কবিতার ভিতর বাহির সিকদার আমিনুল হক

শিহাব সরকার

দেখা গেছে যে, শিল্পীর মোক্ষ লাভের পথে উত্তরোত্তর উৎকর্ষ অর্জনের পাশাপাশি স্বাতন্ত্র্যেরও একটা বড় ভূমিকা থেকে যায়। শিল্পীর বড় এক পরিচয় তাঁর স্বাতন্ত্র্য। আজীবন এই স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার ভেতর দিয়েই সিকদার আমিনুল হক বাংলাদেশের, তথা বাংলা কবিতায় তাঁর স্থানটি খোদাই করে নিয়েছেন। সাহিত্যে একটি বৈশিষ্ট্যময় অবস্থান তৈরি করে নেয়া যে কোনো কবির জন্য বড় এক অর্জন। অনেক ‘বড়’ কবির এটা হয়ে ওঠে না, গড়পড়তা মানের কবিদের কথা বাদই থাকলো। বহু কবি স্বাতন্ত্র্য ব্যাপারটির গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। বুঝতে পারেন না যে, সাহিত্যের নিরিখে এর বিশেষ একটি অর্থ আছে। সিকদার আমিনুল হকের (১৯৪২-২০০৩) কবিতার সার্বিক মেজাজ সম্পর্কে ধারণা নিতে গিয়ে আমরা তাঁর স্বাতন্ত্র্যের পরিধি দেখে অবাক না হয়ে পারি না। তিনি আয়ত্ত করেছিলেন এক অনন্য কণ্ঠ।

এখানে একটা রহস্যালু ব্যাপার আছে। শিল্পীর স্বাতন্ত্র্য কখনোই তাঁর জন্মগত বা সহজাত ব্যাপার নয়। ‘শিল্পী’র অভিধায় কবিরা অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত। কবি তাঁর প্রথম রচনা থেকেই স্বতন্ত্র নন সাধারণত। যেমন ছিলেন না জীবনানন্দ দাশ এবং আরো অনেকে। অনেক কবি দ্রুত অগ্রজ কবিদের প্রভাব-বলয় থেকে মুক্ত হয়ে যেতে পারেন। কেউ কেউ নিজস্ব কণ্ঠস্বরটি তৈরি করতে সময় নিয়ে নেন প্রচুর। প্রথম বই ‘দূরের কার্নিশ’-এ (১৯৭৫) সিকদার আমিনুল হককে দেখা যায় এক প্রকার ডুবে আছেন শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভুবনে। কিন্তু পরের বই ‘তিন পাপড়ির ফুল’-এ (১৯৭৯) তিনি এই তিনজন কবির আচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে ভিন্ন এক ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করেন। এটি তাঁর নিজস্ব, এবং পৃথক এক ভাষা। প্রভাবের কথা বলতে গেলে, উপরোক্ত তিন কবি যেন কবিতায় চেপে থাকেন শ্বাসরুদ্ধকরভাবে। এ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসা কঠিন কাজ। সিকদার আমিনুল হক তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থে এটি পেরেছিলেন, যদিও তাঁদের মায়াজালে তিনি তখনো অল্পবিস্তর আবিষ্ট। এখানে অনেকে মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারেন। আমি তার কারণ দেখি না। জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রথম দুই বইয়ে নজরুলীয় প্রভাবে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে ছিলেন যে, তিনি আদৌ কখনো নিজস্ব বাকভঙ্গিতে লিখতে পারবেনÑ তা রীতিমতো অচিন্ত্যনীয় ছিলো। এখন দেখি কী আয়রনি, জীবনানন্দ এমনই এক কাব্যভাষা বাঙালি কবিদের ভেতর ছড়িয়ে গিয়েছেন যে, এই ২০১৭ সালেও, সত্তর-আশি বছর পর, এর কুহক থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন পথ দেখি না। কোনো না কোনো পরোক্ষ মাধ্যমে জীবনানন্দ জড়িয়ে আছেনই বাঙালি কবির কবিতায়, সে ঢাকায় হোক, কলকাতায় হোক বা আগরতলায় হোক।

