স্বপ্নের স্বামী তরুণীর দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো

৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভারতে পাচার করলো

একজন নারীর জীবনে সবচেয়ে বড় নিরাপদ আশ্রয় ও ভরসা তার স্বামী। আর সেই স্বামী যদি হয় তার জীবনের অভিশাপ তাহলে ওই নারীর আর কোন আশ্রয় থাকে না। বিয়ে করে সংসারের স্বপ্ন দেখা এক তরুণীর জীবনে স্বপ্ন একদিন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। মাত্র ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে স্ত্রীকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করেছেন স্বামী। তারপর ভারতেই দু’দফা বিক্রি হওয়া তরুণীকে ৬ মাস সইতে হয়েছে অমানুষিক বর্বর নির্যাতন।

নিজের জীবনের করুণ পরিণতির কথা জানিয়ে হাতিরঝিল থানায় স্বামীসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ওই তরুণী। গত বৃহস্পতিবার মামলাটি করেন তিনি। পুলিশ যদিও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পুলিশ জানিয়েছে, ভারতে বিভিন্ন সময়ে পাচার হওয়া নারীদের একজন ওই তরুণী। যিনি গত ৩ মে পালিয়ে এসেছেন।

এদিকে ভারতে পাচারের জন্য আটকে রাখা এক নারীকে সাভার থেকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব। অভিযানে পাচারকারী চক্রের নারী সদস্যকে আটক করা হয়েছে।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মো. শহিদুল্লাহ জানান, গত বৃহস্পতিবার ২০ বছর বয়সী এক তরুণী হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলায় নিজের স্বামী জাহিদুল ইসলাম রনিসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে। ওই তরুণী এখন তার পরিবারের কাছে আছে।

পুলিশ জানায়, ওই তরুণীকে বিয়ে করেছিল জাহিদুল ইসলাম রনি। নিজের স্ত্রীকে চাকরির জন্য ভারতে যাওয়ার প্রলোভন দেখায়। পাচারকারী চক্রের সঙ্গে পরিকল্পনা করে গত জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখে বাংলাদেশ থেকে পাচার করে। সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয় মাত্র ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে। নিজের স্ত্রীকে পাচার করার ঘটনা পুলিশের কাছে প্রথম এসেছে। তরুণী গত বৃহস্পতিবার থানায় এসে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে তিনি কীভাবে পাচার হয়েছেন, কোথায় তাকে আটকে রাখা হয়েছে, তাকে দিয়ে কী কাজ করানো হয়েছে সবকিছুই বলেছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, নদী নামে এক নারীর মাধ্যমে ওই তরুণীকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করা হয় ৪০ হাজার টাকায়। ওই বাংলাদেশি পাচারকারীরা ৭০ হাজার টাকায় ভারতীয় নারী পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয়। সীমান্ত থেকে পাচারকারীরা ওই তরুণীকে নিয়ে চলে যায় ভারতের চেন্নাইয়ে। চেন্নাইয়ে একটি কক্ষে ওই তরুণীকে টানা ৪ মাস আটকে রাখা হয়। আটক থাকাবস্থায় ওই তরুণীকে যৌন কাজে বাধ্য করা হতো। কথা না শুনলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো। টানা ৪ মাস শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ওই তরুণী ওই আস্তানা থেকে পালিয়ে যায়। পরে নানাভাবে চেষ্টার পর গত ৩ মে দেশে ফিরে আসে।

এর আগে, ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে দেশে পালিয়ে আসা আরেক তরুণী গত ১ জুন রাতে হাতিরঝিল থানায় রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে হৃদয় বাবুসহ পাচারকারী চক্রের ১২ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত ৭ মে দেশে ফেরেন ওই তরুণী। সেখানে ৭৭ দিন ওই তরুণী তার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দেন। ওই মামলায় পুলিশ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ৮ জুন ৩ জনের দু’জন দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিও দিয়েছে।

