শরীয়তপুর-নাওডোবা ৪ লেন সড়ক প্রকল্প

অধিক ক্ষতিপুরণের লোভে প্রকল্প এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক

পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে শরীয়তপুর পর্যন্ত চার লেনের সড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সওজ। এ জন্য সড়কের উভয় পাশে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। তালিকা প্রস্তুতের আগেই ক্ষতিপূরণের অর্থ হাতিয়ে নিতে নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ করছে একটি চক্র। লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির চারাগাছ। নির্মাণ করা হচ্ছে মিল ফ্যাক্টরিও।

সওজ সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুর- জাজিরা- নাওডোবা (পদ্মা ব্রিজ এ্যাপ্রোচ) সড়ক উন্নয়ন চারলেন সড়কে উন্নীতকরণের প্রকল্পটি ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় অনুমোদন হয়। একই বছর অক্টোবর মাসে সড়ক-পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক চিঠি পায় শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ৩টি প্যাকেজে ২৭ কিলোমিটার সড়ক, ২৭টি কালভার্ট ও দুইটি সেতু প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৮২ কোটি টাকা। যার মধ্যে সড়ক নির্মাণে ৪৫০ কোটি টাকা বাকি ১২৩১ কোটি ১৮ লাখ টাকা জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হবে। শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনকে ১০৫ দশমি ৫৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা দিয়েছে সড়ক বিভাগ। জমি অধিগ্রহণের ৪ধারা নোটিসও জারি করে প্রশাসন।

এ খবর শুনেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে দালাল চক্র। যৌথ তদন্তের আগেই প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। বাসিন্দা না থাকলেও বেশি ক্ষতিপূরণ পেতে অধিগ্রহণকৃত জমিতে প্রতিদিন তোলা হচ্ছে ঘর বাড়ি । রোপণ করা হচ্ছে বিভিন্ন জাতের শত শত চারাগাছ। নির্মাণ কর হয়েছে সমিল, মৎস্য খামার, পোল্ট্রি খামারসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

জাজিরার টিঅ্যান্ডটি মোড় পেরুতেই সড়কের পশ্চিম পাশে ফসলি জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে ১০টি টিনসেড ঘর। প্রতিটি ঘরের দরজায়ই তালা ঝুঁলছে। বসবাস তো দূরের কথা আশপাশেও নেই বসতি। সে সব জমিতেই রোপণ করা হয়েছে চারাগাছ। বসানো হয়েছে অগভীর নলকূপ। লম্বা করে নির্মাণ করা হয়েছে মুরগির খামার। অবকাঠামো থাকলেও নেই প্রাণের অস্তিত্ব।

সড়ক দিয়ে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছিলেন জাজিরা পৌরসভার বাসিন্দা আজগর আলী। সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে রিক্সা থামিয়ে দেন। তিনি বলেন, এই রাস্তা দিয়া বছরের পর বছর রিক্সা চালাই। এইয়া সব চাষের জমিন। কিছু দিন ধইরা গরডি উডাইছে। রাস্তা বড় করবো হুইন্যা হের নিগ্যাই এই গরগুলান উডাইছে। গর উডালে টাহা পাইবো। টাহার উছিলায় কইবো এইডা আমার বাড়ি। টাহার লোবেই উডাইছে। এট্টা গরেও মানুষ থাকে না। সবগুলান তালা মারা।

সড়ক ধরে শরীয়তপুর থেকে নাওডোবার দিকে যেতে থাকলে বর্তমান সড়কের উভয় পাশেই দেখা মিলবে নির্মাণাধীন পাকা আধাপাকা ও টিন শেডের বসতঘর, দোকানঘর, করাতকল, মুরগির খামার, মৎস্য হ্যাচারি আর গরুর খামার কি নেই! জাজিরার বড় কৃষ্ণনগর এলাকায় দেখা মিলল একটি গরুর খামারের নির্মাণ কাজ চলছে। ৬ থেকে ৭ জন রাজমিস্ত্রি আর ৪ থেকে ৫ জন কাঠমিস্ত্রি খামার নির্মাণ কাজ করছেন। রাজমিস্ত্রি মানিক হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, গত তিনদিন ধইরা আমরা ৬-৭ জন কইরা কাচ করতাছি। আর অহনতোরি সপ্তাখানিক লাগবো। আমাগো তাড়াতাড়ি বানাইতে কইছে। আমরা শ্রমিক। আতিক ভাই বানাইতে কইছে আমরা বানাইতাছি। কিয়েলিগ্যা বানায় হেইয়া আমরা কইতে পারুম না।

