বাজেটে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন

মিহির কুমার রায়

দেশের অর্থনীতিতে কৃষি গ্রামীণ জীবন ও জীবিকার প্রধান বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পল্লী উন্নয়নের কথা আসলেই কৃষি সবার আগে চলে আসে। সরকার বাজেটে কেবল কৃষি খাতে ১৬১৯৭ কোটি টাকা আগামী বছরের বাজেটে প্রস্তাব করেছে। তার সাথে মৎস্য, পশুসম্পদ, বন ইত্যাদিকে যোগ দিলে সার্বিক কৃষি খাতে বাজেট দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের ৫.৩ শতাংশ। কাজেই ব্যাপক অর্থে পল্লী উন্নয়ন খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা উন্নয়ন বাজেটের ২৯.৬ শতাংশ এবং অনুন্নয়ন বাজেটের ২০.২ শতাংশ বলে প্রতীয়মান হয়।

কৃষি যেহেতু একটি অগ্রাধিকারভুক্ত খাত এবং খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই গত বছরগুলোতে এ খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল ৩২ হাজার ৫০২২ কোটি টাকা, যা গড়ে প্রতি বছর দাঁড়ায় ৬৫০১.৪ কোটি টাকা এবং আগামী বছরের বাজেটের ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে ১০ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। সরকার মনে করছে, কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ, কৃষি গবেষণায় দক্ষতা বৃদ্ধি, কৃষির বহুমুখীকরণ, রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ, পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদিতে জোর দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বর্তমান বছরের বাজেটে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) যে টার্গেট ধরা হয়েছে তা অজর্নে কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় সেই খাতে প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ৪.৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে বলে কৃষি অথনীতিবিদরা মনে করেন। কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি ও খাদ্য উৎপাদন খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা কতটা জরুরি। ২০২০-২১ অর্থবছরে কোভিডের কারণে ভারতসহ অনেক দেশের জিডিপিতে যেখানে নেতিবাচক সূচক পরিলক্ষিত, সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে খাতগুলো প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে, কৃষি তার মধ্যে প্রধানতম। মহামারীকালেও বাংলাদেশের জিডিপিতে গড় প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের মতে ৩.৬ শতাংশ, এডিবির মতে ৫.৫-৬ শতাংশ এবং সরকারি তথ্যমতে ৫.২ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি যা-ই হোক না কেন তা অর্জিত হয়েছে মূলত কৃষি, প্রবাসী আয় এবং পোশাক রপ্তানি খাত থেকে।

কৃষি খাতের আগামী বছরের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায় মুরগি, মাছ ও গবাদিপশুর খাবার তৈরির উপকরণ আমদানিতে কাঁচামালে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, নিড়ানি, ঝাড়াই কল, কম্বাইন হারভেস্ট, থ্রেসার, রিপার, পাওয়ার টিলার, সিডার ইত্যাদি কৃষিযন্ত্রে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, যা সামগ্রিক কৃষির জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ। কৃষি খাতের এই বাজেটকে সাধুবাদ জানাতে চাই। কিন্তু কোভিডে লকডাউনে আমরা লক্ষ্য করেছি- পণ্য যে অঞ্চলে উৎপন্ন হয় না সেখানে তার আকাশছোঁয়া দাম। আর যেটি উৎপন্ন হয় তা কৃষক বিক্রি করতে পারছেন না। কৃষিপণ্য রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। বাজেটে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা নেই। এ রকম বাস্তবতায় কৃষি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩.৬ শতাংশ, মোট বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশ, কৃষি খাতের বাজেটও বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশ।

তথ্য বলছে- বিগত বছরগুলোতে জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতের বরাদ্দ অবহেলিত হয়ে এসেছে এবং কৃষি খাতে ভর্তুকি অন্যান্যবারের মতো এবারেও একই অবস্থা রয়েছে।