এক তরুণীকে নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ভিডিও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর গত ২৭ মে ভারতের পুলিশ হৃদয়সহ আর পাঁচ বাংলাদেশিকে বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায় ৫০ সদস্যের একটি আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায়। এর পর অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। এখন পর্যন্ত, তিন বাংলাদেশি তরুণী ভারত থেকে পালিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন। এসব ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় মানব পাচার আইনে তিনটি মামলা করা হয়েছে। পৃথক অভিযান চালিয়ে পুলিশ ও র‌্যাব এখন পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ছাড়া, ভারতের পুলিশ পাচার কাজে জড়িত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

পাচারকারী চক্রের নারী সদস্য গ্রেপ্তার

এদিকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে নারী পাচারকারী চক্রের এক নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব। সাভার থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ওই নারীর নাম মোছা. রেহানা বেগম। তার আস্তানা থেকে পাচারের জন্য আটকে রাখা এক নারীকেও উদ্ধার করা হয় অভিযানে।

র‌্যাব-৪-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া অফিসার) এএসপি মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম সজল জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (১০ জুন) র‌্যাব-৪-এর একটি আভিযানিক দল ঢাকার সাভার মডেল থানাধীন বড়দেশী পশ্চিমপাড়ের ১/১ রোডের ৫৫ নম্বর বাসায় অভিযান পরিচালনা করে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য মোছা. রেহানা বেগমকে আটক করে। আটক রেহানার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক রেহানা জানান, জাকির হোসেন নামে চক্রের এক সদস্য ভুক্তভোগী নারীকে বিদেশে চাকরি দেয়ার কথা বলে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর তারা দু’জন মিলে ওই নারীকে বাড়ির একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখেন। এছাড়াও গত চার মাস ধরে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে ওই নারীকে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করেন। ভুক্তভোগী ওই নারী শারীরিক সম্পর্ক করতে না চাইলে তাকে বিভিন্ন ভয়ভীতিসহ হত্যার হুমকি দেয়া হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, অভিযানে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য রেহানাকে আটক করা সম্ভব হলেও আসামি জাকির হোসেন পলাতক রয়েছেন। এছাড়াও চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আটক রেহানার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।

শনিবার, ১২ জুন ২০২১ , ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৩০ শাওয়াল ১৪৪২

স্বপ্নের স্বামী তরুণীর দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো

৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভারতে পাচার করলো

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

একজন নারীর জীবনে সবচেয়ে বড় নিরাপদ আশ্রয় ও ভরসা তার স্বামী। আর সেই স্বামী যদি হয় তার জীবনের অভিশাপ তাহলে ওই নারীর আর কোন আশ্রয় থাকে না। বিয়ে করে সংসারের স্বপ্ন দেখা এক তরুণীর জীবনে স্বপ্ন একদিন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। মাত্র ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে স্ত্রীকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করেছেন স্বামী। তারপর ভারতেই দু’দফা বিক্রি হওয়া তরুণীকে ৬ মাস সইতে হয়েছে অমানুষিক বর্বর নির্যাতন।

নিজের জীবনের করুণ পরিণতির কথা জানিয়ে হাতিরঝিল থানায় স্বামীসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ওই তরুণী। গত বৃহস্পতিবার মামলাটি করেন তিনি। পুলিশ যদিও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পুলিশ জানিয়েছে, ভারতে বিভিন্ন সময়ে পাচার হওয়া নারীদের একজন ওই তরুণী। যিনি গত ৩ মে পালিয়ে এসেছেন।

এদিকে ভারতে পাচারের জন্য আটকে রাখা এক নারীকে সাভার থেকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব। অভিযানে পাচারকারী চক্রের নারী সদস্যকে আটক করা হয়েছে।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মো. শহিদুল্লাহ জানান, গত বৃহস্পতিবার ২০ বছর বয়সী এক তরুণী হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলায় নিজের স্বামী জাহিদুল ইসলাম রনিসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে। ওই তরুণী এখন তার পরিবারের কাছে আছে।