জাজিরার পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক সংলগ্ন জমাদ্দার স্ট্যান্ড। সেখানে গিয়ে দেখা মিলল সড়ক ও জনপথ থেকে টাঙিয়ে দেয়া লাল পাতাকা। খুঁটির সঙ্গে পতাকাগুলো পত পত করে উড়ছে। আর সেই নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই উঠেছে অবৈধ স্থাপনাগুলো। জমাদ্দার স্ট্যান্ডের ওষুধের দোকান জসিম জমাদ্দারের। সাংবাদিক দেখে তিনি বেশ উৎসাহ নিয়ে অনেক কথাই বললেন। জমি অধিগ্রহণের সময় দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য নিয়ে তিনি জানালেন দীর্ঘদিনের তার অভিজ্ঞতার কথা। বলেন, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণের সময়ও এ চক্র সক্রিয় ছিল এরপর রেলওয়ের অধিগ্রহণের, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী নির্মাণ সব ক্ষেত্রেই প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আতাত করে তারা এসব কাজ হাসিল করে নিচ্ছে। এখন আমাদের অনেক প্রত্যাশার শরীয়তপুর-নাওয়াডোবা সড়ক উন্নয়ন হচ্ছে এখানেও তারা বসে নেই। অনেক আগেই তথ্য পেয়েছেন ওই চক্রের সদস্যরা। তখন থেকেই স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছেন।

তবে শুরু থেকেই সোচ্চার শরীয়তপুর সড়ক বিভাগ। কাজের শুরতেই প্রকল্প এলাকা ভিডিও চিত্র ধারণ করেছেন। তাও জমাও দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের দপ্তরে। শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ভূঁইয়া রেদওয়ানুর রহমান বলেন, বর্তমানে যেভাবে অবৈধ স্থাপনাগুলো গড়ে উঠছে। এটা যদি বাদ বিচার না করে ক্ষতিপূরণের টাকা দেই। সেক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তাই এ বিষয়ে আমার একেবারেই জিরো টলারেন্ট। আমাদের ভিডিওতে যদি ধরা পড়ে সেক্ষেত্রে তারা ক্ষতিপূরণ পাবে না।

শরীয়তপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি) আসমাউল হুসনা লিজা বলেন, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে খবর পেয়ে আমরা সেখানে গিয়েছি। তার জন্য জনস্বার্থ বিরোধী তালিকা হিসেবে চিহ্নিত করে তালিকাভুক্তি করা হচ্ছে এবং তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না বলে মাইকিংও করা হয়েছে। প্রতিনিয়তই আমাদের কর্মকর্তার সেখানে গিয়ে তালিকাটা আপডেট করছেন। আইনের বাইরে ক্ষতিপূরণ দেয়ার সুযোগ নেই।

শুক্রবার, ১১ জুন ২০২১ , ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৯ শাওয়াল ১৪৪২

শরীয়তপুর-নাওডোবা ৪ লেন সড়ক প্রকল্প

অধিক ক্ষতিপুরণের লোভে প্রকল্প এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক

সংবাদদাতা, জাজিরা (শরীয়তপুর)

image

জাজিরা (শরীয়তপুর) : এভাবেই অধিগ্রহণ করা জমিতে তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন স্থাপনা -সংবাদ

পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে শরীয়তপুর পর্যন্ত চার লেনের সড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সওজ। এ জন্য সড়কের উভয় পাশে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। তালিকা প্রস্তুতের আগেই ক্ষতিপূরণের অর্থ হাতিয়ে নিতে নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ করছে একটি চক্র। লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির চারাগাছ। নির্মাণ করা হচ্ছে মিল ফ্যাক্টরিও।

সওজ সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুর- জাজিরা- নাওডোবা (পদ্মা ব্রিজ এ্যাপ্রোচ) সড়ক উন্নয়ন চারলেন সড়কে উন্নীতকরণের প্রকল্পটি ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় অনুমোদন হয়। একই বছর অক্টোবর মাসে সড়ক-পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক চিঠি পায় শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ৩টি প্যাকেজে ২৭ কিলোমিটার সড়ক, ২৭টি কালভার্ট ও দুইটি সেতু প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬৮২ কোটি টাকা। যার মধ্যে সড়ক নির্মাণে ৪৫০ কোটি টাকা বাকি ১২৩১ কোটি ১৮ লাখ টাকা জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হবে। শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনকে ১০৫ দশমি ৫৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা দিয়েছে সড়ক বিভাগ। জমি অধিগ্রহণের ৪ধারা নোটিসও জারি করে প্রশাসন।

এ খবর শুনেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে দালাল চক্র। যৌথ তদন্তের আগেই প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। বাসিন্দা না থাকলেও বেশি ক্ষতিপূরণ পেতে অধিগ্রহণকৃত জমিতে প্রতিদিন তোলা হচ্ছে ঘর বাড়ি । রোপণ করা হচ্ছে বিভিন্ন জাতের শত শত চারাগাছ। নির্মাণ কর হয়েছে সমিল, মৎস্য খামার, পোল্ট্রি খামারসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

জাজিরার টিঅ্যান্ডটি মোড় পেরুতেই সড়কের পশ্চিম পাশে ফসলি জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে ১০টি টিনসেড ঘর। প্রতিটি ঘরের দরজায়ই তালা ঝুঁলছে। বসবাস তো দূরের কথা আশপাশেও নেই বসতি। সে সব জমিতেই রোপণ করা হয়েছে চারাগাছ। বসানো হয়েছে অগভীর নলকূপ। লম্বা করে নির্মাণ করা হয়েছে মুরগির খামার। অবকাঠামো থাকলেও নেই প্রাণের অস্তিত্ব।

