‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?’

শেখর ভট্টাচার্য

আশির দশক। ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় জহুর হোসেন চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশ মানুষই ছিলেন দৈনিক সংবাদের পাঠক। আমাদের তখন যৌবন। যৌবন মানে ভরা যৌবন। সমাজের বিদ্যমান কোন অসঙ্গতি সহ্য করতে পারি না। যেখানেই নায্যতার অভাব সেখানেই প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয়। দৈনিক সংবাদে বৈঠকি ঢঙে লেখা জহুর হোসেন চৌধুরীর ‘দরবার ই জহুর’, সিরাজুল ইসালাম চৌধুরীর গাছ পাথর ছদ্মনামে লেখা কলাম, সাহিত্য বিভাগে নানা রুচিশীল লেখার সঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকের ‘হৃৎ কলমের টানে’ আমাদের মতো তরুণদের মনের খোরাক জোগাতো, আমরা তাদের লেখা গোগ্রাসে গিলতে থাকতাম। পঁচাত্তর উত্তর বাংলাদেশে তখন ঘোর অমানিশা, দেশকে পেছন দিকে টেনে চাঁদ-তারার কাছা কাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। এরকম ঘোর লাগা সময়ে সংবাদ উচ্চলয়ে নয়, পরিমিতি বোধ বজায় রেখে সাহিত্য সংস্কৃতিতে রুচিবোধ পুনর্জাগরণের চেষ্টা করে গেছে। একই ভাবে আমাদের প্রবাদ প্রতীম সাংবাদিক, বুদ্ধিবজীবীরা ছদ্ম সামরিক শাসনের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে থেকেও প্রয়োজনীয় প্রতিবাদ এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। ইতোমধ্যে অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমি বোধ হয় পঁচাত্তর উত্তর সময়ে দৈনিক সংবাদ পত্রিকাটির ভূমিকা নিয়ে কিছু লিখতে বসছি। আসলে আমার এই লেখার উদ্দেশ্য তা’ নয়।

গত কয়েকদিন ধরে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি কথা বারবার মনে হচ্ছে। তিনি গাছ-পাথর শিরোনামে যখন সংবাদে কলাম লিখতেন তখন প্রায়ই বলতেন এবং এখনও সুযোগ পেলে বলেন প্রতিটি সমাজে তরুণদের সামনে অনুসরণীয় নায়ক প্রয়োজন। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যার পর তিনি বারবার মনে করিয়ে দিতেন বাঙালি জাতির সামনে অনুসরণ করার মতো নেতার দুর্ভিক্ষ চলছে। এক সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অনেক ত্যাগী নেতাকেই তরুণরা অনুসরণ করত। ছাত্র সমাজের সামনেও অনেক অনুসরণীয় ছাত্র নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সময় কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আদর্শের রাজনীতি করে গেছেন। মত ও পথের পার্থক্য থাকতে পারে, জাতীয় স্বার্থে সবার সঙ্গে সবার ঐক্য ছিল দৃঢ়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখতে পাই, শেরে বাংলা ফজলুল হক যখন কৃষক প্রজা পার্টি করছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার পথের কিছুটা ভিন্নতা তৈরি হয়েছে কিন্তু শ্রদ্ধিব, ভক্তি, ভালোবাসা বিন্দু মাত্র কমেনি। এ ব্যাপারে শুধু বঙ্গবন্ধুই নন তার বাবা তাকে সব সময় বলতেন ‘আর যাই করো বাবা হক সাহেবকে চরকাল সম্মান করে যেও’। এই হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ।

পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে এক বিশাল ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় কি হয়? বায়ুম-লের বায়ু বিভিন্ন কারণে উষ্ণ হয়ে পড়ে, উষ্ণ বায়ু তখন কিছুটা হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। দ্রুত উপরে উঠে যাওয়ার কারণে, বায়ুম-লে শূন্যস্থান তৈরি হয়। সেই শূন্যস্থান পুরনের জন্য উচ্চ চাপ অঞ্চলের বিভিন্ন মানের বায়ু প্রবাহিত হয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক আকাশেও পঁচাত্তরের পর বেনোজলের মতো পরগাছা, বাতিল হয়ে যাওয়া, দেশদ্রোহী অনেক নেতারা এসে শূন্যস্থান পূরণ করতে চেষ্টা করেন। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, অনুসরণীয় জাতীয় নেতাদের মৃত্যুর পর আর ত্যাগী, কর্মী থেকে ধাপে ধাপে স্বাভাবিক নিয়মে নেতা হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে নষ্ট করে দেয়া হয়। সরা সরি বলতে গেলে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া রাজনীতিবীদদের হাত থেকে রাজনীতি চলে যাওয়ার সংস্কৃতির সূচনা ঘটে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে, সাধারণ মানুষের অন্তরের অনুভূতি অনুধাবন করে ধীরে ধীরে নেতা হওয়া মানুষের হওয়ার যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলছিল, সে প্রক্রিয়াটি থামিয়ে দেয়া হয়। বলা হয়, ‘রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেয়া হবে।’ রাজনীতিতে কর্মী থেকে নেতা হওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আছে। সেই প্রক্রিয়াটিকে যে অচল করে দেয়া হয়েছিল তা আর সচল হতে পারেনি। কোন দলের ভেতরেই এখন আর স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কাজ করছে না। কর্মী থেকে নেতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতা হওয়া সম্ভব এ কথাটি এখন কার্যকর নয়। নিভৃত গ্রামের সাধারণ কোন কর্মীর দলের সদস্যদের ভোটে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই তাই অস্বাভাবিক নানা সহজ পথ তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক দলে।

অস্বাভাবিক পথে তৈরি হওয়া নেতা কারা? তারা হলেন অধিকাংশই উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতা। তারা কেউ কেউ শিল্পপতি, অনেকেই সামরিক ও বেসামরিক অব. আমলা কেউ কেউ আছেন দলের শীর্ষ নেতাদের স্বজন। তারা অনেকেই নেতৃত্ব ক্রয় করে নেতা হন। পরে আবার প্রভাব অনুযায়ী অনেকে মন্ত্রিত্বও লাভ করেন। সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, জীবনধারণের বিষয়ে তাদের কোন ধারণা নেই। তাদের ধারণা মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো নির্মাণই একমাত্র উপায়। তারা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাই অবকাঠামো নির্মাণ করতে সবসময় তৎপর থাকেন। যেখানে পথঘাট নেই সেখানেও তারা সেতু নির্মাণ করেন। মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম সৃজন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মানুষের সহজে সেবা গ্রহণ নিশ্চিত করা, মানুষ যাতে তাদের অধিকারের কথা বলতে পারে এ রকম পরিবেশ তৈরি করে মানবাধিকার নিশ্চিত করা যে তাদের প্রধান কাজ, এসব বিষয়ে তারা মোটেই ভাবেন না। মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি নেই, সমভাবনা তো দূরের কথা।

সারা-বিশ্ব এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশেও একইভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি ভয়াবহ ক্রান্তিকালের মধ্যে আছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি আমাদের ধীরে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। গাণিতিকভাবে আমরা মাথাপিছু আয়ের অঙ্ক করে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সফলতায় নিজেরাই নিজেদের বাহবা দিচ্ছি। প্রশ্ন হচ্ছে মাথাপিছু আয় বেশি থাকলেই কি মানুষ ভালো থাকেন নাকি সম্পদের সুষম বণ্টন মানুষকে স্বস্তি দিতে পারে? অসংখ্য বিলাসবহুল হাসপাতাল নির্মিত হলেই কি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে নাকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সব মানুষের সহজে সেবা পাওয়া নিশ্চিত হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত ও কার্যকর বলা যেতে পারে। একইভাবে আমরা শিক্ষা ও অন্যান্য মৌলিক ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করতে পারি। সব সেবা খাতে মানুষের সমান ও সহজ সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ এ রকম বিষয় নিয়ে চিন্তা করবেন কারা? এর সরাসরি উত্তর রাজনীতিবিদরা।

যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জবাদিহিতার সংস্কৃতি কার্যকর সে রকম ব্যবস্থার মধ্যে থেকে, চ্যালেঞ্জ নিতে পারা রাজনৈতিক নেতা কোথায়? আমাদের এখন প্রয়োজন অসংখ্য স্বচ্ছ এবং ত্যাগী নেতার। যে সমস্ত নেতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের সুখ দুঃখকে ধারণ করে ওপরে ওঠার সুযোগ পাবেন। তারা মওলানা ভাসানির মতো সহজ সরল জীবন ধারণ করবেন। বঙ্গবন্ধুর মতো জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। ফাঁসির রজ্জু এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বললে যিনি বলবেন আমি ফাঁসির রজ্জু চাই, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারব না, এ রকম প্রকৃত জননেতা এখন সময়ের দাবি। এই ঘোর লাগা সময়ে মণি সিংহের মতো ত্যাগী নেতা, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো নির্লোভ নেতার বড়ই প্রয়োজন। আদর্শম-িত রাজনৈতিক নেতা, যারা অনুসরণীয় হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, সে রকম ত্যাগী নেতাদের শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে। আমরা জানি শূন্যস্থান পূরণ করা কঠিন। তাদের আদর্শ, জীবনধারণকে অনুসরণ করে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার সূচনা করতে হবে। ক্রান্তিকাল অতিক্রম করার জন্য আমাদের জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে অনেক সামাজিক নায়ক গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর এই পরিবেশ গড়ে তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন আমাদের সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো। সময়ের ঘণ্টা খুব দ্রুত বেজে চলছে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]

শনিবার, ১৯ জুন ২০২১ , ৫ আষাঢ় ১৪২৮ ৭ জিলকদ ১৪৪২

‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?’

শেখর ভট্টাচার্য

আশির দশক। ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় জহুর হোসেন চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশ মানুষই ছিলেন দৈনিক সংবাদের পাঠক। আমাদের তখন যৌবন। যৌবন মানে ভরা যৌবন। সমাজের বিদ্যমান কোন অসঙ্গতি সহ্য করতে পারি না। যেখানেই নায্যতার অভাব সেখানেই প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয়। দৈনিক সংবাদে বৈঠকি ঢঙে লেখা জহুর হোসেন চৌধুরীর ‘দরবার ই জহুর’, সিরাজুল ইসালাম চৌধুরীর গাছ পাথর ছদ্মনামে লেখা কলাম, সাহিত্য বিভাগে নানা রুচিশীল লেখার সঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকের ‘হৃৎ কলমের টানে’ আমাদের মতো তরুণদের মনের খোরাক জোগাতো, আমরা তাদের লেখা গোগ্রাসে গিলতে থাকতাম। পঁচাত্তর উত্তর বাংলাদেশে তখন ঘোর অমানিশা, দেশকে পেছন দিকে টেনে চাঁদ-তারার কাছা কাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। এরকম ঘোর লাগা সময়ে সংবাদ উচ্চলয়ে নয়, পরিমিতি বোধ বজায় রেখে সাহিত্য সংস্কৃতিতে রুচিবোধ পুনর্জাগরণের চেষ্টা করে গেছে। একই ভাবে আমাদের প্রবাদ প্রতীম সাংবাদিক, বুদ্ধিবজীবীরা ছদ্ম সামরিক শাসনের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে থেকেও প্রয়োজনীয় প্রতিবাদ এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। ইতোমধ্যে অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমি বোধ হয় পঁচাত্তর উত্তর সময়ে দৈনিক সংবাদ পত্রিকাটির ভূমিকা নিয়ে কিছু লিখতে বসছি। আসলে আমার এই লেখার উদ্দেশ্য তা’ নয়।