আল মাহমুদের প্রথম দিকের বইয়ে তাঁর বাংলার লোকজ মোটিফসঞ্জাত স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট ছিলো। পরের দিকে নিজের জগতের সীমাকে বিস্তৃত করতে গিয়ে তিনি তাঁর অগুনতি অভ্যস্ত পাঠকের কাছে ‘অচেনা’ হয়ে পড়েন। এরা আল মাহমুদের কবিতার গ্রামীণ আবহের সঙ্গে পরিচিত। এর অনুপস্থিতি তাদের অনেককে বিভ্রান্ত করে। আল মাহমুদের স্বাতন্ত্র্য পরে থিতু হয় তাঁর রোমান্টিক গীতলতায়। এদিক থেকে শামসুর রাহমানের নিজস্ব ভাষাভঙ্গি বরাবর অটুট। দু-চারটি চরণ পড়েই তাঁকে চেনা যায়।

কবিতা নিয়ে সিকদার আমিনুল হকের ‘হোমওয়ার্ক’ বিস্ময়কর। সমসাময়িক ও অনুজতর কবিদের মতো তাঁর বাস্তব জগতের সীমা খুব বিস্তৃত বা কোলাহলমুখর ছিলো না। নিরিবিলি, অন্তরঙ্গ পরিবেশের জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি, স্বেচ্ছানির্বাসনের মতো অনেকটা। এ জীবন এক পর্যায়ে তাঁর জন্য হয়ে দাঁড়ায় বিশুদ্ধ কবিতাযাপন। পার্থিব জীবনের ক্লেদ-কর্দম, নানা ধরনের যুদ্ধ ও অর্থহীন দৌড়ঝাঁপ থেকে তিনি নিজেকে অনেকটা সরিয়ে

রাখতে পেরেছিলেন সৌভাগ্যবশত। একজন কবির অনিবার্য রক্তপাত থেকে তিনি অবশ্য মুক্ত থাকতে পারেননি। তাঁর জন্য এটা হয়ে দাঁড়ায় আশীর্বাদ। না হলে কবি জীবনের মধ্য পর্যায়ে পৌঁছে তিনি কীভাবে পেয়ে যান তাঁর জাদুকরী কাব্যভাষা; চিত্রকল্প-উপমা-রূপক-বিরোধাভাস ইত্যাদি মিলিয়ে যা আমাদের কানে বাজে এক ঐন্দ্রজালিক সঙ্গীতের মতো।

সব পাঠকের কবি নন সিকদার আমিনুল হক। মনে হতে পারে তিনি দুরূহ। আসলে বই থেকে বইয়ে তিনি অভিনব থেকে অভিনবতর গন্তব্য খুঁজেছেন। কবিতার, বৃহত্তর অর্থে শিল্পের। তিনি এক পর্যায়ে আমাদের কাছে হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ নতুন চরিত্রের এক কবি। একটি খাঁটি বাঙালি সত্তাকে ধারণ করেও তিনি পাঠককে নিজের পরিচয় দেন এক অবিশ্রান্ত যাযাবর হিসেবে। শুরুর দিকে তাঁর কবিতার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো নিসর্গ, প্রেম, বিষণœতা ও নানা পর্যায়ে ব্যক্তির মানসচিত্র। তাঁর বাচনভঙ্গি ছিলো একরৈখিক। পাঠক আন্দাজ করতে পারেনি, চেনা আবহের অন্তরালে তিনি কী অক্লান্তভাবে নিজের রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছেন। প্রসন্ন মেজাজের এক মেদুরতা ছড়িয়ে ছিলো তাঁর প্রথম দিকের বই ক’টিতে। কবির এই মানসিক অবয়বের সঙ্গে পাঠক পরিচিত। বাঙালি কবি সাধারণত নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন দেশজ পরিমণ্ডলে। জীবনানন্দ দাশ আমাদের প্রথম কবি, যিনি পাঠকের সামনে হাজির করেন দূরভূমি, দূর সমুদ্রতট, ইতিহাস এবং অতীত-ধূসর চরিত্রদের। কবি জানান পাঠককে, অনেক পথ তিনি হেঁটেছেন পৃথিবীর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ও পথে। কোনো রকমের ভবিষ্যদ্বাণীর অতীত, আত্মরূপান্তরের এই প্রক্রিয়ায় সিকদার আমিনুল হকও নিজেকে আবিষ্কার করেন এক যাযাবর হিসেবে। জীবনানন্দের মতো নয় পুরোপুরি, তাঁর নিজের ধরনে এই কবি হয়ে ওঠেন পরিব্রাজক। বলতে ইচ্ছে হয়, পালাবদলের এই পর্যায়ে সিকদার আমিনুল হকের মনোজগতের অবচেতন স্তরে ও তাঁর মৌলিক কবিসত্তায় ক্রিয়াশীল ছিলো একজন বিশুদ্ধ কবির মুক্তিস্পৃহাÑ যা চিরকালীন।

