জীবনের গল্প, জীবনানন্দের গল্প

সুজাউদ্দৌলা

নিজেকে তার জীবনানন্দের গল্প উপন্যাসের চরিত্র বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় সে-ই আজকের জীবনানন্দ। তবে কবি নয় অকবি জীবনানন্দ।

আর এটা মনে হবার পর থেকে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না এটা তার অসুখ কিনা। কারো কাছে বলতেও পারছেনা এই কথা। সবচেয়ে বড় কথা হলো জীবনানন্দ বিখ্যাত কবি আর সে জীবনে এক লাইন কবিতাও লিখেনি। তবে জীবনানন্দের কবিতার ভক্ত সে। আসলে সে বসত করে জীবনানন্দের কবিতা আর গল্প উপন্যাসের জগতে। সে জীবনানন্দের কবিতা গল্প আর উপন্যাস পড়ে। আর পড়তে পড়তে তার মনে হতে শুরু করেছে সে জীবনানন্দের গল্প উপন্যাসের নায়কদের মতো। ছোট একটা মনোহারী দোকান আছে তার। নাম বনলতা স্টোর। জীবনানন্দের বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেনের নামে রেখেছে নামটা। ব্যবসায় তার লোকসান হয় সব সময়। মাল কিনতে লস হয়। বেচতে গিয়েও লস হয়। আর হারাতে থাকে জীবনের আনন্দ। কিন্তু হাতে থাকে জীবনানন্দের বই। ক্রেতা এসে কোন জিনিস দুইবার চাইলে সে বুঝতে পারে। বুঝেও লাভ নেই জিনিসটা কোন তাকের কোথায় রেখেছে তা মনে করতে লাগে আরও কিছুক্ষণ। যে সব ক্রেতার তাড়া থাকে তারা তার দোকানে পারত পক্ষে আসে না। কেউ আবার এসে ইয়ার্কি করে বলে তোমার হাতে ওইটা কী বই?

কথার জবাব না দিয়ে সে কভার পৃষ্ঠা দেখায়।

তুমি একটা ছা পোষা মুদি এইসব পইড়া তুমি কী কর? এইসব পড়ব যারা ছাত্র কিংবা ধরো যারা মাস্টারি করে।

এসব মাস্টারি ধরনের কথারও সে জবাব দেয় না। আসলে মানুষের সাথে বেহুদা প্যাঁচাল পাড়তে তার ভালো লাগে না বলেই সে জীবনানন্দের বই নিয়ে বসে থাকে।

কথায় আছে যার মুখে হাসি নেই, তার জন্য ব্যবসা নয়। সে অকারণে হাসে না। পণ্যের বাহারি গুণের কথা বলে ক্রেতাকে মোহিত করেনা। করতে পারে না।

তার সুন্দরী বউ তাকে উঠতে বসতে খেতে শুতে কথা শোনায়।

নিমুরাইদ্যা পুরুষ কোন একটা কাম যদি ঠিকমতো পারতো।

বউয়ের চড়া গলা শুনে আশেপাশের ভাবি বুবুরা এগিয়ে আসে। হাওয়া দিয়ে আগুনটাকে ঠিকঠাক জ্বালিয়ে দিতে।

কোন কামই পায় না কইতাছ? তাইলে রাইতের কামও পায় না।

জিগান না? ইছা মাছের মতো একটা ফাল দিয়াই শ্যাষ। সে আর দাঁড়ায় না। লাঠি দেখে সাপ যেরকম মাথা নিচু করে চলে যায় সেও তেমনি আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বউয়ের বিষ ঢালা তখনও শেষ হয়নি।

জীবনডা জ্বইলা গেল আমার। বিয়ার আগে মাইনষে কইছে সরল সোজা মানুষ যেমনে চাইবা তেমনে চালাইবা। অহন দেহি এইডার মতো প্যাঁচ আর কারো মধ্যে নাই। কত বেচল কত আয় অইল জিগাইলে কোন উত্তর নাই। কোন একটা মাইয়া মানুষ হাইসা কতা কইলেই তারে অয় কম দামে না অয় বাকিতে জিনিস দিয়া দিব। মুরাদ না থাকলে কী অইব ভাবের অন্ত নাই।

