজেলার ইশলাছড়া পুঞ্জি, সিঁগুরপুঞ্জি পরিদর্শন করেছি। খাসিয়া অধ্যুষিত বরমচাল মিশন ও ব্রাহ্মণবাজারস্থ মিশনেও অনেকবার থেকে খাসিয়াদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। অনেক খাসিয়া ব্যক্তিত্ব, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক ও পুঞ্জিগুলোতে আমন্ত্রিত হওয়ার পরও যাওয়ার ফুসরত হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আগ্রহী হলেও অর্থনৈতিক মেরুদ- হিসেবে পূর্ব পুরুষদের আদি পেশা পান চাষই সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়ে থাকে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার খাসিয়া নারীরা অত্যন্ত ভালোবেসে, স্নেহময়ী পরশে যতেœর সঙ্গে জীবনযাপনের একমাত্র সম্বল পান গাছকে, পান চাষকে মর্যাদা দিয়ে থাকে। পরিবারে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হলে সবকিছুর পর পান আবশ্যিকই অর্থাৎ জীবনের সঙ্গে অষ্টেপৃষ্টে পানের সম্পর্ক বিদ্যমান।

গত ৩১ মে, ২০২১ খ্রি. তারিখে প্রকাশিত একটি সংবাদ আমাদের খুবই আহত করেছে। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ছোটলেখা চা বাগানের আগার পান পুঞ্জির সহস্রাধিক পান গাছ কে বা কারা যেন রাতের অন্ধকারে/দিনের আলোতে নির্বিচারে কেটে ফেলেছে। পুঞ্জির মন্ত্রী সুখমন আমসে বড়লেখা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। দুর্বৃত্ত কর্তৃক পান গাছ কর্তনের ঘটনা বার বার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, কিন্তু কেন? বোধকরি, সেদিন দিনের বা রাতের অন্ধকারে এক সময় আগার পুঞ্জির প্রায় এক হাজার পান গাছ কেটে সটকে পড়েছে দুর্বৃত্তরা, চাষিদের চোখে পড়েছে বিকেলে। পুঞ্জিতে ৪৮টি পরিবার বসবাস করে, এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে পান চাষের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রত্যেকটি পরিবারই হতভম্ব ও নির্বাক হয়েছেন, কী করে একজন সুস্থ সবল মানুষ এরূপ কাজ করতে পারে! চিন্তনীয় যে, আমরা যারা শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে নিজেদের বিবেচনা করি, গাছ-গাছালি, চাষের ফসলির ওপর আঘাত করার মানসিকতা সত্যিই হীনমন্যতার, অমানবিকতার পরিচায়ক।

খোঁজার চেষ্টা করছিলাম কেন এই আবাদি পান চাষের ওপর আক্রমণ, কেন এটিকে বেছে নেয়া হয়েছে? প্রায়শঃই খাসিয়াদের পুঞ্জি, পান চাষ বিষয়টি দৈনিক পত্র-পত্রিকায় শিরোনাম হচ্ছে? তাহলে কী স্থানীয় প্রশাসন উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে অপারগ বা দায়িত্ব পালনে গাফলতি করছে! নাহার পুঞ্জি, বনাখলাপুঞ্জি, সিঁঙ্গুরপুঞ্জি ইত্যাদি জায়গাগুলোতে খাসিয়াদের বসবাসে কী স্থানীয় জনসাধারণ সহযোগিতা থেকে বিরত থাকে! শতাব্দীকাল থেকেই খাসিয়া জনগোষ্ঠীও বঙ্গভূমিতে বসবাস করেন, অতপরও কী তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিজ দেশে পরবাসীর মতো। আমরা তাদের আকার ইঙ্গিতে, আচার আচরণে কিংবা কখনও কখনও প্রকাশ্যেই নাগরিকত্বতাকে চ্যালেঞ্জ করে থাকি! এই দৃষ্টিভঙ্গি সর্বত্রই করোনাভাইরাসের মতোই ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। খাসিয়ারা বলেছেন, নিকট অতীতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের যে সখ্যতা, হৃদতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল; সেটি ক্রমশই বিবর্ণ হতে চলেছে। আগার পুঞ্জির মন্ত্রীর অভিব্যক্তি, ‘স্থানীয় কারও সঙ্গে তাদের পূর্ববিরোধ নেই। পানগাছ কাটায় তাদের সাত-আট লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কে বা কারা এ কাজটি করল, সেটা তারা বুঝে উঠতে পারছেন না।’ একে-অপরের সাহায্য-সহযোগিতা, আর্থ-সামাজিক বিষয়াদিতে আলোচনা সাপেক্ষে সন্তোষজনক সমাধান সত্যিই যেন ক্ষীণ হতে চলেছে। সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ককে বলি দিতে হচ্ছে অঘোষিত উগ্রবাদিতার হাতে।

