নেপথ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে খুন

সম্পত্তি নিয়ে ভাই ও ভাতিজার কাছ থেকে প্রতারিত ও লাঞ্ছিত হন ফারুক মিয়া। ভাই জীবিত থাকতে এ নিয়ে কোন কথা না বললেও ভাইয়ের মৃত্যুর পর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন তিনি। ভাতিজা একেএম মনজিলকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়ার পাশাপাশি খোয়া যাওয়া সম্পদ নিজের ভোগদখলে নেয়ার পরিকল্পনা করেন।

অন্যদিকে মনজিলের মাকে হত্যা করিয়ে তার বাবাকে বিয়ে করেন খালা লায়লা ইয়াসমিন লিপি। বোনের মৃত্যুর পর তার স্বর্ণলঙ্কারও নিজের দখলে নেন। এ নিয়ে বিরোধ তৈরি হয় সৎছেলে মনজিলের সঙ্গে। চাচা ও সৎমায়ের সঙ্গে পারিবারিক এসব ঝামেলায় শেষ পর্যন্ত মায়ের মতো তাকেও খুন হতে হয়। সাড়ে ৩ বছর পর মনজিল হত্যার তদন্তে এমন পারিবারিক কলহের কারণ খুঁজে পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।

গত ২ মাসে হত্যায় জড়িত ৩ ভাড়াটে কিলারসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও এখনও অধরা রয়ে গেছেন খুনের পরিকল্পনায় যুক্ত ৩ পরিকল্পনাকারী চাচা, মামা এবং সৎমা। তাদের গ্রেপ্তার করতে মাঠে নেমেছে সিআইডি।

২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজধানীর আফতাবনগরে খুন হন মনজুল হক ময়না মিয়ার প্রথম ঘরের ছেলে এসএম মনজিল। এ হত্যার ঘটনায় মনজিলের আপন চাচা ফারুক মিয়া বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় ঘটনার পরদিন একটি মামলা করেন। দীর্ঘ তদন্ত করেও পুলিশ কোন ক্লু উদ্ঘাটন করতে না পারায় ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ পুলিশ সদর দপ্তর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব সিআইডিকে দেয়। সিআইডির ঢাকা মেট্টো ইউনিট মামলাটি তদন্ত শুরু করে। তদন্ত করে সর্বশেষ ভাড়াটে কিলার সীমান্ত হাসান তাকবিরকে গ্রেপ্তার করা হয় শনিবার রাতে। এর আগে এ হত্যার ঘটনায় ২ ভাড়াটে কিলার রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুল ইসলাম রাকিব এবং হত্যার মূল নেতৃত্ব দেয়া মনজিলের সৎভাই মোহাম্মদ ইয়াসিনকে গ্রেপ্তার করা। তবে এখনও অধরা রয়ে গেছে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মনজিলের চাচা ফারুক মিয়া, সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপি এবং সৎমামা আবু ইউছুফ।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক গতকাল সাংবাদিকদের জানান, আপন ভাইয়ের কাছ থেকে ফ্ল্যাট কিনে প্রতারিত ও লাঞ্ছিত হয় ফারুক মিয়া। এর জের ধরে প্রতিশোধ নিতে ভাইয়ের ছেলেকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভাড়াটে কিলারদের ব্যবহার করেন। হত্যাকাণ্ডের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কিলারদের ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।

সিআইডি জানিয়েছে, হত্যা মামলাটি সিআইডিতে আসার পর মামলার বাদী মনজিলের চাচা ফারুক মিয়া সিআইডিকে নানাভাবে অসহযোগিতা করে। মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। অন্যদিকে মনজিল খুন হওয়ার পর থেকেই তার সৎভাই ইয়াছিন নিখোঁজ ছিল। ইয়াছিন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় তার আপন মামা আবু ইউছুপ বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সিআইডির কাছে মনে হয়েছিল মনজিল হত্যার সঙ্গে ইয়াছিনের নিখোঁজ হওয়ার একটি যোগসূত্র রয়েছে। কিন্তু ইয়াছিনকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা অপহরণ করে লাশ গুম করেছে, ইয়াছিনকে না পেলে এ মামলার কোন রহস্য উদ্ঘাটন হবে না এমন জোর দাবি করে আসছিল মামলার বাদী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ফারুক মিয়া। বাদীর এমন আচরণে সিআইডির সন্দেহ হয়। তারা প্রথমে ইয়াছিন নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটনে জোর দেয়। সিআইডির তদন্তেই বেরিয়ে আসে আসলে ইয়াছিন নিখোঁজ হয়নি। নাম পরিবর্তন করে চট্টগ্রামে একটি আঞ্চলিক পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন।

গত মার্চ মাসে ইয়াছিনকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কারণ, জড়িতদের নাম, পরিকল্পনা সবকিছু প্রকাশ করে ইয়াছিন। ইয়াছিনের দেয়া তথ্যে ভাড়াটে কিলার ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতোমধ্যে ইয়াছিন, রাকিব সিয়াম আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। আর সর্বশেষ গ্রেপ্তার তাকবীর আদালতে জবানবন্দি দিতে সম্মত হয়েছে।

সিআইডি জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত ৩ আসামি বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে বলেছে মনজিল হককে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করা হয়। এরপর পেটে ছুরিকাঘাত করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুই হাতের ও পায়ের রগ কেটে ফেলা হয়। ঘটনার আগের দিন ভাড়াটে ৩ খুনি ইয়াসিন হকের বনশ্রীস্থ পৈত্রিক ফ্ল্যাটে রাত্রি যাপন করে। ইয়াসিন হকের মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, মামলার বাদী ফারুক মিয়া ও ইয়াসিন হকের মামা আবু ইউসুফ নয়ন ভাড়াটে খুনি সরদার রবিউল ইসলাম সিয়ামকে নিয়ে গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি কিভাবে মনজিলকে হত্যা করা হবে তার একটি দিকনির্দেশনা দেন। এ হত্যায় চুক্তি হয় ৫ লাখ টাকায়।

সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ভাড়াটে খুনি রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব ও সীমান্ত হাসান তাকবিরকে হত্যায় সহযোগিতা করে সৎভাই ইয়াছিন। আর পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছিল মনজিলের সৎমা ও খালা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, মামা আবু ইউসুফ নয়ন এবং মামলার বাদী ফারুক মিয়া।

ঘটনার আগে ইয়াসিন হক তার মামা আবু ইউসুফ নয়নের সঙ্গে মনজিল হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করলে তিনি তাতে সম্মতি প্রকাশ করেন। খুনের কাজে ব্যয় করার জন্য তাকে নগদ ২০ হাজার টাকা দেন মামা ইউসুফ মিয়া। ওই টাকা দিয়ে ইয়াসিন ভাড়াটে খুনি সরদার রবিউল ইসলাম সিয়ামকে নিয়ে ঘটনার ৮ থেকে ১০ দিন আগে নিউ মার্কেটের ফুটপাত হতে খুনের কাজে ব্যবহারের জন্য দুটি ধারালো চাকু, পাটের রশি এবং এগুলো বহনের জন্য একটি রেক্সিনের ব্যাগ ক্রয় করে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাকু, রেক্সিনের ব্যাগ ও রশি এবং খুনিদের ফেলে যাওয়া রক্তমাখা কাপড়-চোপড় সিআইডি ডিএনএ ল্যাবের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। তাতে ৫ জন পুরুষ ব্যক্তির উপস্থিতি পাওয়া যায়।

আসামি ইয়াসিন হক মনজিলকে খুন করার পর তার রক্তমাখা কাপড়-চোপড় আফতাব নগরস্থ খালে ফেলে দেয় বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করে। অন্যান্য ভাড়াটে খুনিরা তাদের রক্তমাখা কাপড়-চোপড় ঘটনাস্থলে ফেলে মনজিল হকের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় পড়ে পালিয়ে যায়।

মামলা তদন্তকালে আরও জানা যায়, মনজিলের বয়স যখন ৩ থেকে ৪ বছর, তখন মনজিলের বাবার সঙ্গে খালাত শ্যালিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে লায়লা ইয়াসমিন লিপির প্ররোচনায় মনজিলের বাবা মইনুল হক তার শান্তিনগরন্থ বাসায় মনজিলের মা সাদিয়া পারভীন কাজলের গায়ে কোরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মনজিলের মা সাদিয়া পারভীন কাজল মৃত্যুবরণ করেন। মনজিলের পিতা গ্যাসের চুলা থেকে মনজিলের মায়ের পরনের কাপড়ে আগুন ধরিয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে চালিয়ে দেয়। মনজিলের মায়ের মৃত্যুর পরের বছর মনজিলের পিতা মনা তার প্রেমিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপিকে বিয়ে করে ঘরসংসার শুরু করে।