(২)

দোকানে বসে সে এক প্যাকেট বিস্কুট হাতে নেয় দেখে মনে হবে যে তার হয়তো ক্ষুধা লাগছে বিস্কুট খেয়ে পানি খেয়ে ক্ষুধাটাকে দমিয়ে রাখবে। কিন্তু প্যাকেট থেকে একটা বিস্কুটও সে খায়না। একট খোঁড়া শালিক আসে এসময় তাকে সে বিস্কুট খাওয়ায়। নিজেকে তার এই খোঁড়া শালিকের মতো মনে হয়। সবার থেকে পিছিয়ে পড়া আর অসহায়। শালিকটাকে যে খোঁড়া করেছে সে এই কাজ করেও আনন্দ পেয়েছে আর সে বিস্কুট খাইয়ে আনন্দ পায়। বউ তাকে উপহাস করে অন্যের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে আনন্দ পায়। জীবনের আনন্দ কে যে কিসের থেকে পায় সেটা বড় আশ্চর্যের। চালাকের পৃথিবীতে সে বোকার হদ্দ। তাই মানুষের কাছ থেকে তার আহরিত আনন্দ খুবই কম। বউ তাকে ভালবাসে না জেনেও বউয়ের সাথে তাকে কাটাতে হচ্ছে জীবন। এক ধরনের ঘৃণা গোপন করে কোন কোন রাতে মিলিত হয় তারা। অসম্পূর্ণ অসুখি মিলন সেটা। বউয়ের প্রেমিক আছে এটা সে বুঝতে পারে। বুঝতে পেরেও সম্পর্কের গেঁড়ো থেকে বেরোতে না পারা মানুষদের সে একজন। তার প্রেমিকা নেই। যে ধরনের পুরুষকে নারীরা ভালবাসে সে সেরকম বাকপটু নয়। সে ভালবাসতে পারে। তবে সেটা বুঝাতে পারে না। বউ তাকে বলে-

মাইনষের স্বামীরা ঘরে আইসা দুইডা আদর সোহাগের খথা কয় আর তার মুখটা দেখলে মনে অয় যেন গান্ধি পোকায় পাদ মাইরা থুইছে।

বউয়ের প্রেমিক আসে তার দোকানে। বিদেশি সেন্টের শিশি খোঁজে। না পেয়ে বলে-

কি দুই টাকার মাল নিয়া বইসা আছেন? ভালো মাল তুলেন তাইলে না বেচা বিক্রি অইব। ক্যাশ না থাকলে কন ক্যাশ দেই। হাজার হউক আপনে পিয়ারী বেগমের স্বামী।

তোর ট্যাহা আছে তুই মাল কিন্যা দোকানে বস।

দোকানে বসমু আমি? আরে আমি এই লাবলু এই রকম পাঁচটা দোকানের চাইয়া বেশি মাল বেচি একদিনে। তাও আবার বইয়া বইয়া না। মোবইলের এক কলে। থাক ওসব কথা। যাই পিয়ারী ভাবীর লগে দেখা কইরা তার হাতের একখান মিষ্টি পান খাইয়া আসি।

লাবলু বিদায় হবার পরেই সে দোকানের ঝাঁপ নামায়। দ্রুত পায়ে বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। বাসায় এসে দেখে লাবলুর ল টাও নেই। বউ এসময় তাকে বাসায় দেখে বলে-

কী দেখতে আইছ বউ আছে না গেছে? আরে যায়ুন সুময় তর

চউক্ষের সামনে দিয়াই যামু। দোকানে বইসা খালি চিন্তা বউ কার লগে কতা কয় বউ কার লগে কী করে? এইতা চিন্তা মাথায় থাকলে ব্যবসা করব ক্যামনে?

