হাফিজ হয়তো আগেই চলে গেছে

মোহাম্মদ আবু নোমান

এমন বিপজ্জনক মাদক দেশে এসে গেছে; মেধাবী শিক্ষার্থী দা দিয়ে নিজের গলা নিজে কোপ দিয়ে কেটে ফেলতে পারে! অথচ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কিছুই জানতো না? যে নিজেকে কুপিয়ে হত্যা করতে পারে, সে নিজ পরিবারের জন্য, তথা শত মানুষের জন্য হুমকি। অবশ্য বাংলাদেশে মাদকাসক্তির সমস্যা যত প্রকট, সমাধানে জাতীয় উদ্যোগ সে তুলনায় একেবারেই কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর আগে অনেকে শুনেইনি লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড (এলএসডি) নামক নেশাও আছে! ফেসবুকে গ্রুপ ও আইডি খুলে পশ্চিমের ভয়ঙ্কর এ মাদকের বিকিকিনি চলছে বাংলাদেশে, যা এতদিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধারণার বাইরে ছিল, ছিল নজরেরও বাইরে।

একজন মেধাবী, উচ্ছল, প্রাণবন্ত ছাত্রের এ রকম অকাল পরিণতি কিছুতেই মেনে নেয়ার মতো নয়। ছেলেটার বেশভূষা দেখলে বোঝার উপায় নেই, সে মাদকাসক্ত হতে পারে। এ যেন তরতাজা এক সপ্নকে, নেশা নামক জীবনবিধ্বংসী ভাইরাস, টগবগে রক্তের স্রোত বইয়ে নিজকে নিজে মেরে ফেললো! অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে ওই মায়ের জন্য যে তার ছেলেকে এ অবস্থায় দেখল। কষ্ট হচ্ছে সেই বাবার জন্য যার কাঁধে সন্তানের লাশ! মাদকের শিকার হয়ে একজন মা তার সন্তান হারিয়েছেন; যে কোন মায়ের জন্য এর চেয়ে কষ্টের কিছু নেই। না জানি কত স্বপ্ন বুকে লালন করেছিল হাফিজের মা-বাবা। ছেলেমেয়েগুলোও পর্বতসম স্বপ্ন বুকে লালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকে। যে কোনভাবেই হোক, মাদকাসক্ত হয়ে সে প্রতিভার মৃত্যুতে মা-বাবার বুকের আগুন ও হাহাকার পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরের সমস্ত পানি ঢেলেও নেভানো যাবে কী?

দুঃখজনক ও ভয়াবহ উদ্বেগের সংবাদ হলেও সত্যি- হেরোইন, ফেনসিডিল, কোকেন, আফিম, পিয়োট, মারিজুয়ানা, খাট, আইস, এনপিএস, ইয়াবার পর এলএসডি নামের ভয়ঙ্কর মরণনেশা এসে গেছে বাংলাদেশেও।

বিশেষজ্ঞরা এলএসডিকে দানবের সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা বলছেন, এই মাদক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। এলএসডি সেবনকারীর মধ্যে আত্মহনন অথবা অন্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে। এলএসডি সেবনকারীর মনে অলীক মায়াজাল বিস্তার করে বলে এর অন্য নাম ‘হ্যালুসিনোজিক ড্রাগ’। কখনো কখনো ‘হ্যালুসিনেট’ বা অলীক বস্তু প্রত্যক্ষ করা ছাড়াও মতিভ্রম হয়ে উদ্ভট কিছু অস্তিত্বে বিশ্বাস ও সেবনকারীর মধ্যে ভীতিকর অনুভূতি তৈরি করে। এ ধরনের মাদকের প্রভাবে সাধারণত মানুষ নিজের আশপাশের বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে এবং কখনো কখনো অলীক বস্তু প্রত্যক্ষ করে। আবার কেউ বলেন, ভয়াবহতার বিচারে এলএসডি হলো ‘লাস্ট স্টেজ অব ড্রাগ’। অর্থাৎ, মাদক নেশার অন্তিম পর্বে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের মাদকসেবীরা। বলা বাহুল্য এ অবস্থা দেশের তরুণ সমাজের চরম সর্বনাশের ইঙ্গিত দেয়।

