কোভিড-১৯ : ভ্যাকসিন তৈরি ও কর্মকৌশল

নাজমুল হুদা খান

রোগ ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পেতে মানবদেহে তিন ধাপের প্রতিরক্ষা স্তর (খরহব ড়ভ ফবভবহংব) রয়েছে। প্রতিটি স্তরের ভৌত কিংবা রাসায়নিক প্রতিবন্ধকগুলো জন্ম থেকেই সদা সতর্ক রয়েছে দেহে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করে দিতে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সবচাইতে আলোচিত যুদ্ধ করোনার বৈশি্বক অতিমারী।

মরণঘাতী এ কোভিড-১৯ কে ধ্বংস করতে বিজ্ঞানীরা দ্রুতই আবিষ্কার করেছেন করোনাভাইরাসের মারণাস্ত্র ভ্যাকসিন। এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে প্রায় ৭৫ কোটি লোককে এবং সম্পূর্ণ ডোজ পেয়েছে ৩৮ কোটির বেশি জনসংখ্যা। বাংলাদেশে প্রথম ডোজ নিয়েছে ৫৮,২০,০১৫ জন এবং ডোজ সম্পূর্ণ করেছে ৪১,৪২,২৫৫ জন। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ শতাধিক ভ্যাকসিন প্রস্তুতের বিভিন্ন পর্যায়ে সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে ৭৩টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে, ২৪টি প্রথম পর্যায়ে, ৩৩টি দ্বিতীয় পর্যায়ে এবং ১৫টি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল অবস্থানে বিদ্যমান। ১৬টি ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ফাইজার, মডার্না, কোরভি, করোনা-ভ্যাক, কোভ্যাক্স, ডওইচ-কোভিড, কোভি-ভ্যাক, কাজ-ব্যাক, স্পুতনিক-ভি, স্পুতনিক-লাইট, কোভিশিল্ড, কোভিডেশিয়া, জনসন অ্যান্ড জনসন, এপিভ্যাক করোনা ও আরবিডি-ডাইমার প্রমুখ প্রধান। এ ভ্যাকসিন তৈরির জন্য গতানুগতিক যে পদ্ধতিগুলো বেছে নেয়া হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ।

নিষ্ক্রিয় ভাইরাল ভ্যাকসিন : এ ভ্যাকসিন তৈরিতে জীবাণুর মৃত কোষ ব্যবহার করা হয়, যা শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না; কিন্তু প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। হেপাটাইটিস, পোলিও এবং রেভিস ভ্যাকসিন এ প্রযুক্তির ভ্যাকসিন। কোভিড-১৯ বিরুদ্ধে চীনে তৈরি সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক এবং ভারত রায়োটেকের কোভ্যাকসিন এ প্রক্রিয়ায় তৈরি।

ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন : মানবদেহে ক্ষতিকারক নয় এমন ভাইরাসের কোষে রোগ সৃষ্টিকারি ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান সংযুক্তির মাধ্যমে এ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়। এটি দেহে প্রবেশ করালে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা উদ্দীত্ত হয়ে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনিকা উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন এবং রাশিয়ার গ্যামেলিয়া গবেষণাগার প্রস্তুতকৃত স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিন এ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করা হয়েছে।

আরএনএ ভ্যাকসিন : এ পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন তৈরির সময় কোভিড-১৯ ভাইরাসের কোষের জেনেটিক উপাদান জঘঅ ব্যবহার করা হয়। শরীরে প্রবেশের পর এটি দেহ কোষে এক ধরনের বিশেষ প্রোটিন সৃষ্টি করে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে এন্টিবডি সৃষ্টি করে এবং আক্রান্ত হলে ভাইরাসকে ধ্বংস করে। যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার এবং মডার্না এ শ্রেণীর ভ্যাকসিন।

প্রোটিন ভ্যাকসিন : এ প্রযুক্তিতে ভাইরাসের কোষস্থ প্রোটিনের পুরো অথবা একাংশ ব্যবহার করা হয়। এটি ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর দেহে প্রতিরোধী কোষসমূহ সক্রিয় করে তোলে এবং সংক্রমিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি প্রস্তুত করে রাখে। নোভা ভ্যাক্স এবং স্যানফী জিএসকে ভ্যাকসিন সমূহতে এ টেকনোলজি ব্যবহার করে ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়েছে।

