পরীমনির মামলায় গ্রেপ্তার নাসির, অমি

শেষ পর্যন্ত মামলা হলো, গ্রেপ্তারও হলেন প্রধান অভিযুক্তসহ পাঁচজন তবে ঘটনার ৬ দিন পর। তার আগে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আবেদন জানাতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। করতে হয়েছে সংবাদ সম্মেলন যা সব সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত প্রকাশিত হয়েছে। এরপরই তৎপর হলো পুলিশ।

পরীমনি অভিযোগ করেছিলেন ঘটনার দিন রাতে, তিনি মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। তবে পুলিশ বলছে, তিনি অপ্রকৃতস্থ ছিলেন এবং সুনির্দিষ্টভাবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগও করতে পারছিলেন না। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে সহায়তা চেয়েও পাননি বলে অভিযোগ পরীমনি র। তবে এখন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন তারা পরীমনি র সঙ্গে থাকবেন।

চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমনিকে ‘ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা’ মামলায় গতকাল গ্রেপ্তার হলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবাসন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও পূর্ব পরিচিত অমিসহ ৫ জন। পরীমনির করা মামলায় আসামি নাসির মাহমুদ এবং অমি। অন্য ৩ জন নারী। অমির বাসায় অভিযান চালিয়ে ওই ৩ নারীকে পাওয়া যায়। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মাদকও উদ্ধার করে পুলিশ। তবে মামলায় ৬ আসামির মধ্যে এখনও অজ্ঞাত ৪ আসামিকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

গত ৮ জুন বনানীর বাসা থেকে ঢাকা বোট ক্লাবে যাওয়ার পর সেখানে তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ করেন পরীমনি। নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধেই মূল অভিযোগ পরীমনির।

৪ দিন পর এ ঘটনা নিয়ে ১৩ জুন রাত ৮টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিলে ঘটনা প্রকাশ পায়। রাতেই এ ঘটনা নিয়ে বনানীর নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন। গতকাল ভোরে বাসা থেকে এ ঘটনায় একটি লিখিত অভিযোগ পুলিশকে দেয়ার পর সেটি সাভার থানায় মামলা হিসেবে রেকর্ড হয়। সেখানে নাসির উদ্দিন মাহমুদ, পূর্ব পরিচিত অমিসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়। দুপুরের পর ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে মামলায় অভিযুক্ত আসামি নাসির মাহমুদ, অমিসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে।

ফেইসবুক স্ট্যাটাসে তাকে ‘ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার’ অভিযোগ তুলে ঘটনায় কোন বিচার না পাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে পরীমনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তা চান। রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে পরীমনি অভিযোগ করেন, বোট ক্লাবে তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত। তাকে সুকৌশলে সেদিন ওই ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়।

তবে গতকাল গ্রেপ্তারের সময় নাসির মাহমুদ উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন তিনি ‘ঘটনার শিকার’।

পুলিশ বলছে, নাসিরের বিরুদ্ধে আগেও মাদক ও নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে। নানা অভিযোগে তাকে উত্তরা ক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ। ‘কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে আমরা সেগুলোর তদন্ত করব,’ বলেন হারুন।

এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে বোট ক্লাব কর্তৃপক্ষ। তবে ক্লাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন তারা এ ঘটনায় মন্তব্য করবে না।