ক্লেদাকীর্ণ, একঘেঁয়ে বাস্তবের অর্গল ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন কবি। পরের পর্যায়ের কবিতায় তিনি আমাদের নিয়ে যান তাঁর রূপান্তর-পরবর্তী ভুবনে। আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি বিবরণ ও বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উচ্চারণ ভঙ্গিও পাল্টেছে। এ পর্যায়ে কবির রচনায় আমরা পাই টানা গদ্যের প্রাধান্যÑ বাংলাদেশের কবিতায় মুখ্যত অনাস্বাদিত এক চিত্রল ও মূর্ছনাময় কাব্যভাষা। ‘সতত ডানার মানুষ’ (১৯৯১) গ্রন্থটি দিয়ে কবির এই নতুন কাব্যভাষা ও বিশ্বভ্রমণের সূচনা। অবশ্য পূর্ববর্তী ক’টি বই ‘আমি সেই ইলেকট্রা’ (১৯৮৫), ‘পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল’ (১৯৮৭), ‘এক রাত্রি এক ঋতু’ (১৯৯১) ইত্যাদিতেও আসন্ন রূপান্তর ও টানা গদ্যে লেখা কবিতা বা প্রোজ পোয়েমের প্রতি তার ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে ষাটের দশকে এই বিশেষ প্রকরণটি ব্যবহার ক’রে আবদুল মান্নান সৈয়দ বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। আবার অনেকেই এর প্রতি আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু এই বিশেষ ধরনের কবিতার যে-বিপুল সম্ভাবনা আছে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করার, তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সিকদার আমিনুল হক। গদ্যভঙ্গিপ্রধান এই আঙ্গিকটি গত শতকের ষাট দশকের অন্যতম প্রধান এই কবির রচনাকে বিশেষভাবে ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে। সিকদার আমিনুল হকের বড় অর্জন এইখানে।

বাংলাদেশের কবিতায় বরাবর যা দেখা যায়, প্রায় সব কবিই তাঁদের রচনায় প্রচ্ছন্নভাবে হলেও মেসেজ বা বক্তব্য ধরে রাখতে চান। কবিকে পাঠকের উদ্দেশে কিছু বলতে হয়। যাঁরা নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে চান না, তাঁদের রচনাশৈলী থেকে পাঠক কবির মনোজগৎ সম্পর্কে ধারণা করে নেন। কবিতায় প্রকট সামাজিক অঙ্গীকার বা রাজনীতিমনষ্কতা সিকদার আমিনুল হককে কখনো টানেনি। ব্যক্তিজীবনে তাঁর একটি অবিচল রাজনৈতিক বিশ্বাস অবশ্যই ছিলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার প্রতি আপসহীনভাবে আনুগত্য দেখিয়ে গেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কাছে ছিলেন বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। এই প্রেক্ষিতে বলতে হয়, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত তাঁর কবিতা কম, যদিও বাঙালির স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত এই যুদ্ধ নিজস্ব ধরনের চিত্রকল্প ও রূপকের মাধ্যমে তাঁর কবিতায় ছায়াপাত করে গেছে বরাবর। ১৯৭১-এর ন’মাস পাকবাহিনী কর্তৃক অধিকৃত ঢাকা নিয়ে অনবদ্য একটি কবিতা আছে সিকদার আমিনুল হকের। আসলে এই কবি তাঁর সার্বিক কাব্যমেজাজ, প্রকরণ এবং কবিতাভাবনার নিরিখে বাংলাদেশের কবিতায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন।

আমাদের কবিতার প্রথাবদ্ধ এবং বহুল ব্যবহৃত প্রকাশভঙ্গির প্রতি বিমুখ তিনি শুরু থেকেই। পরবর্তী সময়ে কবিতায় তাঁর স্বতন্ত্র ভাষাটি আয়ত্ত করার সঙ্গে সঙ্গে এই বিমুখতা অনীহার রূপ নেয়। অনভ্যস্ত পাঠক তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে স্বচ্ছন্দ না-ও বোধ করতে পারেন। কিন্তু এই কবির রচনায় ঢোকার জন্য পাঠের রুচি এবং পাঠাভ্যাসকে প্রস্তুত করার প্রয়োজন ব্যাপকভাবে।