আমাদের দেশ, পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ ও বিশ্বব্যাপী বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং আলোচিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের মধ্যে নিম্নোক্তগুলো অন্যতম।

অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রিটিশ সুইডিশ বহুদেশীয় ওষুধ ও বায়োটেকনোলজি কোম্পানির যৌথ আবিষ্কার অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন। মানবদেহে নিষ্ক্রিয় এডিনো ভাইরাস নামে কোভিড-১৯ ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন সংযুক্তির মাধ্যমে এ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিনের ব্র্যান্ড নাম কোভিশিল্ড। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সিসহ বিভিন্ন দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কর্তৃক ব্যবহারের অনুমাদন পেয়েছে। ২ ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণকারীকে প্রায় ৮৭ শতাংশ কোভিড ভাইরাস বি.১.৬১৭.২ ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। গ্রহণকারীর দেহে মৃদু থেকে মাঝারি পাশর্^প্রতিক্রিয়া ছাড়া তেমন সমস্যা এখন পর্যন্ত গবেষণায় পাওয়া যায়নি। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৬৫টি দেশে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। কর্তৃক দেশে অল্পসংখ্যক রোগীর শরীরে রক্ত জমাটের খবরের পর এ টিকার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তবে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, রক্ত জমাটের ঘটনার সঙ্গে এ টিকার কোন যোগসূত্র নেই। ১২ সপ্তাহ কিংবা তার বেশি সময়ের ব্যবধানে এ টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ কার্যকরী বলে প্রমাণিত এবং ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণে এর কার্যকারিতা অক্ষুণ্ণ থাকে।

সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক : চীনের সিনোফার্ম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি প্রবর্তিত সিনোফার্ম ভ্যাকসিন সম্পতি বাংলাদেশে প্রয়োগের জন্য উপহার হিসেবে ৫ লাখ ডোজ গ্রহণ করেছে। এর ধারাবাহিকতায় আরও ভ্যাকসিন আমদানি করা হবে। সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনও চীনের সিনোভ্যাক বায়ো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন। এ দুটি ভ্যাকসিনই বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বিশ^ব্যাপী ব্যবহারের অনুমোদন প্রদান করেছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস কোষকে ল্যাবে নিষ্ক্রিয় করে এ ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। মোট ২ ডোজের এ ভ্যাকসিন প্রায় ৭৯% কার্যকর বলে প্রমাণিত; তবে সিনোভ্যাক ৬৭% কার্যকর বলে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে প্রমাণিত হয়েছে। ২ ডোজের এ ভ্যাকসিনের তেমন পাশর্^প্রতিক্রিয়া নেই এবং ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা সম্ভব।

ফাইজার বায়োনটেক ভ্যাকসিন : যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার এবং জার্মানির বায়োফার্মাসিউটিক্যাল নিউ টেকনোলজি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয় ফাইজার বায়োনটেক ভ্যাকসিন। করোনাভাইরাসের নিউক্লিওসাইড মডিফাইড মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে এ ভ্যাকসিনের উদ্ভব। ২১ দিনের তফাতে ২ ডোজ ফাইজার ভ্যাকসিন প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর কার্যকর বলে প্রস্তুতকারী কোম্পানির গবেষণা তথ্যে দাবি করা হয়। তবে -৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণের বিষয়টি তৃতীয় বিশে^র দেশসমূহের জন্য চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ফাইজার বায়োনটেকের এক লক্ষ ছয় হাজার ভ্যাকসিন পৌঁছেছে।

জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন : অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ন্যায় এডিনোভাইরাস ভেক্টর প্ল্যাটফর্ম প্রযুক্তিতে এ ভ্যাকসিন তৈরি। নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ কোম্পানির ভ্যাকসিনের একমাত্র ডোজ প্রায় ৬৬% কার্যকর এবং সাধারণ ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণযোগ্য। অন্যান্য ভ্যাকসিনের ন্যায় এটিরও রয়েছে মৃদু থেকে মাঝারি পর্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