সে আবার দোকানে ফিরে আসে। লাবলু এসে বলে-

কই গেছিলেন ভাই? এই দোকান খোলা এই বন্ধ। এ তো দেখি বিজলি নিয়া ছোটবেলা যে ছড়া কাটতাম সেই দশা হইছে-

এই আছে এই নাই

গাবতলে গাই নাই।

কন তো এইডা কী? পাইলেন না। আরে আগে কী কইলাম বিজলি। আসমানে দেখেন না বিজলি চমকায়। হঠাৎ এক ঝলক দেখা যায় পরেই আর নাই। পিয়ারী বেগম ঠিকই কয় আপনে আসলে রাম ভোদাই।

ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলে গেলেও বাইরে সে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো শান্ত থাকে। বউ কথা শোনে না। বউ পরকীয়া করে। সে কিছুই করতে পারে না। বউয়ের সাথে তার প্রেম নেই। তার প্রেমিকাও নেই। দোকানে দু’একজন আসে তেমন মেয়ে যাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে তা প্রকাশ করতে পারে না। আবার কোনো মেয়ে নিজে থেকে উদ্যোগী হলে তার মনে হয় মেয়েটা কেমন গায়ে পড়া স্বভাবের। ফলে তার প্রেম হয় না। বউ পরকীয়া করে। লাবলু তার বাসায় যায়। তার কোন সন্তান নেই। মাঝে মাঝে ভাবে লাবলুর সাথে যদি পিয়ারী ভেগে যেত কত ভালো হতো। সে মুক্তি পেত। কিন্তু মুক্তি মেলেনা। নিজেকে তার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী মনে হয়। এর থেকে ফাঁসি হলে ভালো হতো। নাকি নিজেই করবে কাজটা? তার আগে পিয়ারী বেগমকে শেষ করে যাবে। আজকাল হরহামেশা হচ্ছে এসব। পরকীয়ার জন্য বউকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করে। সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে। সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে হওয়া একটা চাকরিতে সে যোগদান করেনি। আরও দু’একটা চাকরিতে যোগ দিয়েও ধরে রাখতে পারেনি তার কুঁড়েমি আর ঘরকুনো স্বভাবের কারণে। তার আসলে বিয়ে করাটা ভুল হয়েছে। একা থাকত স্বাধীন জীবন। হাত মারত না হয় বেশ্যাদের কাছে যেত। পৃথিবীতে নিজে এসেছে বলেই কি আরও ক্উাকে আনতে হবে? কই কেউ তো এল না? জীবনানন্দ তার উপরে ভর করেছে। কোন কোন অতৃপ্ত আত্মা নাকি মানুষের উপর ভর করে। জীবনানন্দ কি অতৃপ্ত ছিলেন? তিনি কি আত্মহত্যা করেছিলেন? অপমৃত্যুর আত্মারা নাকি পৃথিবীতে থেকে যায়। যদি জীবনানন্দ ভর করলেনই কবিত্বসহ ভর করতেন। তাহলে এইসব ব্যবসায়ীক লস আর পিয়ারী বেগম লাবলুকে সে এক তুড়িতে উড়িয়ে দিত। কিন্তু জীবনানন্দ তার উপরে ভর করেনি। জীবনানন্দের গল্পের ব্যর্থ অকর্মণ্য নায়কেরা তার উপরে ভর করেছে। তার মানে প্রতি দুপুরে দোকানে বিস্কুট খেতে আসা শালিকটির মতো সে। এসব ভেবে তার বড় ক্লান্ত লাগে। সে খোঁজে আনন্দ। জীবনের আনন্দ। বাসায় এসে দেখে লাবলুকে পিয়ারী বেগম গালির গুলি বর্ষণ করে চলেছে।

গোলামের পুত তুই আমারে ট্যাহা দেহাস। তর ট্যাহায় আমি থু দেই ওয়াক থু। তর সমান না থাউক আমার জামাইয়েরও ট্যাহা আছে। তুই কি আমারে বেশ্যা মাগী মনে করস? আর কোনদিন তরে এই বাসায় দেখলে মাছ কাটা বঁটি দিয়া ইলশা কাটা করমু কইলাম। লাবলু দাবড়ানি খাওয়া বেড়ালের মতো মাথা নিচু করে তার পাশ দিয়ে চলে যায়। সে বুঝতে পারে না এটা স্বপ্ন না বাস্তব।

বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১ , ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৮ শাওয়াল ১৪৪২