এই ভয়ঙ্কর মাদক সেবনে এতটাই বিভ্রম তৈরি হয় যে, সেবনকারী নিজেকে প্রচ- শক্তিশালী মনে করে। কিছুতেই কিছু হবে না, এমন বেপরোয়া মনোভাব থেকে সেবনকারী হয়ে ওঠে আত্মঘাতী। এক ধরনের কাল্পনিক বিভ্রম ঘটার সঙ্গে সেবনকারী আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এ মাদক মানবদেহের সাধারণ চিন্তা ও অনুভূতিকে পাল্টে দেয়। মাদক গ্রহণকারীর ভেতরে অলীক বা কাল্পনিক ভাবনা বা অনুভবের সৃষ্টি করে।

তরুণদের জন্য শিক্ষণীয় হলো, হাফিজের বাবা-মায়ের মতো এ রকম পরিস্থিতিতে যেন কেউ কারও পিতা-মাতাকে না ফেলেন। আজ হাফিজ তো ভিকটিম। তার জীবনের প্রতিটা অধ্যায় সবার জানার প্রয়োজন। হাফিজ কীভাবে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণহীন’ মাদকাসক্ত হয়ে উঠল সেটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাফিজ কোন জনবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠা অপরাধী নয়। সে আমাদেরই কারও না কারও ঘরের ছেলে। পুলিশের তদন্তে যে এলএসডির কথা জানা গেছে, তার প্রভাব কতটা সর্বগ্রাসী হতে পারে হাফিজের ঘটনা তার উদাহরণ। ব্যক্তির বেড়ে উঠার প্রক্রিয়ার পেছনে মানুষের আচার-আচরণ পরিবর্তন হয়ে থাকে। এজন্য বলা হয়, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ কীভাবে একজন মেধাবী, উচ্ছল, প্রাণবন্ত ছাত্রের এ রকম অকাল পরিণতি, সেটা তরুণ সমাজের জানা উচিত। মনে রাখতে হবে, কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। আর একটা নির্দিষ্ট বয়সে যদি নিজেকে সংযত করা যায় তবে আশা করা যায়, অনেক তরুণ এভাবে ঝরে পড়বে না, নিজের গলায় নিজে গা দিয়ে কোপ মারবে না। আমাদের দেশে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরাই তাদের অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর প্রায় সব ছাত্রছাত্রী অপার স্বাধীনতা ভোগ করে। আর এই অপার স্বাধীনতাই অনেকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য তরুণদের নেশাখোর সহপাঠীদের এড়িয়ে চলতে হবে। নইলে হাফিজের মতো মা-বাবাকে শোক ও লজ্জার সাগরে ভাসিয়ে হারিয়ে যেতে হবে। যারা নেশাগ্রস্ত তাদের পরিণতি করুণই হয়ে থাকে। হাফিজ হয়তো আগেই চলে গেছে। বেঁচে থাকলেও নেশাগ্রস্তরা পরিবারের জন্য বোঝা ও সমাজকে কলুষিত করে থাকে।

