বাজেটে উপেক্ষিত আদিবাসীরা

মিথুশিলাক মুরমু

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ কথা ভেবে আমরা অনেকটা আশস্ত হই যে, দেশের সুশীল সমাজ রাষ্ট্রীয় বাজেটে আদিবাসীদের উপেক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছেন। পিছিয়ে পড়া আদিবাসী অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে তাদের যে আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ, আদিবাসীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেটি ব্যক্ত করেছেন। সুশীল সমাজের এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা কাছ থেকে আদিবাসীদের জীবন সংগ্রাম, বঞ্চনা, অবহেলা এবং রাজনৈতিকভাবেও অপাংক্তেয় হিসেবেই পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীগুলোর খোঁজ পড়ে শুধু নির্বাচনের প্রাক্কালে; প্রয়োজনের তাগিদে, বাকিদিনগুলোতে উদয়স্ত হস্তেই পরিবারের চাকাকে ঘোরাতে ব্যস্ত থাকেন। বিগত কয়েকদিনে দু’একজন আদিবাসী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বাজেট নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রের বিষয়াদিতে তাদের কোন আগ্রহ নেই, কোন খাতে কত বরাদ্দ কিংবা কেন বরাদ্দ নেই; সেটিও জানার অনীহা দেখেছি। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে- রাষ্ট্র তার নৈতিকতার দায়বদ্ধতা থেকেই আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন; তবে সেটিতে ফাঁক থেকে গেছে। সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ এই অস্বচ্ছ জায়গাটিতেই স্বচ্ছতায় আনার লক্ষ্যে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরকারকে উৎসাহিত করেছেন। গণতান্ত্রিক সরকারের চিন্তা-চেতনা ও পরিকল্পনা সর্বস্তরের জনবান্ধব না হলে, উন্নয়ন ধারা শিখরের দিকে এগুবে; অপরদিকে বঞ্চিতরা বঞ্চনার তলানিতেই থেকে যাবে। বাজেট উপস্থাপনের পূর্বেই সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের মতামত জানিয়েছিলেন কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই দেখেছি। রাষ্ট্রীয় বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও আদিবাসীদের বিষয়টি তিমিরেই রয়ে গেল। নিচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কিছু মতামত তুলে ধরছি :

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, ‘আমাদের দলীয় কমিটমেন্ট আছে। কিন্তু কিছু বাস্তব বিষয় আছে, যা মাঠে গিয়ে মোকাবিলা করতে হয়। তখন পরিস্থিতির কারণে সব সময় সবকিছু আমরা পারি না। আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থানের দিকে আদিবাসীদের এগিয়ে আনতে হবে। কোটা থাকতে হবে আরও কিছুদিন। আদিবাসীদের চাহিদার প্রতিফলন যাতে বাজেটে পড়ে সেই চেষ্টা করা হবে’

সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বাজেট আলোচনায় বলেছেন, ‘বাজেটের বিষয়ে প্রতি বছরই এই ধরনের আলোচনা করা হয়। এখন উদ্যোগ নেয়াই মূল বিষয়। গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বরাদ্দ পাচ্ছে কি না তা দেখাই এখন মূল কাজ। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ শান্তিচুক্তি করার জন্য, কিন্তু এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। একের পর এক উদ্যোগের কথা বলা হয় কিন্তু বাস্তবায়ন আর হয় না। আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাজেট সামনে রেখে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সুপারিশ শীর্ষক আলোচনায় বলেন, ‘পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর শিক্ষায় অগ্রাধিকার দিতে হবে’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘করোনার কারণে যেসব আর্থিক প্রণোদনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার বেশিরভাগই ঋণনির্ভর এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রত্যক্ষ সহায়তা খুব কম। এসব দরিদ্র মানুষের জন্য প্রকৃত বরাদ্দ বাড়াতে হবে’