এখন আসা যাক বিনিয়োগের প্রসঙ্গে, যা বর্তমান বছরের বাজেট উন্নয়ন খাতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০৩০ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ বছরের সংশোধিত বাজেট ছিল ২.৩৯৭ কোটি টাকা (যা ঘোষিত ২৫৪৪ কোটি টাকার বিপরীতে)। আবার যদি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পর্যালোচনা করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, জিডিপিতে এর হার মাত্র ২২% ভাগ; যা গত কয়েক বছর যাবত স্থবির হয়ে আছে। আবার ব্যাংকিং খাতের হিসাবে দেখা যায় যে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যক্তি পর্যায়ে যে বিনিয়োগ হয়েছে তা সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ এবং এতে কৃষি খাতের অংশ আরও কম অথচ ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি বাণিজ্যকরণের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল- যেখানে পরিবারভিত্তিক চাষাবাদকে পরিহার করে খামারভিত্তিক বৈজ্ঞানিক চাষাবাদকে (গ্রিন হাউস) উৎসাহিত করা হয়েছিল।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছে, ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিরা অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। বাজার ব্যবস্থাপানায় এসব কৃষকের কোন প্রবেশাধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি; যার প্রমাণ কৃষিপণ্য বিশেষত কৃষকের ধানের মূল্য না পাওয়া যার প্রভাব পড়েছে ক্রমাগতভাবে কৃষি প্রবৃদ্ধির হ্রাস পাওয়ায়। কৃষি বাজেটের আরও দিক হলো কৃষির প্রক্রিয়া যেহেতু গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই এর গতিশীলতা ও কর্মসংস্থান বাড়াতে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৩৫ হাজার ২৯ কোটি টাকা (বাজেটের ৭.৪৮ শতাংশ), নদীভাঙন রোধ ও নদী ব্যবস্থাপনার জন্য পানিসম্পদ খাতে ৬ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা (বাজেটের ২.৭৯ শতাংশ) বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাত মিলিয়ে বর্তমান অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৬ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৬৬ হাজার ২৩৪ কোটি ৬৭৭ লাখ টাকা (হিসাব মতে বেড়েছে ৭১৩ কোটি টাকা)।

করোনাকালেও বাজেট বৃদ্ধি পেলেও ঘাটতি বাজেটের বিষয় এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে এবং কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার বিষয়।

কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি তাকে প্রকৃতিবান্ধবও করে তুলতে হবে। জনগণের স্বাস্থ্য, পুষ্টির সঙ্গে সমন্বয় রেখে কৃষি ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে সম্ভাব্য খাদ্য বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে, পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র এবং পারিবারিক কৃষকদের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

বর্তমানে সীমান্তবর্তী উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে করোনার প্রভাব সবচাইতে বেশি, যার প্রভাব পড়ছে কৃষিপণ্যের ওপর। যেমন- আম নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজশাহী অঞ্চলের আমচাষিরা এবং এই পরিস্থিতিতে লকডাউন দেয়ার ফলে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব উভয়ই বাড়বে বলে মনে করেন গবেষকরা। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, দেশব্যাপী কঠোরভাবে লকডাউন সম্ভব নয়; কারণ এতে দেশের ৬ কোটি কৃষক পরিবার, পৌনে ২ কোটি ইনফরমাল খাতে নিয়োজিত কর্মহীন এবং কৃষিপণ্যের ওপর ১৭ কোটি ভোক্তা যারা নির্ভরশীল তাদের কী হবে। তার মতে, মানবিক লকডাউন যা সরকার অনুসরণ করছে সেভাবেই সরকার এগোবে। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় এ জটিল বিষয়গুলো সেভাবে উপস্থাপিত হলে ভালো হতো। দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় ১৫০ উপজেলার সব প্রবীণ, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ এক-চতুর্থাংশ পরিবারকে সামাজিক নিবাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী মোট খাদ্য উৎপাদনের ৮০ শতাংশই আসে পারিবারিক কৃষির মাধ্যমে, যার বিবেচনায় জাতিসংঘ ইতোমধ্যে (২০১৯-২০২৮) পারিবারিক কৃষি দশক ঘোষণা করেছে এবং একটি বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনাও চূড়ান্ত করেছে। এ কর্মপরিকল্পনার আলোকে জাতীয় পর্যায়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে সরকার এবং কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার নকশা তৈরি অত্যন্ত জরুরি। যার জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, কুটির শিল্প, সংরক্ষণাগার, যান্ত্রিকীকরণ, বাজার ব্যবস্থাপনাসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও পারিবারিক কৃষির উন্নয়ন, কৃষি সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ও সেবা এবং জৈব কৃষি বা জলবায়ু সহনশীল স্থায়ীত্বশীল কৃষিচর্চায়, যা খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশের অগণিত কৃষক যারা খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তাদের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন দৃশ্যত দেখা যায় না। তাই কৃষক পরিবারের জন্য ভাতা-পেনশনের ব্যবস্থা বাজেটে রাখতে হবে; যেমন ভারতের কেরালা রাজ্যের কমিউনিস্ট সরকার কৃষকদের জীবনমান রক্ষার জন্য বহু আগে থেকেই এ ব্যবস্থা চালু রেখেছে- যা প্রশংসনীয়। বর্তমানে করোনার সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষায় টিকা গ্রহণের প্রাধিকারের তালিকায় কৃষকদের-গ্রামবাসীদেরও সংযুক্ত করতে হবে। আশা করা যায়, বাজেট সংক্রান্ত এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

[লেখক : ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য,

সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন ২০২১ , ১০ আষাঢ় ১৪২৮ ১২ জিলকদ ১৪৪২