যেখান থেকে লেখাপড়া শেষ করে দেশের প্রথম স্থানের নাগরিক হবে, যাকে সবাই স্যালুট দেবে। অথচ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থীরা যখন এলএসডি, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক সেবনে জরিয়ে পরবে। তাহলে এ জাতি কীভাবে উন্নতীর শিখরে পৌঁছবে? বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাবরই গবেষণায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাদক, সন্ত্রাসী, ক্যাডার, মারামারি ইত্যাদি সূচকে ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে! শিক্ষার্থীরা ইয়াবা, এলএসডি নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তাদের দ্বারা কোন আবিষ্কার, উদ্যোক্তা বা উদ্ভাবন আশা করা যায় কী? বরং যা হচ্ছে তা হলো, মাদকের উদ্যোক্তা! যার প্রমাণ, আটককৃত সাদমান জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ‘বেটার ব্রাওয়ারি অ্যান্ড বিওয়ন্ড’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ পরিচালনা করত সে। যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। সাদমান, আসহাব ও আদিব এই তিনজন মিলে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডি বিক্রি করত। এগুলোর মাধ্যমে তারা এলএসডি ও গাঁজার নির্যাস দিয়ে তৈরি এক ধরনের ‘গাঁজার কেক’ তৈরি করত। এই ‘গাঁজার কেক’ নতুন উদ্ভাবন বলে দাবি তাদের। এই হলো অবস্থা! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা নতুন উদ্ভাবন হলো কথিত ‘গাঁজার কেক’। এছাড়া বেশিরভাগ মেধাবী ছাত্রছাত্রীর জীবন শেষ হয়ে যায় রাজনীতি নামক কালো থাবায়।

ইতোমধ্যে এলএসডি বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তারা হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র সাদমান সাকিব (রূপল) ও আসহাব ওয়াদুদ (তুর্জ) এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফ। এরমধ্যে সাদমান সাকিব (রূপল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র বহিষ্কৃত ছাত্র। বর্তমানে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ (শেষ বর্ষ) পড়ছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ার খবর বেশ আলোচিত ছিল। দেশে ইয়াবার প্রবেশ ঠেকাতে সরকার মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়েছিল। সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান অল্পকিছু বিতর্কিত ঘটনা ছাড়া প্রশংসা পেয়েছিল। নতুন ভয়ঙ্কর এই মাদক যাতে বিস্তার লাভ করতে না পারে, সে জন্য প্রশাসন, ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। সবাইকে মাদকের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে, নাহলে মেধাবীরা মাদকের মাধ্যমে নিজের জীবন শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিবার ও সমাজকেও ধ্বংস করবে।

abunoman1972@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১ , ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৮ শাওয়াল ১৪৪২

হাফিজ হয়তো আগেই চলে গেছে

মোহাম্মদ আবু নোমান

এমন বিপজ্জনক মাদক দেশে এসে গেছে; মেধাবী শিক্ষার্থী দা দিয়ে নিজের গলা নিজে কোপ দিয়ে কেটে ফেলতে পারে! অথচ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কিছুই জানতো না? যে নিজেকে কুপিয়ে হত্যা করতে পারে, সে নিজ পরিবারের জন্য, তথা শত মানুষের জন্য হুমকি। অবশ্য বাংলাদেশে মাদকাসক্তির সমস্যা যত প্রকট, সমাধানে জাতীয় উদ্যোগ সে তুলনায় একেবারেই কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর আগে অনেকে শুনেইনি লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড (এলএসডি) নামক নেশাও আছে! ফেসবুকে গ্রুপ ও আইডি খুলে পশ্চিমের ভয়ঙ্কর এ মাদকের বিকিকিনি চলছে বাংলাদেশে, যা এতদিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধারণার বাইরে ছিল, ছিল নজরেরও বাইরে।

একজন মেধাবী, উচ্ছল, প্রাণবন্ত ছাত্রের এ রকম অকাল পরিণতি কিছুতেই মেনে নেয়ার মতো নয়। ছেলেটার বেশভূষা দেখলে বোঝার উপায় নেই, সে মাদকাসক্ত হতে পারে। এ যেন তরতাজা এক সপ্নকে, নেশা নামক জীবনবিধ্বংসী ভাইরাস, টগবগে রক্তের স্রোত বইয়ে নিজকে নিজে মেরে ফেললো! অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে ওই মায়ের জন্য যে তার ছেলেকে এ অবস্থায় দেখল। কষ্ট হচ্ছে সেই বাবার জন্য যার কাঁধে সন্তানের লাশ! মাদকের শিকার হয়ে একজন মা তার সন্তান হারিয়েছেন; যে কোন মায়ের জন্য এর চেয়ে কষ্টের কিছু নেই। না জানি কত স্বপ্ন বুকে লালন করেছিল হাফিজের মা-বাবা। ছেলেমেয়েগুলোও পর্বতসম স্বপ্ন বুকে লালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকে। যে কোনভাবেই হোক, মাদকাসক্ত হয়ে সে প্রতিভার মৃত্যুতে মা-বাবার বুকের আগুন ও হাহাকার পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরের সমস্ত পানি ঢেলেও নেভানো যাবে কী?

