করোনার ঢেউয়ে শিক্ষাদানের বিকল্প পথ কী

মাছুম বিল্লাহ

দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর এবার আঘাত হানছে করোনার তৃতীয় ঢেউ। ১৩ জুন অর্থাৎ ৪৫২ দিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ছিল কিন্তু খোলা হলো না, বন্ধ বৃদ্ধি করা হয়েছে ৩০ জুন পর্যন্ত। তার মানে হচ্ছে ৪৭০ দিন বন্ধ। এরপর কি খোলা হবে? তারও নিশ্চয়তা নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিকল্প উপায়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এবং অভিভাবকদের অবহিত করতে একটি রোডম্যাপ দেয়া হতে পারে বলে জানা যায়। ২০২০ সালে প্রাথমিক

সমাপনী, জেএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ দুই বছরের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রকাশ করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী শিক্ষা বোর্ডগুলো পরীক্ষা নেয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। শিক্ষা প্রশাসন বলছে পরীক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীদের ফল দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আর তাই করোনা সংক্রমণ কমলে ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর মধ্য দিয়ে সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে চায় শিক্ষা প্রশাসন। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ৬০ দিন ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ৮৪ দিন ক্লাস করিয়ে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে নামলেই এ কার্যক্রম শুরু হবে। অনলাইনে পাবলিক পরীক্ষা নেয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী এর বিপরীতে মত প্রদান করে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান যিনি আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক চমৎকার বলেছেন যে, এবারকার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে যেহেতু কোন ক্লাস করেনি তাই গতবারের মতো তাদের অটো প্রমোশন দেয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রয়োজন হলে পরীক্ষা চার-ছয় মাস পরেও নেয়া হবে। আবার শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে আলামত পাওয়া গেল যে, অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে অটোপ্রমোশনই হয়তো দিতে হবে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা আসলে দিশেহারা। তারা কংক্রিট কোন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।

যেসব বিকল্প পন্থার কথা আলোচনা হচ্ছে সেগুলো হলো ক্লাস্টারভিত্তিক শিক্ষাদান এবং শিক্ষা টিভি চালু করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ। মন্ত্রণালয় আশা করে শিক্ষা টিভি চালু হলে হয়তো একসঙ্গে জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ টিভি দেখবে সেখান থেকে ১০ থেকে ১২ শতাংশও যদি উপকৃত হয় তাহলেও অনেক শিক্ষার্থী সুফল পাবে। এ ক্ষেত্রে আর একটি প্রস্তাব পেশ করছি। দেশে বর্তমানে ডজন তিনেক প্রাইভেট চ্যানেল রয়েছে। এগুলোকেও কাজে লাগানো যেতে পারে, নতুন চ্যানেল স্থাপন করা তো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। চার-পাঁচটা চ্যানেলকে দায়িত্ব দিয়ে বিষয়ভিত্তিক ক্লাস বণ্টন করে দেয়া যেতে পারে। যেমন ‘এ’ টিভি শুধু বাংলা ও ইংরেজি ক্লাস প্রচার করবে শনিবার ও রোববার। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত। এভাবে কয়েকটি টিভি চ্যানেলকে কয়েকটি বিষয় ভাগ করে দিলে কাজ কিছুটা আগাবে। অনেক প্রাইভেট চ্যানেল অর্থ সংকটে ভুগছে, আকর্ষণীয় কোন প্রোগ্রামও করতে পারছে না। তারা শিক্ষার একটি বড় অংশ প্রচার করতে পারে। এদিক ক্লাস্টারভিত্তিক শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরানোর বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। সে লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের রোল নম্বর, বয়স এবং শাখাভিত্তিক ডিভিশনে ভাগ করা হতে পারে। একেক দিন একেক ক্লাস্টারের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে আসবে, যারা আসবে না তাদের জন্য অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হবে। এর পাশাপাশি অনলাইন ক্লাসও চলতে থাকবে।

পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাসূচি এলেমেলো করে ফেলেছে করোনা। এক দশক ধরে পূর্ব নির্ধারিত শিক্ষাসূচি অনুযায়ীই চলছে শিক্ষাব্যবস্থা। দীর্ঘ এই ক্ষতি কীভাবে পোষানো হবে তার বিশ্লেষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে বিকল্প শিক্ষায় নানা উদ্যোগ দেখলেও বাস্তবে তা কতটা সফল হয়েছে তা দেখার বিষয়। যেমন স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট ডেটা প্যাক ডিভাইস ক্রয়ের জন্য সফট লোন ইত্যাদির সঙ্গে সংসদ টেলিভিশন, বেতার, কমিউনিটি রেডিওর পাশাপাশি ভার্চুয়াল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা। যান্ত্রিক এ শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পরিচিত না থাকায় সমস্যা বেড়েছে।

জাতিসংঘের মতে এত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ আগে কখনো হয়নি। এমনকি দুটি মহাযুদ্ধের সময়ও শিক্ষাক্ষেত্রে এই সংকটের তৈরি হয়নি। অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী অটোপ্রমোশন নিয়ে উপরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছে। অন্যদিকে করোনার কারণে বাতিল হয়েছে সব পাবলিক পরীক্ষা। এর মধ্যে বেশি আলোচনায় ছিল গত বছরের এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল ও অটো পাশের বিষয়টি। তবে চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসিসহ সমমানের অন্যান্য পরীক্ষা বাতিল না করে বরং সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে সেগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানিয়েছে শিক্ষাবোর্ড। ২৩লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দেবে, তাদের জন্য ২৩ লাখ ল্যাপটপের ব্যবস্থা করতে হবে, স্মার্টফোনে এটি হবে না। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের সবাই তো ল্যাপটপের ব্যবহারও জানে না, সেটি আর একটি সমস্যা।

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের একটা অংশকে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা গেলেও একটা বড় অংশ এ কার্যক্রমের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। আমরা জানি, পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা, যাদের ইন্টারনেট সাপোর্ট ডিভাইস ও দুর্বল ইন্টারনেট গতির অসুবিধার কারণে সবাইকে সংযুক্ত করা যাচেছনা। অনেক শিক্ষার্থী এ প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত থাকায় শিক্ষকরা যথাযথ দিকনির্দেশনা ও সঠিক মূল্যায়নের দিকে যেতে পারছেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নেমে এসেছিল শূন্যের কোঠায়, অবার তা শুরু হলো যার কারণে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার ও চাকরিজীবনের প্রতিযোগিতায় অনেক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আসবে। ২০২০ সালের পাস করা উচচ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা একমাত্র এমবিবিএস ভর্তি ছাড়া সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পরীক্ষা দিতে পারেনি। এভাবে উঠতি বয়সের তরুন-তরুণীরা অনকেই মূলধারার বাইরে চলে যাচেছ। শারীরিকভাবে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হতে পারছেনা শিক্ষার্থীরা, ভেঙে পড়ছে ‘শিক্ষা চেইন’। তাই স্বাস্থ্য ঝুঁকির সঙ্গে চলে আসছে শিক্ষা ঝুঁকি যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে আর এই মানসিক চাপ আবার সামাজিক অপরাধকে বাড়াচ্ছে। তরুণদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। সংগঠনটি দাবি করে যে, আত্মহত্যার প্রবণতা প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। মোট আত্মহত্যার মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী ও ৪৩ শতাংশ পুরুষ। গণমাধ্যম সূত্র বলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ১৫ মাসে অন্তত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ২৯ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের বেশিরভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। ব্যক্তি ও সমাজ পর্যায়ে ধ্বংস ডেকে আনছে। পুরো ব্যবস্থা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে।

