গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা, দালান-কোঠা
সিলেট সদরের একটি ইউনিয়নে অনেকটা অবিশ্বাস্যভাবে সরকারের হাজার কোটি টাকার খাস জমি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করে দিচ্ছে প্রভাবশালীরা। পাহাড়-টিলা, বন ও চা বাগান কেটে প্লট সৃষ্টি করে তাদের দখলও বুঝিয়ে দিচ্ছে ওই ভূমিখেকোচক্র। এমনকি কেউ কেউ সেসব পাহাড়-টিলা কাটার পর ওই এলাকাগুলোতে নিজেদের নামে আবাসিক এলাকার নামকরণও করেছে।
প্রকাশ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মাঝেমধে লোক দেখানো অভিযান পরিচালিত হলেও কারা এসব সরকারি জায়গা অন্যত্র বিক্রি বা কারা পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করছে সেসব তথ্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা বা এই দখলবাজির মহোৎসব বন্ধ করা হচ্ছে না। সরেজমিন দেখা গেছে, শহরতলীর খাদিমপাড়া ইউনিয়নের মেজরটিলা থেকে বটেশ্বর পর্যন্ত দখলবাজির এই মহোৎসব চলছে, যার সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন ও একটি চা বাগানের ব্যবস্থাপক জড়িত বলে অভিযোগ।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই এলাকাগুলোতে সরকারি বিভিন্ন মৌজার দাগ ও চা বাগান রয়েছে। প্রায় প্রতিটি মৌজার জায়গা ও চা বাগানের অংশ ধীরে ধীরে কেটে দখল ও বিক্রি করা হচ্ছে। এর জন্য জোনাল সেটেলম্যান্টের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কিছু জাল কাগজও তৈরি করেছে ওই সিন্ডিকেট। এসব অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা যুগের পর যুগ চিঠি চালাচালি করলেও প্রশাসন থেকে কোন প্রতিকার পায়নি। এসব একাধিক বিক্রির স্ট্যাম্প ও নথি সংরক্ষিত রয়েছে এ প্রতিবেদকের হাতে।
বিভিন্ন নথি ও অভিযোগ থেকে জানা যায়, সদর উপজলার খাদিমপাড়া ইউনিয়নের বহর মৌজার ১, ২, খতিয়ানের ৭০ নম্বর জেএল’র ১৪২ নম্বর দাগে ৩৮ একর ৩৪ শতক সরকারি খাস জায়গার নাম ছিল বহর কলনী। এই নামটি পরিবর্তন করে ভূমিখেকো চক্র বহর আবাসিক এলাকা ও আল বারাকা গ্রিন সিটি নাম দিয়ে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে প্লট বিক্রি করছে। এই জায়গায় ইতোমধ্যে পাহাড়, টিলা, বন কেটে গড়ে উঠেছে অনেক দালানকোঠা। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে প্লটে সাইনবোর্ডও রয়েছে।
এখন চলছে নানা নির্মাণ কাজ। অথচ ১৯৯৭ সালে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর সিলেট সদর কানুনগো স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬৪ সালে ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা মোহাজেরদের ঐ জায়গা থেকে ৮ একর ৪ শতক ভূমি বরাদ্দ দেয়া হয়। বাকি ৩০ একর ৩০ শতক (তিন হাজার ৩০ শতাংশ) জায়গায় নজর পড়ে স্থানীয় খন্দকার আনোয়ার হোসেন, আইয়ূব আলী মুহুরী, অমির মিয়া, উছমান আলী মুহুরী, করিম হাজারী, কয়েস মিয়া, রুস্তম আলী, ইউনুছ আলী, সাইফুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম ও আলী মুসলিম মিয়া গংদের। এরা স্ট্যাম্পের মাধ্যমে ঐ পরিমাণ জায়গা বিক্রি ও সেখানে একশ’ ২৩টি পরিবারকে দখলিয় ভূমিহীন দেখিয়ে ২০০৩ সালে সরকারকে বিবাদী করে একটি মামলা করে। কিন্তু ভূমিখেকোদের ছত্রছায়ায় থেকে কিছুসংখ্যক ভূমিহীন মিলে মামলাটি বন্ধ করে দেয়। ২০১২ সালে আইয়ূব আলী গং একটি জালিয়াতি আপোষনামা তৈরি করে উচ্ছেদ মামলা জারি করে। বিষয়টি জানাজানি হলে ২০১৫ সালে ভূমিহীনরা একত্রিত হয়ে ওই গংদের বিরুদ্ধে পাল্টা আরেকটি মামলা করে।