কেন এই অর্থকারী ফসল, অর্থনৈতিক মেরুদ-কে বেছে নেয়া হলো? মূলত: খাসিয়ারা পানকেই তাদের প্রধান উপজীব্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। খাসিয়া পান চাষের জন্য শীর্ষদেশ কম ঝোপালো এমন গাছ বাছাই করা হয়। পুঞ্জির চতুর্দিকে, যেখানে গাছ রয়েছে, সেটিতেই পান চাষের সুযোগ খুঁজে থাকেন। পান চাষের আশ্রয়ী গাছ হিসেবে চাপালিশ ও সুপারি গাছ সবচেয়ে বেশি উপযোগী কারণ গাছ দুটিকে ছাঁটায়ের প্রয়োজন পড়ে না। অন্যান্য আশ্রয়ী গাছের মধ্যে জারুল, কালাজাম, তুন, বোনাক, শিমুল, কদম, ডুমুর, জাম ও ডেউয়া উল্লেখযোগ্য। বসতবাটিতে কাঁঠাল ও আম গাছের সঙ্গেও খাসিয়া পানের আবাদ করা হয়ে থাকে। গবেষণা অনুযায়ী, ১ হেক্টর বনভূমিতে খাসিয়া পান আবাদ করে প্রায় ২ লক্ষ টাকা আয় করা সম্ভবপর। আয়ের মূলস্তম্ভকে সমুলে উৎপাটন করতেই পান গাছকে বেছে নেয়া হয়েছে। বারংবার পুঞ্জিগুলো আক্রান্ত হতে থাকলে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলহীন হলে সন্তান-সন্ততির লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, সামাজিক-ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান উদযাপন ব্যাহত, চিকিৎসাহীনতায় কর্মঅক্ষম জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে এক সময় জায়গা স্থানান্তর হতেও বাধ্য হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ফাদার জোসেফ গোমেজ ওএমআই বলেছেন, ‘আমার ধারণা জুম দখল করার জন্যই দুর্বৃত্তরা পান গাছগুলো কেটে দিয়েছে। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন পান গাছ কেটে ফেলায় পরিবারগুলার পথে বসার উপক্রম হয়েছে।’ হৃদয়ে গভীরে স্বপ্নদেখা দুর্বৃত্তদের জয়যাত্রা কী এভাবেই এগিয়ে যাবে!

মৌলভীবাজারের ৬টি উপজেলায় ছোট-বড় ৬৫টি খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে। পান নির্ভর পুঞ্জিগুলোতে সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পান গাছ থেকে সম্পূর্ণ পান উত্তোলন শেষ হয়ে যায়। সময়মতো বৃষ্টি হলে মে মাসের শেষ দিকে আবারও পান উত্তোলন শুরু হয়। তবে এবার আগাম বৃষ্টি হওয়ার কারণে মার্চ মাসেই পান উত্তোলন শুরু হয়েছে। পানের উৎপাদনের বছরেই দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর নিষেধাজ্ঞার পর দেশ থেকে ইউরোপে পান রপ্তানির কথা জানিয়েছে কৃষিমন্ত্রী জনাব মো. আব্দুর রাজ্জাক। বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে পান রপ্তানি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে’। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্ত পূরণ করায় গত ১৫ এপ্রিল পান রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এ নিষেধাজ্ঞার আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৩ হাজার ২৫০ টন পান রপ্তানি করে। সে বছর পান রপ্তানি করে বাংলাদেশ তিন কোটি ডলার আয় করে। খাসিয়াদের কথানুযায়ী, খাসিয়াদের উৎপাদিত পান পছন্দের শীর্ষে থাকায় রপ্তানির তালিকাতে প্রথমসারিতেই রয়েছে। জাতীয়ভাবে একটি শুভ সংবাদের পরই যখন খাসিয়াদের দূরবস্থা ও তাদের অসহায়ত্বতা কথা শুনছি, সত্যিই বিবেক আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে!

বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বিষয়টি তারা তদন্ত করে দেখছেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি আদিবাসীদের বিরূপ মনোভাব ক্রমশঃই ফুটে উঠছে, আস্থা শূন্যের কোঠায়। বনাখলা পুঞ্জির মন্ত্রী একদা হামলার শিকার হয়ে স্থানীয় দক্ষিণ গান্ধাই গ্রামের বাসিন্দা আতিক মিয়া ও লেছাই মিয়াসহ আরও ১৫/২০ জনের নামে অভিযোগ করলে থানার কর্মকর্তা সেবার বলেছিলেন, ‘তারা লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। তদন্ত করে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান।’ স্থানীয় প্রশাসনের সম্ভুকগতির তদন্ত আদৌ হয়েছে কি না সন্দেহ রয়েছে! অপরদিকে মন্ত্রী তার পুঞ্জিবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘পুলিশ বলেছে ব্যবস্থা নেবে’। আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন (কুবরাজ)-এর সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাংয়ের অভিযোগও অগ্রগণ্য, ‘কুলাউড়ার বিভিন্ন পুঞ্জিতে আদিবাসীদের পানের জুম থেকে পান গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির চারা কর্তন করে দুর্বৃত্তরা। যার কারণে খাসি পান চাষিরা বেশ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। পান চাষ করেই খাসিয়ারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু আমরা সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি। বিষয়টি প্রশাসনের কাছে একাধিকবার জানিয়েছি কিন্তু আদৌ কোন সুরহা হয়নি।’ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, যে সব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে জাতিগত বৈষম্যকে লালন করেন, ন্যায্যতাকে অর্থের কাছে জিম্মি রাখে; তাদের বিষয়ে অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পিছপা হবেন না।

দেশের নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা ও সুবিচার প্রাপ্তির অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। যারা পান চাষ করে বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করেন, তাদের সহযোগিতা ও উৎসাহ দেয়া আমাদের কর্তব্য। পান গাছ না থাকলে খাসিয়ারা বাঁচবে কি করে! সরকারকে দুটি দিকের গুরুত্বারোপ করেই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সোমবার, ০৭ জুন ২০২১ , ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৫ শাওয়াল ১৪৪২

পান গাছ না থাকলে খাসিয়ারা বাঁচবে কী করে

মিথুশিলাক মুরমু

আদিবাসী খাসিয়ারা সবচেয়ে বেশি বসবাস করে মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। কর্মসূত্রে কয়েকটি খাসিয়া পুঞ্জি ও পান চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে চাষীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও হয়েছিল। কুলাউড়া উপজেলার ইশলাছড়া পুঞ্জি, সিঁগুরপুঞ্জি পরিদর্শন করেছি। খাসিয়া অধ্যুষিত বরমচাল মিশন ও ব্রাহ্মণবাজারস্থ মিশনেও অনেকবার থেকে খাসিয়াদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। অনেক খাসিয়া ব্যক্তিত্ব, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক ও পুঞ্জিগুলোতে আমন্ত্রিত হওয়ার পরও যাওয়ার ফুসরত হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আগ্রহী হলেও অর্থনৈতিক মেরুদ- হিসেবে পূর্ব পুরুষদের আদি পেশা পান চাষই সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়ে থাকে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার খাসিয়া নারীরা অত্যন্ত ভালোবেসে, স্নেহময়ী পরশে যতেœর সঙ্গে জীবনযাপনের একমাত্র সম্বল পান গাছকে, পান চাষকে মর্যাদা দিয়ে থাকে। পরিবারে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হলে সবকিছুর পর পান আবশ্যিকই অর্থাৎ জীবনের সঙ্গে অষ্টেপৃষ্টে পানের সম্পর্ক বিদ্যমান।

গত ৩১ মে, ২০২১ খ্রি. তারিখে প্রকাশিত একটি সংবাদ আমাদের খুবই আহত করেছে। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ছোটলেখা চা বাগানের আগার পান পুঞ্জির সহস্রাধিক পান গাছ কে বা কারা যেন রাতের অন্ধকারে/দিনের আলোতে নির্বিচারে কেটে ফেলেছে। পুঞ্জির মন্ত্রী সুখমন আমসে বড়লেখা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। দুর্বৃত্ত কর্তৃক পান গাছ কর্তনের ঘটনা বার বার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, কিন্তু কেন? বোধকরি, সেদিন দিনের বা রাতের অন্ধকারে এক সময় আগার পুঞ্জির প্রায় এক হাজার পান গাছ কেটে সটকে পড়েছে দুর্বৃত্তরা, চাষিদের চোখে পড়েছে বিকেলে। পুঞ্জিতে ৪৮টি পরিবার বসবাস করে, এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে পান চাষের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রত্যেকটি পরিবারই হতভম্ব ও নির্বাক হয়েছেন, কী করে একজন সুস্থ সবল মানুষ এরূপ কাজ করতে পারে! চিন্তনীয় যে, আমরা যারা শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে নিজেদের বিবেচনা করি, গাছ-গাছালি, চাষের ফসলির ওপর আঘাত করার মানসিকতা সত্যিই হীনমন্যতার, অমানবিকতার পরিচায়ক।

