শফী অনুসারীদের বাদ রেখে হেফাজতের নতুন কমিটি

শফীপুত্রের প্রত্যাখ্যান

অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে বহুল আলোচিত কওমি মাদ্র্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ৩৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নুরুল ইসলাম জিহাদীকে মহাসচিব করা হয়েছে।

নতুন এই কমিটিতে ঠাঁই হয়নি হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমীর প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অনুসারীদের।

তবে, কমিটিতে নাম থাকলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন আল্লামা শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানী। এছাড়া কমিটিতে থেকে বাদ পড়েছেন বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ বিতর্কিত চট্টগ্রামের অনেক নেতাও।

গতকাল খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। মাওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী এই কমিটি ঘোষণা করেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ভবিষ্যতে প্রত্যেক জেলা কমিটির সভাপতি পদাধিকারবলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবে। জেলা কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতে হবে।

জানা গেছে, বিভিন্ন অভিযোগে জেলে থাকা ও রাজনৈতিক পরিচয়ধারী নেতাদের বাদ দিয়ে ‘অরাজনৈতিক’ এই সংগঠনের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও সদ্য ঘোষিত কমিটিতে আহমদ শফীর ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীসহ শফী অনুসারীদের বেশ কয়েকজনকে রাখা হবে বলে একটি গুঞ্জন সপ্তাহ খানেক ধরে চলছিল। নতুন কমিটি ঘোষণার পর দেখা যায় কমিটিতে শফী অনুসারী হিসেবে পরিচিত তেমন কাউকেই রাখা হয়নি।

ঘোষিত কমিটিতে সহকারী মহাসচিবের পদ দেয়া হয় আহমদ শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে। তবে কমিটি ঘোষণার পরপরই হাতে লেখা এক চিঠিতে তা প্রত্যাখান করেছেন তিনি।

চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আমি মাওলানা ইউসুফ মাদানী, আজ ঘোষিত তথাকথিত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমার নাম দেখে আমি মর্মাহত। যারা আমার পিতাকে কষ্ট দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়েছেন তাদের সঙ্গে আমি কখনও এক হতে পারি না। আজকের ঘোষিত তথাকথিত হেফাজতের কমিটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি’।

কমিটিতে শফির অনুসারীদের বাদ দেয়ার ব্যাপারে জানতে তার ছোট পুত্র হেফাজতের সাবেক প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাস মাদানীর মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরবর্তীতে শফিপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত হেফাজতের সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহীর সঙ্গে যোগাযোগ করা চেষ্টা করলে তিনিও ফোন ধরেননি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনের বিরোধিতা করে সংগঠনের বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত মার্চের ২৫, ২৬ ও ২৭ তারিখ দেশজুড়ে সহিংসতা চালায় হেফাজত। সে সময় সরকারি অফিস, স্থাপনা ধ্বংসের পাশাপাশি অন্তত ১৭ জনের প্রাণহানি হয়। এরপর ঢাকা মহানগর হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হকের রিসোর্টকা-ের পর নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ১১ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন মামলায় হেফাজতের নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আলোচিত হেফাজত নেতাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আহমদ আবদুল কাদের, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা মামুনুল হক, সহকারী মহাসচিব মাওলানা মনঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দিসহ অনেকেই।

এমন পরিস্থিতিতে ২৬ এপ্রিল রাতে জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। আর তার কয়েক ঘণ্টা পর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা আসে। তখন থেকেই হেফাজত নেতারা বলে আসছিলেন শীঘ্রই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। সবশেষ গতকাল নতুন কমিটি ঘোষণা করল হেফাজত।

হেফাজতের সদ্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে চট্টগ্রামের ১৪ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন সংগঠনটির আমির হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী, নায়েবে আমির মাওলানা সালাহউদ্দীন নানুপুরী (ফটিকছড়ি), মাওলানা ইয়াহইয়া (হাটহাজারী), মাওলানা তাজুল ইসলাম (চট্টগ্রাম), মাওলানা মুফতি জসিমুদ্দীন (হাটহাজারী)। সংগঠনটির বর্তমান মহাসচিব হাফেজ নূরুল ইসলাম জিহাদী ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও তার পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায়।

এছাড়া যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা লোকমান হাকীম (চট্টগ্রাম), মাওলানা আইয়ুব বাবুনগরী (ফটিকছড়ি), সহকারী মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ মাদানী (রাঙ্গুনিয়া), সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস (হাটহাজারী), অর্থ-সম্পাদক মাওলানা মুফতি মুহাম্মাদ আলী (হাটহাজারী), সহ-অর্থ সম্পাদক মুফতি হাবিবুর রহমান কাসেমী (হাটহাজারী) এবং সদস্য মাওলানা ফোরকানুল্লাহ খলিল (চট্টগ্রাম) ও মাওলানা মাহমুদল হাসান (হাটহাজারী)।

হেফাজতের নতুন এই কমিটির ব্যাপারে জানতে নতুন নায়েবে আমীর মাওলানা মুফতি জসিমুদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন চট্টগ্রামে, ঢাকায় ছিলাম না তাই বেশি কিছু বলতে পারব না’, এ কথা বলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ ব্যাপারে নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিসকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া নতুন কমিটি হতে বাদ পড়ার ব্যাপারে সংগঠনটির সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনিরকে কল করা হলে তিনিও ফোন ধরেননি।

মঙ্গলবার, ০৮ জুন ২০২১ , ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৬ শাওয়াল ১৪৪২

শফী অনুসারীদের বাদ রেখে হেফাজতের নতুন কমিটি

শফীপুত্রের প্রত্যাখ্যান

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে বহুল আলোচিত কওমি মাদ্র্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ৩৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নুরুল ইসলাম জিহাদীকে মহাসচিব করা হয়েছে।

নতুন এই কমিটিতে ঠাঁই হয়নি হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমীর প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অনুসারীদের।

তবে, কমিটিতে নাম থাকলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন আল্লামা শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানী। এছাড়া কমিটিতে থেকে বাদ পড়েছেন বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ বিতর্কিত চট্টগ্রামের অনেক নেতাও।

গতকাল খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। মাওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী এই কমিটি ঘোষণা করেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ভবিষ্যতে প্রত্যেক জেলা কমিটির সভাপতি পদাধিকারবলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবে। জেলা কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতে হবে।

জানা গেছে, বিভিন্ন অভিযোগে জেলে থাকা ও রাজনৈতিক পরিচয়ধারী নেতাদের বাদ দিয়ে ‘অরাজনৈতিক’ এই সংগঠনের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও সদ্য ঘোষিত কমিটিতে আহমদ শফীর ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীসহ শফী অনুসারীদের বেশ কয়েকজনকে রাখা হবে বলে একটি গুঞ্জন সপ্তাহ খানেক ধরে চলছিল। নতুন কমিটি ঘোষণার পর দেখা যায় কমিটিতে শফী অনুসারী হিসেবে পরিচিত তেমন কাউকেই রাখা হয়নি।

ঘোষিত কমিটিতে সহকারী মহাসচিবের পদ দেয়া হয় আহমদ শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে। তবে কমিটি ঘোষণার পরপরই হাতে লেখা এক চিঠিতে তা প্রত্যাখান করেছেন তিনি।

চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আমি মাওলানা ইউসুফ মাদানী, আজ ঘোষিত তথাকথিত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমার নাম দেখে আমি মর্মাহত। যারা আমার পিতাকে কষ্ট দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়েছেন তাদের সঙ্গে আমি কখনও এক হতে পারি না। আজকের ঘোষিত তথাকথিত হেফাজতের কমিটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি’।

কমিটিতে শফির অনুসারীদের বাদ দেয়ার ব্যাপারে জানতে তার ছোট পুত্র হেফাজতের সাবেক প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাস মাদানীর মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরবর্তীতে শফিপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত হেফাজতের সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহীর সঙ্গে যোগাযোগ করা চেষ্টা করলে তিনিও ফোন ধরেননি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনের বিরোধিতা করে সংগঠনের বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত মার্চের ২৫, ২৬ ও ২৭ তারিখ দেশজুড়ে সহিংসতা চালায় হেফাজত। সে সময় সরকারি অফিস, স্থাপনা ধ্বংসের পাশাপাশি অন্তত ১৭ জনের প্রাণহানি হয়। এরপর ঢাকা মহানগর হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হকের রিসোর্টকা-ের পর নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ১১ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন মামলায় হেফাজতের নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আলোচিত হেফাজত নেতাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আহমদ আবদুল কাদের, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা মামুনুল হক, সহকারী মহাসচিব মাওলানা মনঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দিসহ অনেকেই।

এমন পরিস্থিতিতে ২৬ এপ্রিল রাতে জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। আর তার কয়েক ঘণ্টা পর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা আসে। তখন থেকেই হেফাজত নেতারা বলে আসছিলেন শীঘ্রই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। সবশেষ গতকাল নতুন কমিটি ঘোষণা করল হেফাজত।

হেফাজতের সদ্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে চট্টগ্রামের ১৪ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন সংগঠনটির আমির হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী, নায়েবে আমির মাওলানা সালাহউদ্দীন নানুপুরী (ফটিকছড়ি), মাওলানা ইয়াহইয়া (হাটহাজারী), মাওলানা তাজুল ইসলাম (চট্টগ্রাম), মাওলানা মুফতি জসিমুদ্দীন (হাটহাজারী)। সংগঠনটির বর্তমান মহাসচিব হাফেজ নূরুল ইসলাম জিহাদী ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও তার পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায়।

এছাড়া যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা লোকমান হাকীম (চট্টগ্রাম), মাওলানা আইয়ুব বাবুনগরী (ফটিকছড়ি), সহকারী মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ মাদানী (রাঙ্গুনিয়া), সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস (হাটহাজারী), অর্থ-সম্পাদক মাওলানা মুফতি মুহাম্মাদ আলী (হাটহাজারী), সহ-অর্থ সম্পাদক মুফতি হাবিবুর রহমান কাসেমী (হাটহাজারী) এবং সদস্য মাওলানা ফোরকানুল্লাহ খলিল (চট্টগ্রাম) ও মাওলানা মাহমুদল হাসান (হাটহাজারী)।

হেফাজতের নতুন এই কমিটির ব্যাপারে জানতে নতুন নায়েবে আমীর মাওলানা মুফতি জসিমুদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন চট্টগ্রামে, ঢাকায় ছিলাম না তাই বেশি কিছু বলতে পারব না’, এ কথা বলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ ব্যাপারে নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিসকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া নতুন কমিটি হতে বাদ পড়ার ব্যাপারে সংগঠনটির সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনিরকে কল করা হলে তিনিও ফোন ধরেননি।