সিকদার আমিনুল হকের কবিতার ভুবন এবং এর খুঁটিনাটি বাস্তবতা সব সময় দেশজ সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না। তা উন্মোচিত হয় আমাদের কাছে অপরিচিত ভূমণ্ডল, মানুষ ও জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে। সমুদ্র ও অরণ্য তাঁর প্রিয় দুটি বিষয়, একই সঙ্গে নারী ও মৃত্যুচিন্তা। কিন্তু এরা আছে আমাদের চিরচেনা ভূ-প্রকৃতি ও সমাজের অতীত কোনো আবহের ভেতর। আবার এক কুশলী শিল্পীর মতো কবি এই আপাত-অচেনা প্রেক্ষাপটের সঙ্গে দেশজ বাস্তবতারও মিশেল ঘটিয়ে দেন। তাঁর কবিতার স্বাদু গদ্যভঙ্গির সঙ্গে এই কোলাজ স্বচ্ছন্দে মিশে যায়।

কাব্য-কোলাজ সৃষ্টিতে পারদর্শী সিকদার আমিনুল হক। প্রচলিত মেজাজের কবিতায় এটা আশা করা যায় না। তাঁর কবিতার গঠনপ্রকৃতিতে আরো একটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। এক অননুকরণীয় কৌশলে শব্দের পিঠে শব্দ বসিয়ে, ওগুলোর মধ্যে মধুমিলন ও বিরোধিতা ঘটিয়ে তিনি কবিতার ভেতরে, পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে এক অদ্ভুত সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা জাগান। একজন সহজাত এবং খাঁটিÑ জেনুইন অর্থে, কবির পক্ষেই এই কাজটি সম্ভব। নানা উচ্চতার শিখরে পৌঁছানোর জন্য প্রাণপাতরত আমাদের বহু কবি কবিতার এই রহস্যটি ধরতে পারেননি। করুণা হয়, এঁরা সারাজীবন সস্তা, প্যাচপ্যাচে আবেগের বিবর্ণ কবিতা লিখে গেছেন, তা প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে হোক বা মাটিসংলগ্নতা নিয়েই হোক। আসলে প্রকৃত কবিকে প্রথমে জানতে হয় কবিতা মাধ্যম হিসেবে মূলত কী, ‘কবিতা’ থেকে ‘পদ্য’ বা নিরেট গদ্যের পার্থক্য কোথায় তারপর বিষয়বৈচিত্র্য। আমরা ছদ্মকবিদের ও মারমার-কাটকাট পদ্যাকারদের নানা কায়দাবাজি দেখে এতদূর এসেছি। গুটি কয়েক কবি বাদে কবিতার অন্তহীন, অনিশ্চিত যাত্রাই শুরু করেননি কেউ প্রকৃত অর্থে।একজন বিশুদ্ধ কবি হিসেবে নিজেকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা, অন্য অন্য বড় আধুনিক বাঙালি ও বিদেশি কবিদের রচনা বিপুল আয়াসসাধ্য অভিনিবেশ নিয়ে অধ্যয়ন এবং সেগুলোর মর্মমূলে পৌঁছাবার কারণে সিকদার আমিনুল হক বাংলা কবিতায় নিজের অমোচনীয় মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। প্রস্তুতিপর্বেই তিনি আয়ত্ত করেছিলেন আধুনিক কবিতার আন্তর্জাতিক চারিত্র ও প্রকরণ।

প্রতিভাবান কবিদের বহুলপ্রজ না হলেও চলে। সিকদার আমিনুল হকের বইয়ের সংখ্যা বিপুল নয়। ১৯৭৫ থেকে মৃত্যুর এক বছর আগে ২০০২ পর্যন্ত ১৫টি কবিতার বই রেখে গিয়ে তিনি আমাদের প্রধান কবিদের একজন হিসেবে টিকে গেছেন নিঃসন্দেহে। কাব্যজীবনের এক তিক্ত পর্যায়ে অভিমানের সঙ্গে তাঁর একটি বইয়ের নাম রেখেছিলেন তিনি ’বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে’। এখন উপলব্ধি করি, অন্ধকারে বা উপেক্ষায় থাকার কবি নন সিকদার আমিনুল হক। তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে আলোকিত দিব্যরথ।

বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১ , ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৮ শাওয়াল ১৪৪২

