চোখ রাঙাচ্ছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট

শফিকুর রহমান

বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই ঈদের পর থেকে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের জেলাগুলোতে করোনার অধিক সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টগুলো ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশেরও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোত আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার উচ্চ সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের বি.১.১.৭ মিউট্যান্টকে আলফা, ভারতের ট্রিপল মিউট্যান্ট নামে পরিচিত বি.১.৬১৭.২ ভ্যারিয়েন্টকে ডেল্টা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বি.১.৩৫১ মিউট্যান্টকে বিটা ভ্যারিয়েন্ট নামে আখ্যায়িত করেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং ১৬ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকান বিটা ভ্যারিয়েন্ট বলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভসের (আইডিএসএইচআই) যৌথ সমীক্ষায় পাওয়া গেছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের প্রমাণও পাওয়া গেছে ওই সমীক্ষায়, যার কারণে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে আস্তে আস্তে পাশের জেলাগুলোতে করোনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা রীতিমতো ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই, এ সময় ভারত থেকে আসা অধিক সংক্রমণশীল এসব ভয়ঙ্কর ভ্যারিয়েন্টগুলোর কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঠেকিয়ে রাখা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানা গেছে, টিকা নেয়ার পরও করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই, যা যুক্তরাজ্যে শনাক্ত আলফা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে হয়নি। ফলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে চিকিৎসক মহলে। ইতোমধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টি যুক্তরাজ্য ও কানাডাসহ ৫০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

করোনার আলফা ধরনের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ৪০ শতাংশ বেশি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে যুক্তরাজ্যের সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ ফর ইমার্জেন্সিসের (এসএজিই) বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তবে যারা করোনার টিকার দুটি ডোজ নিয়েছেন, তারা করোনার আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকেও একই রকমের সুরক্ষা পাচ্ছেন বলে এসএজিই জানিয়েছে।

ব্রিটেনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউট এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ রিসার্চের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার ডেল্টা রূপটি অন্য যেকোন রূপের চেয়ে দ্রুততম হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে খুব দ্রুতই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এমনকি কোভিড-১৯ এর মূল স্ট্রেইনের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি সংক্রমণশীল যুক্তরাজ্যের আলফা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বিগুণ হারে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল বলে গবেষণা রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শুধু দ্রুতই ছড়ায় না, এটি মারাত্মক অসুস্থতার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। কাজেই, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের জন্য খুবই উদ্বেগজনক।

সম্প্রতি ল্যানসেটে প্রকাশিত ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউট এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ রিসার্চের একটি গবেষণাপত্রে দেখা যায়, ফাইজারের টিকার শুধু একটি ডোজ গ্রহণকারীদের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে নিম্ন স্তরের অ্যান্টিবডি তৈরি করেছিল। বিশেষকরে ফাইজারের একক ডোজ গ্রহণের পরে ৭৯ শতাংশ লোকের মূল স্ট্রেনের বিপরীতে কার্যকর নিউট্রেলাইজিং এন্টিবডি বা পূর্ণ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়, তবে এটি আলফা, ডেল্টা ও বিটা ভেরিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৫০, ৩২ ও ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এজন্যই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে টিকার কার্যকারিতা ও করোনা থেকে সেরে ওঠা ব্যাক্তিদের হার্ড ইমিউনিটি এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

আবার যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডেল্টা সংক্রমণের ৭৩ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে যারা টিকা গ্রহণ করেন নাই তাদের মধ্যে এবং যারা দুটি ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ডেল্টা সংক্রমণ মাত্র ৩.৭ শতাংশ দেখা গেছে। গবেষণায় সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া এবং যাদের এসব নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি নয়, তাদের বুস্টার ডোজ দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এজন্যই যুক্তরাজ্য ও কানাডা টিকার দুটি ডোজের মধ্যবর্তী সময় ১৬ সপ্তাহ থেকে কমিয়ে ৪-৮ সপ্তাহে নিয়ে আসছে। গবেষকদের মতে, করোনায় আক্রান্ত বহুসংখ্যক মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হওয়া থেকে রক্ষা করছে টিকা। সুতারাং, যেসব দেশ টিকার মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে পিছিয়ে আছে সেসব দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ভারতের মতো ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।