এছাড়া মনজিল, ইয়াসিন এবং ফারুক মিয়ার ছেলে একেএম নেওয়াজের নামে শান্তিনগর বাজারের পিছনে যৌথ মালিকানার একটি ফ্ল্যাট ছিল। ওই ফ্ল্যাটে মনজিলের মা ও মনজিলকে নিয়ে প্রথমে বসবাস করতেন। ২য় বিবাহের পর মনজিলের পিতা মনা, মনজিল, তার সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপি ও লিপির সংসারে আসা সন্তান একেএম ইয়াসিনকে নিয়ে বসবাস করতেন।

ইয়াসিনের বয়স যখন ১২ থেকে ১৩ বছর তখন মনজিলের বাবা ফ্ল্যাটটি ইয়াসিন ও মনজিলকে দিয়ে দলিল করিয়ে গোপনে বিক্রি করে দেন। ফারুক মিয়া তার ছেলের নামের ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা চাইলে মনজিল ও মনজিলের পিতা ফারুক মিয়াকে মাদকাসক্ত বলে প্রচার করে বাড্ডায় সেতু নামক একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ২ মাস ২১ দিন আটকে রাখে। ফারুক মিয়ার লন্ডন প্রবাসী ছেলে একেএম নেওয়াজ ও ফারুক মিয়ার মেয়ের জামাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ফারুক মিয়াকে উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে ফারুক মিয়া কোন মামলা করেনি। পুরনো ওই ক্ষোভ থেকেই ফারুক মিয়া তার ভাতিজা ইয়াসিন ও ভাড়াটে ৩ খুনিদের দিয়ে মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনা করে বলে তদন্তে এসেছে।

সিআইডি জানিয়েছে, মনজিলের মায়ের স্বর্ণালঙ্কার ছিল সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপির কাছে। বাবা মনা মিয়ার কাছ থেকে এমন তথ্য পেয়েছিল মনজিল। পরে বাবার মৃত্যুর পর মনজিল তার সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপির কাছে তার মায়ের গহনাগুলো ফেরত চায়। সৎমা লিপি মনজিলকে জানায় স্বর্ণালংকার তার ভাই আবু ইউসুফ নয়নের কাছে আছে। মনজিল আবু ইউসুফ নয়নের সঙ্গে কথা বলে মায়ের গহনাগুলো ফেরত দেয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও আবু ইউসুফ নয়ন সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। কিছুদিন পর মনজিল তার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপির ভাই সিদ্দিকের রাজারবাগের বাসায় মায়ের স্বর্ণালঙ্কার ফেরত না দেয়ায় নয়নকে লাঞ্ছিত করে। ইয়াসিন তার সৎভাই মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনার পরামর্শ করলে সেই ক্ষোভ থেকে নয়ন ইয়াসিনের প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করে।

সিআইডি জানিয়েছে, হত্যার পরিকল্পকারী মনজিলের সৎমা লিপি, চাচা ফারুক এবং মামা আবু ইউসুফকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। শ্রীঘ্রই মামলাটির চার্জশিট দেয়া হবে।

আরও খবর
ঈদুল আজহায় বৈধ বা অবৈধ কোন গরু ভারত থেকে আনা যাবে না
এলএনজি খালাস বন্ধ, ৩ দিন গ্যাসের চাপ কম থাকবে
বিমানবাহিনী প্রধানকে এয়ার মার্শাল র‌্যাংক ব্যাজ পরানো হয়েছে
ক্ষুদ্র ও তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ঘাটতি
যেখানে নিষেধাজ্ঞা নেই, সেখানে ইউপি নির্বাচন সিইসি
রোগীদের হয়রানি রোধে ঢাকা মেডিকেলে ৫ বিশেষ ব্যবস্থা
রংপুর মেডিকেল থেকে ৭ দালাল গ্রেপ্তার
বিএনপি রাজনীতির শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন : কাদের
হামলার মামলা ১৬৩ জনকে আসামি
প্রতারণা করে বিয়ে, নির্যাতনে হত্যার কারণ হতে পারে, স্বামী মিল্লাত পলাতক : পুলিশ
রাজধানীর দক্ষিণে ম্যানহোল থেকে ১০৭ মে.টন বর্জ্য অপসারণ