কবিতার ভিতর বাহির সিকদার আমিনুল হক

শিহাব সরকার

image

সিকদার আমিনুল হক

দেখা গেছে যে, শিল্পীর মোক্ষ লাভের পথে উত্তরোত্তর উৎকর্ষ অর্জনের পাশাপাশি স্বাতন্ত্র্যেরও একটা বড় ভূমিকা থেকে যায়। শিল্পীর বড় এক পরিচয় তাঁর স্বাতন্ত্র্য। আজীবন এই স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার ভেতর দিয়েই সিকদার আমিনুল হক বাংলাদেশের, তথা বাংলা কবিতায় তাঁর স্থানটি খোদাই করে নিয়েছেন। সাহিত্যে একটি বৈশিষ্ট্যময় অবস্থান তৈরি করে নেয়া যে কোনো কবির জন্য বড় এক অর্জন। অনেক ‘বড়’ কবির এটা হয়ে ওঠে না, গড়পড়তা মানের কবিদের কথা বাদই থাকলো। বহু কবি স্বাতন্ত্র্য ব্যাপারটির গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। বুঝতে পারেন না যে, সাহিত্যের নিরিখে এর বিশেষ একটি অর্থ আছে। সিকদার আমিনুল হকের (১৯৪২-২০০৩) কবিতার সার্বিক মেজাজ সম্পর্কে ধারণা নিতে গিয়ে আমরা তাঁর স্বাতন্ত্র্যের পরিধি দেখে অবাক না হয়ে পারি না। তিনি আয়ত্ত করেছিলেন এক অনন্য কণ্ঠ।

এখানে একটা রহস্যালু ব্যাপার আছে। শিল্পীর স্বাতন্ত্র্য কখনোই তাঁর জন্মগত বা সহজাত ব্যাপার নয়। ‘শিল্পী’র অভিধায় কবিরা অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত। কবি তাঁর প্রথম রচনা থেকেই স্বতন্ত্র নন সাধারণত। যেমন ছিলেন না জীবনানন্দ দাশ এবং আরো অনেকে। অনেক কবি দ্রুত অগ্রজ কবিদের প্রভাব-বলয় থেকে মুক্ত হয়ে যেতে পারেন। কেউ কেউ নিজস্ব কণ্ঠস্বরটি তৈরি করতে সময় নিয়ে নেন প্রচুর। প্রথম বই ‘দূরের কার্নিশ’-এ (১৯৭৫) সিকদার আমিনুল হককে দেখা যায় এক প্রকার ডুবে আছেন শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভুবনে। কিন্তু পরের বই ‘তিন পাপড়ির ফুল’-এ (১৯৭৯) তিনি এই তিনজন কবির আচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে ভিন্ন এক ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করেন। এটি তাঁর নিজস্ব, এবং পৃথক এক ভাষা। প্রভাবের কথা বলতে গেলে, উপরোক্ত তিন কবি যেন কবিতায় চেপে থাকেন শ্বাসরুদ্ধকরভাবে। এ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসা কঠিন কাজ। সিকদার আমিনুল হক তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থে এটি পেরেছিলেন, যদিও তাঁদের মায়াজালে তিনি তখনো অল্পবিস্তর আবিষ্ট। এখানে অনেকে মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারেন। আমি তার কারণ দেখি না। জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রথম দুই বইয়ে নজরুলীয় প্রভাবে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে ছিলেন যে, তিনি আদৌ কখনো নিজস্ব বাকভঙ্গিতে লিখতে পারবেনÑ তা রীতিমতো অচিন্ত্যনীয় ছিলো। এখন দেখি কী আয়রনি, জীবনানন্দ এমনই এক কাব্যভাষা বাঙালি কবিদের ভেতর ছড়িয়ে গিয়েছেন যে, এই ২০১৭ সালেও, সত্তর-আশি বছর পর, এর কুহক থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন পথ দেখি না। কোনো না কোনো পরোক্ষ মাধ্যমে জীবনানন্দ জড়িয়ে আছেনই বাঙালি কবির কবিতায়, সে ঢাকায় হোক, কলকাতায় হোক বা আগরতলায় হোক।

আল মাহমুদের প্রথম দিকের বইয়ে তাঁর বাংলার লোকজ মোটিফসঞ্জাত স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট ছিলো। পরের দিকে নিজের জগতের সীমাকে বিস্তৃত করতে গিয়ে তিনি তাঁর অগুনতি অভ্যস্ত পাঠকের কাছে ‘অচেনা’ হয়ে পড়েন। এরা আল মাহমুদের কবিতার গ্রামীণ আবহের সঙ্গে পরিচিত। এর অনুপস্থিতি তাদের অনেককে বিভ্রান্ত করে। আল মাহমুদের স্বাতন্ত্র্য পরে থিতু হয় তাঁর রোমান্টিক গীতলতায়। এদিক থেকে শামসুর রাহমানের নিজস্ব ভাষাভঙ্গি বরাবর অটুট। দু-চারটি চরণ পড়েই তাঁকে চেনা যায়।

কবিতা নিয়ে সিকদার আমিনুল হকের ‘হোমওয়ার্ক’ বিস্ময়কর। সমসাময়িক ও অনুজতর কবিদের মতো তাঁর বাস্তব জগতের সীমা খুব বিস্তৃত বা কোলাহলমুখর ছিলো না। নিরিবিলি, অন্তরঙ্গ পরিবেশের জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি, স্বেচ্ছানির্বাসনের মতো অনেকটা। এ জীবন এক পর্যায়ে তাঁর জন্য হয়ে দাঁড়ায় বিশুদ্ধ কবিতাযাপন। পার্থিব জীবনের ক্লেদ-কর্দম, নানা ধরনের যুদ্ধ ও অর্থহীন দৌড়ঝাঁপ থেকে তিনি নিজেকে অনেকটা সরিয়ে

রাখতে পেরেছিলেন সৌভাগ্যবশত। একজন কবির অনিবার্য রক্তপাত থেকে তিনি অবশ্য মুক্ত থাকতে পারেননি। তাঁর জন্য এটা হয়ে দাঁড়ায় আশীর্বাদ। না হলে কবি জীবনের মধ্য পর্যায়ে পৌঁছে তিনি কীভাবে পেয়ে যান তাঁর জাদুকরী কাব্যভাষা; চিত্রকল্প-উপমা-রূপক-বিরোধাভাস ইত্যাদি মিলিয়ে যা আমাদের কানে বাজে এক ঐন্দ্রজালিক সঙ্গীতের মতো।

সব পাঠকের কবি নন সিকদার আমিনুল হক। মনে হতে পারে তিনি দুরূহ। আসলে বই থেকে বইয়ে তিনি অভিনব থেকে অভিনবতর গন্তব্য খুঁজেছেন। কবিতার, বৃহত্তর অর্থে শিল্পের। তিনি এক পর্যায়ে আমাদের কাছে হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ নতুন চরিত্রের এক কবি। একটি খাঁটি বাঙালি সত্তাকে ধারণ করেও তিনি পাঠককে নিজের পরিচয় দেন এক অবিশ্রান্ত যাযাবর হিসেবে। শুরুর দিকে তাঁর কবিতার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো নিসর্গ, প্রেম, বিষণœতা ও নানা পর্যায়ে ব্যক্তির মানসচিত্র। তাঁর বাচনভঙ্গি ছিলো একরৈখিক। পাঠক আন্দাজ করতে পারেনি, চেনা আবহের অন্তরালে তিনি কী অক্লান্তভাবে নিজের রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছেন। প্রসন্ন মেজাজের এক মেদুরতা ছড়িয়ে ছিলো তাঁর প্রথম দিকের বই ক’টিতে। কবির এই মানসিক অবয়বের সঙ্গে পাঠক পরিচিত। বাঙালি কবি সাধারণত নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন দেশজ পরিমণ্ডলে। জীবনানন্দ দাশ আমাদের প্রথম কবি, যিনি পাঠকের সামনে হাজির করেন দূরভূমি, দূর সমুদ্রতট, ইতিহাস এবং অতীত-ধূসর চরিত্রদের। কবি জানান পাঠককে, অনেক পথ তিনি হেঁটেছেন পৃথিবীর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ও পথে। কোনো রকমের ভবিষ্যদ্বাণীর অতীত, আত্মরূপান্তরের এই প্রক্রিয়ায় সিকদার আমিনুল হকও নিজেকে আবিষ্কার করেন এক যাযাবর হিসেবে। জীবনানন্দের মতো নয় পুরোপুরি, তাঁর নিজের ধরনে এই কবি হয়ে ওঠেন পরিব্রাজক। বলতে ইচ্ছে হয়, পালাবদলের এই পর্যায়ে সিকদার আমিনুল হকের মনোজগতের অবচেতন স্তরে ও তাঁর মৌলিক কবিসত্তায় ক্রিয়াশীল ছিলো একজন বিশুদ্ধ কবির মুক্তিস্পৃহাÑ যা চিরকালীন।

