ছাইয়ের মধ্যে স্বপ্ন হাতড়াচ্ছেন বস্তিবাসী

৭ বছর ধরে রাজধানীর মহাখালী এলাকায় ভিক্ষা করেন নূরজাহান বেগম। ৫ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট আসমা মানসিক রোগী। ভিক্ষার টাকায় ওই মেয়ের চিকিৎসা চলে। যারা টাকার বদলে চাল বা অন্যকিছু দেয় সেগুলো দিয়ে চলে সংসার। এভাবে দ্বারে দ্বারে হাত পেতে সাততলা বস্তির একটি ছোট ঘরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন ছোট সংসার। কিন্তু বিধি বাম। সর্বনাশা আগুন নূরজাহানের চোখের সামনেই ছাই করে দিয়েছে সবকিছু। তাইতো ছাইয়ের মধ্যে নিজের স্বপ্ন হাতরাতে হাতরাতে বিলাপ করছেন নূরজাহান বেগম। প্রতিবেশী কাউকে দেখলেই কেঁদে কেঁদে বলছেন, ’পরনের কাপড় ছাড়া কিছু রইলনা। দুই বস্তা ভিক্ষার চাল ছিল। তাও পুড়ে গেছে। এখন খাব কী? থাকব কোথায়?

শুধু নূরজাহান বেগম নয়, একই অবস্থা রাজধানীর মহাখালী সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর। গত রোববার ভোররাতে লাগা আগুনে সবকিছু পুড়ে গেলেও সবাই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অবশিষ্ট কিছু পাওয়া যায় কিনা সেই খোঁজ করছেন। গতকাল দুপুরে সরেজমিন সাততলা বস্তিতে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। এর আগে গতকাল ভোর ৪টার দিকে সাততলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে, পুলিশের হিসাবে বস্তির ১২৫টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেখানে প্রায় হাজারখানেক ঘর ছিল। অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনের কারণেই এ অগ্নিকা-ের সূত্রপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

এদিকে অগ্নিকা-ের ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে ৫ হাজার টাকা, টিন ও ত্রাণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। পাশাপাশি বস্তির অগ্নিদুর্ঘটনা কমাতে স্থায়ী আবাসন করার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন তিনি।

সরেজমিন দেখা যায়, পুড়ে ছাই হওয়া ঘরগুলোর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুড়ে যাওয়া টিভি-ফ্রিজ, হাঁড়ি-পাতিল, বালিশ-তোশক, চামচ, খুনতি, ট্রাংকসহ পুড়ে কয়লা হওয়া নানা ধরনের আসবাবপত্র। পোড়া টিন কাঠ কিংবা বাঁশ দিয়ে সরিয়ে অবশিষ্ট কিছু আছে কিনা সেটি খুঁজে দেখছেন সবাই। অনেকে আবার ঘরের উপরে বসে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্না করছেন। একইভাবেই আর্তনাদ করছিলেন ভিক্ষাবৃত্তি করা নূরজাহান বেগম। জানতে চাইলে নূরজাহান বলেন, ৭ বছর আগে তার স্বামী বাদল মিয়া মারা যায়। এরপর থেকে ভিক্ষা করে সংসারটা দাঁড় করাইছি। খুব কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একটা চকি, একটা ফ্যান ও একটা পুরনো ওয়্যারড্রোব কিনছিলাম। চোখের সামনে ঘরে আগুন লাগার ১৫ মিনিটের মধ্যে সব পুড়ে গেল। কিছুই করতে পারলাম না। খালি মেয়ে আসমাকে নিয়ে বের হতে পারছি বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নূরজাহান। চোখ মোছা দিতে দিতে পুড়া চাল হাতে নিয়ে বলেন, ভিক্ষা করে আনা এ চালগুলোই খাওয়ার ভরসা ছিল। সব শেষ। আমার মতো গরিবের কেন এই সর্বনাশ হলো, কি পাপ করছিলাম যে মাথা গুজার জায়গাটাও হারালাম।

নূরজাহানের ঘর থেকে কিছুটা সামনে গেলে চোখে পড়ে নাসিমা বেগম নামে এক গৃহবধূ বিলাপ করে কান্না করছেন। কান্না করবেনইবা না কেন? জীবনের সর্বস্ব ও লোনের টাকায় বস্তিতে গড়ে তোলা ১৪টি রুমের ৩টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যা কিছুতেই মানতে পারছেন না নাসিমা বেগম। কান্না করতে করতে বলেন, সারাজীবনের জমানো টাকা আর লোনের ২ লাখ টাকা দিয়ে এখানে ঘর তুলেছিলাম। সবকয়টি ঘরই ছাই হয়ে গেছে। আর মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা থাকল না। ব্যাংক লোনের কিছুটা শোধ করেছি। বাকিটা কিভাবে দেব, ঘরইবা কিভাবে তুলব আবার। মাথায় কিছুই কাজ করছে না। বস্তিবাসী জানায়, বস্তির সব ঘর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে দোতলা ও তিনতলা করায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মানুষই সন্তান কোলে এক কাপড়ে ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়েছেন জীবন রক্ষার তাগিদে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর সাংবাদিকদের বলেন, এই বস্তি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এখানে অবৈধ গ্যাস ও বিদুৎ সংযোগও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে গ্যাস বা বিদুৎ সংযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত। তিনি বলেন, এই বস্তির ঘর-বাড়ি বাঁশ ও কাঠের কাঠামোতে তৈরি করা হয়েছে। ফলে আগুন সহজেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণা বাতাসের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে কিছুটা সময় লেগেছে। তবে ঘটনার পর খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ছুটে এসেছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।

প্রায় তিন ঘণ্টা পর সকাল ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এ অগ্নিকা-ে হতাহতের কোন খবর এখনও পাওয়া যায়নি। তবে বস্তির কয়েকশ’ ঘর পুড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত শেষে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে বলেও জানান তিনি। বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা যে তালিকা করেছি, সেই হিসাবে ১২৫টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেখানে হাজারখানেক রুম ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, পুরো বস্তিতে ঠিক কতটি ঘর আছে সেটি বলা মুশকিল। তবে আমাদের ধারণা আড়াই হাজার ঘর আছে।

এদিকে, দুপুর ১টার দিকে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, বস্তিবাসীকে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা যাতে স্থায়ী জমি পায় সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আগামীকাল কড়াইল বস্তির জমির মালিক ৩ মন্ত্রণালয়কে ডাকা হয়েছে। তাদের সঙ্গে স্থায়ী আবাসনের বিষয়ে কথা বলা হবে। পর্যায়ক্রমে অন্য বস্তির বিষয়েও উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ সময় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে ৫ হাজার টাকা, টিন ও ত্রাণ দেয়ার ঘোষণা দেন ডিএনসিসি মেয়র। পাশাপাশি দুপুর ও রাতের খাবার দেয়ার ঘোষণা দিয়ে মেয়র আতিক আরও বলেন, রাজধানীর সব বস্তিতেই অবৈধ গ্যাস বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। ফলে বার বার দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এগুলো চাইলেই বন্ধ করে দেয়া সম্ভব না। কারণ বন্ধ করে দিলে এই খেটেখাওয়া মানুষগুলো আর চলতে পারবে না। সুতরাং এর একটা স্থায়ী সমাধান করতে বস্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। একই ভাড়ায় যেন তারা ফ্ল্যাট বাসায় থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ বস্তির ৭৪০ পরিবারের স্থায়ী আবাসনের কাজ চলছে। গাবতলীতেও ৭৮০ পরিবারের জন্য স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে অন্য বস্তিতেও আমরা এ উদ্যোগ গ্রহণ করব।

গ্যাসের চুলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আগুন লাগার নিশ্চিত কারণ বলা না হলেও বস্তিবাসী জানিয়েছে, জামাল মুহুরির বাড়ির চুলা থেকেই আগুণের সূত্রপাত হয়েছে। ১৫-২০ দিন ধরে চুলাটিতে লিকেজ থাকলেও সেটি ঠিক করতে কোন উদ্যগ নেননি বাড়ির মালিক। চুলা সংলগ্ন রুমের ভাড়াটিয়া মুক্তা বেগম বলেন, বেশ কিছুদিন ধরেই চুলাটিতে লিকেজ ছিল কিন্তু সংস্কার করা হয়নি। গতকাল ভোরে হঠাৎ করেই আগুন আগুন চিৎকার শুনতে পাই। পরে দেখি আমার ঘরেই আগুন লেগেছে। এ সময় স্বামী আরিফ হোসেনকে নিয়ে কোনমতে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পেরেছি। তবে চুলসহ শরীরে থাকা জামা-কাপড় পুড়ে গেছে বলে জানান তিনি। একই তথ্য দেন আশপাশের বাসিন্দারা।