গত কয়েকদিন ধরে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি কথা বারবার মনে হচ্ছে। তিনি গাছ-পাথর শিরোনামে যখন সংবাদে কলাম লিখতেন তখন প্রায়ই বলতেন এবং এখনও সুযোগ পেলে বলেন প্রতিটি সমাজে তরুণদের সামনে অনুসরণীয় নায়ক প্রয়োজন। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যার পর তিনি বারবার মনে করিয়ে দিতেন বাঙালি জাতির সামনে অনুসরণ করার মতো নেতার দুর্ভিক্ষ চলছে। এক সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অনেক ত্যাগী নেতাকেই তরুণরা অনুসরণ করত। ছাত্র সমাজের সামনেও অনেক অনুসরণীয় ছাত্র নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সময় কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আদর্শের রাজনীতি করে গেছেন। মত ও পথের পার্থক্য থাকতে পারে, জাতীয় স্বার্থে সবার সঙ্গে সবার ঐক্য ছিল দৃঢ়। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখতে পাই, শেরে বাংলা ফজলুল হক যখন কৃষক প্রজা পার্টি করছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার পথের কিছুটা ভিন্নতা তৈরি হয়েছে কিন্তু শ্রদ্ধিব, ভক্তি, ভালোবাসা বিন্দু মাত্র কমেনি। এ ব্যাপারে শুধু বঙ্গবন্ধুই নন তার বাবা তাকে সব সময় বলতেন ‘আর যাই করো বাবা হক সাহেবকে চরকাল সম্মান করে যেও’। এই হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ।

পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে এক বিশাল ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় কি হয়? বায়ুম-লের বায়ু বিভিন্ন কারণে উষ্ণ হয়ে পড়ে, উষ্ণ বায়ু তখন কিছুটা হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। দ্রুত উপরে উঠে যাওয়ার কারণে, বায়ুম-লে শূন্যস্থান তৈরি হয়। সেই শূন্যস্থান পুরনের জন্য উচ্চ চাপ অঞ্চলের বিভিন্ন মানের বায়ু প্রবাহিত হয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক আকাশেও পঁচাত্তরের পর বেনোজলের মতো পরগাছা, বাতিল হয়ে যাওয়া, দেশদ্রোহী অনেক নেতারা এসে শূন্যস্থান পূরণ করতে চেষ্টা করেন। আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, অনুসরণীয় জাতীয় নেতাদের মৃত্যুর পর আর ত্যাগী, কর্মী থেকে ধাপে ধাপে স্বাভাবিক নিয়মে নেতা হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে নষ্ট করে দেয়া হয়। সরা সরি বলতে গেলে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া রাজনীতিবীদদের হাত থেকে রাজনীতি চলে যাওয়ার সংস্কৃতির সূচনা ঘটে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে, সাধারণ মানুষের অন্তরের অনুভূতি অনুধাবন করে ধীরে ধীরে নেতা হওয়া মানুষের হওয়ার যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলছিল, সে প্রক্রিয়াটি থামিয়ে দেয়া হয়। বলা হয়, ‘রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেয়া হবে।’ রাজনীতিতে কর্মী থেকে নেতা হওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আছে। সেই প্রক্রিয়াটিকে যে অচল করে দেয়া হয়েছিল তা আর সচল হতে পারেনি। কোন দলের ভেতরেই এখন আর স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কাজ করছে না। কর্মী থেকে নেতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতা হওয়া সম্ভব এ কথাটি এখন কার্যকর নয়। নিভৃত গ্রামের সাধারণ কোন কর্মীর দলের সদস্যদের ভোটে ধীরে ধীরে নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই তাই অস্বাভাবিক নানা সহজ পথ তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক দলে।