জীবনের গল্প, জীবনানন্দের গল্প

সুজাউদ্দৌলা

image

নিজেকে তার জীবনানন্দের গল্প উপন্যাসের চরিত্র বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় সে-ই আজকের জীবনানন্দ। তবে কবি নয় অকবি জীবনানন্দ।

আর এটা মনে হবার পর থেকে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না এটা তার অসুখ কিনা। কারো কাছে বলতেও পারছেনা এই কথা। সবচেয়ে বড় কথা হলো জীবনানন্দ বিখ্যাত কবি আর সে জীবনে এক লাইন কবিতাও লিখেনি। তবে জীবনানন্দের কবিতার ভক্ত সে। আসলে সে বসত করে জীবনানন্দের কবিতা আর গল্প উপন্যাসের জগতে। সে জীবনানন্দের কবিতা গল্প আর উপন্যাস পড়ে। আর পড়তে পড়তে তার মনে হতে শুরু করেছে সে জীবনানন্দের গল্প উপন্যাসের নায়কদের মতো। ছোট একটা মনোহারী দোকান আছে তার। নাম বনলতা স্টোর। জীবনানন্দের বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেনের নামে রেখেছে নামটা। ব্যবসায় তার লোকসান হয় সব সময়। মাল কিনতে লস হয়। বেচতে গিয়েও লস হয়। আর হারাতে থাকে জীবনের আনন্দ। কিন্তু হাতে থাকে জীবনানন্দের বই। ক্রেতা এসে কোন জিনিস দুইবার চাইলে সে বুঝতে পারে। বুঝেও লাভ নেই জিনিসটা কোন তাকের কোথায় রেখেছে তা মনে করতে লাগে আরও কিছুক্ষণ। যে সব ক্রেতার তাড়া থাকে তারা তার দোকানে পারত পক্ষে আসে না। কেউ আবার এসে ইয়ার্কি করে বলে তোমার হাতে ওইটা কী বই?

কথার জবাব না দিয়ে সে কভার পৃষ্ঠা দেখায়।

তুমি একটা ছা পোষা মুদি এইসব পইড়া তুমি কী কর? এইসব পড়ব যারা ছাত্র কিংবা ধরো যারা মাস্টারি করে।

এসব মাস্টারি ধরনের কথারও সে জবাব দেয় না। আসলে মানুষের সাথে বেহুদা প্যাঁচাল পাড়তে তার ভালো লাগে না বলেই সে জীবনানন্দের বই নিয়ে বসে থাকে।

কথায় আছে যার মুখে হাসি নেই, তার জন্য ব্যবসা নয়। সে অকারণে হাসে না। পণ্যের বাহারি গুণের কথা বলে ক্রেতাকে মোহিত করেনা। করতে পারে না।

তার সুন্দরী বউ তাকে উঠতে বসতে খেতে শুতে কথা শোনায়।

নিমুরাইদ্যা পুরুষ কোন একটা কাম যদি ঠিকমতো পারতো।

বউয়ের চড়া গলা শুনে আশেপাশের ভাবি বুবুরা এগিয়ে আসে। হাওয়া দিয়ে আগুনটাকে ঠিকঠাক জ্বালিয়ে দিতে।

কোন কামই পায় না কইতাছ? তাইলে রাইতের কামও পায় না।

জিগান না? ইছা মাছের মতো একটা ফাল দিয়াই শ্যাষ। সে আর দাঁড়ায় না। লাঠি দেখে সাপ যেরকম মাথা নিচু করে চলে যায় সেও তেমনি আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বউয়ের বিষ ঢালা তখনও শেষ হয়নি।

জীবনডা জ্বইলা গেল আমার। বিয়ার আগে মাইনষে কইছে সরল সোজা মানুষ যেমনে চাইবা তেমনে চালাইবা। অহন দেহি এইডার মতো প্যাঁচ আর কারো মধ্যে নাই। কত বেচল কত আয় অইল জিগাইলে কোন উত্তর নাই। কোন একটা মাইয়া মানুষ হাইসা কতা কইলেই তারে অয় কম দামে না অয় বাকিতে জিনিস দিয়া দিব। মুরাদ না থাকলে কী অইব ভাবের অন্ত নাই।