বারবার কেন আগ্নিকা-

মহাখালীর সাততলা বস্তিতে অগ্নিকা-ের ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার এখানে আগুন লেগেছে। ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর এই বস্তিতে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। প্রতিবারই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগের দুর্বল তারের কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। আর সেই ঝুঁকি এখনও রয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সরেজমিন অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। বস্তির ভেতর ছোট ছোট চিপা গলিতে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অবৈধ গ্যাস লাইন। পায়ে হাঁটা রাস্তার ওপর দিয়ে অরক্ষিতভাবে নেয়া হয়েছে অধিকাংশ অবৈধ গ্যাস সংযোগের লাইন। এসব লাইনের ওপর দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত চলাচল করে। আবার অনেকের রান্নার চুলাও বসানো হয়েছে অরক্ষিত এসব গ্যাস লাইনের খুব কাছে। এছাড়া বিদ্যুতের তারের সংযোগগুলো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।

বস্তিবাসী জানায়, একচুলা ৭০০ টাকা, দুই চুলা ১৪০০ টাকা এবং ৩ চুলা ২১০০ টাকা হারে গ্যাসের সংযোগ দেন ইউসুফ মীর্জা নামে এক ব্যক্তি। আর ইউনিটপ্রতি ৭ টাকা হিসাবে বিদ্যুতের সংযোগ দেন সাইদুল নামে এক ব্যক্তি। কখনও গ্যাস বা বিদ্যুতের লাইনে সমস্যা দেখা দিলেই তারাই ঠিক করে দেন। বস্তিবাসী বলছে, সরকারের উচিত বারবার কেন আগুন লাগে, কেউ ইচ্ছা করে আগুন লাগিয়ে দেয় কিনা সেসব বিষয় খুঁজে বের করা। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ঢাকার অন্য বস্তিতে যেভাবে আগুন লাগে সাততলা বস্তিও এর বাইরে না। বস্তিতে দাহ্য পদার্থ, বাঁশ, কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর, আবার অনেক ঘর দোতলা, এসব কারণে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, গ্যাসের লাইনগুলো কতটুকু বৈধ-অবৈধ জানি না। তবে কিছু লাইন অবৈধ থাকতে পারে এবং এখানে বিদ্যুতের লাইনও অবৈধ। কী কারণে আগুন লেগেছে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

মঙ্গলবার, ০৮ জুন ২০২১ , ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৬ শাওয়াল ১৪৪২

ছাইয়ের মধ্যে স্বপ্ন হাতড়াচ্ছেন বস্তিবাসী

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

সোমবার ভোররাতে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুনে নিঃস্ব বস্তিবাসীর আহাজারি -সংবাদ

৭ বছর ধরে রাজধানীর মহাখালী এলাকায় ভিক্ষা করেন নূরজাহান বেগম। ৫ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট আসমা মানসিক রোগী। ভিক্ষার টাকায় ওই মেয়ের চিকিৎসা চলে। যারা টাকার বদলে চাল বা অন্যকিছু দেয় সেগুলো দিয়ে চলে সংসার। এভাবে দ্বারে দ্বারে হাত পেতে সাততলা বস্তির একটি ছোট ঘরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন ছোট সংসার। কিন্তু বিধি বাম। সর্বনাশা আগুন নূরজাহানের চোখের সামনেই ছাই করে দিয়েছে সবকিছু। তাইতো ছাইয়ের মধ্যে নিজের স্বপ্ন হাতরাতে হাতরাতে বিলাপ করছেন নূরজাহান বেগম। প্রতিবেশী কাউকে দেখলেই কেঁদে কেঁদে বলছেন, ’পরনের কাপড় ছাড়া কিছু রইলনা। দুই বস্তা ভিক্ষার চাল ছিল। তাও পুড়ে গেছে। এখন খাব কী? থাকব কোথায়?

শুধু নূরজাহান বেগম নয়, একই অবস্থা রাজধানীর মহাখালী সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর। গত রোববার ভোররাতে লাগা আগুনে সবকিছু পুড়ে গেলেও সবাই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অবশিষ্ট কিছু পাওয়া যায় কিনা সেই খোঁজ করছেন। গতকাল দুপুরে সরেজমিন সাততলা বস্তিতে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। এর আগে গতকাল ভোর ৪টার দিকে সাততলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে, পুলিশের হিসাবে বস্তির ১২৫টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেখানে প্রায় হাজারখানেক ঘর ছিল। অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনের কারণেই এ অগ্নিকা-ের সূত্রপাত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

এদিকে অগ্নিকা-ের ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে ৫ হাজার টাকা, টিন ও ত্রাণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। পাশাপাশি বস্তির অগ্নিদুর্ঘটনা কমাতে স্থায়ী আবাসন করার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন তিনি।

সরেজমিন দেখা যায়, পুড়ে ছাই হওয়া ঘরগুলোর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুড়ে যাওয়া টিভি-ফ্রিজ, হাঁড়ি-পাতিল, বালিশ-তোশক, চামচ, খুনতি, ট্রাংকসহ পুড়ে কয়লা হওয়া নানা ধরনের আসবাবপত্র। পোড়া টিন কাঠ কিংবা বাঁশ দিয়ে সরিয়ে অবশিষ্ট কিছু আছে কিনা সেটি খুঁজে দেখছেন সবাই। অনেকে আবার ঘরের উপরে বসে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্না করছেন। একইভাবেই আর্তনাদ করছিলেন ভিক্ষাবৃত্তি করা নূরজাহান বেগম। জানতে চাইলে নূরজাহান বলেন, ৭ বছর আগে তার স্বামী বাদল মিয়া মারা যায়। এরপর থেকে ভিক্ষা করে সংসারটা দাঁড় করাইছি। খুব কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একটা চকি, একটা ফ্যান ও একটা পুরনো ওয়্যারড্রোব কিনছিলাম। চোখের সামনে ঘরে আগুন লাগার ১৫ মিনিটের মধ্যে সব পুড়ে গেল। কিছুই করতে পারলাম না। খালি মেয়ে আসমাকে নিয়ে বের হতে পারছি বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নূরজাহান। চোখ মোছা দিতে দিতে পুড়া চাল হাতে নিয়ে বলেন, ভিক্ষা করে আনা এ চালগুলোই খাওয়ার ভরসা ছিল। সব শেষ। আমার মতো গরিবের কেন এই সর্বনাশ হলো, কি পাপ করছিলাম যে মাথা গুজার জায়গাটাও হারালাম।

নূরজাহানের ঘর থেকে কিছুটা সামনে গেলে চোখে পড়ে নাসিমা বেগম নামে এক গৃহবধূ বিলাপ করে কান্না করছেন। কান্না করবেনইবা না কেন? জীবনের সর্বস্ব ও লোনের টাকায় বস্তিতে গড়ে তোলা ১৪টি রুমের ৩টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যা কিছুতেই মানতে পারছেন না নাসিমা বেগম। কান্না করতে করতে বলেন, সারাজীবনের জমানো টাকা আর লোনের ২ লাখ টাকা দিয়ে এখানে ঘর তুলেছিলাম। সবকয়টি ঘরই ছাই হয়ে গেছে। আর মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা থাকল না। ব্যাংক লোনের কিছুটা শোধ করেছি। বাকিটা কিভাবে দেব, ঘরইবা কিভাবে তুলব আবার। মাথায় কিছুই কাজ করছে না। বস্তিবাসী জানায়, বস্তির সব ঘর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে দোতলা ও তিনতলা করায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মানুষই সন্তান কোলে এক কাপড়ে ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়েছেন জীবন রক্ষার তাগিদে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর সাংবাদিকদের বলেন, এই বস্তি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এখানে অবৈধ গ্যাস ও বিদুৎ সংযোগও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে গ্যাস বা বিদুৎ সংযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত। তিনি বলেন, এই বস্তির ঘর-বাড়ি বাঁশ ও কাঠের কাঠামোতে তৈরি করা হয়েছে। ফলে আগুন সহজেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণা বাতাসের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে কিছুটা সময় লেগেছে। তবে ঘটনার পর খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ছুটে এসেছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।

প্রায় তিন ঘণ্টা পর সকাল ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এ অগ্নিকা-ে হতাহতের কোন খবর এখনও পাওয়া যায়নি। তবে বস্তির কয়েকশ’ ঘর পুড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত শেষে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে বলেও জানান তিনি। বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা যে তালিকা করেছি, সেই হিসাবে ১২৫টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেখানে হাজারখানেক রুম ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, পুরো বস্তিতে ঠিক কতটি ঘর আছে সেটি বলা মুশকিল। তবে আমাদের ধারণা আড়াই হাজার ঘর আছে।