দুঃখজনক ও ভয়াবহ উদ্বেগের সংবাদ হলেও সত্যি- হেরোইন, ফেনসিডিল, কোকেন, আফিম, পিয়োট, মারিজুয়ানা, খাট, আইস, এনপিএস, ইয়াবার পর এলএসডি নামের ভয়ঙ্কর মরণনেশা এসে গেছে বাংলাদেশেও।

বিশেষজ্ঞরা এলএসডিকে দানবের সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা বলছেন, এই মাদক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। এলএসডি সেবনকারীর মধ্যে আত্মহনন অথবা অন্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে। এলএসডি সেবনকারীর মনে অলীক মায়াজাল বিস্তার করে বলে এর অন্য নাম ‘হ্যালুসিনোজিক ড্রাগ’। কখনো কখনো ‘হ্যালুসিনেট’ বা অলীক বস্তু প্রত্যক্ষ করা ছাড়াও মতিভ্রম হয়ে উদ্ভট কিছু অস্তিত্বে বিশ্বাস ও সেবনকারীর মধ্যে ভীতিকর অনুভূতি তৈরি করে। এ ধরনের মাদকের প্রভাবে সাধারণত মানুষ নিজের আশপাশের বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে এবং কখনো কখনো অলীক বস্তু প্রত্যক্ষ করে। আবার কেউ বলেন, ভয়াবহতার বিচারে এলএসডি হলো ‘লাস্ট স্টেজ অব ড্রাগ’। অর্থাৎ, মাদক নেশার অন্তিম পর্বে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের মাদকসেবীরা। বলা বাহুল্য এ অবস্থা দেশের তরুণ সমাজের চরম সর্বনাশের ইঙ্গিত দেয়।

এই ভয়ঙ্কর মাদক সেবনে এতটাই বিভ্রম তৈরি হয় যে, সেবনকারী নিজেকে প্রচ- শক্তিশালী মনে করে। কিছুতেই কিছু হবে না, এমন বেপরোয়া মনোভাব থেকে সেবনকারী হয়ে ওঠে আত্মঘাতী। এক ধরনের কাল্পনিক বিভ্রম ঘটার সঙ্গে সেবনকারী আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এ মাদক মানবদেহের সাধারণ চিন্তা ও অনুভূতিকে পাল্টে দেয়। মাদক গ্রহণকারীর ভেতরে অলীক বা কাল্পনিক ভাবনা বা অনুভবের সৃষ্টি করে।