শিক্ষার বিকল্প শিক্ষা এবং সেটি সরাসারি, ফেস টু ফেস, অংশগ্রহণমূলক। বিকল্প হিসেবে যেগুলো চলছে যেমন অ্যাসাইনমেন্ট, টেলিভিশন বা রেডিও ক্লাস, অনলাইন ক্লাস এগুলো কোনভাবেই মূল শিক্ষাদানের বিকল্প বিষয় নয়। কিন্তু উপায় না থাকায় শিক্ষার্থীদের কোনরকমে শিক্ষার সঙ্গে ধরে রাখতে এই পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আর কত? শিক্ষার্থীরা তো এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। টেলিভিশনে প্রচারিত ক্লাসগুলোতে ‘অ্যানিমেশন’ ব্যবহার করলে ক্লাসকে অনেকটা আকর্ষণীয় করা যেত। কিন্তু শিক্ষা সংক্রান্ত প্রশাসন বিষয়টিতে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। আর তাই, শিক্ষার্থীদের প্রথমদিকে এসব ক্লাসের প্রতি আগ্রহ থাকলেও এখন আর তা নেই। দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো এবং শিক্ষার্থী ১ কোটি ৬৩ লাখ ৩৬ হাজার। মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০ হাজার ৬৬০টি এবং শিক্ষার্থী প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ ৫০ হাজার। আগামী দিনের এই বিশাল জনশক্তির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। সরকারি পর্যায়ে টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদানে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিতে সক্ষম হয়েছে। অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে লেখাপড়ায় যুক্ত করা গেলেও সে পদ্ধতি গুণগত শিক্ষার জন্য কতটুকু উপযোগী সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করি তারা বলেছিলাম যে, দেশের যেসব এলাকায় করোনা সংক্রমণ কম বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় সেসব জায়গার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা। গণসাক্ষরতা অভিযানসহ এনজিওদের মোর্চাও একই কথা বলেছিল। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষা নিয়ে আমরা কোন অসাম্য তৈরি করতে পারি না। মন্ত্রীর কথায় যুক্তি আছে। তারপরেও বলছি যে, অসাম্য তো তৈরি হয়েই আছে। শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কিন্তু প্রাইভেট টিউশন, অনলাইন, নিজেরা, অভিভাবকদের সহযোগিতায় পড়াশোনার সঙ্গে যোগাযোগ কিছুট হলেও রক্ষা করে চলেছে যেটি গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা পারছে না অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে। তাই তারা সপ্তাহে এক-দুদিন বিদ্যালয়ে যেতে পারলে তাদের কিছুট উপকার হতো, আর কিছুটা টিভি রেডিওর ক্লাস থেকে পুষিয়ে নিত। কিন্তু এখন কি হচ্ছে? শিক্ষার্থীদের এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো শেখানোর জন্যও তাদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা উচিত।

[লেখক : চিফ অব পার্টি : আউট অফ স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রাম-ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি]

শুক্রবার, ১৮ জুন ২০২১ , ৪ আষাড় ১৪২৮ ৬ জিলকদ ১৪৪২

করোনার ঢেউয়ে শিক্ষাদানের বিকল্প পথ কী

মাছুম বিল্লাহ

image

দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর এবার আঘাত হানছে করোনার তৃতীয় ঢেউ। ১৩ জুন অর্থাৎ ৪৫২ দিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ছিল কিন্তু খোলা হলো না, বন্ধ বৃদ্ধি করা হয়েছে ৩০ জুন পর্যন্ত। তার মানে হচ্ছে ৪৭০ দিন বন্ধ। এরপর কি খোলা হবে? তারও নিশ্চয়তা নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিকল্প উপায়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এবং অভিভাবকদের অবহিত করতে একটি রোডম্যাপ দেয়া হতে পারে বলে জানা যায়। ২০২০ সালে প্রাথমিক

সমাপনী, জেএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ দুই বছরের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রকাশ করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী শিক্ষা বোর্ডগুলো পরীক্ষা নেয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। শিক্ষা প্রশাসন বলছে পরীক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থীদের ফল দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আর তাই করোনা সংক্রমণ কমলে ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর মধ্য দিয়ে সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে চায় শিক্ষা প্রশাসন। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ৬০ দিন ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ৮৪ দিন ক্লাস করিয়ে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে নামলেই এ কার্যক্রম শুরু হবে। অনলাইনে পাবলিক পরীক্ষা নেয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী এর বিপরীতে মত প্রদান করে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান যিনি আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক চমৎকার বলেছেন যে, এবারকার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে যেহেতু কোন ক্লাস করেনি তাই গতবারের মতো তাদের অটো প্রমোশন দেয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রয়োজন হলে পরীক্ষা চার-ছয় মাস পরেও নেয়া হবে। আবার শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে আলামত পাওয়া গেল যে, অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে অটোপ্রমোশনই হয়তো দিতে হবে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা আসলে দিশেহারা। তারা কংক্রিট কোন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।