মডার্না ভ্যাকসিন : ফাইজার বায়োনটেক ভ্যাকসিন ন্যায় একই প্রযুক্তির মডার্না ভ্যাকসিন। যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ফার্মাসিউটিক্যাল, জাতীয় এনার্জি ও সংক্রামক ব্যাধি সংস্থা এবং বায়োমেডিকেল অ্যাডভান্সড গবেষণা ও উন্নয়ন অথরিটির যৌথ উদ্যোগে এটির উদ্ভব। প্রস্তুতকারী সংস্থাসমূহের দাবি মডার্না ভ্যাকসিন প্রায় ৯৪% কার্যকর। চার সপ্তাহ অন্তর ২ ডোজের এ ভ্যাকসিন ও প্রায় -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। এই ভ্যাকসিনেরও মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।

বিশ^ব্যাপী একদিকে যেমন নানা প্রযুক্তি ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে করোনাভাইরাসকে ধ্বংসের জন্য, অন্যদিকে এ বিধ্বংসী ভাইরাসটিও বসে নেই। বিভিন্ন দেশে হাজারো ধরনের ভ্যারিয়েন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে এ ভাইরাস। তাই এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ কৌশল নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো। আশার কথা হচ্ছে এ পর্যন্ত প্রয়োগকৃত সব ভ্যাকসিনই প্রায় সফলভাবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধ করছে। যদিও একেক ভ্যাকসিন এক এক ধরনের স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কার্যকর বলে প্রমাণিত, তথাপি সব ভ্যাকসিনই গ্রহনকারীর তীব্র অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার কমাতে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগের পর কোভিড-১৯ পূববর্তী জীবনযাত্রায় ফিরে যাচ্ছে। তথাপি এ মরণব্যাধি ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পেতে ভ্যাকসিন গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মেনে চলতে হবে।

[লেখক : সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

রবিবার, ১৩ জুন ২০২১ , ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৩১ রজব ১৪৪২

কোভিড-১৯ : ভ্যাকসিন তৈরি ও কর্মকৌশল

নাজমুল হুদা খান

image

রোগ ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পেতে মানবদেহে তিন ধাপের প্রতিরক্ষা স্তর (খরহব ড়ভ ফবভবহংব) রয়েছে। প্রতিটি স্তরের ভৌত কিংবা রাসায়নিক প্রতিবন্ধকগুলো জন্ম থেকেই সদা সতর্ক রয়েছে দেহে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করে দিতে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সবচাইতে আলোচিত যুদ্ধ করোনার বৈশি্বক অতিমারী।

মরণঘাতী এ কোভিড-১৯ কে ধ্বংস করতে বিজ্ঞানীরা দ্রুতই আবিষ্কার করেছেন করোনাভাইরাসের মারণাস্ত্র ভ্যাকসিন। এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে প্রায় ৭৫ কোটি লোককে এবং সম্পূর্ণ ডোজ পেয়েছে ৩৮ কোটির বেশি জনসংখ্যা। বাংলাদেশে প্রথম ডোজ নিয়েছে ৫৮,২০,০১৫ জন এবং ডোজ সম্পূর্ণ করেছে ৪১,৪২,২৫৫ জন। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ শতাধিক ভ্যাকসিন প্রস্তুতের বিভিন্ন পর্যায়ে সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে ৭৩টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে, ২৪টি প্রথম পর্যায়ে, ৩৩টি দ্বিতীয় পর্যায়ে এবং ১৫টি তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল অবস্থানে বিদ্যমান। ১৬টি ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ফাইজার, মডার্না, কোরভি, করোনা-ভ্যাক, কোভ্যাক্স, ডওইচ-কোভিড, কোভি-ভ্যাক, কাজ-ব্যাক, স্পুতনিক-ভি, স্পুতনিক-লাইট, কোভিশিল্ড, কোভিডেশিয়া, জনসন অ্যান্ড জনসন, এপিভ্যাক করোনা ও আরবিডি-ডাইমার প্রমুখ প্রধান। এ ভ্যাকসিন তৈরির জন্য গতানুগতিক যে পদ্ধতিগুলো বেছে নেয়া হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ।