মামলায় যা বলেছেন পরীমনি

মামলায় পরীমনি অভিযোগ করেন, গত ৮ জুন রাত সাড়ে ১১টায় পরীমনি তার বনানীর বাসা কষ্টিমিউ জিজাইনার জিমি, পূর্ব পরিচিত অমি, বনিসহ দুটি গাড়িতে উত্তরায় রওনা দেন। পথে তার পূর্ব পরিচিত অমি তাদের বলে, বেড়িবাঁধে ঢাকা বোট ক্লাবে দুই মিনিটের কাজ আছে। রাত ১২টা ২০ মিনিটে তারা বোট ক্লাবের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বোট ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অমি অজ্ঞাত এক ব্যক্তির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এরপর বোট ক্লাবের সিকিউরিটি গার্ডরা মূল ফটক খুলে দিয়ে তারা ভেতরে প্রবেশ করে। অমি তখন তাদের বলে ক্লাবের পরিবেশ সুন্দর আছে তোমরা নামতে পার। এ সময় তার ছোট বোনের বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে তিনি তার বোনকে নিয়ে ক্লাবের ওয়াশরুম ব্যবহার করেন। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর নাসির ইউ মাহমুদ তাদের ক্লাবে বসে কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে নাসির ইউ মাহমুদ মদ পান করার জন্য জোর করেন। একপর্যায়ে পরীমনির মুখে মদের বোতল ঢুকিয়ে মদ পান করানোর চেষ্টা করেন। এতে তিনি ঠোঁট ও দাঁতে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এ পর্যায়ে নাসির মাহমুদ তাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে হাত দেন এবং তাকে ধর্ষণচেষ্টা করেন এবং তার দিকে মদের বোতল ছুড়ে মারেন। এ সময় তার কষ্টিটিউ ডিজাইনার জিমি বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে তাকে মারধর করা হয়। অমিসহ অন্য ৪ ব্যক্তি ঘটনায় নাসির মাহমুদকে সহযোগিতা করে। তিনি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করতে গেলে তার ফোন কেড়ে ফেলে দেয়া হয়। এরপর ফোন তুলে আবার ফোন করার চেষ্টা করলে ফোনটি ফেলে দেয়। পরে তিনি তার সঙ্গীদের সহযোগিতায় সেখান থেকে রক্ষা পান। তাকে তার সঙ্গীরা অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে গাড়িতে তোলেন। এরপর এ ঘটনায় নাসির ও অমিসহ আসামিরা তাকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেন। তিনি ঘটনা চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির নেতাদের কাছে জানান। এ কারণে তার মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে।

অভিযোগ জানিয়ে কোন সুরাহা না পাওয়ায় ফেইসবুক স্ট্যাটাস পরীমনির

পরীমনির ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, ৮ জুনের ঘটনার পর তিনি বনানী থানায় অভিযোগ করতে যান কিন্তু বনানী থানা পুলিশ তার মামলা গ্রহণ করেনি। এরপর তিনি ঘটনা চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নেতা, ঘনিষ্ঠজনদের কাছে জানান। ঘটনা তিনি পুলিশের মহাপরির্দশক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদের কাছেও জানান। ৪ দিন তিনি পুলিশ, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন কিন্তু কোন সুরাহা তো হয়নি উল্টো তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ঘটনা তুলে ধরলেও ঘটনাস্থল এবং তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের নাম ভয়ে প্রকাশ করেননি। রাতে এ ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

পুলিশ যা জানিয়েছে

পরীমনির অভিযোগ না নেয়ার বিষয়ে গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার সংবাদকে জানিয়েছেন, ৯ জুন ভোর ৪টায় পরীমনি বনানী থানায় আসেন। ওই থানার ওসির সঙ্গে পরীমনির পূর্ব থেকেই পরিচয় ছিল। কারণ পুলিশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরীমনিকে দাওয়াত করা হতো এবং চলচ্চিত্র নায়িকা হিসেবে পুলিশের অনুষ্ঠানগুলোতে সে থাকত। ভোররাতে পরীমনি যখন থানায় আসে তখন সে মদ্যপ অবস্থায় ছিল। ডিউটি অফিসারকে গিয়ে সে বলেছে, তাকে কে বা কারা বোট ক্লাবে জোর করে মদ খাইয়ে দিয়েছে এবং সেই মদের সঙ্গে তাকে অন্য কিছুও খাওয়ানো হয়েছে এ বিষয়ে সে মামলা করবে। ডিউটি অফিসার তখন তার পরিস্থিতি দেখে বলে ম্যাডাম আপনি আগে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হোন।

এরপর আপনি সুস্থ হয়ে মামলা করেন। পুলিশ তার অবস্থা দেখে বলে আপনি চিকিৎসা নিতে কোথায় যাবেন আমাদের বললে আমরা প্রয়োজনে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। তখন পরীমনি এভারকেয়ার হাসপাতালে যেতে চাইলে পুলিশ স্কট দিয়ে তাকে হাসপাতলে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসে। পরীমনি পরে থানায় আসবে জানালেও আর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এরপর সে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলে রোববার রাতে রূপনগর থানা এবং বনানী থানা পুলিশ তার বাসায় যায়। তখন অলরেডি অনেক সাংবাদিক তার বাসায় চলে আসে। তখন পুলিশ কথা বলতে পারেনি। এরপর ভোরে বাসায় থেকেই পরীমনি একটি লিখিত অভিযোগ দিলে সেটি সাভার থানায় পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, পরীমনি ঘটনা ওসিকেও জানাতে পারতেন অথবা আমাকেও জানাতে পারতেন কিন্তু সেটি তিনি করেননি আর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় পুলিশও ঘটনাটি নিয়ে এগোতে পারেনি। এছাড়া আমরাও তখন বোট ক্লাব কোথায়, সেখানে কী হয়েছে তা পরীমনির কাছ থেকেও জানতে পারিনি। পরীমনি ফেইসবুক বা সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বিষয়ে যে বর্ণনা দিয়েছেন সেটি তিনি ওইদিন এভাবে বলেননি বলে পুলিশ বুঝে উঠতে পারিনিÑসেদিন কী হয়েছিল।

মামলার পর পুলিশের তৎপরতা

গতকাল সকালে সাভার থানায় পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা মামলা রেকর্ড করা হয় (মামলা নং ৩৮)। এরপর দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি মামলার প্রধান আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়। তবে মামলার দ্বিতীয় আসামি অমির বাসায় অভিযান চালিয়ে মামলার প্রধান আসামি কুঞ্জ ডেভেলপার লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসির ইউ আহমেদ ও অমিকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করা হয়। এ সময় ৩ নারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। যারা মূলত নাসির ইউ মাহমুদের রক্ষিতা ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, এটা অমির বাসা। পরীমনির সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে নাসির তার তিন রক্ষিতাকে নিয়ে এ বাসায় পালিয়ে ছিলেন। মাদক রাখার অভিযোগে সে তিনজনকেও আমরা গ্রেপ্তার করেছি।

নাসিরের বিরুদ্ধে আগেও মাদক ও নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে। নানা অভিযোগে তাকে উত্তরা ক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জেনেছি। কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে আমরা সেগুলোর তদন্ত করব।

পরীমনি ক্লাবের সদস্য না হয়ে সেখানে যাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে যুগ্ম কমিশনার বলেন, তিনি (পরীমনি) স্বনামধন্য নায়িকা। ওখানে (বোট ক্লাব) যেতেই পারেন। গেলেই যে তাকে ওখানে হ্যারেজ (হয়রানি) করবে, সেটা ঠিক নয়। আসলে কী ঘটেছে তা বিস্তারিত তদন্ত করে বলতে পারব। তিনি বলেন, এ ঘটনা নিয়ে রোববার রাতে সংবাদ সম্মেলন করেন পরীমনি। সংবাদ সম্মেলনের পরপরই আমরা অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, তবে যেহেতু রাতে মামলা হয়নি, তাই আমরা অ্যাকশনে যাইনি। সাভার থানায় মামলার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করি। হত্যাচেষ্টা ও ধর্ষণচেষ্টার মামলায় নাসিরকে সাভার থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে বর্তমানে মাদক উদ্ধারের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ডিবি কার্যালয়ে রাখা হয়েছে।

পরীমনির বাসায় নিরাপত্তা জোরদার

এদিকে রোববার রাত থেকেই পুলিশ পরীমনির বনানীর বাসায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে। পুলিশের একটি টিম বাসার আশপাশে মোতায়েন করে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছেন পরীমনি। পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে সব ধরনের নিরাপত্তা দেয়া হবে জানানো হয়েছে। তিনি যদি বাইরে কোথাও যাওয়ার ক্ষেত্রেও পুলিশের নিরাপত্তা চান সেটিও দেয়া হবে।

পুলিশের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার জানান, পরীমনির নিরাপত্তায় পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

রোববার রাত থেকে নিজের জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কথা বললেও গতকাল পরীমনি গণমাধ্যমকে বলেছে ‘এত দ্রুতই প্রধান আসামি গ্রেপ্তার হওয়ায় এখন ভরসা পাচ্ছি। নিশ্চিন্ত হলাম। বাঁচতে পারব। বাকি অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক।’