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেছিলেন, ‘বাজেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে আনার উদ্যোগ দরকার। আদিবাসী, দলিত, হরিজন, প্রতিবন্ধী, বেদে ও জেলেদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দরকার’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশ বহু জাতির দেশ। এই কথা বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। শান্তিচুক্তির কারণে যে সুফল আমাদের পাওয়ার কথা তা আমরা পাচ্ছি না। এ বছরের বাজেটে যারা নিগৃহীত জাতি তাদের গুরুত্ব দেয়া, তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দ করা দরকার। সমতলের আদিবাসীরা অনেক বেশি অবহেলিত। মন্ত্রণালয়ে যদি দুটি ভাগ করা যায় সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসী, তাহলে সমতলের আদিবাসীরা গুরুত্ব পেতে পারে’

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেছেন, ‘করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। আগামী দিনগুলোতে করোনা আরও ভয়ংকর হলে এ দেশের মানুষের ক্ষতি আরও বাড়বে। গত এক বছরে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে দেড় থেকে দ্বিগুণ মানুষ। ফলে প্রান্তিক শ্রেণীর প্রতি বৈষম্য বেড়েছে। ... স্বাভাবিক সময়ের বাজেটেও দেখা গেছে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি ন্যায্য বরাদ্দ দেয়া হয় না। এবারের করোনাকালের বাজেট আঁটসাঁট-সংকুচিত হতে পারে। ফলে এবারের বাজেটেও দরিদ্র শ্রেণীর জন্য অপর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকবে সে শঙ্কা অমূলক নয়। মূলত : দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রভাব-প্রতিপত্তি কম এবং তাদের অধিকার আদায়ের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ, এ কারণেই গত ৫০ বছরে ঘোষিত বাজেটগুলোতে তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়নি’

বিগত বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট ধরা হয়েছিল ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সেই বছরও অনেকেই আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দিকে সরকারকে বিশেষ নজর দেয়ার সুপারিশ ও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কখনো কখনো মনে হয়, সরকার আদিবাসীদের বিষয়ে উদাসীন কিংবা তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তির গত বছর বলা কিছু মন্তব্য তুলে ধরছি:

আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, ‘সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ২০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ৮০ কোটি টাকা বার্ষিক বরাদ্দ এলে কিছুই না। তাদের উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ দরকার। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য যেহেতু এখনও কোনো মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় একটি অধিদপ্তর খুলে বাজেট বরাদ্দ বাস্তবায়ন করা দরকার’

সরকারি সংগঠন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘যাদের জন্য বাজেট তাদের বাজেট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরাসরি যুক্ত করতে না পারলে লাভ নেই। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য শুধু বরাদ্দ রাখলে হবে না, বাজেট বাস্তবায়নের সুষ্ঠু পর্যালোচনাও থাকা উচিত। আমলানির্ভর বাজেট না করে দেশের সব শ্রেণীর লোকজনকে যুক্ত করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে বাজেট নির্ধারণের দাবি জানান তিনি’

আমরা বরাবর দেখে আসছি, জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ বাজেট পরিমাণ সীমিত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা’ বরাদ্দ থাকলেও সেটিতেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি টাকা মাত্র। প্রতিজনের ভাগে বরাদ্দ ছিল ২৫০ টাকা করে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেছেন, ‘প্রতি বছরই বাজেটের পরিধি বাড়ছে। একদিন হয়তো ১০ লাখ কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যাবে আমাদের বাজেট। কিন্তু এ ক্রমবর্ধমান বাজেটের কোন প্রতিফলন আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে পড়েনি।’

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার শেষান্তে বলেছেন- ‘...আমাদের এবারের বাজেটেও দেশ ও জাতির উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাধিকার পাচ্ছে দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ- প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবন জীবিকা।’ আমরা মনে করি, আদিবাসীদের উন্নয়নে সরকারকে ইতিবাচক বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজেট কার্যক্রমে আদিবাসীদের কোনো অংশগ্রহণ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ থাকলে সরকারই লাভবান হতো। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ভাষাতেই আমরাও বলতে চাই- ‘আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি জাতির পিতার তুলিতে আঁকা স্বপ্ন সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাবে, এগিয়ে যাবে অনেক দূর- বহুদূর, বহুদূর ... নিরন্তর।’

রবিবার, ১৩ জুন ২০২১ , ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৩১ রজব ১৪৪২