এরপর থেকে তাদের উপর নেমে আসে নানা অত্যাচার। তাদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ওই ভূমি দখল করে বিক্রি অব্যাহত রেখেছে চক্রটি। এরসঙ্গে জড়িত খন্দকার আনোয়ার হোসেন, মৃত মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী, তার ছোট ভাই মাওলানা জাহিদ উদ্দিন চৌধুরী। আর এ দখলীয়তার জন্য তাদের লাঠিয়াল বাহিনীর মধ্যে রয়েছে শেখ আমিনুর রহমান, হায়দার আলী, সুজন মিয়া, আলাল মিয়া, কুদ্দুস মিয়া, কালাম মিয়া, সেবুল মিয়া ও মঈন উদ্দিন গং। উল্লেখিত স্থানে প্রতি শতাংশ জায়গার মূল্য রয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। এ হিসেবে এর মূল্য দাঁড়ায় ৯৯ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অভিযুক্তদের একজন উছমান আলী মুহুরী বলেন, আমরা ক্রমান্বয়ে ১৯৪৫ সালে কৃষ্ণ গোবিন্দ দত্তের কাছ থেকে এই জায়গার মালিক। তিনি মারা যাওয়ার পর তার ছেলে আদালতে স্বীকার করেন তার বাবা এই জায়গা বিক্রি করে গেছেন। ১৯৬৪ সালে জায়গাটি ফল বাগান করার জন্য সরকার জনৈক ব্যক্তিকে লিজ প্রদান করে। কিন্তু মালিকপক্ষ মামলা করার পর তা আদালতের মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায়। ২০১০ সালে আমরা এই জায়গা ক্রয় করে আদালতে মামলা করি। বর্তমানে এই মামলা চলছে।
এছাড়া যারা এখানে ভূমিহীন বলে বসবাস করছে তাদের পক্ষ করেও একটি মামলা করি। তিনি বলেন, আমরা= কোন জায়গা স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করছি না। তবে যারা বসবাস করছে তাদের কেউ কেউ এমনটি করছে; যেহেতু এই জায়গার দলিল রেজিস্ট্রি হবে না। তিনি বলেন, খন্দকার আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে নয়, তিনি পার্শ্ববর্তীতে বাতিলকৃত লিজ দলিল ক্রয় করে জায়গার মালিক হয়েছেন। উছমান আলী মুহুরী দাবি করেন, তিনি নিজে টিলা কাটার বিরুদ্ধে। বলেন, প্রভাবশালী একজন আ’লীগ নেতা খাদিম চা বাগানের টিলা কাটছেন।
এছাড়া খাদিমনগর ও দেবপুর মৌজার সরকারি ও খাদিম চা বাগানের জায়গায় গড়ে উঠেছে ফাতেমানগর নামের একটি আবাসিক এলাকা। এই তালিকায় রয়েছে জাহানপুর, আলুরতল, সৈয়দপুর, টিলাগড় মৌজার বাঘমারা এলাকা। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী একজন নেতার নেতৃত্বে গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়, টিলা ও বন কেটে ধীরে ধীরে প্লট তৈরি করা হচ্ছে। গড়ে উঠেছে দালান কোঠা। এখানেও প্রায় ৫০ একর জায়গা রয়েছে যার মূল্য প্রতি শতকে প্রায় দুই লাখ টাকা করে হলে দাঁড়ায় একশ’ কোটি টাকা।
এদিকে, ফাতেমানগরের পাশেই খাদিমনগর মৌজার ১১৪২ নম্বর দাগে ছিল নয় নম্বর ও ১১৫৫ নম্বর দাগে ছিল তিন নম্বর উপজাতি কুলি বস্তি। বর্তমানে সেখানে বহর পশ্চিম আবাসিক এলাকা, সিরাজনগর ও সবুজনগর আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। ওই এলাকাগুলোতে সরকারি জায়গা ছাড়াও খাদিম চা বাগানের জায়গা রয়েছে। উল্লেখিত দুই দাগে যথাক্রমে ৩৮.৩৪ একর ও ৬.৭ একর জায়গা রয়েছ।
