বাজেট ২০২১-২২

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই বাজেট ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল বাজেটের তুলনায় ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি। নতুন অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা এবং এই অর্থ দ্বারা ১ হাজার ৫১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, বনায়ন, উপকূল রক্ষা বাঁধ ইত্যাদির সংস্কার, তৈরি, উন্নয়ন ও নির্মাণে উল্লেখিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। করোনায় পর্যদুস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রস্তাবিত উন্নয়ন বাজেটে পূর্ববর্তী বাজেটের চেয়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যে স্থবিরতা এসেছে তাতে গতি সৃষ্টি করার জন্য, অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য আনার লক্ষ্যে সরকার প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের ব্যবস্থা করে ব্যয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া মতামত ব্যক্ত করে না, কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বাজেটের বিরুদ্ধে কি বলবে তা বাজেট ঘোষণার আগেই ঠিক করে রাখে। আমার বাজেট সম্পর্কে বোধশক্তি জন্মানোর পর থেকেই এই অদ্ভুত রীতি দেখে আসছি। বাজেট পড়ে ধীরেসুস্থে মতামত দেয়ার ধৈর্য কারো নেই। সংসদেও একই চেহারা; সাংসদদের বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করতে দেখা যায় না, বাজেটের বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্টভাবে নতুন প্রস্তাব দেয়ার জন্য কেউ বাজেট পড়ার পরিশ্রম করেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ ফরহাদ বাজেট পর্যালোচনায় একবার সংসদে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের পুনর্বিন্যাস করে সুবিন্যস্ত একটি নতুন বাজেট পেশ করেছিলেন, খাতওয়ারি সংশোধনের বিশদ প্রস্তাব উপস্থাপনের জন্য দীর্ঘ সময় দিতে স্পিকার সম্মত না হলে অন্যান্য সংসদ সদস্যরা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সময় কমরেড ফরদানকে দিয়ে দেন। এবার কেউ কেউ যমুনা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি বড় বড় প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ করে দিয়ে বা বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে করোনা উত্তর পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্থ খরচের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোর কাজে স্থবিরতা এলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাবে, পরবর্তীতে কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করেও সুচারুভাবে প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।

দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রস্তাবিত বাজেটে বড় বড় কোম্পানির কর হার ২% কমানো হয়েছে। বাজেট প্রণেতাদের ধারণা, কর হার কমানো হলে করপোরেটগুলো অধিকতর বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে এবং এতে উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। অবশ্য ছোট ব্যবসায়ীদের করহারও বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কর আদায়ের জটিল প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এবং দুর্নীতির বেড়াজালের কারণে সরকারের প্রত্যাশিত আয় সব সময় হয় না। আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর থেকে আদায় কোন কারণে বাধাগ্রস্ত হলে সরকারকে ব্যয় কমাতে হয়, অথবা ঋণ করে বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে হয়। কিন্তু কিছু ব্যয় আছে যা হ্রাস করা যায় না, সরকারের কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করতেই হয়। ব্যয় কমানো যায় শুধু উন্নয়ন বাজেট থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরেও মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.২%। করোনার মধ্যে এই উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয় বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন; বিশ্ব ব্যাংকের অভিমত হচ্ছে ৫.১% এর বেশি হবে না। কিন্তু চলতি বছরে যে প্রবৃদ্ধি (৫.৩%) বাংলাদেশ অর্জন করেছে তা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের এই প্রবৃদ্ধি অর্জনে, দেশের উন্নয়নে ব্যয় না করলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাবে, উন্নয়নে ব্যয় না হলে মেট্রোরেল হবে না, পদ্মাসেতু হবে না, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে না, নতুন ভবন হবে না, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে না, করোনা রোগীর জন্য নতুন শয্যার সংযোজন হবে না, কর্মহীনদের বেকারত্ব যাবে না।