সোমবার, ১৪ জুন ২০২১ , ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ২ জিলকদ ১৪৪২

রাজধানীর আফতাবনগরে মনজিল হত্যা

নেপথ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে খুন

বাকী বিল্লাহ ও সাইফ বাবলু

সম্পত্তি নিয়ে ভাই ও ভাতিজার কাছ থেকে প্রতারিত ও লাঞ্ছিত হন ফারুক মিয়া। ভাই জীবিত থাকতে এ নিয়ে কোন কথা না বললেও ভাইয়ের মৃত্যুর পর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন তিনি। ভাতিজা একেএম মনজিলকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়ার পাশাপাশি খোয়া যাওয়া সম্পদ নিজের ভোগদখলে নেয়ার পরিকল্পনা করেন।

অন্যদিকে মনজিলের মাকে হত্যা করিয়ে তার বাবাকে বিয়ে করেন খালা লায়লা ইয়াসমিন লিপি। বোনের মৃত্যুর পর তার স্বর্ণলঙ্কারও নিজের দখলে নেন। এ নিয়ে বিরোধ তৈরি হয় সৎছেলে মনজিলের সঙ্গে। চাচা ও সৎমায়ের সঙ্গে পারিবারিক এসব ঝামেলায় শেষ পর্যন্ত মায়ের মতো তাকেও খুন হতে হয়। সাড়ে ৩ বছর পর মনজিল হত্যার তদন্তে এমন পারিবারিক কলহের কারণ খুঁজে পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।

গত ২ মাসে হত্যায় জড়িত ৩ ভাড়াটে কিলারসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও এখনও অধরা রয়ে গেছেন খুনের পরিকল্পনায় যুক্ত ৩ পরিকল্পনাকারী চাচা, মামা এবং সৎমা। তাদের গ্রেপ্তার করতে মাঠে নেমেছে সিআইডি।

২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজধানীর আফতাবনগরে খুন হন মনজুল হক ময়না মিয়ার প্রথম ঘরের ছেলে এসএম মনজিল। এ হত্যার ঘটনায় মনজিলের আপন চাচা ফারুক মিয়া বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় ঘটনার পরদিন একটি মামলা করেন। দীর্ঘ তদন্ত করেও পুলিশ কোন ক্লু উদ্ঘাটন করতে না পারায় ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ পুলিশ সদর দপ্তর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব সিআইডিকে দেয়। সিআইডির ঢাকা মেট্টো ইউনিট মামলাটি তদন্ত শুরু করে। তদন্ত করে সর্বশেষ ভাড়াটে কিলার সীমান্ত হাসান তাকবিরকে গ্রেপ্তার করা হয় শনিবার রাতে। এর আগে এ হত্যার ঘটনায় ২ ভাড়াটে কিলার রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুল ইসলাম রাকিব এবং হত্যার মূল নেতৃত্ব দেয়া মনজিলের সৎভাই মোহাম্মদ ইয়াসিনকে গ্রেপ্তার করা। তবে এখনও অধরা রয়ে গেছে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মনজিলের চাচা ফারুক মিয়া, সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপি এবং সৎমামা আবু ইউছুফ।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক গতকাল সাংবাদিকদের জানান, আপন ভাইয়ের কাছ থেকে ফ্ল্যাট কিনে প্রতারিত ও লাঞ্ছিত হয় ফারুক মিয়া। এর জের ধরে প্রতিশোধ নিতে ভাইয়ের ছেলেকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভাড়াটে কিলারদের ব্যবহার করেন। হত্যাকাণ্ডের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কিলারদের ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।