(২)

দোকানে বসে সে এক প্যাকেট বিস্কুট হাতে নেয় দেখে মনে হবে যে তার হয়তো ক্ষুধা লাগছে বিস্কুট খেয়ে পানি খেয়ে ক্ষুধাটাকে দমিয়ে রাখবে। কিন্তু প্যাকেট থেকে একটা বিস্কুটও সে খায়না। একট খোঁড়া শালিক আসে এসময় তাকে সে বিস্কুট খাওয়ায়। নিজেকে তার এই খোঁড়া শালিকের মতো মনে হয়। সবার থেকে পিছিয়ে পড়া আর অসহায়। শালিকটাকে যে খোঁড়া করেছে সে এই কাজ করেও আনন্দ পেয়েছে আর সে বিস্কুট খাইয়ে আনন্দ পায়। বউ তাকে উপহাস করে অন্যের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে আনন্দ পায়। জীবনের আনন্দ কে যে কিসের থেকে পায় সেটা বড় আশ্চর্যের। চালাকের পৃথিবীতে সে বোকার হদ্দ। তাই মানুষের কাছ থেকে তার আহরিত আনন্দ খুবই কম। বউ তাকে ভালবাসে না জেনেও বউয়ের সাথে তাকে কাটাতে হচ্ছে জীবন। এক ধরনের ঘৃণা গোপন করে কোন কোন রাতে মিলিত হয় তারা। অসম্পূর্ণ অসুখি মিলন সেটা। বউয়ের প্রেমিক আছে এটা সে বুঝতে পারে। বুঝতে পেরেও সম্পর্কের গেঁড়ো থেকে বেরোতে না পারা মানুষদের সে একজন। তার প্রেমিকা নেই। যে ধরনের পুরুষকে নারীরা ভালবাসে সে সেরকম বাকপটু নয়। সে ভালবাসতে পারে। তবে সেটা বুঝাতে পারে না। বউ তাকে বলে-

মাইনষের স্বামীরা ঘরে আইসা দুইডা আদর সোহাগের খথা কয় আর তার মুখটা দেখলে মনে অয় যেন গান্ধি পোকায় পাদ মাইরা থুইছে।

বউয়ের প্রেমিক আসে তার দোকানে। বিদেশি সেন্টের শিশি খোঁজে। না পেয়ে বলে-

কি দুই টাকার মাল নিয়া বইসা আছেন? ভালো মাল তুলেন তাইলে না বেচা বিক্রি অইব। ক্যাশ না থাকলে কন ক্যাশ দেই। হাজার হউক আপনে পিয়ারী বেগমের স্বামী।

তোর ট্যাহা আছে তুই মাল কিন্যা দোকানে বস।

দোকানে বসমু আমি? আরে আমি এই লাবলু এই রকম পাঁচটা দোকানের চাইয়া বেশি মাল বেচি একদিনে। তাও আবার বইয়া বইয়া না। মোবইলের এক কলে। থাক ওসব কথা। যাই পিয়ারী ভাবীর লগে দেখা কইরা তার হাতের একখান মিষ্টি পান খাইয়া আসি।

লাবলু বিদায় হবার পরেই সে দোকানের ঝাঁপ নামায়। দ্রুত পায়ে বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। বাসায় এসে দেখে লাবলুর ল টাও নেই। বউ এসময় তাকে বাসায় দেখে বলে-

কী দেখতে আইছ বউ আছে না গেছে? আরে যায়ুন সুময় তর

চউক্ষের সামনে দিয়াই যামু। দোকানে বইসা খালি চিন্তা বউ কার লগে কতা কয় বউ কার লগে কী করে? এইতা চিন্তা মাথায় থাকলে ব্যবসা করব ক্যামনে?

সে আবার দোকানে ফিরে আসে। লাবলু এসে বলে-

কই গেছিলেন ভাই? এই দোকান খোলা এই বন্ধ। এ তো দেখি বিজলি নিয়া ছোটবেলা যে ছড়া কাটতাম সেই দশা হইছে-

এই আছে এই নাই

গাবতলে গাই নাই।

কন তো এইডা কী? পাইলেন না। আরে আগে কী কইলাম বিজলি। আসমানে দেখেন না বিজলি চমকায়। হঠাৎ এক ঝলক দেখা যায় পরেই আর নাই। পিয়ারী বেগম ঠিকই কয় আপনে আসলে রাম ভোদাই।

ভেতরে ভেতরে রাগে জ্বলে গেলেও বাইরে সে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো শান্ত থাকে। বউ কথা শোনে না। বউ পরকীয়া করে। সে কিছুই করতে পারে না। বউয়ের সাথে তার প্রেম নেই। তার প্রেমিকাও নেই। দোকানে দু’একজন আসে তেমন মেয়ে যাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে তা প্রকাশ করতে পারে না। আবার কোনো মেয়ে নিজে থেকে উদ্যোগী হলে তার মনে হয় মেয়েটা কেমন গায়ে পড়া স্বভাবের। ফলে তার প্রেম হয় না। বউ পরকীয়া করে। লাবলু তার বাসায় যায়। তার কোন সন্তান নেই। মাঝে মাঝে ভাবে লাবলুর সাথে যদি পিয়ারী ভেগে যেত কত ভালো হতো। সে মুক্তি পেত। কিন্তু মুক্তি মেলেনা। নিজেকে তার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী মনে হয়। এর থেকে ফাঁসি হলে ভালো হতো। নাকি নিজেই করবে কাজটা? তার আগে পিয়ারী বেগমকে শেষ করে যাবে। আজকাল হরহামেশা হচ্ছে এসব। পরকীয়ার জন্য বউকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করে। সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে। সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে হওয়া একটা চাকরিতে সে যোগদান করেনি। আরও দু’একটা চাকরিতে যোগ দিয়েও ধরে রাখতে পারেনি তার কুঁড়েমি আর ঘরকুনো স্বভাবের কারণে। তার আসলে বিয়ে করাটা ভুল হয়েছে। একা থাকত স্বাধীন জীবন। হাত মারত না হয় বেশ্যাদের কাছে যেত। পৃথিবীতে নিজে এসেছে বলেই কি আরও ক্উাকে আনতে হবে? কই কেউ তো এল না? জীবনানন্দ তার উপরে ভর করেছে। কোন কোন অতৃপ্ত আত্মা নাকি মানুষের উপর ভর করে। জীবনানন্দ কি অতৃপ্ত ছিলেন? তিনি কি আত্মহত্যা করেছিলেন? অপমৃত্যুর আত্মারা নাকি পৃথিবীতে থেকে যায়। যদি জীবনানন্দ ভর করলেনই কবিত্বসহ ভর করতেন। তাহলে এইসব ব্যবসায়ীক লস আর পিয়ারী বেগম লাবলুকে সে এক তুড়িতে উড়িয়ে দিত। কিন্তু জীবনানন্দ তার উপরে ভর করেনি। জীবনানন্দের গল্পের ব্যর্থ অকর্মণ্য নায়কেরা তার উপরে ভর করেছে। তার মানে প্রতি দুপুরে দোকানে বিস্কুট খেতে আসা শালিকটির মতো সে। এসব ভেবে তার বড় ক্লান্ত লাগে। সে খোঁজে আনন্দ। জীবনের আনন্দ। বাসায় এসে দেখে লাবলুকে পিয়ারী বেগম গালির গুলি বর্ষণ করে চলেছে।

গোলামের পুত তুই আমারে ট্যাহা দেহাস। তর ট্যাহায় আমি থু দেই ওয়াক থু। তর সমান না থাউক আমার জামাইয়েরও ট্যাহা আছে। তুই কি আমারে বেশ্যা মাগী মনে করস? আর কোনদিন তরে এই বাসায় দেখলে মাছ কাটা বঁটি দিয়া ইলশা কাটা করমু কইলাম। লাবলু দাবড়ানি খাওয়া বেড়ালের মতো মাথা নিচু করে তার পাশ দিয়ে চলে যায়। সে বুঝতে পারে না এটা স্বপ্ন না বাস্তব।