বাজেটে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন

মিহির কুমার রায়

image

দেশের অর্থনীতিতে কৃষি গ্রামীণ জীবন ও জীবিকার প্রধান বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পল্লী উন্নয়নের কথা আসলেই কৃষি সবার আগে চলে আসে। সরকার বাজেটে কেবল কৃষি খাতে ১৬১৯৭ কোটি টাকা আগামী বছরের বাজেটে প্রস্তাব করেছে। তার সাথে মৎস্য, পশুসম্পদ, বন ইত্যাদিকে যোগ দিলে সার্বিক কৃষি খাতে বাজেট দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের ৫.৩ শতাংশ। কাজেই ব্যাপক অর্থে পল্লী উন্নয়ন খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা উন্নয়ন বাজেটের ২৯.৬ শতাংশ এবং অনুন্নয়ন বাজেটের ২০.২ শতাংশ বলে প্রতীয়মান হয়।

কৃষি যেহেতু একটি অগ্রাধিকারভুক্ত খাত এবং খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই গত বছরগুলোতে এ খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল ৩২ হাজার ৫০২২ কোটি টাকা, যা গড়ে প্রতি বছর দাঁড়ায় ৬৫০১.৪ কোটি টাকা এবং আগামী বছরের বাজেটের ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে ১০ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। সরকার মনে করছে, কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ, কৃষি গবেষণায় দক্ষতা বৃদ্ধি, কৃষির বহুমুখীকরণ, রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ, পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদিতে জোর দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বর্তমান বছরের বাজেটে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) যে টার্গেট ধরা হয়েছে তা অজর্নে কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় সেই খাতে প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ৪.৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে বলে কৃষি অথনীতিবিদরা মনে করেন। কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি ও খাদ্য উৎপাদন খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা কতটা জরুরি। ২০২০-২১ অর্থবছরে কোভিডের কারণে ভারতসহ অনেক দেশের জিডিপিতে যেখানে নেতিবাচক সূচক পরিলক্ষিত, সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে খাতগুলো প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে, কৃষি তার মধ্যে প্রধানতম। মহামারীকালেও বাংলাদেশের জিডিপিতে গড় প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের মতে ৩.৬ শতাংশ, এডিবির মতে ৫.৫-৬ শতাংশ এবং সরকারি তথ্যমতে ৫.২ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি যা-ই হোক না কেন তা অর্জিত হয়েছে মূলত কৃষি, প্রবাসী আয় এবং পোশাক রপ্তানি খাত থেকে।

কৃষি খাতের আগামী বছরের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায় মুরগি, মাছ ও গবাদিপশুর খাবার তৈরির উপকরণ আমদানিতে কাঁচামালে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, নিড়ানি, ঝাড়াই কল, কম্বাইন হারভেস্ট, থ্রেসার, রিপার, পাওয়ার টিলার, সিডার ইত্যাদি কৃষিযন্ত্রে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, যা সামগ্রিক কৃষির জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ। কৃষি খাতের এই বাজেটকে সাধুবাদ জানাতে চাই। কিন্তু কোভিডে লকডাউনে আমরা লক্ষ্য করেছি- পণ্য যে অঞ্চলে উৎপন্ন হয় না সেখানে তার আকাশছোঁয়া দাম। আর যেটি উৎপন্ন হয় তা কৃষক বিক্রি করতে পারছেন না। কৃষিপণ্য রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। বাজেটে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা নেই। এ রকম বাস্তবতায় কৃষি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩.৬ শতাংশ, মোট বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশ, কৃষি খাতের বাজেটও বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশ।

তথ্য বলছে- বিগত বছরগুলোতে জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতের বরাদ্দ অবহেলিত হয়ে এসেছে এবং কৃষি খাতে ভর্তুকি অন্যান্যবারের মতো এবারেও একই অবস্থা রয়েছে।