বাজেটে উপেক্ষিত আদিবাসীরা

মিথুশিলাক মুরমু

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ কথা ভেবে আমরা অনেকটা আশস্ত হই যে, দেশের সুশীল সমাজ রাষ্ট্রীয় বাজেটে আদিবাসীদের উপেক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছেন। পিছিয়ে পড়া আদিবাসী অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে তাদের যে আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ, আদিবাসীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেটি ব্যক্ত করেছেন। সুশীল সমাজের এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা কাছ থেকে আদিবাসীদের জীবন সংগ্রাম, বঞ্চনা, অবহেলা এবং রাজনৈতিকভাবেও অপাংক্তেয় হিসেবেই পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীগুলোর খোঁজ পড়ে শুধু নির্বাচনের প্রাক্কালে; প্রয়োজনের তাগিদে, বাকিদিনগুলোতে উদয়স্ত হস্তেই পরিবারের চাকাকে ঘোরাতে ব্যস্ত থাকেন। বিগত কয়েকদিনে দু’একজন আদিবাসী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বাজেট নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রের বিষয়াদিতে তাদের কোন আগ্রহ নেই, কোন খাতে কত বরাদ্দ কিংবা কেন বরাদ্দ নেই; সেটিও জানার অনীহা দেখেছি। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে- রাষ্ট্র তার নৈতিকতার দায়বদ্ধতা থেকেই আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন; তবে সেটিতে ফাঁক থেকে গেছে। সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ এই অস্বচ্ছ জায়গাটিতেই স্বচ্ছতায় আনার লক্ষ্যে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরকারকে উৎসাহিত করেছেন। গণতান্ত্রিক সরকারের চিন্তা-চেতনা ও পরিকল্পনা সর্বস্তরের জনবান্ধব না হলে, উন্নয়ন ধারা শিখরের দিকে এগুবে; অপরদিকে বঞ্চিতরা বঞ্চনার তলানিতেই থেকে যাবে। বাজেট উপস্থাপনের পূর্বেই সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের মতামত জানিয়েছিলেন কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই দেখেছি। রাষ্ট্রীয় বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও আদিবাসীদের বিষয়টি তিমিরেই রয়ে গেল। নিচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কিছু মতামত তুলে ধরছি :

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, ‘আমাদের দলীয় কমিটমেন্ট আছে। কিন্তু কিছু বাস্তব বিষয় আছে, যা মাঠে গিয়ে মোকাবিলা করতে হয়। তখন পরিস্থিতির কারণে সব সময় সবকিছু আমরা পারি না। আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থানের দিকে আদিবাসীদের এগিয়ে আনতে হবে। কোটা থাকতে হবে আরও কিছুদিন। আদিবাসীদের চাহিদার প্রতিফলন যাতে বাজেটে পড়ে সেই চেষ্টা করা হবে’

সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বাজেট আলোচনায় বলেছেন, ‘বাজেটের বিষয়ে প্রতি বছরই এই ধরনের আলোচনা করা হয়। এখন উদ্যোগ নেয়াই মূল বিষয়। গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বরাদ্দ পাচ্ছে কি না তা দেখাই এখন মূল কাজ। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ শান্তিচুক্তি করার জন্য, কিন্তু এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। একের পর এক উদ্যোগের কথা বলা হয় কিন্তু বাস্তবায়ন আর হয় না। আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাজেট সামনে রেখে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সুপারিশ শীর্ষক আলোচনায় বলেন, ‘পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর শিক্ষায় অগ্রাধিকার দিতে হবে’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘করোনার কারণে যেসব আর্থিক প্রণোদনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার বেশিরভাগই ঋণনির্ভর এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রত্যক্ষ সহায়তা খুব কম। এসব দরিদ্র মানুষের জন্য প্রকৃত বরাদ্দ বাড়াতে হবে’

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেছিলেন, ‘বাজেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে আনার উদ্যোগ দরকার। আদিবাসী, দলিত, হরিজন, প্রতিবন্ধী, বেদে ও জেলেদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দরকার’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশ বহু জাতির দেশ। এই কথা বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। শান্তিচুক্তির কারণে যে সুফল আমাদের পাওয়ার কথা তা আমরা পাচ্ছি না। এ বছরের বাজেটে যারা নিগৃহীত জাতি তাদের গুরুত্ব দেয়া, তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দ করা দরকার। সমতলের আদিবাসীরা অনেক বেশি অবহেলিত। মন্ত্রণালয়ে যদি দুটি ভাগ করা যায় সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসী, তাহলে সমতলের আদিবাসীরা গুরুত্ব পেতে পারে’

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেছেন, ‘করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। আগামী দিনগুলোতে করোনা আরও ভয়ংকর হলে এ দেশের মানুষের ক্ষতি আরও বাড়বে। গত এক বছরে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে দেড় থেকে দ্বিগুণ মানুষ। ফলে প্রান্তিক শ্রেণীর প্রতি বৈষম্য বেড়েছে। ... স্বাভাবিক সময়ের বাজেটেও দেখা গেছে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি ন্যায্য বরাদ্দ দেয়া হয় না। এবারের করোনাকালের বাজেট আঁটসাঁট-সংকুচিত হতে পারে। ফলে এবারের বাজেটেও দরিদ্র শ্রেণীর জন্য অপর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকবে সে শঙ্কা অমূলক নয়। মূলত : দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রভাব-প্রতিপত্তি কম এবং তাদের অধিকার আদায়ের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ, এ কারণেই গত ৫০ বছরে ঘোষিত বাজেটগুলোতে তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়নি’

বিগত বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট ধরা হয়েছিল ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সেই বছরও অনেকেই আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দিকে সরকারকে বিশেষ নজর দেয়ার সুপারিশ ও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কখনো কখনো মনে হয়, সরকার আদিবাসীদের বিষয়ে উদাসীন কিংবা তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তির গত বছর বলা কিছু মন্তব্য তুলে ধরছি:

আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, ‘সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ২০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ৮০ কোটি টাকা বার্ষিক বরাদ্দ এলে কিছুই না। তাদের উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ দরকার। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য যেহেতু এখনও কোনো মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় একটি অধিদপ্তর খুলে বাজেট বরাদ্দ বাস্তবায়ন করা দরকার’

সরকারি সংগঠন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘যাদের জন্য বাজেট তাদের বাজেট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরাসরি যুক্ত করতে না পারলে লাভ নেই। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য শুধু বরাদ্দ রাখলে হবে না, বাজেট বাস্তবায়নের সুষ্ঠু পর্যালোচনাও থাকা উচিত। আমলানির্ভর বাজেট না করে দেশের সব শ্রেণীর লোকজনকে যুক্ত করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে বাজেট নির্ধারণের দাবি জানান তিনি’

আমরা বরাবর দেখে আসছি, জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ বাজেট পরিমাণ সীমিত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা’ বরাদ্দ থাকলেও সেটিতেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি টাকা মাত্র। প্রতিজনের ভাগে বরাদ্দ ছিল ২৫০ টাকা করে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেছেন, ‘প্রতি বছরই বাজেটের পরিধি বাড়ছে। একদিন হয়তো ১০ লাখ কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যাবে আমাদের বাজেট। কিন্তু এ ক্রমবর্ধমান বাজেটের কোন প্রতিফলন আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে পড়েনি।’

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার শেষান্তে বলেছেন- ‘...আমাদের এবারের বাজেটেও দেশ ও জাতির উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাধিকার পাচ্ছে দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ- প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবন জীবিকা।’ আমরা মনে করি, আদিবাসীদের উন্নয়নে সরকারকে ইতিবাচক বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজেট কার্যক্রমে আদিবাসীদের কোনো অংশগ্রহণ নেই বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ থাকলে সরকারই লাভবান হতো। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ভাষাতেই আমরাও বলতে চাই- ‘আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি জাতির পিতার তুলিতে আঁকা স্বপ্ন সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাবে, এগিয়ে যাবে অনেক দূর- বহুদূর, বহুদূর ... নিরন্তর।’