বাংলাদেশে করোনার ডেল্টা ও বিটা ভ্যারিয়েন্টগুলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে ও সংক্রমণ আবারও ধীরে ধীরে বাড়ছে। তাই এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে অণুজীববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বার বার সতর্ক করছেন। এসব ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন প্রতিরোধে যতক্ষণ পর্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আরও কার্যকর না হয় এবং টিকাদান কর্মসূচির দ্রুত অগ্রগতি না হয়, ততক্ষণ সংক্রমণ বাড়বে। সীমান্ত এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করাসহ বিশেষ নজর দিতে হবে। আর যারা পাসপোর্ট ছাড়া সীমান্তের বিভিন্ন চোরাই পথে ভারতে আসা-যাওয়া করছেন, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা কোয়ারেন্টিন হচ্ছে না বিধায় এটি ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। করোনা সংক্রমণরোধে সরকার বা প্রশাসন এখন পর্যন্ত সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেনি এবং করোনার হটস্পট জেলাগুলোতে নানা সতর্কতার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না জনগণ। করোনা বিস্তাররোধের বিধিনিষেধ পালনে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে স্থানীয় সরকারসহ জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।

মনে রাখা দরকার, করোনা যতদিন থাকবে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টও আসবে। তাই জনগণকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে ও যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় সেখানে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালনে অভ্যস্থ করে তুলতে হবে, তাহলে সব ভ্যারিয়েন্টই ঠেকানো যাবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে কঠোর মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। কাজেই, করোনা মোকাবিলায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, গা-ছাড়া ভাব থাকলে করোনা পরিস্থিতি ভারতের মতো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবয়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

শুক্রবার, ১১ জুন ২০২১ , ২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২৯ শাওয়াল ১৪৪২

চোখ রাঙাচ্ছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট

শফিকুর রহমান

বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই ঈদের পর থেকে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের জেলাগুলোতে করোনার অধিক সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টগুলো ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশেরও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোত আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার উচ্চ সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের বি.১.১.৭ মিউট্যান্টকে আলফা, ভারতের ট্রিপল মিউট্যান্ট নামে পরিচিত বি.১.৬১৭.২ ভ্যারিয়েন্টকে ডেল্টা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বি.১.৩৫১ মিউট্যান্টকে বিটা ভ্যারিয়েন্ট নামে আখ্যায়িত করেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং ১৬ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকান বিটা ভ্যারিয়েন্ট বলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভসের (আইডিএসএইচআই) যৌথ সমীক্ষায় পাওয়া গেছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের প্রমাণও পাওয়া গেছে ওই সমীক্ষায়, যার কারণে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে আস্তে আস্তে পাশের জেলাগুলোতে করোনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা রীতিমতো ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই, এ সময় ভারত থেকে আসা অধিক সংক্রমণশীল এসব ভয়ঙ্কর ভ্যারিয়েন্টগুলোর কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঠেকিয়ে রাখা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানা গেছে, টিকা নেয়ার পরও করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই, যা যুক্তরাজ্যে শনাক্ত আলফা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে হয়নি। ফলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে চিকিৎসক মহলে। ইতোমধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টি যুক্তরাজ্য ও কানাডাসহ ৫০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

করোনার আলফা ধরনের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ৪০ শতাংশ বেশি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে যুক্তরাজ্যের সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ ফর ইমার্জেন্সিসের (এসএজিই) বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। তবে যারা করোনার টিকার দুটি ডোজ নিয়েছেন, তারা করোনার আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকেও একই রকমের সুরক্ষা পাচ্ছেন বলে এসএজিই জানিয়েছে।

ব্রিটেনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউট এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ রিসার্চের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার ডেল্টা রূপটি অন্য যেকোন রূপের চেয়ে দ্রুততম হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে খুব দ্রুতই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এমনকি কোভিড-১৯ এর মূল স্ট্রেইনের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি সংক্রমণশীল যুক্তরাজ্যের আলফা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বিগুণ হারে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল বলে গবেষণা রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শুধু দ্রুতই ছড়ায় না, এটি মারাত্মক অসুস্থতার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। কাজেই, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের জন্য খুবই উদ্বেগজনক।

সম্প্রতি ল্যানসেটে প্রকাশিত ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউট এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ রিসার্চের একটি গবেষণাপত্রে দেখা যায়, ফাইজারের টিকার শুধু একটি ডোজ গ্রহণকারীদের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে নিম্ন স্তরের অ্যান্টিবডি তৈরি করেছিল। বিশেষকরে ফাইজারের একক ডোজ গ্রহণের পরে ৭৯ শতাংশ লোকের মূল স্ট্রেনের বিপরীতে কার্যকর নিউট্রেলাইজিং এন্টিবডি বা পূর্ণ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়, তবে এটি আলফা, ডেল্টা ও বিটা ভেরিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৫০, ৩২ ও ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এজন্যই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে টিকার কার্যকারিতা ও করোনা থেকে সেরে ওঠা ব্যাক্তিদের হার্ড ইমিউনিটি এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

আবার যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডেল্টা সংক্রমণের ৭৩ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে যারা টিকা গ্রহণ করেন নাই তাদের মধ্যে এবং যারা দুটি ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ডেল্টা সংক্রমণ মাত্র ৩.৭ শতাংশ দেখা গেছে। গবেষণায় সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া এবং যাদের এসব নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি নয়, তাদের বুস্টার ডোজ দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এজন্যই যুক্তরাজ্য ও কানাডা টিকার দুটি ডোজের মধ্যবর্তী সময় ১৬ সপ্তাহ থেকে কমিয়ে ৪-৮ সপ্তাহে নিয়ে আসছে। গবেষকদের মতে, করোনায় আক্রান্ত বহুসংখ্যক মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হওয়া থেকে রক্ষা করছে টিকা। সুতারাং, যেসব দেশ টিকার মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনে পিছিয়ে আছে সেসব দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ভারতের মতো ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।

বাংলাদেশে করোনার ডেল্টা ও বিটা ভ্যারিয়েন্টগুলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে ও সংক্রমণ আবারও ধীরে ধীরে বাড়ছে। তাই এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে অণুজীববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বার বার সতর্ক করছেন। এসব ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন প্রতিরোধে যতক্ষণ পর্যন্ত বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আরও কার্যকর না হয় এবং টিকাদান কর্মসূচির দ্রুত অগ্রগতি না হয়, ততক্ষণ সংক্রমণ বাড়বে। সীমান্ত এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করাসহ বিশেষ নজর দিতে হবে। আর যারা পাসপোর্ট ছাড়া সীমান্তের বিভিন্ন চোরাই পথে ভারতে আসা-যাওয়া করছেন, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা কোয়ারেন্টিন হচ্ছে না বিধায় এটি ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। করোনা সংক্রমণরোধে সরকার বা প্রশাসন এখন পর্যন্ত সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেনি এবং করোনার হটস্পট জেলাগুলোতে নানা সতর্কতার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না জনগণ। করোনা বিস্তাররোধের বিধিনিষেধ পালনে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে স্থানীয় সরকারসহ জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।

মনে রাখা দরকার, করোনা যতদিন থাকবে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টও আসবে। তাই জনগণকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে ও যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় সেখানে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালনে অভ্যস্থ করে তুলতে হবে, তাহলে সব ভ্যারিয়েন্টই ঠেকানো যাবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে কঠোর মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। কাজেই, করোনা মোকাবিলায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, গা-ছাড়া ভাব থাকলে করোনা পরিস্থিতি ভারতের মতো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবয়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]