এখন আসা যাক বিনিয়োগের প্রসঙ্গে, যা বর্তমান বছরের বাজেট উন্নয়ন খাতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০৩০ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ বছরের সংশোধিত বাজেট ছিল ২.৩৯৭ কোটি টাকা (যা ঘোষিত ২৫৪৪ কোটি টাকার বিপরীতে)। আবার যদি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পর্যালোচনা করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, জিডিপিতে এর হার মাত্র ২২% ভাগ; যা গত কয়েক বছর যাবত স্থবির হয়ে আছে। আবার ব্যাংকিং খাতের হিসাবে দেখা যায় যে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যক্তি পর্যায়ে যে বিনিয়োগ হয়েছে তা সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ এবং এতে কৃষি খাতের অংশ আরও কম অথচ ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৃষি বাণিজ্যকরণের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল- যেখানে পরিবারভিত্তিক চাষাবাদকে পরিহার করে খামারভিত্তিক বৈজ্ঞানিক চাষাবাদকে (গ্রিন হাউস) উৎসাহিত করা হয়েছিল।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছে, ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিরা অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। বাজার ব্যবস্থাপানায় এসব কৃষকের কোন প্রবেশাধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি; যার প্রমাণ কৃষিপণ্য বিশেষত কৃষকের ধানের মূল্য না পাওয়া যার প্রভাব পড়েছে ক্রমাগতভাবে কৃষি প্রবৃদ্ধির হ্রাস পাওয়ায়। কৃষি বাজেটের আরও দিক হলো কৃষির প্রক্রিয়া যেহেতু গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই এর গতিশীলতা ও কর্মসংস্থান বাড়াতে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৩৫ হাজার ২৯ কোটি টাকা (বাজেটের ৭.৪৮ শতাংশ), নদীভাঙন রোধ ও নদী ব্যবস্থাপনার জন্য পানিসম্পদ খাতে ৬ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা (বাজেটের ২.৭৯ শতাংশ) বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাত মিলিয়ে বর্তমান অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৬ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৬৬ হাজার ২৩৪ কোটি ৬৭৭ লাখ টাকা (হিসাব মতে বেড়েছে ৭১৩ কোটি টাকা)।

করোনাকালেও বাজেট বৃদ্ধি পেলেও ঘাটতি বাজেটের বিষয় এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে এবং কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার বিষয়।

কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি তাকে প্রকৃতিবান্ধবও করে তুলতে হবে। জনগণের স্বাস্থ্য, পুষ্টির সঙ্গে সমন্বয় রেখে কৃষি ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে সম্ভাব্য খাদ্য বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে, পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র এবং পারিবারিক কৃষকদের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

বর্তমানে সীমান্তবর্তী উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোতে করোনার প্রভাব সবচাইতে বেশি, যার প্রভাব পড়ছে কৃষিপণ্যের ওপর। যেমন- আম নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজশাহী অঞ্চলের আমচাষিরা এবং এই পরিস্থিতিতে লকডাউন দেয়ার ফলে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব উভয়ই বাড়বে বলে মনে করেন গবেষকরা। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, দেশব্যাপী কঠোরভাবে লকডাউন সম্ভব নয়; কারণ এতে দেশের ৬ কোটি কৃষক পরিবার, পৌনে ২ কোটি ইনফরমাল খাতে নিয়োজিত কর্মহীন এবং কৃষিপণ্যের ওপর ১৭ কোটি ভোক্তা যারা নির্ভরশীল তাদের কী হবে। তার মতে, মানবিক লকডাউন যা সরকার অনুসরণ করছে সেভাবেই সরকার এগোবে। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় এ জটিল বিষয়গুলো সেভাবে উপস্থাপিত হলে ভালো হতো। দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় ১৫০ উপজেলার সব প্রবীণ, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ এক-চতুর্থাংশ পরিবারকে সামাজিক নিবাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী মোট খাদ্য উৎপাদনের ৮০ শতাংশই আসে পারিবারিক কৃষির মাধ্যমে, যার বিবেচনায় জাতিসংঘ ইতোমধ্যে (২০১৯-২০২৮) পারিবারিক কৃষি দশক ঘোষণা করেছে এবং একটি বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনাও চূড়ান্ত করেছে। এ কর্মপরিকল্পনার আলোকে জাতীয় পর্যায়ে নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে সরকার এবং কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার নকশা তৈরি অত্যন্ত জরুরি। যার জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, কুটির শিল্প, সংরক্ষণাগার, যান্ত্রিকীকরণ, বাজার ব্যবস্থাপনাসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও পারিবারিক কৃষির উন্নয়ন, কৃষি সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ও সেবা এবং জৈব কৃষি বা জলবায়ু সহনশীল স্থায়ীত্বশীল কৃষিচর্চায়, যা খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশের অগণিত কৃষক যারা খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তাদের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন দৃশ্যত দেখা যায় না। তাই কৃষক পরিবারের জন্য ভাতা-পেনশনের ব্যবস্থা বাজেটে রাখতে হবে; যেমন ভারতের কেরালা রাজ্যের কমিউনিস্ট সরকার কৃষকদের জীবনমান রক্ষার জন্য বহু আগে থেকেই এ ব্যবস্থা চালু রেখেছে- যা প্রশংসনীয়। বর্তমানে করোনার সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষায় টিকা গ্রহণের প্রাধিকারের তালিকায় কৃষকদের-গ্রামবাসীদেরও সংযুক্ত করতে হবে। আশা করা যায়, বাজেট সংক্রান্ত এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

[লেখক : ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য,

সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]