সিআইডি জানিয়েছে, হত্যা মামলাটি সিআইডিতে আসার পর মামলার বাদী মনজিলের চাচা ফারুক মিয়া সিআইডিকে নানাভাবে অসহযোগিতা করে। মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। অন্যদিকে মনজিল খুন হওয়ার পর থেকেই তার সৎভাই ইয়াছিন নিখোঁজ ছিল। ইয়াছিন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় তার আপন মামা আবু ইউছুপ বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। সিআইডির কাছে মনে হয়েছিল মনজিল হত্যার সঙ্গে ইয়াছিনের নিখোঁজ হওয়ার একটি যোগসূত্র রয়েছে। কিন্তু ইয়াছিনকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা অপহরণ করে লাশ গুম করেছে, ইয়াছিনকে না পেলে এ মামলার কোন রহস্য উদ্ঘাটন হবে না এমন জোর দাবি করে আসছিল মামলার বাদী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ফারুক মিয়া। বাদীর এমন আচরণে সিআইডির সন্দেহ হয়। তারা প্রথমে ইয়াছিন নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটনে জোর দেয়। সিআইডির তদন্তেই বেরিয়ে আসে আসলে ইয়াছিন নিখোঁজ হয়নি। নাম পরিবর্তন করে চট্টগ্রামে একটি আঞ্চলিক পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন।

গত মার্চ মাসে ইয়াছিনকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কারণ, জড়িতদের নাম, পরিকল্পনা সবকিছু প্রকাশ করে ইয়াছিন। ইয়াছিনের দেয়া তথ্যে ভাড়াটে কিলার ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতোমধ্যে ইয়াছিন, রাকিব সিয়াম আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। আর সর্বশেষ গ্রেপ্তার তাকবীর আদালতে জবানবন্দি দিতে সম্মত হয়েছে।

সিআইডি জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত ৩ আসামি বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে বলেছে মনজিল হককে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করা হয়। এরপর পেটে ছুরিকাঘাত করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুই হাতের ও পায়ের রগ কেটে ফেলা হয়। ঘটনার আগের দিন ভাড়াটে ৩ খুনি ইয়াসিন হকের বনশ্রীস্থ পৈত্রিক ফ্ল্যাটে রাত্রি যাপন করে। ইয়াসিন হকের মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, মামলার বাদী ফারুক মিয়া ও ইয়াসিন হকের মামা আবু ইউসুফ নয়ন ভাড়াটে খুনি সরদার রবিউল ইসলাম সিয়ামকে নিয়ে গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি কিভাবে মনজিলকে হত্যা করা হবে তার একটি দিকনির্দেশনা দেন। এ হত্যায় চুক্তি হয় ৫ লাখ টাকায়।

সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ভাড়াটে খুনি রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব ও সীমান্ত হাসান তাকবিরকে হত্যায় সহযোগিতা করে সৎভাই ইয়াছিন। আর পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছিল মনজিলের সৎমা ও খালা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, মামা আবু ইউসুফ নয়ন এবং মামলার বাদী ফারুক মিয়া।

ঘটনার আগে ইয়াসিন হক তার মামা আবু ইউসুফ নয়নের সঙ্গে মনজিল হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করলে তিনি তাতে সম্মতি প্রকাশ করেন। খুনের কাজে ব্যয় করার জন্য তাকে নগদ ২০ হাজার টাকা দেন মামা ইউসুফ মিয়া। ওই টাকা দিয়ে ইয়াসিন ভাড়াটে খুনি সরদার রবিউল ইসলাম সিয়ামকে নিয়ে ঘটনার ৮ থেকে ১০ দিন আগে নিউ মার্কেটের ফুটপাত হতে খুনের কাজে ব্যবহারের জন্য দুটি ধারালো চাকু, পাটের রশি এবং এগুলো বহনের জন্য একটি রেক্সিনের ব্যাগ ক্রয় করে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাকু, রেক্সিনের ব্যাগ ও রশি এবং খুনিদের ফেলে যাওয়া রক্তমাখা কাপড়-চোপড় সিআইডি ডিএনএ ল্যাবের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। তাতে ৫ জন পুরুষ ব্যক্তির উপস্থিতি পাওয়া যায়।

আসামি ইয়াসিন হক মনজিলকে খুন করার পর তার রক্তমাখা কাপড়-চোপড় আফতাব নগরস্থ খালে ফেলে দেয় বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করে। অন্যান্য ভাড়াটে খুনিরা তাদের রক্তমাখা কাপড়-চোপড় ঘটনাস্থলে ফেলে মনজিল হকের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় পড়ে পালিয়ে যায়।