এদিকে, দুপুর ১টার দিকে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, বস্তিবাসীকে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা যাতে স্থায়ী জমি পায় সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আগামীকাল কড়াইল বস্তির জমির মালিক ৩ মন্ত্রণালয়কে ডাকা হয়েছে। তাদের সঙ্গে স্থায়ী আবাসনের বিষয়ে কথা বলা হবে। পর্যায়ক্রমে অন্য বস্তির বিষয়েও উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ সময় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে ৫ হাজার টাকা, টিন ও ত্রাণ দেয়ার ঘোষণা দেন ডিএনসিসি মেয়র। পাশাপাশি দুপুর ও রাতের খাবার দেয়ার ঘোষণা দিয়ে মেয়র আতিক আরও বলেন, রাজধানীর সব বস্তিতেই অবৈধ গ্যাস বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। ফলে বার বার দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এগুলো চাইলেই বন্ধ করে দেয়া সম্ভব না। কারণ বন্ধ করে দিলে এই খেটেখাওয়া মানুষগুলো আর চলতে পারবে না। সুতরাং এর একটা স্থায়ী সমাধান করতে বস্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। একই ভাড়ায় যেন তারা ফ্ল্যাট বাসায় থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ বস্তির ৭৪০ পরিবারের স্থায়ী আবাসনের কাজ চলছে। গাবতলীতেও ৭৮০ পরিবারের জন্য স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে অন্য বস্তিতেও আমরা এ উদ্যোগ গ্রহণ করব।

গ্যাসের চুলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আগুন লাগার নিশ্চিত কারণ বলা না হলেও বস্তিবাসী জানিয়েছে, জামাল মুহুরির বাড়ির চুলা থেকেই আগুণের সূত্রপাত হয়েছে। ১৫-২০ দিন ধরে চুলাটিতে লিকেজ থাকলেও সেটি ঠিক করতে কোন উদ্যগ নেননি বাড়ির মালিক। চুলা সংলগ্ন রুমের ভাড়াটিয়া মুক্তা বেগম বলেন, বেশ কিছুদিন ধরেই চুলাটিতে লিকেজ ছিল কিন্তু সংস্কার করা হয়নি। গতকাল ভোরে হঠাৎ করেই আগুন আগুন চিৎকার শুনতে পাই। পরে দেখি আমার ঘরেই আগুন লেগেছে। এ সময় স্বামী আরিফ হোসেনকে নিয়ে কোনমতে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পেরেছি। তবে চুলসহ শরীরে থাকা জামা-কাপড় পুড়ে গেছে বলে জানান তিনি। একই তথ্য দেন আশপাশের বাসিন্দারা।

বারবার কেন আগ্নিকা-

মহাখালীর সাততলা বস্তিতে অগ্নিকা-ের ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার এখানে আগুন লেগেছে। ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর এই বস্তিতে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। প্রতিবারই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগের দুর্বল তারের কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। আর সেই ঝুঁকি এখনও রয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সরেজমিন অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। বস্তির ভেতর ছোট ছোট চিপা গলিতে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অবৈধ গ্যাস লাইন। পায়ে হাঁটা রাস্তার ওপর দিয়ে অরক্ষিতভাবে নেয়া হয়েছে অধিকাংশ অবৈধ গ্যাস সংযোগের লাইন। এসব লাইনের ওপর দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত চলাচল করে। আবার অনেকের রান্নার চুলাও বসানো হয়েছে অরক্ষিত এসব গ্যাস লাইনের খুব কাছে। এছাড়া বিদ্যুতের তারের সংযোগগুলো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।

বস্তিবাসী জানায়, একচুলা ৭০০ টাকা, দুই চুলা ১৪০০ টাকা এবং ৩ চুলা ২১০০ টাকা হারে গ্যাসের সংযোগ দেন ইউসুফ মীর্জা নামে এক ব্যক্তি। আর ইউনিটপ্রতি ৭ টাকা হিসাবে বিদ্যুতের সংযোগ দেন সাইদুল নামে এক ব্যক্তি। কখনও গ্যাস বা বিদ্যুতের লাইনে সমস্যা দেখা দিলেই তারাই ঠিক করে দেন। বস্তিবাসী বলছে, সরকারের উচিত বারবার কেন আগুন লাগে, কেউ ইচ্ছা করে আগুন লাগিয়ে দেয় কিনা সেসব বিষয় খুঁজে বের করা। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ঢাকার অন্য বস্তিতে যেভাবে আগুন লাগে সাততলা বস্তিও এর বাইরে না। বস্তিতে দাহ্য পদার্থ, বাঁশ, কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর, আবার অনেক ঘর দোতলা, এসব কারণে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, গ্যাসের লাইনগুলো কতটুকু বৈধ-অবৈধ জানি না। তবে কিছু লাইন অবৈধ থাকতে পারে এবং এখানে বিদ্যুতের লাইনও অবৈধ। কী কারণে আগুন লেগেছে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।