পুলিশ জানায়, ওই তরুণীকে বিয়ে করেছিল জাহিদুল ইসলাম রনি। নিজের স্ত্রীকে চাকরির জন্য ভারতে যাওয়ার প্রলোভন দেখায়। পাচারকারী চক্রের সঙ্গে পরিকল্পনা করে গত জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখে বাংলাদেশ থেকে পাচার করে। সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয় মাত্র ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে। নিজের স্ত্রীকে পাচার করার ঘটনা পুলিশের কাছে প্রথম এসেছে। তরুণী গত বৃহস্পতিবার থানায় এসে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে তিনি কীভাবে পাচার হয়েছেন, কোথায় তাকে আটকে রাখা হয়েছে, তাকে দিয়ে কী কাজ করানো হয়েছে সবকিছুই বলেছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, নদী নামে এক নারীর মাধ্যমে ওই তরুণীকে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করা হয় ৪০ হাজার টাকায়। ওই বাংলাদেশি পাচারকারীরা ৭০ হাজার টাকায় ভারতীয় নারী পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয়। সীমান্ত থেকে পাচারকারীরা ওই তরুণীকে নিয়ে চলে যায় ভারতের চেন্নাইয়ে। চেন্নাইয়ে একটি কক্ষে ওই তরুণীকে টানা ৪ মাস আটকে রাখা হয়। আটক থাকাবস্থায় ওই তরুণীকে যৌন কাজে বাধ্য করা হতো। কথা না শুনলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো। টানা ৪ মাস শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ওই তরুণী ওই আস্তানা থেকে পালিয়ে যায়। পরে নানাভাবে চেষ্টার পর গত ৩ মে দেশে ফিরে আসে।

এর আগে, ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে দেশে পালিয়ে আসা আরেক তরুণী গত ১ জুন রাতে হাতিরঝিল থানায় রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে হৃদয় বাবুসহ পাচারকারী চক্রের ১২ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত ৭ মে দেশে ফেরেন ওই তরুণী। সেখানে ৭৭ দিন ওই তরুণী তার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দেন। ওই মামলায় পুলিশ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ৮ জুন ৩ জনের দু’জন দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিও দিয়েছে।

এক তরুণীকে নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ভিডিও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর গত ২৭ মে ভারতের পুলিশ হৃদয়সহ আর পাঁচ বাংলাদেশিকে বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায় ৫০ সদস্যের একটি আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের সন্ধান পায়। এর পর অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। এখন পর্যন্ত, তিন বাংলাদেশি তরুণী ভারত থেকে পালিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন। এসব ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় মানব পাচার আইনে তিনটি মামলা করা হয়েছে। পৃথক অভিযান চালিয়ে পুলিশ ও র‌্যাব এখন পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ছাড়া, ভারতের পুলিশ পাচার কাজে জড়িত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

পাচারকারী চক্রের নারী সদস্য গ্রেপ্তার

এদিকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে নারী পাচারকারী চক্রের এক নারী সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব। সাভার থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ওই নারীর নাম মোছা. রেহানা বেগম। তার আস্তানা থেকে পাচারের জন্য আটকে রাখা এক নারীকেও উদ্ধার করা হয় অভিযানে।

র‌্যাব-৪-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া অফিসার) এএসপি মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম সজল জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (১০ জুন) র‌্যাব-৪-এর একটি আভিযানিক দল ঢাকার সাভার মডেল থানাধীন বড়দেশী পশ্চিমপাড়ের ১/১ রোডের ৫৫ নম্বর বাসায় অভিযান পরিচালনা করে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য মোছা. রেহানা বেগমকে আটক করে। আটক রেহানার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক রেহানা জানান, জাকির হোসেন নামে চক্রের এক সদস্য ভুক্তভোগী নারীকে বিদেশে চাকরি দেয়ার কথা বলে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর তারা দু’জন মিলে ওই নারীকে বাড়ির একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখেন। এছাড়াও গত চার মাস ধরে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে ওই নারীকে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করেন। ভুক্তভোগী ওই নারী শারীরিক সম্পর্ক করতে না চাইলে তাকে বিভিন্ন ভয়ভীতিসহ হত্যার হুমকি দেয়া হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, অভিযানে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য রেহানাকে আটক করা সম্ভব হলেও আসামি জাকির হোসেন পলাতক রয়েছেন। এছাড়াও চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আটক রেহানার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।