যার বাজার মূল্য শতাংশে প্রায় এক লাখ টাকা হলে দাঁড়ায় ৪৫ কোটি টাকা। জানা গেছে, এই চা বাগানটি সরকার থেকে ২০১২ সালে আফজাল রশিদ চৌধুরীর নামে বন্দোবস্ত নেয়া হয়। যার মেয়াদ আগামী ২০৩২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু সরকারি জায়গা হওয়ার ফলে বাগানের ব্যবস্থাপক আতিকুর রহমানের সহযোগিতায় ভূমিখেকোরা ক্রমান্বয়ে বাগানের গাছ ও টিলা কেটে দখল করছে। এগুলোর সঙ্গে একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা, আবুল কালাম আজাদ পাটওয়ারী, কেয়ারটেকার আক্কাস আলী, সিরাজুল ইসলাম ও খসরু মিয়া গং জড়িত। তবে সরকার থেকে বন্দোবস্ত আনা বাগানের জমি দখল হলেও সেদিকে নজর নেই লিজগ্রহীতা আফজাল রশিদ চৌধুরীর।
এ বিষয়ে খাদিম চা বাগানের ব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তাদের চা বাগানের সীমানা ঠিক আছে। সিরাজ মিয়া তার ক্রয়কৃত জায়গায় সিরাজনগর আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, চা বাগানের কিছু জায়গা নিয়ে একজন আ’লীগ নেতার সঙ্গে মামলা চলছে।
অপরদিকে উপজাতি কুলিবস্তি ও খাদিম চা বাগানের জায়গা দখল করে সিরাজনগর আবাসিক এলাকার প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ মিয়া দাবি করেন এই জায়গা তার বাবা ফুলবাড়ির জমিদার আবদুল মামুন চৌধুরীর কাছ থেকে ক্রয় করেন। বর্তমানে আদালতে মামলা চলমান। ক্রয় করার পর মামলা কেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জায়গাটি চা বাগানের নামে রেকর্ডে ছিল। একপর্যায়ে বাগান কর্তৃপক্ষ তা ছেড়ে দেয়। পরে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করি রেকর্ড আমার নামে করার জন্য। তবে নিজের নামে রেকর্ড না থাকার পরও তিনি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জায়গা বিক্রি করছেন।
এদিকে বহর মৌজার ২০০১ নম্বর দাগসহ অন্যান্য কয়েকটি দাগে প্রায় ১৫ একর সরকারি খাস জমির মধ্যে ওসমানী মুক্তিযোদ্ধা গুচ্ছগ্রামকে কিছু বন্দোবস্ত দেয়া হয়। কিন্তু বন্দোবস্তের শর্ত ভঙ্গ করে ও অবশিষ্ট খাস জায়গা সেই স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। এরসঙ্গে মৃত সাকির আলী, মৃত জামিল মোল্লা ও বাদুর মিয়া, রশিদ মিয়া, সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মিয়া জড়িত বলে এলাকাবাসী জানায়।
ওই জায়গার মূল্য শতাংশে দেড় লাখ টাকা করে দাঁড়ায় প্রায় ২২ কোটি টাকা। এরই পাশে শান্তিবাগ এলাকায় প্রায় ৭ একর সরকারি খাস জমিতে প্লট তৈরি করে বিক্রি করছে ফাতেমানগরের সেই প্রভাবশালী নেতা ও খোকন নামের এক যুবক। শতাংশে প্রায় দুই লাখ টাকা করে হলে এ জায়গার দাম দাঁড়ায় ১৪ কোটি টাকা। এদিকে খাদিম চা বাগানের কাছেই সরকারি খাস খতিয়ানের পাহাড়-টিলা রয়েছে। সেখানে তিন নম্বর উপজাতি কুলি বস্তির লোকজনের বসবাস।
১৫ একর এই খাস জায়গা খন্দকার আনোয়ার হোসেন, সুহেল মিয়া, সাদিকুর রহমান গংরা শাহপরাণ উপশহর আবাসিক এলাকা নাম দিয়ে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। শতাংশ প্রতি তিন লাখ টাকা করে হলে এই জায়গার দাম দাঁড়ায় ৪৫ কোটি টাকা। উল্লেখিত এলাকা ছাড়া আরও অন্যান্য এলাকা ও দাগ রয়েছে যেখানে ভূমিখেকোরা জাল জালিয়াতি ও স্ট্যাম্পের মাধ্যমে সরকারি জায়গা বেচাকেনা অব্যাহত রেখেছে।
এ বিষয়ে খন্দকার আনোয়ার হোসেনের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আসাদ।
তবে আসাদকে অভিযোগের বিষয়ে জানালে তিনি কোন বক্তব্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে হাসান নামের আর একজনের সে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে হাসানকে বিষয়টি জানালে তিনি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাবেন বলে দুইদিন সময় নেন। দুইদিন পর থেকে তিনি আর এ প্রতিবেদকের ফোন রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে খাদিমপাড়া ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন আনু বলেন, সরকারি খাস জায়গা, চা বাগানের জায়গা দখলের বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সময় প্রশাসনকে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কাজী মহুয়া মমতাজ বলেন, স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জায়গা বিক্রির বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে পাহাড়-টিলা কাটার কথা স্বীকার করে বলেন, যখনই পাহাড় কাটার খবর পাওয়া যায় তখনই অভিযান হয়। তবে তখন সেখানে কোন প্রতক্ষ্যদর্শী পাওয়া যায় না। ফলে কাউকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, এছাড়া সরকারি জায়গাগুলো নিয়ে অনেক জটিলতা আছে। এসব জায়গা নিয়ে অন্তত ১৭টি মামলা চলবে। কেউ বন্দোবস্ত গ্রহীতা, কেউ উত্তরসূরি আবার কেউ দলিলের মাধ্যমে ক্রয় করেছেন। মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কিছু করার নেই। তবে সাময়িকভাবে যেসব অভিযোগ আসে তা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হয়।
বুধবার, ০৯ জুন ২০২১ , ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৭ শাওয়াল ১৪৪২
গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা, দালান-কোঠা
আকাশ চৌধুরী, সিলেট
সিলেট সদরের একটি ইউনিয়নে অনেকটা অবিশ্বাস্যভাবে সরকারের হাজার কোটি টাকার খাস জমি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করে দিচ্ছে প্রভাবশালীরা। পাহাড়-টিলা, বন ও চা বাগান কেটে প্লট সৃষ্টি করে তাদের দখলও বুঝিয়ে দিচ্ছে ওই ভূমিখেকোচক্র। এমনকি কেউ কেউ সেসব পাহাড়-টিলা কাটার পর ওই এলাকাগুলোতে নিজেদের নামে আবাসিক এলাকার নামকরণও করেছে।
প্রকাশ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মাঝেমধে লোক দেখানো অভিযান পরিচালিত হলেও কারা এসব সরকারি জায়গা অন্যত্র বিক্রি বা কারা পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করছে সেসব তথ্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা বা এই দখলবাজির মহোৎসব বন্ধ করা হচ্ছে না। সরেজমিন দেখা গেছে, শহরতলীর খাদিমপাড়া ইউনিয়নের মেজরটিলা থেকে বটেশ্বর পর্যন্ত দখলবাজির এই মহোৎসব চলছে, যার সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন ও একটি চা বাগানের ব্যবস্থাপক জড়িত বলে অভিযোগ।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই এলাকাগুলোতে সরকারি বিভিন্ন মৌজার দাগ ও চা বাগান রয়েছে। প্রায় প্রতিটি মৌজার জায়গা ও চা বাগানের অংশ ধীরে ধীরে কেটে দখল ও বিক্রি করা হচ্ছে। এর জন্য জোনাল সেটেলম্যান্টের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কিছু জাল কাগজও তৈরি করেছে ওই সিন্ডিকেট। এসব অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা যুগের পর যুগ চিঠি চালাচালি করলেও প্রশাসন থেকে কোন প্রতিকার পায়নি। এসব একাধিক বিক্রির স্ট্যাম্প ও নথি সংরক্ষিত রয়েছে এ প্রতিবেদকের হাতে।
বিভিন্ন নথি ও অভিযোগ থেকে জানা যায়, সদর উপজলার খাদিমপাড়া ইউনিয়নের বহর মৌজার ১, ২, খতিয়ানের ৭০ নম্বর জেএল’র ১৪২ নম্বর দাগে ৩৮ একর ৩৪ শতক সরকারি খাস জায়গার নাম ছিল বহর কলনী। এই নামটি পরিবর্তন করে ভূমিখেকো চক্র বহর আবাসিক এলাকা ও আল বারাকা গ্রিন সিটি নাম দিয়ে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে প্লট বিক্রি করছে। এই জায়গায় ইতোমধ্যে পাহাড়, টিলা, বন কেটে গড়ে উঠেছে অনেক দালানকোঠা। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে প্লটে সাইনবোর্ডও রয়েছে।
এখন চলছে নানা নির্মাণ কাজ। অথচ ১৯৯৭ সালে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর সিলেট সদর কানুনগো স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬৪ সালে ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা মোহাজেরদের ঐ জায়গা থেকে ৮ একর ৪ শতক ভূমি বরাদ্দ দেয়া হয়। বাকি ৩০ একর ৩০ শতক (তিন হাজার ৩০ শতাংশ) জায়গায় নজর পড়ে স্থানীয় খন্দকার আনোয়ার হোসেন, আইয়ূব আলী মুহুরী, অমির মিয়া, উছমান আলী মুহুরী, করিম হাজারী, কয়েস মিয়া, রুস্তম আলী, ইউনুছ আলী, সাইফুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম ও আলী মুসলিম মিয়া গংদের। এরা স্ট্যাম্পের মাধ্যমে ঐ পরিমাণ জায়গা বিক্রি ও সেখানে একশ’ ২৩টি পরিবারকে দখলিয় ভূমিহীন দেখিয়ে ২০০৩ সালে সরকারকে বিবাদী করে একটি মামলা করে। কিন্তু ভূমিখেকোদের ছত্রছায়ায় থেকে কিছুসংখ্যক ভূমিহীন মিলে মামলাটি বন্ধ করে দেয়। ২০১২ সালে আইয়ূব আলী গং একটি জালিয়াতি আপোষনামা তৈরি করে উচ্ছেদ মামলা জারি করে। বিষয়টি জানাজানি হলে ২০১৫ সালে ভূমিহীনরা একত্রিত হয়ে ওই গংদের বিরুদ্ধে পাল্টা আরেকটি মামলা করে।
এরপর থেকে তাদের উপর নেমে আসে নানা অত্যাচার। তাদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ওই ভূমি দখল করে বিক্রি অব্যাহত রেখেছে চক্রটি। এরসঙ্গে জড়িত খন্দকার আনোয়ার হোসেন, মৃত মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী, তার ছোট ভাই মাওলানা জাহিদ উদ্দিন চৌধুরী। আর এ দখলীয়তার জন্য তাদের লাঠিয়াল বাহিনীর মধ্যে রয়েছে শেখ আমিনুর রহমান, হায়দার আলী, সুজন মিয়া, আলাল মিয়া, কুদ্দুস মিয়া, কালাম মিয়া, সেবুল মিয়া ও মঈন উদ্দিন গং। উল্লেখিত স্থানে প্রতি শতাংশ জায়গার মূল্য রয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। এ হিসেবে এর মূল্য দাঁড়ায় ৯৯ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অভিযুক্তদের একজন উছমান আলী মুহুরী বলেন, আমরা ক্রমান্বয়ে ১৯৪৫ সালে কৃষ্ণ গোবিন্দ দত্তের কাছ থেকে এই জায়গার মালিক। তিনি মারা যাওয়ার পর তার ছেলে আদালতে স্বীকার করেন তার বাবা এই জায়গা বিক্রি করে গেছেন। ১৯৬৪ সালে জায়গাটি ফল বাগান করার জন্য সরকার জনৈক ব্যক্তিকে লিজ প্রদান করে। কিন্তু মালিকপক্ষ মামলা করার পর তা আদালতের মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায়। ২০১০ সালে আমরা এই জায়গা ক্রয় করে আদালতে মামলা করি। বর্তমানে এই মামলা চলছে।
এছাড়া যারা এখানে ভূমিহীন বলে বসবাস করছে তাদের পক্ষ করেও একটি মামলা করি। তিনি বলেন, আমরা= কোন জায়গা স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করছি না। তবে যারা বসবাস করছে তাদের কেউ কেউ এমনটি করছে; যেহেতু এই জায়গার দলিল রেজিস্ট্রি হবে না। তিনি বলেন, খন্দকার আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে নয়, তিনি পার্শ্ববর্তীতে বাতিলকৃত লিজ দলিল ক্রয় করে জায়গার মালিক হয়েছেন। উছমান আলী মুহুরী দাবি করেন, তিনি নিজে টিলা কাটার বিরুদ্ধে। বলেন, প্রভাবশালী একজন আ’লীগ নেতা খাদিম চা বাগানের টিলা কাটছেন।
এছাড়া খাদিমনগর ও দেবপুর মৌজার সরকারি ও খাদিম চা বাগানের জায়গায় গড়ে উঠেছে ফাতেমানগর নামের একটি আবাসিক এলাকা। এই তালিকায় রয়েছে জাহানপুর, আলুরতল, সৈয়দপুর, টিলাগড় মৌজার বাঘমারা এলাকা। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী একজন নেতার নেতৃত্বে গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়, টিলা ও বন কেটে ধীরে ধীরে প্লট তৈরি করা হচ্ছে। গড়ে উঠেছে দালান কোঠা। এখানেও প্রায় ৫০ একর জায়গা রয়েছে যার মূল্য প্রতি শতকে প্রায় দুই লাখ টাকা করে হলে দাঁড়ায় একশ’ কোটি টাকা।
এদিকে, ফাতেমানগরের পাশেই খাদিমনগর মৌজার ১১৪২ নম্বর দাগে ছিল নয় নম্বর ও ১১৫৫ নম্বর দাগে ছিল তিন নম্বর উপজাতি কুলি বস্তি। বর্তমানে সেখানে বহর পশ্চিম আবাসিক এলাকা, সিরাজনগর ও সবুজনগর আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। ওই এলাকাগুলোতে সরকারি জায়গা ছাড়াও খাদিম চা বাগানের জায়গা রয়েছে। উল্লেখিত দুই দাগে যথাক্রমে ৩৮.৩৪ একর ও ৬.৭ একর জায়গা রয়েছ।
যার বাজার মূল্য শতাংশে প্রায় এক লাখ টাকা হলে দাঁড়ায় ৪৫ কোটি টাকা। জানা গেছে, এই চা বাগানটি সরকার থেকে ২০১২ সালে আফজাল রশিদ চৌধুরীর নামে বন্দোবস্ত নেয়া হয়। যার মেয়াদ আগামী ২০৩২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু সরকারি জায়গা হওয়ার ফলে বাগানের ব্যবস্থাপক আতিকুর রহমানের সহযোগিতায় ভূমিখেকোরা ক্রমান্বয়ে বাগানের গাছ ও টিলা কেটে দখল করছে। এগুলোর সঙ্গে একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা, আবুল কালাম আজাদ পাটওয়ারী, কেয়ারটেকার আক্কাস আলী, সিরাজুল ইসলাম ও খসরু মিয়া গং জড়িত। তবে সরকার থেকে বন্দোবস্ত আনা বাগানের জমি দখল হলেও সেদিকে নজর নেই লিজগ্রহীতা আফজাল রশিদ চৌধুরীর।
এ বিষয়ে খাদিম চা বাগানের ব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তাদের চা বাগানের সীমানা ঠিক আছে। সিরাজ মিয়া তার ক্রয়কৃত জায়গায় সিরাজনগর আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, চা বাগানের কিছু জায়গা নিয়ে একজন আ’লীগ নেতার সঙ্গে মামলা চলছে।
অপরদিকে উপজাতি কুলিবস্তি ও খাদিম চা বাগানের জায়গা দখল করে সিরাজনগর আবাসিক এলাকার প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ মিয়া দাবি করেন এই জায়গা তার বাবা ফুলবাড়ির জমিদার আবদুল মামুন চৌধুরীর কাছ থেকে ক্রয় করেন। বর্তমানে আদালতে মামলা চলমান। ক্রয় করার পর মামলা কেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জায়গাটি চা বাগানের নামে রেকর্ডে ছিল। একপর্যায়ে বাগান কর্তৃপক্ষ তা ছেড়ে দেয়। পরে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করি রেকর্ড আমার নামে করার জন্য। তবে নিজের নামে রেকর্ড না থাকার পরও তিনি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জায়গা বিক্রি করছেন।