মামলা তদন্তকালে আরও জানা যায়, মনজিলের বয়স যখন ৩ থেকে ৪ বছর, তখন মনজিলের বাবার সঙ্গে খালাত শ্যালিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে লায়লা ইয়াসমিন লিপির প্ররোচনায় মনজিলের বাবা মইনুল হক তার শান্তিনগরন্থ বাসায় মনজিলের মা সাদিয়া পারভীন কাজলের গায়ে কোরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মনজিলের মা সাদিয়া পারভীন কাজল মৃত্যুবরণ করেন। মনজিলের পিতা গ্যাসের চুলা থেকে মনজিলের মায়ের পরনের কাপড়ে আগুন ধরিয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে চালিয়ে দেয়। মনজিলের মায়ের মৃত্যুর পরের বছর মনজিলের পিতা মনা তার প্রেমিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপিকে বিয়ে করে ঘরসংসার শুরু করে।

এছাড়া মনজিল, ইয়াসিন এবং ফারুক মিয়ার ছেলে একেএম নেওয়াজের নামে শান্তিনগর বাজারের পিছনে যৌথ মালিকানার একটি ফ্ল্যাট ছিল। ওই ফ্ল্যাটে মনজিলের মা ও মনজিলকে নিয়ে প্রথমে বসবাস করতেন। ২য় বিবাহের পর মনজিলের পিতা মনা, মনজিল, তার সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপি ও লিপির সংসারে আসা সন্তান একেএম ইয়াসিনকে নিয়ে বসবাস করতেন।

ইয়াসিনের বয়স যখন ১২ থেকে ১৩ বছর তখন মনজিলের বাবা ফ্ল্যাটটি ইয়াসিন ও মনজিলকে দিয়ে দলিল করিয়ে গোপনে বিক্রি করে দেন। ফারুক মিয়া তার ছেলের নামের ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা চাইলে মনজিল ও মনজিলের পিতা ফারুক মিয়াকে মাদকাসক্ত বলে প্রচার করে বাড্ডায় সেতু নামক একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ২ মাস ২১ দিন আটকে রাখে। ফারুক মিয়ার লন্ডন প্রবাসী ছেলে একেএম নেওয়াজ ও ফারুক মিয়ার মেয়ের জামাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ফারুক মিয়াকে উদ্ধার করে। এ ব্যাপারে ফারুক মিয়া কোন মামলা করেনি। পুরনো ওই ক্ষোভ থেকেই ফারুক মিয়া তার ভাতিজা ইয়াসিন ও ভাড়াটে ৩ খুনিদের দিয়ে মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনা করে বলে তদন্তে এসেছে।

সিআইডি জানিয়েছে, মনজিলের মায়ের স্বর্ণালঙ্কার ছিল সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপির কাছে। বাবা মনা মিয়ার কাছ থেকে এমন তথ্য পেয়েছিল মনজিল। পরে বাবার মৃত্যুর পর মনজিল তার সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপির কাছে তার মায়ের গহনাগুলো ফেরত চায়। সৎমা লিপি মনজিলকে জানায় স্বর্ণালংকার তার ভাই আবু ইউসুফ নয়নের কাছে আছে। মনজিল আবু ইউসুফ নয়নের সঙ্গে কথা বলে মায়ের গহনাগুলো ফেরত দেয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও আবু ইউসুফ নয়ন সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। কিছুদিন পর মনজিল তার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে সৎমা লায়লা ইয়াসমিন লিপির ভাই সিদ্দিকের রাজারবাগের বাসায় মায়ের স্বর্ণালঙ্কার ফেরত না দেয়ায় নয়নকে লাঞ্ছিত করে। ইয়াসিন তার সৎভাই মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনার পরামর্শ করলে সেই ক্ষোভ থেকে নয়ন ইয়াসিনের প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করে।

সিআইডি জানিয়েছে, হত্যার পরিকল্পকারী মনজিলের সৎমা লিপি, চাচা ফারুক এবং মামা আবু ইউসুফকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। শ্রীঘ্রই মামলাটির চার্জশিট দেয়া হবে।