নিষ্ক্রিয় ভাইরাল ভ্যাকসিন : এ ভ্যাকসিন তৈরিতে জীবাণুর মৃত কোষ ব্যবহার করা হয়, যা শরীরে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না; কিন্তু প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। হেপাটাইটিস, পোলিও এবং রেভিস ভ্যাকসিন এ প্রযুক্তির ভ্যাকসিন। কোভিড-১৯ বিরুদ্ধে চীনে তৈরি সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক এবং ভারত রায়োটেকের কোভ্যাকসিন এ প্রক্রিয়ায় তৈরি।

ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন : মানবদেহে ক্ষতিকারক নয় এমন ভাইরাসের কোষে রোগ সৃষ্টিকারি ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান সংযুক্তির মাধ্যমে এ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়। এটি দেহে প্রবেশ করালে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা উদ্দীত্ত হয়ে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনিকা উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন এবং রাশিয়ার গ্যামেলিয়া গবেষণাগার প্রস্তুতকৃত স্পুতনিক-ভি ভ্যাকসিন এ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করা হয়েছে।

আরএনএ ভ্যাকসিন : এ পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন তৈরির সময় কোভিড-১৯ ভাইরাসের কোষের জেনেটিক উপাদান জঘঅ ব্যবহার করা হয়। শরীরে প্রবেশের পর এটি দেহ কোষে এক ধরনের বিশেষ প্রোটিন সৃষ্টি করে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে এন্টিবডি সৃষ্টি করে এবং আক্রান্ত হলে ভাইরাসকে ধ্বংস করে। যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার এবং মডার্না এ শ্রেণীর ভ্যাকসিন।

প্রোটিন ভ্যাকসিন : এ প্রযুক্তিতে ভাইরাসের কোষস্থ প্রোটিনের পুরো অথবা একাংশ ব্যবহার করা হয়। এটি ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর দেহে প্রতিরোধী কোষসমূহ সক্রিয় করে তোলে এবং সংক্রমিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি প্রস্তুত করে রাখে। নোভা ভ্যাক্স এবং স্যানফী জিএসকে ভ্যাকসিন সমূহতে এ টেকনোলজি ব্যবহার করে ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়েছে।

আমাদের দেশ, পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ ও বিশ্বব্যাপী বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং আলোচিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের মধ্যে নিম্নোক্তগুলো অন্যতম।

অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রিটিশ সুইডিশ বহুদেশীয় ওষুধ ও বায়োটেকনোলজি কোম্পানির যৌথ আবিষ্কার অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন। মানবদেহে নিষ্ক্রিয় এডিনো ভাইরাস নামে কোভিড-১৯ ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন সংযুক্তির মাধ্যমে এ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিনের ব্র্যান্ড নাম কোভিশিল্ড। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সিসহ বিভিন্ন দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কর্তৃক ব্যবহারের অনুমাদন পেয়েছে। ২ ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণকারীকে প্রায় ৮৭ শতাংশ কোভিড ভাইরাস বি.১.৬১৭.২ ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। গ্রহণকারীর দেহে মৃদু থেকে মাঝারি পাশর্^প্রতিক্রিয়া ছাড়া তেমন সমস্যা এখন পর্যন্ত গবেষণায় পাওয়া যায়নি। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৬৫টি দেশে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। কর্তৃক দেশে অল্পসংখ্যক রোগীর শরীরে রক্ত জমাটের খবরের পর এ টিকার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তবে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, রক্ত জমাটের ঘটনার সঙ্গে এ টিকার কোন যোগসূত্র নেই। ১২ সপ্তাহ কিংবা তার বেশি সময়ের ব্যবধানে এ টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ কার্যকরী বলে প্রমাণিত এবং ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণে এর কার্যকারিতা অক্ষুণ্ণ থাকে।

সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক : চীনের সিনোফার্ম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি প্রবর্তিত সিনোফার্ম ভ্যাকসিন সম্পতি বাংলাদেশে প্রয়োগের জন্য উপহার হিসেবে ৫ লাখ ডোজ গ্রহণ করেছে। এর ধারাবাহিকতায় আরও ভ্যাকসিন আমদানি করা হবে। সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনও চীনের সিনোভ্যাক বায়ো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন। এ দুটি ভ্যাকসিনই বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বিশ^ব্যাপী ব্যবহারের অনুমোদন প্রদান করেছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস কোষকে ল্যাবে নিষ্ক্রিয় করে এ ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। মোট ২ ডোজের এ ভ্যাকসিন প্রায় ৭৯% কার্যকর বলে প্রমাণিত; তবে সিনোভ্যাক ৬৭% কার্যকর বলে দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে প্রমাণিত হয়েছে। ২ ডোজের এ ভ্যাকসিনের তেমন পাশর্^প্রতিক্রিয়া নেই এবং ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা সম্ভব।

ফাইজার বায়োনটেক ভ্যাকসিন : যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার এবং জার্মানির বায়োফার্মাসিউটিক্যাল নিউ টেকনোলজি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয় ফাইজার বায়োনটেক ভ্যাকসিন। করোনাভাইরাসের নিউক্লিওসাইড মডিফাইড মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে এ ভ্যাকসিনের উদ্ভব। ২১ দিনের তফাতে ২ ডোজ ফাইজার ভ্যাকসিন প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর কার্যকর বলে প্রস্তুতকারী কোম্পানির গবেষণা তথ্যে দাবি করা হয়। তবে -৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণের বিষয়টি তৃতীয় বিশে^র দেশসমূহের জন্য চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ফাইজার বায়োনটেকের এক লক্ষ ছয় হাজার ভ্যাকসিন পৌঁছেছে।

জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন : অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ন্যায় এডিনোভাইরাস ভেক্টর প্ল্যাটফর্ম প্রযুক্তিতে এ ভ্যাকসিন তৈরি। নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ কোম্পানির ভ্যাকসিনের একমাত্র ডোজ প্রায় ৬৬% কার্যকর এবং সাধারণ ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণযোগ্য। অন্যান্য ভ্যাকসিনের ন্যায় এটিরও রয়েছে মৃদু থেকে মাঝারি পর্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

মডার্না ভ্যাকসিন : ফাইজার বায়োনটেক ভ্যাকসিন ন্যায় একই প্রযুক্তির মডার্না ভ্যাকসিন। যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ফার্মাসিউটিক্যাল, জাতীয় এনার্জি ও সংক্রামক ব্যাধি সংস্থা এবং বায়োমেডিকেল অ্যাডভান্সড গবেষণা ও উন্নয়ন অথরিটির যৌথ উদ্যোগে এটির উদ্ভব। প্রস্তুতকারী সংস্থাসমূহের দাবি মডার্না ভ্যাকসিন প্রায় ৯৪% কার্যকর। চার সপ্তাহ অন্তর ২ ডোজের এ ভ্যাকসিন ও প্রায় -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। এই ভ্যাকসিনেরও মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।

বিশ^ব্যাপী একদিকে যেমন নানা প্রযুক্তি ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে করোনাভাইরাসকে ধ্বংসের জন্য, অন্যদিকে এ বিধ্বংসী ভাইরাসটিও বসে নেই। বিভিন্ন দেশে হাজারো ধরনের ভ্যারিয়েন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে এ ভাইরাস। তাই এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ কৌশল নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো। আশার কথা হচ্ছে এ পর্যন্ত প্রয়োগকৃত সব ভ্যাকসিনই প্রায় সফলভাবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধ করছে। যদিও একেক ভ্যাকসিন এক এক ধরনের স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কার্যকর বলে প্রমাণিত, তথাপি সব ভ্যাকসিনই গ্রহনকারীর তীব্র অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার কমাতে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগের পর কোভিড-১৯ পূববর্তী জীবনযাত্রায় ফিরে যাচ্ছে। তথাপি এ মরণব্যাধি ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পেতে ভ্যাকসিন গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মেনে চলতে হবে।

[লেখক : সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]