স্বাস্থ্য খাতে অধিক বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তার কথা অর্থনীতিবিদেরা বারবার বলছেন। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন, অনেকেই মনে করছেন, এই খাতে এবার প্রয়োজনানুযায়ী বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে গতবারের তুলনায় ৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এছাড়ও করোনা মোকাবিলায় এবারও থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে জনগণ ভীতশ্রদ্ধ, তাই এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার। শিক্ষা খাতে কাক্সিক্ষত বরাদ্দ কোন সরকারের আমলেই ছিল না; প্রতি বছরই শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দের জন্য বাজেট সমালোচিত হয়ে থাকে। গতবারের তুলনায় এবার ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। বরাদ্দের এমন বৃদ্ধি প্রায় সব খাতেই হয়েছে। বহু নতুন ব্যবসা ও নতুন শিল্পকে কর রেয়াত দেয়া হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরে তৈরি ইলেকট্রনিক সামগ্রীর জন্য কর সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, ক্যান্সারের ওষুধ তৈরির কাঁচামালের শুল্ক হার কমানো হয়েছে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি বাড়ানো হয়েছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ১২ হাজার থেকে বৃদ্ধি করে ২০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে, বাজেটে আরও ৮ লক্ষ লোককে বয়স্ক ভাতা দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, সব মন্ত্রণালয়ই প্রতি বছর বেশি বেশি বরাদ্দের চাহিদা পেশ করে থাকে, কিন্তু অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ই প্রদত্ত বরাদ্দের সম্পূর্ণ খরচ করতে পারে না। ব্যয় না হওয়ার পেছনেও যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। বাজেট পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দের ছাড়করণ হয় না; কারণ বছরব্যাপী যে কর, শুল্ক ইত্যাদি আদায় হয় তা থেকেই বিভিন্ন খাতে প্রদত্ত বরাদ্দের অর্থের জোগান দিতে হয়। বরাদ্দের অর্থ পাওয়ার পর সংগ্রহ নীতিমালার দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করতে করতেই বছরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যেতে হয়। তাই ব্যয়-সংশিষ্ট কর্মকা- সম্পন্ন করার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে বা বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট কর্মকা- সম্পাদনে লোকবলের সক্ষমতার অভাব হলে উন্নয়ন কর্মকা-ে স্থবিরতা আসবেই। হলি আর্টিজানে জাপানি বিশেষজ্ঞদের নির্মমভাবে হত্যার পর মেট্রোরেল নির্মাণ বহুদিন বন্ধ ছিল। এমন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করা সহজ নয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মচারী-কর্মকর্তার অজ্ঞতা, অক্ষমতা বা কাজের প্রতি অনীহার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়া ক্ষমার অযোগ্য। অথর্ব লোকদের সততাও অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয়। অনেক সৎ লোক আছেন যারা কোন দায়িত্ব নেন না, যথাসময়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। এই লোকগুলো দুর্নীতিবাজের চেয়েও বেশি পরিত্যজ্য। সততা এবং কর্মদক্ষতা দুটিই কর্ম সম্পাদনের জন্য অপরিহার্য।

বহুল কথিত কালোটাকাকে সাদা করার সুবিধা প্রস্তাবিত বাজেটে রাখা হয়েছে কী না, রাখা হলেও তা কীভাবে রাখা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। সম্পদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করার সুযোগ না রেখে শুধু ১০% কর দিয়ে কালোটাকাকে সাদা করার সুযোগ বহু বছর যাবত দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, এই সুযোগ গ্রহণ করেই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কালোটাকাকে সাদা করেছেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী এই অর্থকে কালোটাকা বলতে নারাজ, তার কথা অনুযায়ী এই টাকা অপ্রদর্শিত আয় থেকে উদ্ভুত। প্রকৃতপক্ষে অপ্রদর্শিত বৈধ আয় পরবর্তী কোন একটি আয়কর বিবরণীতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখা খারাপ কেন তা বোধগম্য নয়। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক করহার ছাড়াও জরিমানা আরোপের ব্যবস্থা থাকলে কারও অভিযোগ থাকার কথা নয়। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, করোনার কারণে সৃষ্ট মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে শুল্ক ও করকাঠামো সংস্কার করে বিনিয়োগবান্ধব ও উৎপাদনশীল রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করা জরুরি। ব্যবসাবান্ধব নীতি-পদ্ধতির কথা সভা, সেমিনারে অহর্নিশ উচ্চারিত হলেও তা নীতি নির্ধারকদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না, করজাল বাড়ানোর গুরুত্ব উপলব্ধি করা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়নে গড়িমসির কারণ অজ্ঞাত, ভ্যাট আদায়ে ইলেকট্রনিক মেশিনের ব্যবহার সর্বত্র প্রচলন না করার কারণও অজানা।

দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বা টাকশাল কয়েকবার শীর্ষ ১০ করদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল, প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধান হিসেবে আমাকে কয়েকবার ভিআইপি কার্ডও প্রদান করা হয়। তখন বিস্মিত হয়ে দেখতাম, হাকিমপুরী জর্দা প্রস্তুতকারক প্রতিবারই শ্রেষ্ঠ করদাতা হিসাবে অর্থমন্ত্রীর হাত থেকে ক্রেস্ট নিচ্ছেন। দেশে এত বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে মুখরোচক গল্পের প্রচলন রয়েছে তাদের আয় একটি জর্দা কোম্পানির চেয়ে কম-বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো। সম্পদশালী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এবং সরকারের আমলারা বিদেশে ‘বেগমপাড়া’ গড়ে তোলার টাকা পান কই? সরকারের প্রাপ্য কর ও শুল্ক আদায় হচ্ছে না; কর ফাঁকি দিচ্ছেন একজন, কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন আরেকজন। তারপরও বাংলাদেশ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট থেকে ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেটে পৌঁছতে পেরেছে, এই অর্জন কম নয়।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ১৩ জুন ২০২১ , ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৩১ রজব ১৪৪২

বাজেট ২০২১-২২

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই বাজেট ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল বাজেটের তুলনায় ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি। নতুন অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা এবং এই অর্থ দ্বারা ১ হাজার ৫১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, বনায়ন, উপকূল রক্ষা বাঁধ ইত্যাদির সংস্কার, তৈরি, উন্নয়ন ও নির্মাণে উল্লেখিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। করোনায় পর্যদুস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রস্তাবিত উন্নয়ন বাজেটে পূর্ববর্তী বাজেটের চেয়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যে স্থবিরতা এসেছে তাতে গতি সৃষ্টি করার জন্য, অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য আনার লক্ষ্যে সরকার প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের ব্যবস্থা করে ব্যয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া মতামত ব্যক্ত করে না, কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বাজেটের বিরুদ্ধে কি বলবে তা বাজেট ঘোষণার আগেই ঠিক করে রাখে। আমার বাজেট সম্পর্কে বোধশক্তি জন্মানোর পর থেকেই এই অদ্ভুত রীতি দেখে আসছি। বাজেট পড়ে ধীরেসুস্থে মতামত দেয়ার ধৈর্য কারো নেই। সংসদেও একই চেহারা; সাংসদদের বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করতে দেখা যায় না, বাজেটের বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্টভাবে নতুন প্রস্তাব দেয়ার জন্য কেউ বাজেট পড়ার পরিশ্রম করেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ ফরহাদ বাজেট পর্যালোচনায় একবার সংসদে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের পুনর্বিন্যাস করে সুবিন্যস্ত একটি নতুন বাজেট পেশ করেছিলেন, খাতওয়ারি সংশোধনের বিশদ প্রস্তাব উপস্থাপনের জন্য দীর্ঘ সময় দিতে স্পিকার সম্মত না হলে অন্যান্য সংসদ সদস্যরা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সময় কমরেড ফরদানকে দিয়ে দেন। এবার কেউ কেউ যমুনা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি বড় বড় প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ করে দিয়ে বা বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে করোনা উত্তর পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্থ খরচের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোর কাজে স্থবিরতা এলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাবে, পরবর্তীতে কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করেও সুচারুভাবে প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।

দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রস্তাবিত বাজেটে বড় বড় কোম্পানির কর হার ২% কমানো হয়েছে। বাজেট প্রণেতাদের ধারণা, কর হার কমানো হলে করপোরেটগুলো অধিকতর বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে এবং এতে উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। অবশ্য ছোট ব্যবসায়ীদের করহারও বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কর আদায়ের জটিল প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এবং দুর্নীতির বেড়াজালের কারণে সরকারের প্রত্যাশিত আয় সব সময় হয় না। আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর থেকে আদায় কোন কারণে বাধাগ্রস্ত হলে সরকারকে ব্যয় কমাতে হয়, অথবা ঋণ করে বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে হয়। কিন্তু কিছু ব্যয় আছে যা হ্রাস করা যায় না, সরকারের কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করতেই হয়। ব্যয় কমানো যায় শুধু উন্নয়ন বাজেট থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরেও মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.২%। করোনার মধ্যে এই উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয় বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন; বিশ্ব ব্যাংকের অভিমত হচ্ছে ৫.১% এর বেশি হবে না। কিন্তু চলতি বছরে যে প্রবৃদ্ধি (৫.৩%) বাংলাদেশ অর্জন করেছে তা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের এই প্রবৃদ্ধি অর্জনে, দেশের উন্নয়নে ব্যয় না করলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাবে, উন্নয়নে ব্যয় না হলে মেট্রোরেল হবে না, পদ্মাসেতু হবে না, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে না, নতুন ভবন হবে না, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে না, করোনা রোগীর জন্য নতুন শয্যার সংযোজন হবে না, কর্মহীনদের বেকারত্ব যাবে না।

স্বাস্থ্য খাতে অধিক বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তার কথা অর্থনীতিবিদেরা বারবার বলছেন। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন, অনেকেই মনে করছেন, এই খাতে এবার প্রয়োজনানুযায়ী বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে গতবারের তুলনায় ৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এছাড়ও করোনা মোকাবিলায় এবারও থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে জনগণ ভীতশ্রদ্ধ, তাই এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার। শিক্ষা খাতে কাক্সিক্ষত বরাদ্দ কোন সরকারের আমলেই ছিল না; প্রতি বছরই শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দের জন্য বাজেট সমালোচিত হয়ে থাকে। গতবারের তুলনায় এবার ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। বরাদ্দের এমন বৃদ্ধি প্রায় সব খাতেই হয়েছে। বহু নতুন ব্যবসা ও নতুন শিল্পকে কর রেয়াত দেয়া হয়েছে, দেশের অভ্যন্তরে তৈরি ইলেকট্রনিক সামগ্রীর জন্য কর সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, ক্যান্সারের ওষুধ তৈরির কাঁচামালের শুল্ক হার কমানো হয়েছে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি বাড়ানো হয়েছে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ১২ হাজার থেকে বৃদ্ধি করে ২০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে, বাজেটে আরও ৮ লক্ষ লোককে বয়স্ক ভাতা দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, সব মন্ত্রণালয়ই প্রতি বছর বেশি বেশি বরাদ্দের চাহিদা পেশ করে থাকে, কিন্তু অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ই প্রদত্ত বরাদ্দের সম্পূর্ণ খরচ করতে পারে না। ব্যয় না হওয়ার পেছনেও যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। বাজেট পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দের ছাড়করণ হয় না; কারণ বছরব্যাপী যে কর, শুল্ক ইত্যাদি আদায় হয় তা থেকেই বিভিন্ন খাতে প্রদত্ত বরাদ্দের অর্থের জোগান দিতে হয়। বরাদ্দের অর্থ পাওয়ার পর সংগ্রহ নীতিমালার দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করতে করতেই বছরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যেতে হয়। তাই ব্যয়-সংশিষ্ট কর্মকা- সম্পন্ন করার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে বা বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট কর্মকা- সম্পাদনে লোকবলের সক্ষমতার অভাব হলে উন্নয়ন কর্মকা-ে স্থবিরতা আসবেই। হলি আর্টিজানে জাপানি বিশেষজ্ঞদের নির্মমভাবে হত্যার পর মেট্রোরেল নির্মাণ বহুদিন বন্ধ ছিল। এমন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করা সহজ নয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মচারী-কর্মকর্তার অজ্ঞতা, অক্ষমতা বা কাজের প্রতি অনীহার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়া ক্ষমার অযোগ্য। অথর্ব লোকদের সততাও অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয়। অনেক সৎ লোক আছেন যারা কোন দায়িত্ব নেন না, যথাসময়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। এই লোকগুলো দুর্নীতিবাজের চেয়েও বেশি পরিত্যজ্য। সততা এবং কর্মদক্ষতা দুটিই কর্ম সম্পাদনের জন্য অপরিহার্য।