তরুণদের জন্য শিক্ষণীয় হলো, হাফিজের বাবা-মায়ের মতো এ রকম পরিস্থিতিতে যেন কেউ কারও পিতা-মাতাকে না ফেলেন। আজ হাফিজ তো ভিকটিম। তার জীবনের প্রতিটা অধ্যায় সবার জানার প্রয়োজন। হাফিজ কীভাবে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণহীন’ মাদকাসক্ত হয়ে উঠল সেটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাফিজ কোন জনবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠা অপরাধী নয়। সে আমাদেরই কারও না কারও ঘরের ছেলে। পুলিশের তদন্তে যে এলএসডির কথা জানা গেছে, তার প্রভাব কতটা সর্বগ্রাসী হতে পারে হাফিজের ঘটনা তার উদাহরণ। ব্যক্তির বেড়ে উঠার প্রক্রিয়ার পেছনে মানুষের আচার-আচরণ পরিবর্তন হয়ে থাকে। এজন্য বলা হয়, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ কীভাবে একজন মেধাবী, উচ্ছল, প্রাণবন্ত ছাত্রের এ রকম অকাল পরিণতি, সেটা তরুণ সমাজের জানা উচিত। মনে রাখতে হবে, কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। আর একটা নির্দিষ্ট বয়সে যদি নিজেকে সংযত করা যায় তবে আশা করা যায়, অনেক তরুণ এভাবে ঝরে পড়বে না, নিজের গলায় নিজে গা দিয়ে কোপ মারবে না। আমাদের দেশে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরাই তাদের অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর প্রায় সব ছাত্রছাত্রী অপার স্বাধীনতা ভোগ করে। আর এই অপার স্বাধীনতাই অনেকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য তরুণদের নেশাখোর সহপাঠীদের এড়িয়ে চলতে হবে। নইলে হাফিজের মতো মা-বাবাকে শোক ও লজ্জার সাগরে ভাসিয়ে হারিয়ে যেতে হবে। যারা নেশাগ্রস্ত তাদের পরিণতি করুণই হয়ে থাকে। হাফিজ হয়তো আগেই চলে গেছে। বেঁচে থাকলেও নেশাগ্রস্তরা পরিবারের জন্য বোঝা ও সমাজকে কলুষিত করে থাকে।

যেখান থেকে লেখাপড়া শেষ করে দেশের প্রথম স্থানের নাগরিক হবে, যাকে সবাই স্যালুট দেবে। অথচ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থীরা যখন এলএসডি, ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক সেবনে জরিয়ে পরবে। তাহলে এ জাতি কীভাবে উন্নতীর শিখরে পৌঁছবে? বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাবরই গবেষণায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাদক, সন্ত্রাসী, ক্যাডার, মারামারি ইত্যাদি সূচকে ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে! শিক্ষার্থীরা ইয়াবা, এলএসডি নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তাদের দ্বারা কোন আবিষ্কার, উদ্যোক্তা বা উদ্ভাবন আশা করা যায় কী? বরং যা হচ্ছে তা হলো, মাদকের উদ্যোক্তা! যার প্রমাণ, আটককৃত সাদমান জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ‘বেটার ব্রাওয়ারি অ্যান্ড বিওয়ন্ড’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ পরিচালনা করত সে। যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। সাদমান, আসহাব ও আদিব এই তিনজন মিলে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডি বিক্রি করত। এগুলোর মাধ্যমে তারা এলএসডি ও গাঁজার নির্যাস দিয়ে তৈরি এক ধরনের ‘গাঁজার কেক’ তৈরি করত। এই ‘গাঁজার কেক’ নতুন উদ্ভাবন বলে দাবি তাদের। এই হলো অবস্থা! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা নতুন উদ্ভাবন হলো কথিত ‘গাঁজার কেক’। এছাড়া বেশিরভাগ মেধাবী ছাত্রছাত্রীর জীবন শেষ হয়ে যায় রাজনীতি নামক কালো থাবায়।

ইতোমধ্যে এলএসডি বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তারা হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র সাদমান সাকিব (রূপল) ও আসহাব ওয়াদুদ (তুর্জ) এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফ। এরমধ্যে সাদমান সাকিব (রূপল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র বহিষ্কৃত ছাত্র। বর্তমানে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ (শেষ বর্ষ) পড়ছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ার খবর বেশ আলোচিত ছিল। দেশে ইয়াবার প্রবেশ ঠেকাতে সরকার মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়েছিল। সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান অল্পকিছু বিতর্কিত ঘটনা ছাড়া প্রশংসা পেয়েছিল। নতুন ভয়ঙ্কর এই মাদক যাতে বিস্তার লাভ করতে না পারে, সে জন্য প্রশাসন, ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। সবাইকে মাদকের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে, নাহলে মেধাবীরা মাদকের মাধ্যমে নিজের জীবন শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিবার ও সমাজকেও ধ্বংস করবে।

abunoman1972@gmail.com