অস্বাভাবিক পথে তৈরি হওয়া নেতা কারা? তারা হলেন অধিকাংশই উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতা। তারা কেউ কেউ শিল্পপতি, অনেকেই সামরিক ও বেসামরিক অব. আমলা কেউ কেউ আছেন দলের শীর্ষ নেতাদের স্বজন। তারা অনেকেই নেতৃত্ব ক্রয় করে নেতা হন। পরে আবার প্রভাব অনুযায়ী অনেকে মন্ত্রিত্বও লাভ করেন। সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, জীবনধারণের বিষয়ে তাদের কোন ধারণা নেই। তাদের ধারণা মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো নির্মাণই একমাত্র উপায়। তারা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাই অবকাঠামো নির্মাণ করতে সবসময় তৎপর থাকেন। যেখানে পথঘাট নেই সেখানেও তারা সেতু নির্মাণ করেন। মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম সৃজন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মানুষের সহজে সেবা গ্রহণ নিশ্চিত করা, মানুষ যাতে তাদের অধিকারের কথা বলতে পারে এ রকম পরিবেশ তৈরি করে মানবাধিকার নিশ্চিত করা যে তাদের প্রধান কাজ, এসব বিষয়ে তারা মোটেই ভাবেন না। মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি নেই, সমভাবনা তো দূরের কথা।

সারা-বিশ্ব এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশেও একইভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি ভয়াবহ ক্রান্তিকালের মধ্যে আছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি আমাদের ধীরে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। গাণিতিকভাবে আমরা মাথাপিছু আয়ের অঙ্ক করে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সফলতায় নিজেরাই নিজেদের বাহবা দিচ্ছি। প্রশ্ন হচ্ছে মাথাপিছু আয় বেশি থাকলেই কি মানুষ ভালো থাকেন নাকি সম্পদের সুষম বণ্টন মানুষকে স্বস্তি দিতে পারে? অসংখ্য বিলাসবহুল হাসপাতাল নির্মিত হলেই কি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে নাকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সব মানুষের সহজে সেবা পাওয়া নিশ্চিত হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত ও কার্যকর বলা যেতে পারে। একইভাবে আমরা শিক্ষা ও অন্যান্য মৌলিক ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করতে পারি। সব সেবা খাতে মানুষের সমান ও সহজ সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ এ রকম বিষয় নিয়ে চিন্তা করবেন কারা? এর সরাসরি উত্তর রাজনীতিবিদরা।

যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জবাদিহিতার সংস্কৃতি কার্যকর সে রকম ব্যবস্থার মধ্যে থেকে, চ্যালেঞ্জ নিতে পারা রাজনৈতিক নেতা কোথায়? আমাদের এখন প্রয়োজন অসংখ্য স্বচ্ছ এবং ত্যাগী নেতার। যে সমস্ত নেতা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের সুখ দুঃখকে ধারণ করে ওপরে ওঠার সুযোগ পাবেন। তারা মওলানা ভাসানির মতো সহজ সরল জীবন ধারণ করবেন। বঙ্গবন্ধুর মতো জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। ফাঁসির রজ্জু এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বললে যিনি বলবেন আমি ফাঁসির রজ্জু চাই, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারব না, এ রকম প্রকৃত জননেতা এখন সময়ের দাবি। এই ঘোর লাগা সময়ে মণি সিংহের মতো ত্যাগী নেতা, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো নির্লোভ নেতার বড়ই প্রয়োজন। আদর্শম-িত রাজনৈতিক নেতা, যারা অনুসরণীয় হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, সে রকম ত্যাগী নেতাদের শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে। আমরা জানি শূন্যস্থান পূরণ করা কঠিন। তাদের আদর্শ, জীবনধারণকে অনুসরণ করে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার সূচনা করতে হবে। ক্রান্তিকাল অতিক্রম করার জন্য আমাদের জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে অনেক সামাজিক নায়ক গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর এই পরিবেশ গড়ে তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন আমাদের সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো। সময়ের ঘণ্টা খুব দ্রুত বেজে চলছে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।

[লেখক : উন্নয়ন গবেষক]