বহুল কথিত কালোটাকাকে সাদা করার সুবিধা প্রস্তাবিত বাজেটে রাখা হয়েছে কী না, রাখা হলেও তা কীভাবে রাখা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। সম্পদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করার সুযোগ না রেখে শুধু ১০% কর দিয়ে কালোটাকাকে সাদা করার সুযোগ বহু বছর যাবত দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, এই সুযোগ গ্রহণ করেই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কালোটাকাকে সাদা করেছেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী এই অর্থকে কালোটাকা বলতে নারাজ, তার কথা অনুযায়ী এই টাকা অপ্রদর্শিত আয় থেকে উদ্ভুত। প্রকৃতপক্ষে অপ্রদর্শিত বৈধ আয় পরবর্তী কোন একটি আয়কর বিবরণীতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখা খারাপ কেন তা বোধগম্য নয়। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক করহার ছাড়াও জরিমানা আরোপের ব্যবস্থা থাকলে কারও অভিযোগ থাকার কথা নয়। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, করোনার কারণে সৃষ্ট মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে শুল্ক ও করকাঠামো সংস্কার করে বিনিয়োগবান্ধব ও উৎপাদনশীল রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করা জরুরি। ব্যবসাবান্ধব নীতি-পদ্ধতির কথা সভা, সেমিনারে অহর্নিশ উচ্চারিত হলেও তা নীতি নির্ধারকদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না, করজাল বাড়ানোর গুরুত্ব উপলব্ধি করা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়নে গড়িমসির কারণ অজ্ঞাত, ভ্যাট আদায়ে ইলেকট্রনিক মেশিনের ব্যবহার সর্বত্র প্রচলন না করার কারণও অজানা।

দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন বা টাকশাল কয়েকবার শীর্ষ ১০ করদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল, প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধান হিসেবে আমাকে কয়েকবার ভিআইপি কার্ডও প্রদান করা হয়। তখন বিস্মিত হয়ে দেখতাম, হাকিমপুরী জর্দা প্রস্তুতকারক প্রতিবারই শ্রেষ্ঠ করদাতা হিসাবে অর্থমন্ত্রীর হাত থেকে ক্রেস্ট নিচ্ছেন। দেশে এত বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে মুখরোচক গল্পের প্রচলন রয়েছে তাদের আয় একটি জর্দা কোম্পানির চেয়ে কম-বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো। সম্পদশালী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এবং সরকারের আমলারা বিদেশে ‘বেগমপাড়া’ গড়ে তোলার টাকা পান কই? সরকারের প্রাপ্য কর ও শুল্ক আদায় হচ্ছে না; কর ফাঁকি দিচ্ছেন একজন, কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন আরেকজন। তারপরও বাংলাদেশ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট থেকে ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেটে পৌঁছতে পেরেছে, এই অর্জন কম নয়।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com