খোঁজার চেষ্টা করছিলাম কেন এই আবাদি পান চাষের ওপর আক্রমণ, কেন এটিকে বেছে নেয়া হয়েছে? প্রায়শঃই খাসিয়াদের পুঞ্জি, পান চাষ বিষয়টি দৈনিক পত্র-পত্রিকায় শিরোনাম হচ্ছে? তাহলে কী স্থানীয় প্রশাসন উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে অপারগ বা দায়িত্ব পালনে গাফলতি করছে! নাহার পুঞ্জি, বনাখলাপুঞ্জি, সিঁঙ্গুরপুঞ্জি ইত্যাদি জায়গাগুলোতে খাসিয়াদের বসবাসে কী স্থানীয় জনসাধারণ সহযোগিতা থেকে বিরত থাকে! শতাব্দীকাল থেকেই খাসিয়া জনগোষ্ঠীও বঙ্গভূমিতে বসবাস করেন, অতপরও কী তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিজ দেশে পরবাসীর মতো। আমরা তাদের আকার ইঙ্গিতে, আচার আচরণে কিংবা কখনও কখনও প্রকাশ্যেই নাগরিকত্বতাকে চ্যালেঞ্জ করে থাকি! এই দৃষ্টিভঙ্গি সর্বত্রই করোনাভাইরাসের মতোই ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। খাসিয়ারা বলেছেন, নিকট অতীতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের যে সখ্যতা, হৃদতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল; সেটি ক্রমশই বিবর্ণ হতে চলেছে। আগার পুঞ্জির মন্ত্রীর অভিব্যক্তি, ‘স্থানীয় কারও সঙ্গে তাদের পূর্ববিরোধ নেই। পানগাছ কাটায় তাদের সাত-আট লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কে বা কারা এ কাজটি করল, সেটা তারা বুঝে উঠতে পারছেন না।’ একে-অপরের সাহায্য-সহযোগিতা, আর্থ-সামাজিক বিষয়াদিতে আলোচনা সাপেক্ষে সন্তোষজনক সমাধান সত্যিই যেন ক্ষীণ হতে চলেছে। সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ককে বলি দিতে হচ্ছে অঘোষিত উগ্রবাদিতার হাতে।

কেন এই অর্থকারী ফসল, অর্থনৈতিক মেরুদ-কে বেছে নেয়া হলো? মূলত: খাসিয়ারা পানকেই তাদের প্রধান উপজীব্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। খাসিয়া পান চাষের জন্য শীর্ষদেশ কম ঝোপালো এমন গাছ বাছাই করা হয়। পুঞ্জির চতুর্দিকে, যেখানে গাছ রয়েছে, সেটিতেই পান চাষের সুযোগ খুঁজে থাকেন। পান চাষের আশ্রয়ী গাছ হিসেবে চাপালিশ ও সুপারি গাছ সবচেয়ে বেশি উপযোগী কারণ গাছ দুটিকে ছাঁটায়ের প্রয়োজন পড়ে না। অন্যান্য আশ্রয়ী গাছের মধ্যে জারুল, কালাজাম, তুন, বোনাক, শিমুল, কদম, ডুমুর, জাম ও ডেউয়া উল্লেখযোগ্য। বসতবাটিতে কাঁঠাল ও আম গাছের সঙ্গেও খাসিয়া পানের আবাদ করা হয়ে থাকে। গবেষণা অনুযায়ী, ১ হেক্টর বনভূমিতে খাসিয়া পান আবাদ করে প্রায় ২ লক্ষ টাকা আয় করা সম্ভবপর। আয়ের মূলস্তম্ভকে সমুলে উৎপাটন করতেই পান গাছকে বেছে নেয়া হয়েছে। বারংবার পুঞ্জিগুলো আক্রান্ত হতে থাকলে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলহীন হলে সন্তান-সন্ততির লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, সামাজিক-ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান উদযাপন ব্যাহত, চিকিৎসাহীনতায় কর্মঅক্ষম জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে এক সময় জায়গা স্থানান্তর হতেও বাধ্য হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ফাদার জোসেফ গোমেজ ওএমআই বলেছেন, ‘আমার ধারণা জুম দখল করার জন্যই দুর্বৃত্তরা পান গাছগুলো কেটে দিয়েছে। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন পান গাছ কেটে ফেলায় পরিবারগুলার পথে বসার উপক্রম হয়েছে।’ হৃদয়ে গভীরে স্বপ্নদেখা দুর্বৃত্তদের জয়যাত্রা কী এভাবেই এগিয়ে যাবে!

মৌলভীবাজারের ৬টি উপজেলায় ছোট-বড় ৬৫টি খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে। পান নির্ভর পুঞ্জিগুলোতে সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পান গাছ থেকে সম্পূর্ণ পান উত্তোলন শেষ হয়ে যায়। সময়মতো বৃষ্টি হলে মে মাসের শেষ দিকে আবারও পান উত্তোলন শুরু হয়। তবে এবার আগাম বৃষ্টি হওয়ার কারণে মার্চ মাসেই পান উত্তোলন শুরু হয়েছে। পানের উৎপাদনের বছরেই দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর নিষেধাজ্ঞার পর দেশ থেকে ইউরোপে পান রপ্তানির কথা জানিয়েছে কৃষিমন্ত্রী জনাব মো. আব্দুর রাজ্জাক। বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে পান রপ্তানি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে’। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্ত পূরণ করায় গত ১৫ এপ্রিল পান রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এ নিষেধাজ্ঞার আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৩ হাজার ২৫০ টন পান রপ্তানি করে। সে বছর পান রপ্তানি করে বাংলাদেশ তিন কোটি ডলার আয় করে। খাসিয়াদের কথানুযায়ী, খাসিয়াদের উৎপাদিত পান পছন্দের শীর্ষে থাকায় রপ্তানির তালিকাতে প্রথমসারিতেই রয়েছে। জাতীয়ভাবে একটি শুভ সংবাদের পরই যখন খাসিয়াদের দূরবস্থা ও তাদের অসহায়ত্বতা কথা শুনছি, সত্যিই বিবেক আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে!

বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বিষয়টি তারা তদন্ত করে দেখছেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি আদিবাসীদের বিরূপ মনোভাব ক্রমশঃই ফুটে উঠছে, আস্থা শূন্যের কোঠায়। বনাখলা পুঞ্জির মন্ত্রী একদা হামলার শিকার হয়ে স্থানীয় দক্ষিণ গান্ধাই গ্রামের বাসিন্দা আতিক মিয়া ও লেছাই মিয়াসহ আরও ১৫/২০ জনের নামে অভিযোগ করলে থানার কর্মকর্তা সেবার বলেছিলেন, ‘তারা লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। তদন্ত করে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান।’ স্থানীয় প্রশাসনের সম্ভুকগতির তদন্ত আদৌ হয়েছে কি না সন্দেহ রয়েছে! অপরদিকে মন্ত্রী তার পুঞ্জিবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘পুলিশ বলেছে ব্যবস্থা নেবে’। আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন (কুবরাজ)-এর সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাংয়ের অভিযোগও অগ্রগণ্য, ‘কুলাউড়ার বিভিন্ন পুঞ্জিতে আদিবাসীদের পানের জুম থেকে পান গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির চারা কর্তন করে দুর্বৃত্তরা। যার কারণে খাসি পান চাষিরা বেশ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। পান চাষ করেই খাসিয়ারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু আমরা সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি। বিষয়টি প্রশাসনের কাছে একাধিকবার জানিয়েছি কিন্তু আদৌ কোন সুরহা হয়নি।’ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, যে সব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে জাতিগত বৈষম্যকে লালন করেন, ন্যায্যতাকে অর্থের কাছে জিম্মি রাখে; তাদের বিষয়ে অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পিছপা হবেন না।

দেশের নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা ও সুবিচার প্রাপ্তির অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। যারা পান চাষ করে বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করেন, তাদের সহযোগিতা ও উৎসাহ দেয়া আমাদের কর্তব্য। পান গাছ না থাকলে খাসিয়ারা বাঁচবে কি করে! সরকারকে দুটি দিকের গুরুত্বারোপ করেই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।