ক্লেদাকীর্ণ, একঘেঁয়ে বাস্তবের অর্গল ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন কবি। পরের পর্যায়ের কবিতায় তিনি আমাদের নিয়ে যান তাঁর রূপান্তর-পরবর্তী ভুবনে। আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি বিবরণ ও বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উচ্চারণ ভঙ্গিও পাল্টেছে। এ পর্যায়ে কবির রচনায় আমরা পাই টানা গদ্যের প্রাধান্যÑ বাংলাদেশের কবিতায় মুখ্যত অনাস্বাদিত এক চিত্রল ও মূর্ছনাময় কাব্যভাষা। ‘সতত ডানার মানুষ’ (১৯৯১) গ্রন্থটি দিয়ে কবির এই নতুন কাব্যভাষা ও বিশ্বভ্রমণের সূচনা। অবশ্য পূর্ববর্তী ক’টি বই ‘আমি সেই ইলেকট্রা’ (১৯৮৫), ‘পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল’ (১৯৮৭), ‘এক রাত্রি এক ঋতু’ (১৯৯১) ইত্যাদিতেও আসন্ন রূপান্তর ও টানা গদ্যে লেখা কবিতা বা প্রোজ পোয়েমের প্রতি তার ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে ষাটের দশকে এই বিশেষ প্রকরণটি ব্যবহার ক’রে আবদুল মান্নান সৈয়দ বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। আবার অনেকেই এর প্রতি আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু এই বিশেষ ধরনের কবিতার যে-বিপুল সম্ভাবনা আছে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করার, তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সিকদার আমিনুল হক। গদ্যভঙ্গিপ্রধান এই আঙ্গিকটি গত শতকের ষাট দশকের অন্যতম প্রধান এই কবির রচনাকে বিশেষভাবে ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে। সিকদার আমিনুল হকের বড় অর্জন এইখানে।

বাংলাদেশের কবিতায় বরাবর যা দেখা যায়, প্রায় সব কবিই তাঁদের রচনায় প্রচ্ছন্নভাবে হলেও মেসেজ বা বক্তব্য ধরে রাখতে চান। কবিকে পাঠকের উদ্দেশে কিছু বলতে হয়। যাঁরা নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে চান না, তাঁদের রচনাশৈলী থেকে পাঠক কবির মনোজগৎ সম্পর্কে ধারণা করে নেন। কবিতায় প্রকট সামাজিক অঙ্গীকার বা রাজনীতিমনষ্কতা সিকদার আমিনুল হককে কখনো টানেনি। ব্যক্তিজীবনে তাঁর একটি অবিচল রাজনৈতিক বিশ্বাস অবশ্যই ছিলো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার প্রতি আপসহীনভাবে আনুগত্য দেখিয়ে গেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কাছে ছিলেন বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। এই প্রেক্ষিতে বলতে হয়, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত তাঁর কবিতা কম, যদিও বাঙালির স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত এই যুদ্ধ নিজস্ব ধরনের চিত্রকল্প ও রূপকের মাধ্যমে তাঁর কবিতায় ছায়াপাত করে গেছে বরাবর। ১৯৭১-এর ন’মাস পাকবাহিনী কর্তৃক অধিকৃত ঢাকা নিয়ে অনবদ্য একটি কবিতা আছে সিকদার আমিনুল হকের। আসলে এই কবি তাঁর সার্বিক কাব্যমেজাজ, প্রকরণ এবং কবিতাভাবনার নিরিখে বাংলাদেশের কবিতায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন।

আমাদের কবিতার প্রথাবদ্ধ এবং বহুল ব্যবহৃত প্রকাশভঙ্গির প্রতি বিমুখ তিনি শুরু থেকেই। পরবর্তী সময়ে কবিতায় তাঁর স্বতন্ত্র ভাষাটি আয়ত্ত করার সঙ্গে সঙ্গে এই বিমুখতা অনীহার রূপ নেয়। অনভ্যস্ত পাঠক তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে স্বচ্ছন্দ না-ও বোধ করতে পারেন। কিন্তু এই কবির রচনায় ঢোকার জন্য পাঠের রুচি এবং পাঠাভ্যাসকে প্রস্তুত করার প্রয়োজন ব্যাপকভাবে।