এদিকে বহর মৌজার ২০০১ নম্বর দাগসহ অন্যান্য কয়েকটি দাগে প্রায় ১৫ একর সরকারি খাস জমির মধ্যে ওসমানী মুক্তিযোদ্ধা গুচ্ছগ্রামকে কিছু বন্দোবস্ত দেয়া হয়। কিন্তু বন্দোবস্তের শর্ত ভঙ্গ করে ও অবশিষ্ট খাস জায়গা সেই স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। এরসঙ্গে মৃত সাকির আলী, মৃত জামিল মোল্লা ও বাদুর মিয়া, রশিদ মিয়া, সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ মিয়া জড়িত বলে এলাকাবাসী জানায়।
ওই জায়গার মূল্য শতাংশে দেড় লাখ টাকা করে দাঁড়ায় প্রায় ২২ কোটি টাকা। এরই পাশে শান্তিবাগ এলাকায় প্রায় ৭ একর সরকারি খাস জমিতে প্লট তৈরি করে বিক্রি করছে ফাতেমানগরের সেই প্রভাবশালী নেতা ও খোকন নামের এক যুবক। শতাংশে প্রায় দুই লাখ টাকা করে হলে এ জায়গার দাম দাঁড়ায় ১৪ কোটি টাকা। এদিকে খাদিম চা বাগানের কাছেই সরকারি খাস খতিয়ানের পাহাড়-টিলা রয়েছে। সেখানে তিন নম্বর উপজাতি কুলি বস্তির লোকজনের বসবাস।
১৫ একর এই খাস জায়গা খন্দকার আনোয়ার হোসেন, সুহেল মিয়া, সাদিকুর রহমান গংরা শাহপরাণ উপশহর আবাসিক এলাকা নাম দিয়ে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। শতাংশ প্রতি তিন লাখ টাকা করে হলে এই জায়গার দাম দাঁড়ায় ৪৫ কোটি টাকা। উল্লেখিত এলাকা ছাড়া আরও অন্যান্য এলাকা ও দাগ রয়েছে যেখানে ভূমিখেকোরা জাল জালিয়াতি ও স্ট্যাম্পের মাধ্যমে সরকারি জায়গা বেচাকেনা অব্যাহত রেখেছে।
এ বিষয়ে খন্দকার আনোয়ার হোসেনের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আসাদ।
তবে আসাদকে অভিযোগের বিষয়ে জানালে তিনি কোন বক্তব্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে হাসান নামের আর একজনের সে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে হাসানকে বিষয়টি জানালে তিনি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাবেন বলে দুইদিন সময় নেন। দুইদিন পর থেকে তিনি আর এ প্রতিবেদকের ফোন রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে খাদিমপাড়া ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন আনু বলেন, সরকারি খাস জায়গা, চা বাগানের জায়গা দখলের বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সময় প্রশাসনকে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কাজী মহুয়া মমতাজ বলেন, স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জায়গা বিক্রির বিষয়টি তিনি জানেন না। তবে পাহাড়-টিলা কাটার কথা স্বীকার করে বলেন, যখনই পাহাড় কাটার খবর পাওয়া যায় তখনই অভিযান হয়। তবে তখন সেখানে কোন প্রতক্ষ্যদর্শী পাওয়া যায় না। ফলে কাউকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, এছাড়া সরকারি জায়গাগুলো নিয়ে অনেক জটিলতা আছে। এসব জায়গা নিয়ে অন্তত ১৭টি মামলা চলবে। কেউ বন্দোবস্ত গ্রহীতা, কেউ উত্তরসূরি আবার কেউ দলিলের মাধ্যমে ক্রয় করেছেন। মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কিছু করার নেই। তবে সাময়িকভাবে যেসব অভিযোগ আসে তা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হয়।