যেসব বিকল্প পন্থার কথা আলোচনা হচ্ছে সেগুলো হলো ক্লাস্টারভিত্তিক শিক্ষাদান এবং শিক্ষা টিভি চালু করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ। মন্ত্রণালয় আশা করে শিক্ষা টিভি চালু হলে হয়তো একসঙ্গে জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ টিভি দেখবে সেখান থেকে ১০ থেকে ১২ শতাংশও যদি উপকৃত হয় তাহলেও অনেক শিক্ষার্থী সুফল পাবে। এ ক্ষেত্রে আর একটি প্রস্তাব পেশ করছি। দেশে বর্তমানে ডজন তিনেক প্রাইভেট চ্যানেল রয়েছে। এগুলোকেও কাজে লাগানো যেতে পারে, নতুন চ্যানেল স্থাপন করা তো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। চার-পাঁচটা চ্যানেলকে দায়িত্ব দিয়ে বিষয়ভিত্তিক ক্লাস বণ্টন করে দেয়া যেতে পারে। যেমন ‘এ’ টিভি শুধু বাংলা ও ইংরেজি ক্লাস প্রচার করবে শনিবার ও রোববার। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত। এভাবে কয়েকটি টিভি চ্যানেলকে কয়েকটি বিষয় ভাগ করে দিলে কাজ কিছুটা আগাবে। অনেক প্রাইভেট চ্যানেল অর্থ সংকটে ভুগছে, আকর্ষণীয় কোন প্রোগ্রামও করতে পারছে না। তারা শিক্ষার একটি বড় অংশ প্রচার করতে পারে। এদিক ক্লাস্টারভিত্তিক শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরানোর বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। সে লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের রোল নম্বর, বয়স এবং শাখাভিত্তিক ডিভিশনে ভাগ করা হতে পারে। একেক দিন একেক ক্লাস্টারের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে আসবে, যারা আসবে না তাদের জন্য অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হবে। এর পাশাপাশি অনলাইন ক্লাসও চলতে থাকবে।

পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাসূচি এলেমেলো করে ফেলেছে করোনা। এক দশক ধরে পূর্ব নির্ধারিত শিক্ষাসূচি অনুযায়ীই চলছে শিক্ষাব্যবস্থা। দীর্ঘ এই ক্ষতি কীভাবে পোষানো হবে তার বিশ্লেষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে বিকল্প শিক্ষায় নানা উদ্যোগ দেখলেও বাস্তবে তা কতটা সফল হয়েছে তা দেখার বিষয়। যেমন স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট ডেটা প্যাক ডিভাইস ক্রয়ের জন্য সফট লোন ইত্যাদির সঙ্গে সংসদ টেলিভিশন, বেতার, কমিউনিটি রেডিওর পাশাপাশি ভার্চুয়াল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা। যান্ত্রিক এ শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পরিচিত না থাকায় সমস্যা বেড়েছে।

জাতিসংঘের মতে এত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ আগে কখনো হয়নি। এমনকি দুটি মহাযুদ্ধের সময়ও শিক্ষাক্ষেত্রে এই সংকটের তৈরি হয়নি। অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী অটোপ্রমোশন নিয়ে উপরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছে। অন্যদিকে করোনার কারণে বাতিল হয়েছে সব পাবলিক পরীক্ষা। এর মধ্যে বেশি আলোচনায় ছিল গত বছরের এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল ও অটো পাশের বিষয়টি। তবে চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসিসহ সমমানের অন্যান্য পরীক্ষা বাতিল না করে বরং সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে সেগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানিয়েছে শিক্ষাবোর্ড। ২৩লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দেবে, তাদের জন্য ২৩ লাখ ল্যাপটপের ব্যবস্থা করতে হবে, স্মার্টফোনে এটি হবে না। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের সবাই তো ল্যাপটপের ব্যবহারও জানে না, সেটি আর একটি সমস্যা।

