সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যু বেশি চট্টগ্রামে

রাজশাহী জেলায় একদিনে ২৭০ জন শনাক্ত

সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও খুলনায় গত কয়েকদিন ধরে করোনার ‘উচ্চ’ সংক্রমণ হলেও দু’দিনে করোনায় বেশি মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলার মধ্যে কক্সবাজার, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। তবে ওইসব জেলায় করোনার ভারতীয় অর্থাৎ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

দু’দিনে সারাদেশে করোনায় ৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৩ জনই চট্টগ্রাম বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। গতকাল সারাদেশে সর্বোচ্চ ২৭০ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী জেলায়।

দেশে গত একদিনে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ও নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণের হার আবারও বেড়েছে। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রোগী শনাক্ত দুই হাজারের কাছাকাছি এবং শনাক্তের হারও সাড়ে ১১ শতাংশে পৌঁছে গেছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে গত ৪১ দিনের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ সংক্রমণের হার।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর সংক্রমণ রোধ করতে না পারায় তা অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। এখন কমিউনিটি ট্রানমিশনও হচ্ছে। ক্রমশ তা ব্যাপক মাত্রায় ছড়াচ্ছে। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আগামীতে মৃত্যু আরও বাড়তে পারে। তবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে গবেষণার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজশাহী বিভাগের সব জেলায় ছড়িয়েছে সংক্রমণ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের সব বিভাগেই সংক্রমণ বেড়েছে। একদিনে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এ বিভাগের ৮ জেলায় গত একদিনে ৬০৭ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ বিভাগের তিন হাজার ৩৪৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৬০৭ জনের করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

রাজশাহী বিভাগের মধ্যে রাজশাহীতে ৮৯৫টি নমুনা পরীক্ষায় ২৭০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ১৭ শতাংশ। অন্য জেলার মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭৫ জন (শনাক্তের হার ১৯.১৩ শতাংশ), নাটোরে ৩৫ জন, নওগাঁও ১১৯ জন, পাবনায় ১৬ জন, সিরাজগঞ্জে ১৫ জন, বগুড়ায় ১৬ জন এবং জয়পুরহাটে ৬১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কোভিড-১৯ বিষয়ক ‘জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি’র সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, সংক্রমণ এখন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই; প্রায় সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ যত বাড়বে, মৃত্যুও সেভাবে বাড়তে থাকবে। প্রথমদিকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর সংক্রমণ ঠেকানোর যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় এটি হয়েছে।

বিএসএমএমইউ’র সাবেক এই উপাচার্য নমুনা পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘লকডাউন’ পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। এখন নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধি করে চিকিৎসার ওপরই জোর দিতে হবে। আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করে সমন্বয় করা মুশকিল; যদি এসব এলাকায় অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হয় তাহলে একটা সুরাহা হয়। তাতে দ্রুত রোগী শনাক্ত হবে আর রোগী শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশন এবং রোগীর সংস্পর্শে আসা লোকজনের কোয়ারেন্টিন করতে সুবিধা হবে।

যেসব এলাকায় আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেখানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হলে রোগী শনাক্তের হার আরও বাড়বেÑ মন্তব্য করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, তখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে স্বাস্থ্য বিভাগ।

ঢাকা বিভাগেও বাড়ছে সংক্রমণ

ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায় ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত বেড়েছে। তবে নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশ। এর মধ্যে ফরিদপুরে ৪৪ জন, গাজীপুরে ২৫ জন, গোপালগঞ্জে ১২ জন, কিশোরগঞ্জে ১৮ জন, নারায়ণগঞ্জে ১৯ জন, নরসিংদীতে ৩২ জন, টাঙ্গাইলে ২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। বাকি জেলারগুলোতে রোগী শনাক্ত ১০ জনেরও কম।

ময়মনসিংহ বিভাগের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় ৩২ জন ও জামালপুরে ১০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই বেড়েছে

চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মধ্যে গত একদিনে এক হাজার ৮৫০টি নমুনা পরীক্ষায় ২৪৪ জনের দেহে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।

চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ৬০ জনের, কক্সবাজারে ৩৯ জনের, ফেনীতে ১৯ জনের, নোয়াখালীতে ৯৪ জনের, চাঁদপুরে ১৪ জনের, কুমিল্লায় ১০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘এখানে মানুষজন ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না আবার গ্রামাঞ্চলেও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এ কারণেই সংক্রমণ বাড়ছে। তবে কক্সবাজারের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত নেই। এ কারণে এখানে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নয়।’

অন্যান্য বিভাগেও বাড়ছে সংক্রমণ

রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৪৪১টি নমুনা পরীক্ষায় ৯৪ জনের করোনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রংপুরে ২৮ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৮ জন ও দিনাজপুরে ৩৩ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।

খুলনা বিভাগের ১০টি জেলায় এক হাজার ৪০৮টি নমুনা পরীক্ষায় ৪২৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ বাগেরহাটে ৩২ জন, যশোরে ১৬১ জন, খুলনায় ৭৯ জন, কুষ্টিয়ায় ৫৬ জন, মেহেরপুরে ১০ জন, নড়াইলে ১৭ জন ও সাতক্ষীরায় ৫০ জনের দেহে করোনা পাওয়া গেছে।

বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলায় ২৭০টি নমুনা পরীক্ষায় ৪১ জন করোনা রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পিরোজপুর জেলায় ১৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় ৩২৩টি নমুনা পরীক্ষা ৫৪ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিলেটে ২৯ জন ও মৌলভীবাজারে ১৭ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ৬ জুন স্বাস্থ্য বুলেটিনে বলেছিলেন, ভারতীয় ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে শনাক্ত হয়েছে এবং সেটা এখন বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে।

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশিÑ উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই পরিচালক বলেন, ‘আর সংক্রমণ অনেক বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি হবে। তবে দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চেষ্টা করছে।’

মৃত্যু বাড়ছে চট্টগ্রাম বিভাগে

গতকাল মৃত্যু হওয়া ৩০ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগের সাতজন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জন, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুই জন করে, খুলনা বিভাগের তিনজন, সিলেট বিভাগের চারজন এবং রংপুর বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন একজন।

এর আগের দিন করোনায় সারাদেশে ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২ জন ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলায় গত একদিনে দু’জনের মৃত্যু বেড়েছে। তবে অন্য জেলার বিষয়টি আমি বলতে পারব না।’

গত ৫ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাপ্তাহিক বিশ্লেষণে বলা হয়, গত ৩০ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত-এক সপ্তাহে সারাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৯২৮ জন। এর আগের সপ্তাহে (২৩ মে থেকে ২৯ মে) রোগী শনাক্ত হয়েছিল নয় হাজার ৬৬০ জন। এ হিসেবে গত সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।

আর গত সপ্তাহে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২৫২ জনের। এর আগের সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছিল ২০১ জনের। এ হিসেবে এক সপ্তাহে মৃত্যু বেড়েছে ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে শনাক্তের সংখ্যা ও হার বেড়েছে

গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে এক হাজার ৯৭০ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এটি গত ৩৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত; গত ৩০ এপ্রিলের পর এটি একদিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত। ওইদিন দুই হাজার ১৭৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছিল।

গতকাল নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এটি গত ৪১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা শনাক্ত হয়েছে আট লাখ ১২ হাজার ৯৬০ জনের।

২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩০ জন। এ নিয়ে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১২ হাজার ৮৬৯ জনে।

গত একদিনে করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৯১৮ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হলেন সাত লাখ ৫৩ হাজার ২৪০ জন। মোট সুস্থতার হার ৯২ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার এক দশমিক ৫৮ শতাংশ।

গত একদিনে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৭ হাজার ১৬৯টি আর এখন পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৬০ লাখ ৬৭ হাজার ৪২টি।

গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ৩০ জনের মধ্যে পুরুষ ১৯ জন ও নারী ১১ জন। এখন পর্যন্ত দেশে মৃত্যু হওয়া লোকজনের মধ্যে পুরুষ নয় হাজার ২৭৫ জন এবং নারী তিন হাজার ৫৯৪ জন।

মঙ্গলবার, ০৮ জুন ২০২১ , ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৬ শাওয়াল ১৪৪২

সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যু বেশি চট্টগ্রামে

রাজশাহী জেলায় একদিনে ২৭০ জন শনাক্ত

রাকিব উদ্দিন

image

স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না সাধারণ মানুষের মাঝে, পরছেন না মাস্ক, গতকাল সোয়ারি ঘাটের চিত্র -সংবাদ

সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও খুলনায় গত কয়েকদিন ধরে করোনার ‘উচ্চ’ সংক্রমণ হলেও দু’দিনে করোনায় বেশি মৃত্যু চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলার মধ্যে কক্সবাজার, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। তবে ওইসব জেলায় করোনার ভারতীয় অর্থাৎ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

দু’দিনে সারাদেশে করোনায় ৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৩ জনই চট্টগ্রাম বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। গতকাল সারাদেশে সর্বোচ্চ ২৭০ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী জেলায়।

দেশে গত একদিনে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ও নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণের হার আবারও বেড়েছে। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রোগী শনাক্ত দুই হাজারের কাছাকাছি এবং শনাক্তের হারও সাড়ে ১১ শতাংশে পৌঁছে গেছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে গত ৪১ দিনের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ সংক্রমণের হার।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর সংক্রমণ রোধ করতে না পারায় তা অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। এখন কমিউনিটি ট্রানমিশনও হচ্ছে। ক্রমশ তা ব্যাপক মাত্রায় ছড়াচ্ছে। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় আগামীতে মৃত্যু আরও বাড়তে পারে। তবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে গবেষণার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজশাহী বিভাগের সব জেলায় ছড়িয়েছে সংক্রমণ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের সব বিভাগেই সংক্রমণ বেড়েছে। একদিনে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এ বিভাগের ৮ জেলায় গত একদিনে ৬০৭ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ বিভাগের তিন হাজার ৩৪৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৬০৭ জনের করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

রাজশাহী বিভাগের মধ্যে রাজশাহীতে ৮৯৫টি নমুনা পরীক্ষায় ২৭০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ১৭ শতাংশ। অন্য জেলার মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭৫ জন (শনাক্তের হার ১৯.১৩ শতাংশ), নাটোরে ৩৫ জন, নওগাঁও ১১৯ জন, পাবনায় ১৬ জন, সিরাজগঞ্জে ১৫ জন, বগুড়ায় ১৬ জন এবং জয়পুরহাটে ৬১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কোভিড-১৯ বিষয়ক ‘জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি’র সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, সংক্রমণ এখন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই; প্রায় সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ যত বাড়বে, মৃত্যুও সেভাবে বাড়তে থাকবে। প্রথমদিকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর সংক্রমণ ঠেকানোর যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় এটি হয়েছে।

বিএসএমএমইউ’র সাবেক এই উপাচার্য নমুনা পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘লকডাউন’ পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। এখন নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধি করে চিকিৎসার ওপরই জোর দিতে হবে। আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করে সমন্বয় করা মুশকিল; যদি এসব এলাকায় অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হয় তাহলে একটা সুরাহা হয়। তাতে দ্রুত রোগী শনাক্ত হবে আর রোগী শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশন এবং রোগীর সংস্পর্শে আসা লোকজনের কোয়ারেন্টিন করতে সুবিধা হবে।

যেসব এলাকায় আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেখানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হলে রোগী শনাক্তের হার আরও বাড়বেÑ মন্তব্য করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, তখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে স্বাস্থ্য বিভাগ।

ঢাকা বিভাগেও বাড়ছে সংক্রমণ

ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায় ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত বেড়েছে। তবে নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশ। এর মধ্যে ফরিদপুরে ৪৪ জন, গাজীপুরে ২৫ জন, গোপালগঞ্জে ১২ জন, কিশোরগঞ্জে ১৮ জন, নারায়ণগঞ্জে ১৯ জন, নরসিংদীতে ৩২ জন, টাঙ্গাইলে ২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। বাকি জেলারগুলোতে রোগী শনাক্ত ১০ জনেরও কম।

ময়মনসিংহ বিভাগের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় ৩২ জন ও জামালপুরে ১০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই বেড়েছে

চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মধ্যে গত একদিনে এক হাজার ৮৫০টি নমুনা পরীক্ষায় ২৪৪ জনের দেহে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।

চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় ৬০ জনের, কক্সবাজারে ৩৯ জনের, ফেনীতে ১৯ জনের, নোয়াখালীতে ৯৪ জনের, চাঁদপুরে ১৪ জনের, কুমিল্লায় ১০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘এখানে মানুষজন ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না আবার গ্রামাঞ্চলেও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এ কারণেই সংক্রমণ বাড়ছে। তবে কক্সবাজারের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত নেই। এ কারণে এখানে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ ছড়াচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নয়।’

অন্যান্য বিভাগেও বাড়ছে সংক্রমণ

রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৪৪১টি নমুনা পরীক্ষায় ৯৪ জনের করোনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রংপুরে ২৮ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৮ জন ও দিনাজপুরে ৩৩ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।

খুলনা বিভাগের ১০টি জেলায় এক হাজার ৪০৮টি নমুনা পরীক্ষায় ৪২৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ বাগেরহাটে ৩২ জন, যশোরে ১৬১ জন, খুলনায় ৭৯ জন, কুষ্টিয়ায় ৫৬ জন, মেহেরপুরে ১০ জন, নড়াইলে ১৭ জন ও সাতক্ষীরায় ৫০ জনের দেহে করোনা পাওয়া গেছে।

বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলায় ২৭০টি নমুনা পরীক্ষায় ৪১ জন করোনা রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পিরোজপুর জেলায় ১৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় ৩২৩টি নমুনা পরীক্ষা ৫৪ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিলেটে ২৯ জন ও মৌলভীবাজারে ১৭ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ৬ জুন স্বাস্থ্য বুলেটিনে বলেছিলেন, ভারতীয় ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে শনাক্ত হয়েছে এবং সেটা এখন বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে।

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশিÑ উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই পরিচালক বলেন, ‘আর সংক্রমণ অনেক বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি হবে। তবে দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চেষ্টা করছে।’

মৃত্যু বাড়ছে চট্টগ্রাম বিভাগে

গতকাল মৃত্যু হওয়া ৩০ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগের সাতজন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জন, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুই জন করে, খুলনা বিভাগের তিনজন, সিলেট বিভাগের চারজন এবং রংপুর বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন একজন।

এর আগের দিন করোনায় সারাদেশে ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২ জন ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলায় গত একদিনে দু’জনের মৃত্যু বেড়েছে। তবে অন্য জেলার বিষয়টি আমি বলতে পারব না।’

গত ৫ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাপ্তাহিক বিশ্লেষণে বলা হয়, গত ৩০ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত-এক সপ্তাহে সারাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৯২৮ জন। এর আগের সপ্তাহে (২৩ মে থেকে ২৯ মে) রোগী শনাক্ত হয়েছিল নয় হাজার ৬৬০ জন। এ হিসেবে গত সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।

আর গত সপ্তাহে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২৫২ জনের। এর আগের সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছিল ২০১ জনের। এ হিসেবে এক সপ্তাহে মৃত্যু বেড়েছে ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে শনাক্তের সংখ্যা ও হার বেড়েছে

গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে এক হাজার ৯৭০ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এটি গত ৩৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত; গত ৩০ এপ্রিলের পর এটি একদিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত। ওইদিন দুই হাজার ১৭৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছিল।

গতকাল নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এটি গত ৪১ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা শনাক্ত হয়েছে আট লাখ ১২ হাজার ৯৬০ জনের।

২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩০ জন। এ নিয়ে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১২ হাজার ৮৬৯ জনে।

গত একদিনে করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৯১৮ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ হলেন সাত লাখ ৫৩ হাজার ২৪০ জন। মোট সুস্থতার হার ৯২ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার এক দশমিক ৫৮ শতাংশ।

গত একদিনে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৭ হাজার ১৬৯টি আর এখন পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৬০ লাখ ৬৭ হাজার ৪২টি।

গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ৩০ জনের মধ্যে পুরুষ ১৯ জন ও নারী ১১ জন। এখন পর্যন্ত দেশে মৃত্যু হওয়া লোকজনের মধ্যে পুরুষ নয় হাজার ২৭৫ জন এবং নারী তিন হাজার ৫৯৪ জন।