সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’

আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে বলে দাবি করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এই ফাঁকফোকরগুলোর মধ্যে তিনটিকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তিনি।

গতকাল সিপিডি, অক্সফাম ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনা শেষে লাখ-কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে তিনি ফাঁকিগুলো তুলে ধরেন। ‘কোভিড-১৯ কালে এই বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের জন্য কী আছে’- শীর্ষক সংলাপে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সভাপতিত্ব করেন।

দেবপ্রিয় বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রথম ফাঁকি হলো, বরাদ্দ যা নয়, তার চেয়ে বেশি করে বলা। দ্বিতীয়টি হলো, গরিবদের যে অনুপাতে পাওয়ার কথা, সেই অনুপাতে পাচ্ছে না আর তৃতীয় ফাঁকি হলো, যেটি দেয়া হয় সেটি যাদের পাওয়া উচিত, তারা পায় না।’

বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেড়েছে এমন প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘যেহেতু ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সেহেতু গরিবদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো দরকার।’

অনুষ্ঠানে সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান এই বাজেটকে ‘নাটক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাজেট আলোচনা এক ধরনের নাটক। সংসদ সদস্যরা নিজেদের এলাকার প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন। প্ল্যাকার্ড নিয়ে সংসদ সদস্যরা সংসদে কথা বলেন। বাজেট আলোচনায় একজন সংসদ সদস্যের জন্য গড়ে ১০ মিনিট সময় দেয়ার কোন মানে নেই।’

সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষার আওতায় অভীষ্ট মানুষেরা বাদ পড়ে যাচ্ছে, অন্যরা ঢুকে পড়েছে আর কোভিড-১৯ কালে নতুন গরিব বেড়েছে। নতুন গরিব ও পুরনো গরিব- এই দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। মানুষ কতটা ঝুঁকিতে আছে, সেটাই বড় বিবেচ্য বিষয়।’

তিনি গরিব মানুষ ও দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা বিবেচনায় গরিব মানুষের জন্য বীমা সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।

রেহমান সোবহানের প্রসঙ্গ তুলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বাজেট নাটক কিনা, জানি না। একটি স্টেজ থাকে, সেখানে গিয়ে আমরা হাজির হই। বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা অর্থহীন। আলোচনা করতে হয় বলেই করি। ১০ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকলে কী হয়, একটি পয়েন্ট আলোচনা করতেই ১০ মিনিট চলে যায়। প্রান্তিক মানুষের কথা বাজেটে না এলে বাজেট অর্থহীন। বাজেট অনেকটা আমলানির্ভর হয়ে গেছে।’

অনলাইনে আয়োজিত সংলাপে সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেখানে কোভিড-১৯’র কারণে কর্মসংস্থানে প্রভাববিষয়ক এক সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে চাকরি হারানোর চিত্র তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, করোনার কারণে ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তারা গড়ে ৯৫ দিনের মতো কাজ পাননি। পরে তাদের অনেকেই কাজ পেয়েছেন। তবে আয় কমেছে। এর পরিমাণ গড়ে ১২ শতাংশ। করোনার কারণে সেবা খাতে চাকরি কমেছে আর কৃষিতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি।

সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্য আলী আশরাফ মনে করেন, তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনা করেই বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত। তিনি বলেন, ‘রাশেদ খান মেনন বললেন, বাজেট আমলানির্ভর হয়ে গেছে। এটি যদি হয়, তাহলে তা ভালো লক্ষণ নয়।’

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ পরামর্শ দেন, করোনার সময় যেসব প্রতিষ্ঠান কোন কর্মী ছাঁটাই করবে না, তারা আড়াই শতাংশ কর ছাড় পাবে আর যারা ১০ শতাংশ নতুন কর্মী নিয়োগ দেবে, তারা আরও কর ছাড় পাবে। সেই ব্যবস্থা করা গেলে কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক লায়লা আশরাফুন বলেন, ‘মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিতে হবে।’

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আশিকুর রহমান মনে করেন, ‘এ দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোয় শহরের গরিবদের উপেক্ষা করা হয়।’

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন আরও বক্তব্য দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের বরিশাল শাখার নেত্রী মনীষা চক্রবর্তীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