মঙ্গলবার, ১৫ জুন ২০২১ , ১ আষাড় ১৪২৮ ৩ জিলকদ ১৪৪২

পরীমনির মামলায় গ্রেপ্তার নাসির, অমি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

শেষ পর্যন্ত মামলা হলো, গ্রেপ্তারও হলেন প্রধান অভিযুক্তসহ পাঁচজন তবে ঘটনার ৬ দিন পর। তার আগে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আবেদন জানাতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। করতে হয়েছে সংবাদ সম্মেলন যা সব সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত প্রকাশিত হয়েছে। এরপরই তৎপর হলো পুলিশ।

পরীমনি অভিযোগ করেছিলেন ঘটনার দিন রাতে, তিনি মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। তবে পুলিশ বলছে, তিনি অপ্রকৃতস্থ ছিলেন এবং সুনির্দিষ্টভাবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগও করতে পারছিলেন না। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে সহায়তা চেয়েও পাননি বলে অভিযোগ পরীমনি র। তবে এখন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন তারা পরীমনি র সঙ্গে থাকবেন।

চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমনিকে ‘ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা’ মামলায় গতকাল গ্রেপ্তার হলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবাসন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও পূর্ব পরিচিত অমিসহ ৫ জন। পরীমনির করা মামলায় আসামি নাসির মাহমুদ এবং অমি। অন্য ৩ জন নারী। অমির বাসায় অভিযান চালিয়ে ওই ৩ নারীকে পাওয়া যায়। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মাদকও উদ্ধার করে পুলিশ। তবে মামলায় ৬ আসামির মধ্যে এখনও অজ্ঞাত ৪ আসামিকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

গত ৮ জুন বনানীর বাসা থেকে ঢাকা বোট ক্লাবে যাওয়ার পর সেখানে তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ করেন পরীমনি। নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধেই মূল অভিযোগ পরীমনির।

৪ দিন পর এ ঘটনা নিয়ে ১৩ জুন রাত ৮টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিলে ঘটনা প্রকাশ পায়। রাতেই এ ঘটনা নিয়ে বনানীর নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন। গতকাল ভোরে বাসা থেকে এ ঘটনায় একটি লিখিত অভিযোগ পুলিশকে দেয়ার পর সেটি সাভার থানায় মামলা হিসেবে রেকর্ড হয়। সেখানে নাসির উদ্দিন মাহমুদ, পূর্ব পরিচিত অমিসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়। দুপুরের পর ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে মামলায় অভিযুক্ত আসামি নাসির মাহমুদ, অমিসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে।

ফেইসবুক স্ট্যাটাসে তাকে ‘ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার’ অভিযোগ তুলে ঘটনায় কোন বিচার না পাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে পরীমনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তা চান। রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে পরীমনি অভিযোগ করেন, বোট ক্লাবে তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত। তাকে সুকৌশলে সেদিন ওই ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়।

তবে গতকাল গ্রেপ্তারের সময় নাসির মাহমুদ উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন তিনি ‘ঘটনার শিকার’।

পুলিশ বলছে, নাসিরের বিরুদ্ধে আগেও মাদক ও নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে। নানা অভিযোগে তাকে উত্তরা ক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ। ‘কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে আমরা সেগুলোর তদন্ত করব,’ বলেন হারুন।

এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে বোট ক্লাব কর্তৃপক্ষ। তবে ক্লাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন তারা এ ঘটনায় মন্তব্য করবে না।

মামলায় যা বলেছেন পরীমনি

মামলায় পরীমনি অভিযোগ করেন, গত ৮ জুন রাত সাড়ে ১১টায় পরীমনি তার বনানীর বাসা কষ্টিমিউ জিজাইনার জিমি, পূর্ব পরিচিত অমি, বনিসহ দুটি গাড়িতে উত্তরায় রওনা দেন। পথে তার পূর্ব পরিচিত অমি তাদের বলে, বেড়িবাঁধে ঢাকা বোট ক্লাবে দুই মিনিটের কাজ আছে। রাত ১২টা ২০ মিনিটে তারা বোট ক্লাবের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বোট ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অমি অজ্ঞাত এক ব্যক্তির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এরপর বোট ক্লাবের সিকিউরিটি গার্ডরা মূল ফটক খুলে দিয়ে তারা ভেতরে প্রবেশ করে। অমি তখন তাদের বলে ক্লাবের পরিবেশ সুন্দর আছে তোমরা নামতে পার। এ সময় তার ছোট বোনের বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে তিনি তার বোনকে নিয়ে ক্লাবের ওয়াশরুম ব্যবহার করেন। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর নাসির ইউ মাহমুদ তাদের ক্লাবে বসে কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে নাসির ইউ মাহমুদ মদ পান করার জন্য জোর করেন। একপর্যায়ে পরীমনির মুখে মদের বোতল ঢুকিয়ে মদ পান করানোর চেষ্টা করেন। এতে তিনি ঠোঁট ও দাঁতে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এ পর্যায়ে নাসির মাহমুদ তাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে হাত দেন এবং তাকে ধর্ষণচেষ্টা করেন এবং তার দিকে মদের বোতল ছুড়ে মারেন। এ সময় তার কষ্টিটিউ ডিজাইনার জিমি বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে তাকে মারধর করা হয়। অমিসহ অন্য ৪ ব্যক্তি ঘটনায় নাসির মাহমুদকে সহযোগিতা করে। তিনি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করতে গেলে তার ফোন কেড়ে ফেলে দেয়া হয়। এরপর ফোন তুলে আবার ফোন করার চেষ্টা করলে ফোনটি ফেলে দেয়। পরে তিনি তার সঙ্গীদের সহযোগিতায় সেখান থেকে রক্ষা পান। তাকে তার সঙ্গীরা অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে গাড়িতে তোলেন। এরপর এ ঘটনায় নাসির ও অমিসহ আসামিরা তাকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেন। তিনি ঘটনা চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির নেতাদের কাছে জানান। এ কারণে তার মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে।

অভিযোগ জানিয়ে কোন সুরাহা না পাওয়ায় ফেইসবুক স্ট্যাটাস পরীমনির

পরীমনির ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, ৮ জুনের ঘটনার পর তিনি বনানী থানায় অভিযোগ করতে যান কিন্তু বনানী থানা পুলিশ তার মামলা গ্রহণ করেনি। এরপর তিনি ঘটনা চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নেতা, ঘনিষ্ঠজনদের কাছে জানান। ঘটনা তিনি পুলিশের মহাপরির্দশক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদের কাছেও জানান। ৪ দিন তিনি পুলিশ, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন কিন্তু কোন সুরাহা তো হয়নি উল্টো তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ঘটনা তুলে ধরলেও ঘটনাস্থল এবং তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের নাম ভয়ে প্রকাশ করেননি। রাতে এ ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত বর্ণনা দেন।

পুলিশ যা জানিয়েছে

পরীমনির অভিযোগ না নেয়ার বিষয়ে গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার সংবাদকে জানিয়েছেন, ৯ জুন ভোর ৪টায় পরীমনি বনানী থানায় আসেন। ওই থানার ওসির সঙ্গে পরীমনির পূর্ব থেকেই পরিচয় ছিল। কারণ পুলিশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরীমনিকে দাওয়াত করা হতো এবং চলচ্চিত্র নায়িকা হিসেবে পুলিশের অনুষ্ঠানগুলোতে সে থাকত। ভোররাতে পরীমনি যখন থানায় আসে তখন সে মদ্যপ অবস্থায় ছিল। ডিউটি অফিসারকে গিয়ে সে বলেছে, তাকে কে বা কারা বোট ক্লাবে জোর করে মদ খাইয়ে দিয়েছে এবং সেই মদের সঙ্গে তাকে অন্য কিছুও খাওয়ানো হয়েছে এ বিষয়ে সে মামলা করবে। ডিউটি অফিসার তখন তার পরিস্থিতি দেখে বলে ম্যাডাম আপনি আগে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হোন।

এরপর আপনি সুস্থ হয়ে মামলা করেন। পুলিশ তার অবস্থা দেখে বলে আপনি চিকিৎসা নিতে কোথায় যাবেন আমাদের বললে আমরা প্রয়োজনে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। তখন পরীমনি এভারকেয়ার হাসপাতালে যেতে চাইলে পুলিশ স্কট দিয়ে তাকে হাসপাতলে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসে। পরীমনি পরে থানায় আসবে জানালেও আর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এরপর সে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলে রোববার রাতে রূপনগর থানা এবং বনানী থানা পুলিশ তার বাসায় যায়। তখন অলরেডি অনেক সাংবাদিক তার বাসায় চলে আসে। তখন পুলিশ কথা বলতে পারেনি। এরপর ভোরে বাসায় থেকেই পরীমনি একটি লিখিত অভিযোগ দিলে সেটি সাভার থানায় পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, পরীমনি ঘটনা ওসিকেও জানাতে পারতেন অথবা আমাকেও জানাতে পারতেন কিন্তু সেটি তিনি করেননি আর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় পুলিশও ঘটনাটি নিয়ে এগোতে পারেনি। এছাড়া আমরাও তখন বোট ক্লাব কোথায়, সেখানে কী হয়েছে তা পরীমনির কাছ থেকেও জানতে পারিনি। পরীমনি ফেইসবুক বা সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বিষয়ে যে বর্ণনা দিয়েছেন সেটি তিনি ওইদিন এভাবে বলেননি বলে পুলিশ বুঝে উঠতে পারিনিÑসেদিন কী হয়েছিল।

মামলার পর পুলিশের তৎপরতা

গতকাল সকালে সাভার থানায় পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা মামলা রেকর্ড করা হয় (মামলা নং ৩৮)। এরপর দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি মামলার প্রধান আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়। তবে মামলার দ্বিতীয় আসামি অমির বাসায় অভিযান চালিয়ে মামলার প্রধান আসামি কুঞ্জ ডেভেলপার লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসির ইউ আহমেদ ও অমিকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করা হয়। এ সময় ৩ নারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। যারা মূলত নাসির ইউ মাহমুদের রক্ষিতা ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, এটা অমির বাসা। পরীমনির সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে নাসির তার তিন রক্ষিতাকে নিয়ে এ বাসায় পালিয়ে ছিলেন। মাদক রাখার অভিযোগে সে তিনজনকেও আমরা গ্রেপ্তার করেছি।

নাসিরের বিরুদ্ধে আগেও মাদক ও নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে। নানা অভিযোগে তাকে উত্তরা ক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জেনেছি। কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে আমরা সেগুলোর তদন্ত করব।

পরীমনি ক্লাবের সদস্য না হয়ে সেখানে যাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে যুগ্ম কমিশনার বলেন, তিনি (পরীমনি) স্বনামধন্য নায়িকা। ওখানে (বোট ক্লাব) যেতেই পারেন। গেলেই যে তাকে ওখানে হ্যারেজ (হয়রানি) করবে, সেটা ঠিক নয়। আসলে কী ঘটেছে তা বিস্তারিত তদন্ত করে বলতে পারব। তিনি বলেন, এ ঘটনা নিয়ে রোববার রাতে সংবাদ সম্মেলন করেন পরীমনি। সংবাদ সম্মেলনের পরপরই আমরা অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, তবে যেহেতু রাতে মামলা হয়নি, তাই আমরা অ্যাকশনে যাইনি। সাভার থানায় মামলার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করি। হত্যাচেষ্টা ও ধর্ষণচেষ্টার মামলায় নাসিরকে সাভার থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে বর্তমানে মাদক উদ্ধারের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ডিবি কার্যালয়ে রাখা হয়েছে।

পরীমনির বাসায় নিরাপত্তা জোরদার

এদিকে রোববার রাত থেকেই পুলিশ পরীমনির বনানীর বাসায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে। পুলিশের একটি টিম বাসার আশপাশে মোতায়েন করে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছেন পরীমনি। পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে সব ধরনের নিরাপত্তা দেয়া হবে জানানো হয়েছে। তিনি যদি বাইরে কোথাও যাওয়ার ক্ষেত্রেও পুলিশের নিরাপত্তা চান সেটিও দেয়া হবে।

পুলিশের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার জানান, পরীমনির নিরাপত্তায় পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

রোববার রাত থেকে নিজের জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কথা বললেও গতকাল পরীমনি গণমাধ্যমকে বলেছে ‘এত দ্রুতই প্রধান আসামি গ্রেপ্তার হওয়ায় এখন ভরসা পাচ্ছি। নিশ্চিন্ত হলাম। বাঁচতে পারব। বাকি অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক।’