সড়ক দিয়ে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছিলেন জাজিরা পৌরসভার বাসিন্দা আজগর আলী। সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে রিক্সা থামিয়ে দেন। তিনি বলেন, এই রাস্তা দিয়া বছরের পর বছর রিক্সা চালাই। এইয়া সব চাষের জমিন। কিছু দিন ধইরা গরডি উডাইছে। রাস্তা বড় করবো হুইন্যা হের নিগ্যাই এই গরগুলান উডাইছে। গর উডালে টাহা পাইবো। টাহার উছিলায় কইবো এইডা আমার বাড়ি। টাহার লোবেই উডাইছে। এট্টা গরেও মানুষ থাকে না। সবগুলান তালা মারা।

সড়ক ধরে শরীয়তপুর থেকে নাওডোবার দিকে যেতে থাকলে বর্তমান সড়কের উভয় পাশেই দেখা মিলবে নির্মাণাধীন পাকা আধাপাকা ও টিন শেডের বসতঘর, দোকানঘর, করাতকল, মুরগির খামার, মৎস্য হ্যাচারি আর গরুর খামার কি নেই! জাজিরার বড় কৃষ্ণনগর এলাকায় দেখা মিলল একটি গরুর খামারের নির্মাণ কাজ চলছে। ৬ থেকে ৭ জন রাজমিস্ত্রি আর ৪ থেকে ৫ জন কাঠমিস্ত্রি খামার নির্মাণ কাজ করছেন। রাজমিস্ত্রি মানিক হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, গত তিনদিন ধইরা আমরা ৬-৭ জন কইরা কাচ করতাছি। আর অহনতোরি সপ্তাখানিক লাগবো। আমাগো তাড়াতাড়ি বানাইতে কইছে। আমরা শ্রমিক। আতিক ভাই বানাইতে কইছে আমরা বানাইতাছি। কিয়েলিগ্যা বানায় হেইয়া আমরা কইতে পারুম না।

জাজিরার পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক সংলগ্ন জমাদ্দার স্ট্যান্ড। সেখানে গিয়ে দেখা মিলল সড়ক ও জনপথ থেকে টাঙিয়ে দেয়া লাল পাতাকা। খুঁটির সঙ্গে পতাকাগুলো পত পত করে উড়ছে। আর সেই নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই উঠেছে অবৈধ স্থাপনাগুলো। জমাদ্দার স্ট্যান্ডের ওষুধের দোকান জসিম জমাদ্দারের। সাংবাদিক দেখে তিনি বেশ উৎসাহ নিয়ে অনেক কথাই বললেন। জমি অধিগ্রহণের সময় দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য নিয়ে তিনি জানালেন দীর্ঘদিনের তার অভিজ্ঞতার কথা। বলেন, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণের সময়ও এ চক্র সক্রিয় ছিল এরপর রেলওয়ের অধিগ্রহণের, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী নির্মাণ সব ক্ষেত্রেই প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আতাত করে তারা এসব কাজ হাসিল করে নিচ্ছে। এখন আমাদের অনেক প্রত্যাশার শরীয়তপুর-নাওয়াডোবা সড়ক উন্নয়ন হচ্ছে এখানেও তারা বসে নেই। অনেক আগেই তথ্য পেয়েছেন ওই চক্রের সদস্যরা। তখন থেকেই স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছেন।

তবে শুরু থেকেই সোচ্চার শরীয়তপুর সড়ক বিভাগ। কাজের শুরতেই প্রকল্প এলাকা ভিডিও চিত্র ধারণ করেছেন। তাও জমাও দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের দপ্তরে। শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ভূঁইয়া রেদওয়ানুর রহমান বলেন, বর্তমানে যেভাবে অবৈধ স্থাপনাগুলো গড়ে উঠছে। এটা যদি বাদ বিচার না করে ক্ষতিপূরণের টাকা দেই। সেক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তাই এ বিষয়ে আমার একেবারেই জিরো টলারেন্ট। আমাদের ভিডিওতে যদি ধরা পড়ে সেক্ষেত্রে তারা ক্ষতিপূরণ পাবে না।

শরীয়তপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি) আসমাউল হুসনা লিজা বলেন, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে খবর পেয়ে আমরা সেখানে গিয়েছি। তার জন্য জনস্বার্থ বিরোধী তালিকা হিসেবে চিহ্নিত করে তালিকাভুক্তি করা হচ্ছে এবং তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না বলে মাইকিংও করা হয়েছে। প্রতিনিয়তই আমাদের কর্মকর্তার সেখানে গিয়ে তালিকাটা আপডেট করছেন। আইনের বাইরে ক্ষতিপূরণ দেয়ার সুযোগ নেই।