সিকদার আমিনুল হকের কবিতার ভুবন এবং এর খুঁটিনাটি বাস্তবতা সব সময় দেশজ সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না। তা উন্মোচিত হয় আমাদের কাছে অপরিচিত ভূমণ্ডল, মানুষ ও জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে। সমুদ্র ও অরণ্য তাঁর প্রিয় দুটি বিষয়, একই সঙ্গে নারী ও মৃত্যুচিন্তা। কিন্তু এরা আছে আমাদের চিরচেনা ভূ-প্রকৃতি ও সমাজের অতীত কোনো আবহের ভেতর। আবার এক কুশলী শিল্পীর মতো কবি এই আপাত-অচেনা প্রেক্ষাপটের সঙ্গে দেশজ বাস্তবতারও মিশেল ঘটিয়ে দেন। তাঁর কবিতার স্বাদু গদ্যভঙ্গির সঙ্গে এই কোলাজ স্বচ্ছন্দে মিশে যায়।

কাব্য-কোলাজ সৃষ্টিতে পারদর্শী সিকদার আমিনুল হক। প্রচলিত মেজাজের কবিতায় এটা আশা করা যায় না। তাঁর কবিতার গঠনপ্রকৃতিতে আরো একটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। এক অননুকরণীয় কৌশলে শব্দের পিঠে শব্দ বসিয়ে, ওগুলোর মধ্যে মধুমিলন ও বিরোধিতা ঘটিয়ে তিনি কবিতার ভেতরে, পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে এক অদ্ভুত সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা জাগান। একজন সহজাত এবং খাঁটিÑ জেনুইন অর্থে, কবির পক্ষেই এই কাজটি সম্ভব। নানা উচ্চতার শিখরে পৌঁছানোর জন্য প্রাণপাতরত আমাদের বহু কবি কবিতার এই রহস্যটি ধরতে পারেননি। করুণা হয়, এঁরা সারাজীবন সস্তা, প্যাচপ্যাচে আবেগের বিবর্ণ কবিতা লিখে গেছেন, তা প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে হোক বা মাটিসংলগ্নতা নিয়েই হোক। আসলে প্রকৃত কবিকে প্রথমে জানতে হয় কবিতা মাধ্যম হিসেবে মূলত কী, ‘কবিতা’ থেকে ‘পদ্য’ বা নিরেট গদ্যের পার্থক্য কোথায় তারপর বিষয়বৈচিত্র্য। আমরা ছদ্মকবিদের ও মারমার-কাটকাট পদ্যাকারদের নানা কায়দাবাজি দেখে এতদূর এসেছি। গুটি কয়েক কবি বাদে কবিতার অন্তহীন, অনিশ্চিত যাত্রাই শুরু করেননি কেউ প্রকৃত অর্থে।একজন বিশুদ্ধ কবি হিসেবে নিজেকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা, অন্য অন্য বড় আধুনিক বাঙালি ও বিদেশি কবিদের রচনা বিপুল আয়াসসাধ্য অভিনিবেশ নিয়ে অধ্যয়ন এবং সেগুলোর মর্মমূলে পৌঁছাবার কারণে সিকদার আমিনুল হক বাংলা কবিতায় নিজের অমোচনীয় মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। প্রস্তুতিপর্বেই তিনি আয়ত্ত করেছিলেন আধুনিক কবিতার আন্তর্জাতিক চারিত্র ও প্রকরণ।

প্রতিভাবান কবিদের বহুলপ্রজ না হলেও চলে। সিকদার আমিনুল হকের বইয়ের সংখ্যা বিপুল নয়। ১৯৭৫ থেকে মৃত্যুর এক বছর আগে ২০০২ পর্যন্ত ১৫টি কবিতার বই রেখে গিয়ে তিনি আমাদের প্রধান কবিদের একজন হিসেবে টিকে গেছেন নিঃসন্দেহে। কাব্যজীবনের এক তিক্ত পর্যায়ে অভিমানের সঙ্গে তাঁর একটি বইয়ের নাম রেখেছিলেন তিনি ’বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে’। এখন উপলব্ধি করি, অন্ধকারে বা উপেক্ষায় থাকার কবি নন সিকদার আমিনুল হক। তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে আলোকিত দিব্যরথ।