শুক্রবার, ১৮ জুন ২০২১ , ৪ আষাড় ১৪২৮ ৬ জিলকদ ১৪৪২

সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে বলে দাবি করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এই ফাঁকফোকরগুলোর মধ্যে তিনটিকে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তিনি।

গতকাল সিপিডি, অক্সফাম ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনা শেষে লাখ-কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে তিনি ফাঁকিগুলো তুলে ধরেন। ‘কোভিড-১৯ কালে এই বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের জন্য কী আছে’- শীর্ষক সংলাপে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সভাপতিত্ব করেন।

দেবপ্রিয় বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রথম ফাঁকি হলো, বরাদ্দ যা নয়, তার চেয়ে বেশি করে বলা। দ্বিতীয়টি হলো, গরিবদের যে অনুপাতে পাওয়ার কথা, সেই অনুপাতে পাচ্ছে না আর তৃতীয় ফাঁকি হলো, যেটি দেয়া হয় সেটি যাদের পাওয়া উচিত, তারা পায় না।’

বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেড়েছে এমন প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘যেহেতু ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সেহেতু গরিবদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো দরকার।’

অনুষ্ঠানে সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান এই বাজেটকে ‘নাটক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাজেট আলোচনা এক ধরনের নাটক। সংসদ সদস্যরা নিজেদের এলাকার প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন। প্ল্যাকার্ড নিয়ে সংসদ সদস্যরা সংসদে কথা বলেন। বাজেট আলোচনায় একজন সংসদ সদস্যের জন্য গড়ে ১০ মিনিট সময় দেয়ার কোন মানে নেই।’

সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষার আওতায় অভীষ্ট মানুষেরা বাদ পড়ে যাচ্ছে, অন্যরা ঢুকে পড়েছে আর কোভিড-১৯ কালে নতুন গরিব বেড়েছে। নতুন গরিব ও পুরনো গরিব- এই দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। মানুষ কতটা ঝুঁকিতে আছে, সেটাই বড় বিবেচ্য বিষয়।’

তিনি গরিব মানুষ ও দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা বিবেচনায় গরিব মানুষের জন্য বীমা সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।

রেহমান সোবহানের প্রসঙ্গ তুলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বাজেট নাটক কিনা, জানি না। একটি স্টেজ থাকে, সেখানে গিয়ে আমরা হাজির হই। বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা অর্থহীন। আলোচনা করতে হয় বলেই করি। ১০ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকলে কী হয়, একটি পয়েন্ট আলোচনা করতেই ১০ মিনিট চলে যায়। প্রান্তিক মানুষের কথা বাজেটে না এলে বাজেট অর্থহীন। বাজেট অনেকটা আমলানির্ভর হয়ে গেছে।’

অনলাইনে আয়োজিত সংলাপে সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেখানে কোভিড-১৯’র কারণে কর্মসংস্থানে প্রভাববিষয়ক এক সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে চাকরি হারানোর চিত্র তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, করোনার কারণে ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। তারা গড়ে ৯৫ দিনের মতো কাজ পাননি। পরে তাদের অনেকেই কাজ পেয়েছেন। তবে আয় কমেছে। এর পরিমাণ গড়ে ১২ শতাংশ। করোনার কারণে সেবা খাতে চাকরি কমেছে আর কৃষিতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি।

সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্য আলী আশরাফ মনে করেন, তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনা করেই বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত। তিনি বলেন, ‘রাশেদ খান মেনন বললেন, বাজেট আমলানির্ভর হয়ে গেছে। এটি যদি হয়, তাহলে তা ভালো লক্ষণ নয়।’

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ পরামর্শ দেন, করোনার সময় যেসব প্রতিষ্ঠান কোন কর্মী ছাঁটাই করবে না, তারা আড়াই শতাংশ কর ছাড় পাবে আর যারা ১০ শতাংশ নতুন কর্মী নিয়োগ দেবে, তারা আরও কর ছাড় পাবে। সেই ব্যবস্থা করা গেলে কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক লায়লা আশরাফুন বলেন, ‘মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিতে হবে।’

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আশিকুর রহমান মনে করেন, ‘এ দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোয় শহরের গরিবদের উপেক্ষা করা হয়।’

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন আরও বক্তব্য দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের বরিশাল শাখার নেত্রী মনীষা চক্রবর্তীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।