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের একটা অংশকে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা গেলেও একটা বড় অংশ এ কার্যক্রমের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। আমরা জানি, পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা, যাদের ইন্টারনেট সাপোর্ট ডিভাইস ও দুর্বল ইন্টারনেট গতির অসুবিধার কারণে সবাইকে সংযুক্ত করা যাচেছনা। অনেক শিক্ষার্থী এ প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত থাকায় শিক্ষকরা যথাযথ দিকনির্দেশনা ও সঠিক মূল্যায়নের দিকে যেতে পারছেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নেমে এসেছিল শূন্যের কোঠায়, অবার তা শুরু হলো যার কারণে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার ও চাকরিজীবনের প্রতিযোগিতায় অনেক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আসবে। ২০২০ সালের পাস করা উচচ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা একমাত্র এমবিবিএস ভর্তি ছাড়া সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পরীক্ষা দিতে পারেনি। এভাবে উঠতি বয়সের তরুন-তরুণীরা অনকেই মূলধারার বাইরে চলে যাচেছ। শারীরিকভাবে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হতে পারছেনা শিক্ষার্থীরা, ভেঙে পড়ছে ‘শিক্ষা চেইন’। তাই স্বাস্থ্য ঝুঁকির সঙ্গে চলে আসছে শিক্ষা ঝুঁকি যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে আর এই মানসিক চাপ আবার সামাজিক অপরাধকে বাড়াচ্ছে। তরুণদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। সংগঠনটি দাবি করে যে, আত্মহত্যার প্রবণতা প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। মোট আত্মহত্যার মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী ও ৪৩ শতাংশ পুরুষ। গণমাধ্যম সূত্র বলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ১৫ মাসে অন্তত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ২৯ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের বেশিরভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। ব্যক্তি ও সমাজ পর্যায়ে ধ্বংস ডেকে আনছে। পুরো ব্যবস্থা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছে।

শিক্ষার বিকল্প শিক্ষা এবং সেটি সরাসারি, ফেস টু ফেস, অংশগ্রহণমূলক। বিকল্প হিসেবে যেগুলো চলছে যেমন অ্যাসাইনমেন্ট, টেলিভিশন বা রেডিও ক্লাস, অনলাইন ক্লাস এগুলো কোনভাবেই মূল শিক্ষাদানের বিকল্প বিষয় নয়। কিন্তু উপায় না থাকায় শিক্ষার্থীদের কোনরকমে শিক্ষার সঙ্গে ধরে রাখতে এই পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আর কত? শিক্ষার্থীরা তো এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। টেলিভিশনে প্রচারিত ক্লাসগুলোতে ‘অ্যানিমেশন’ ব্যবহার করলে ক্লাসকে অনেকটা আকর্ষণীয় করা যেত। কিন্তু শিক্ষা সংক্রান্ত প্রশাসন বিষয়টিতে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। আর তাই, শিক্ষার্থীদের প্রথমদিকে এসব ক্লাসের প্রতি আগ্রহ থাকলেও এখন আর তা নেই। দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো এবং শিক্ষার্থী ১ কোটি ৬৩ লাখ ৩৬ হাজার। মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০ হাজার ৬৬০টি এবং শিক্ষার্থী প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ ৫০ হাজার। আগামী দিনের এই বিশাল জনশক্তির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। সরকারি পর্যায়ে টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদানে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিতে সক্ষম হয়েছে। অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে লেখাপড়ায় যুক্ত করা গেলেও সে পদ্ধতি গুণগত শিক্ষার জন্য কতটুকু উপযোগী সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করি তারা বলেছিলাম যে, দেশের যেসব এলাকায় করোনা সংক্রমণ কম বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় সেসব জায়গার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা। গণসাক্ষরতা অভিযানসহ এনজিওদের মোর্চাও একই কথা বলেছিল। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষা নিয়ে আমরা কোন অসাম্য তৈরি করতে পারি না। মন্ত্রীর কথায় যুক্তি আছে। তারপরেও বলছি যে, অসাম্য তো তৈরি হয়েই আছে। শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কিন্তু প্রাইভেট টিউশন, অনলাইন, নিজেরা, অভিভাবকদের সহযোগিতায় পড়াশোনার সঙ্গে যোগাযোগ কিছুট হলেও রক্ষা করে চলেছে যেটি গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা পারছে না অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে। তাই তারা সপ্তাহে এক-দুদিন বিদ্যালয়ে যেতে পারলে তাদের কিছুট উপকার হতো, আর কিছুটা টিভি রেডিওর ক্লাস থেকে পুষিয়ে নিত। কিন্তু এখন কি হচ্ছে? শিক্ষার্থীদের এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো শেখানোর জন্যও তাদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা উচিত।

[লেখক : চিফ অব পার্টি : আউট অফ স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রাম-ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি]