প্রধানমন্ত্রীকে ‘সাতকরা’ রান্না করে খাওয়ানোর ইচ্ছা বীরাঙ্গনা শিলার

মুক্তিযুদ্ধকালে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে মৃত ভেবে ধানখেতে ফেলে দিয়েছিল, যাত্রাদলের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে বাগেরহাটের মেয়ে শিলা গুহের এক সময় ঠাঁই হয়েছিল শ্রীমঙ্গলে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে তিনি পেয়েছেন নতুন ঘর।

গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় ধাপে সাড়ে ৫৩ হাজার পরিবারকে দুই শতক জমিসহ সেমি পাকা ঘর প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। সেই অনুষ্ঠানে নিজের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন মৌলভীবাজারের বীরাঙ্গনা শিলা গুহ।

তিনি বলেন, ‘আমি ঘর পেয়ে খুবই খুশি। আমি আগে ছিলাম রাস্তার ভিখারি। এখন আমি লাখপতি। শুধুমাত্র মুজিবকন্যার জন্যই এই পথে আমি আসতে পেরেছি। তাই ভগবান তাকে দীর্ঘজীবী করুক, আমি এই কামনা করি।’

নতুন পাওয়া ঘরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে শিলা গুহ বলেন, শেখ মুজিবের মেয়ে তার বাড়ি গেলে সাতকরা দিয়ে তরকারি রেঁধে খাওয়াবেন।

মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা শিলা

শিলা যাত্রাদলের সঙ্গে মুক্তিযদ্ধের শুরুর দিকে ছিলেন কুড়িগ্রামে। সেখানে অলিপুর বালিকা বিদ্যালয়ে থাকাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্যাতিতা হন।

দিনের পর দিন শিলা ও আরও কয়েকজন কিশোরীকে স্কুলের কক্ষে আটকে রেখে ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনারা। একদিন জ্ঞান না ফেরায় শিলাকে মৃত ভেবে পাশে একটি ধানখেতে ফেলে দেয় তারা।

স্থানীয় দুই ভাই শিলাকে উদ্ধার করে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তোলেন। পরে পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। আরেক পরিবারের সঙ্গে শিলা ভারতে চলে যান।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাগেরহাটের পেয়াজহাটির কচুর হাঠখোলায় নিজের বাড়িতে ফিরলেও সেখানে জায়গা হয়নি শিলার। তখন আবার যোগ দেন যাত্রাদলে। সেই দলের গাড়িচালক যতীন গুহের সঙ্গে শিলার বিয়ে হয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের খবর জেনে শিলাকে ছেড়ে চলে যান তার স্বামী যতীন। এরপর থেকে শিলা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় থাকছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাদের একজন স্বামীর বাড়ি থাকলেও আরেকজন ফিরে এসেছেন এক মেয়েসহ।

সাতকরা দিয়ে তরকারি খাওয়ানোর ইচ্ছা

আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাড়ি পাওয়ার আনন্দের কথা বলতে গিয়ে শিলা সেসব দিনের কথাও স্মরণ করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা যে এই বৃদ্ধ বয়সেও তাকে দেখে রাখবেন, তা তিনি ভাবতে পারেননি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের আত্মার শান্তি কামনা করে শিলা বলেন, ‘তারা যেন স্বর্গ থেকে দেখতে পায়, আমরা সুখী হয়েছি। আরও একটি কথাÑ আমি এখনও আপনার জন্য প্রতিদিন দুটা করে বাতি জ্বালাই। কারণ আমার বোন যাতে সুখী থাকে, আমার বোনকে যেন করোনাভাইরাস আক্রান্ত করতে না পারে, আমার বোন যাতে হাজার বছর বাঁচে, সেই কামনা করি।’

শিলা তার বক্তব্যের শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শ্রীমঙ্গলে তার পাওয়া ঘর দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রী গেলে তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাতকরা দিয়ে তরকারি রেঁধে খাওয়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

কথা বলতে বলতে ভিজে আসে শ্রীমঙ্গল উপজেলার মাইজদীঘি গ্রামের বীরাঙ্গনা শিলা গুহের চোখ। তার কথা শুনতে শুনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চোখও অশ্রুসজল হয়, ভারি হয়ে আসে কণ্ঠ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বোন, আমি যদি সুযোগ পাই, নিশ্চয়ই আমি আসার চেষ্টা করব।’

শিলা দেবীর কান্নায় আবেগ আপ্লুত হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিলা দেবীর কথাগুলো বলা শেষ হওয়া মাত্রই চশমা খুলে চোখ মুছতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীকে।

সোমবার, ২১ জুন ২০২১ , ৭ আষাঢ় ১৪২৮ ৯ জিলকদ ১৪৪২

প্রধানমন্ত্রীকে ‘সাতকরা’ রান্না করে খাওয়ানোর ইচ্ছা বীরাঙ্গনা শিলার

সংবাদ ডেস্ক

image

বীরাঙ্গনা শিলা

মুক্তিযুদ্ধকালে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে মৃত ভেবে ধানখেতে ফেলে দিয়েছিল, যাত্রাদলের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে বাগেরহাটের মেয়ে শিলা গুহের এক সময় ঠাঁই হয়েছিল শ্রীমঙ্গলে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে তিনি পেয়েছেন নতুন ঘর।

গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় ধাপে সাড়ে ৫৩ হাজার পরিবারকে দুই শতক জমিসহ সেমি পাকা ঘর প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। সেই অনুষ্ঠানে নিজের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন মৌলভীবাজারের বীরাঙ্গনা শিলা গুহ।

তিনি বলেন, ‘আমি ঘর পেয়ে খুবই খুশি। আমি আগে ছিলাম রাস্তার ভিখারি। এখন আমি লাখপতি। শুধুমাত্র মুজিবকন্যার জন্যই এই পথে আমি আসতে পেরেছি। তাই ভগবান তাকে দীর্ঘজীবী করুক, আমি এই কামনা করি।’

নতুন পাওয়া ঘরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে শিলা গুহ বলেন, শেখ মুজিবের মেয়ে তার বাড়ি গেলে সাতকরা দিয়ে তরকারি রেঁধে খাওয়াবেন।

মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা শিলা

শিলা যাত্রাদলের সঙ্গে মুক্তিযদ্ধের শুরুর দিকে ছিলেন কুড়িগ্রামে। সেখানে অলিপুর বালিকা বিদ্যালয়ে থাকাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্যাতিতা হন।

দিনের পর দিন শিলা ও আরও কয়েকজন কিশোরীকে স্কুলের কক্ষে আটকে রেখে ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনারা। একদিন জ্ঞান না ফেরায় শিলাকে মৃত ভেবে পাশে একটি ধানখেতে ফেলে দেয় তারা।

স্থানীয় দুই ভাই শিলাকে উদ্ধার করে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তোলেন। পরে পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। আরেক পরিবারের সঙ্গে শিলা ভারতে চলে যান।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাগেরহাটের পেয়াজহাটির কচুর হাঠখোলায় নিজের বাড়িতে ফিরলেও সেখানে জায়গা হয়নি শিলার। তখন আবার যোগ দেন যাত্রাদলে। সেই দলের গাড়িচালক যতীন গুহের সঙ্গে শিলার বিয়ে হয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের খবর জেনে শিলাকে ছেড়ে চলে যান তার স্বামী যতীন। এরপর থেকে শিলা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় থাকছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাদের একজন স্বামীর বাড়ি থাকলেও আরেকজন ফিরে এসেছেন এক মেয়েসহ।

সাতকরা দিয়ে তরকারি খাওয়ানোর ইচ্ছা

আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাড়ি পাওয়ার আনন্দের কথা বলতে গিয়ে শিলা সেসব দিনের কথাও স্মরণ করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা যে এই বৃদ্ধ বয়সেও তাকে দেখে রাখবেন, তা তিনি ভাবতে পারেননি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের আত্মার শান্তি কামনা করে শিলা বলেন, ‘তারা যেন স্বর্গ থেকে দেখতে পায়, আমরা সুখী হয়েছি। আরও একটি কথাÑ আমি এখনও আপনার জন্য প্রতিদিন দুটা করে বাতি জ্বালাই। কারণ আমার বোন যাতে সুখী থাকে, আমার বোনকে যেন করোনাভাইরাস আক্রান্ত করতে না পারে, আমার বোন যাতে হাজার বছর বাঁচে, সেই কামনা করি।’

শিলা তার বক্তব্যের শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শ্রীমঙ্গলে তার পাওয়া ঘর দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রী গেলে তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাতকরা দিয়ে তরকারি রেঁধে খাওয়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

কথা বলতে বলতে ভিজে আসে শ্রীমঙ্গল উপজেলার মাইজদীঘি গ্রামের বীরাঙ্গনা শিলা গুহের চোখ। তার কথা শুনতে শুনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চোখও অশ্রুসজল হয়, ভারি হয়ে আসে কণ্ঠ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বোন, আমি যদি সুযোগ পাই, নিশ্চয়ই আমি আসার চেষ্টা করব।’

শিলা দেবীর কান্নায় আবেগ আপ্লুত হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিলা দেবীর কথাগুলো বলা শেষ হওয়া মাত্রই চশমা খুলে চোখ মুছতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীকে।