স্থলবন্দরগুলোর সমস্যা ও সম্ভাবনা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। স্থলবন্দর কর্তৃক ব্যবহার উপযোগী, অবকাঠামো উন্নয়ন, পণ্য লোডিং-আনলোডিং, পণ্য সংরক্ষণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ঘোষিত ১৮১টি শুল্ক স্টেশনের মধ্যে ২৪টি স্থল শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করে, যার মধ্যে ১২টি চালু রয়েছে এবং বাকি ১২টি চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। ১২টি চালু বন্দরের মধ্যে বেনাপোল, বুড়িমারী, আখাউড়া, ভোমরা, নাকুগাঁও, তামাবিল, সোনাহাটসহ এই সাতটি বন্দর সরাসরি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। বাকি পাঁচটি যথাক্রমে- সোনামসজিদ, হিলি, বাংলাবান্ধা, টেকনাফ ও বিবিরবাজার বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে বিওটি ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। আরো ১২টি নতুন স্থলবন্দর নির্মাণাধীন রয়েছে। স্থলবন্দরসমূহের মধ্যে বেনাপোল স্থলবন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থলপথে সম্পাদিত মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯০ ভাগই বেনাপোল স্থলবন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে সীমান্তে কাজ করতে হয়। এজন্য তাদের অনেক জমি অধিগ্রহণ এবং অবকাঠামো নির্মাণকাজ হাতে নিতে হয়। জমি অধিগ্রহণে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পরিণতিতে বার্ষিক উন্নয়ন অগ্রগতি মন্থর হয়ে যায়, সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রভাব ফেলে। তাছাড়া ত্রিদেশীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় অন্য দেশের ভূরাজনৈতিক বিষয়াদি বন্দরের কার্যক্রমেও প্রভাব সৃষ্টি করে। অনেক সময় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি প্রস্তুত থাকলেও অন্যদেশ যদি তার স্থলবন্দরের ভালোভাবে উন্নতি না করে, তাহলে বাংলাদেশে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এর পুরো সুফল ঘরে তুলতে পারে না। এজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত কার্যকর ব্যবস্থা, যা উভয় পক্ষ বা সকল পক্ষের জন্য অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করে।

গত এক দশকে দেশের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে মানুষ ও পণ্য পরিবহন বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে স্থলবন্দর সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন বন্দর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কারোনাকালে স্থলবন্দরে পণ্য পরিবহন সীমিত। কিন্তু করোনার পর যখন ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হয়ে আসবে, তখন পণ্য ও যাত্রী পরিবহন বাড়বে। অতএব এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। স্থলবন্দগুলোর আয় যেমন বেড়েছে তেমনি এর কাজের বিস্তৃতিও বেড়েছে। বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের কারণে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে আমদানি এবং রপ্তানি দুটিই বেড়েছে। আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থলবন্দরের গতিশীলতাও বেড়েছে, সেই সঙ্গে আয়ও বেড়েছে। বন্দরের সার্বিক কর্মকান্ডও বাড়ছে- সে কারণে জনবলও বাড়াতে হচ্ছে। নতুন নতুন অবকাঠামো বাড়াতে হচ্ছে। সব কিছু মিলে স্থলবন্দরগুলোর সার্বিক কর্মচাঞ্চল্য আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে স্থলবন্দরগুলো ২৫ ভাগ অবদান রাখছে। বছরে আয় করছে ২০০ কোটি টাকারও বেশি। সরকারি কোষাগারে প্রতিবছর ভ্যাট-ট্যাক্সসহ অন্যান্য চার্জবাবদ জমা দিচ্ছে ৩০-৪০ কোটি টাকা। স্থলবন্দরগুলোতে প্রচুর পণ্য আসছে এবং যাচ্ছে। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির ২০-২৫ শতাংশ স্থলবন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া করা হয়।

বন্দরগুলো আরো গতিশীল ও কার্যকর করার পক্ষেও আছে নানা সমস্যা। যেমন- যশোরের বেনাপোল, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, দিনাজপুরের হিলি, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা, কক্সবাজারের টেকনাফ এবং সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের অবকাঠামো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আজও দুর্বল। বন্দরগুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করে সক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। যতদূর জানা যায়, বেনাপোল ছাড়া অন্যান্য স্থলবন্দরে আধুনিক পার্কিং ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত গুদামঘর, ওজনযন্ত্র, ব্যাংকিং সুবিধা ইত্যাদি নাই। ফলে সীমান্ত অতিক্রমকালে বন্দরের আনুষ্ঠানিকতায় বিলম্ব হয়। এতে দেখা যায়, পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি। বেড়ে যায় পরিবহন ব্যয়; যা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া বন্দরগুলোর কাজ-কর্ম গতিশীল করতে পণ্যখালাস পদ্ধতিতে আধুনিকতার ছাপ থাকা প্রয়োজন। কাগজপত্র কম্পিউটারাইজড করা দরকার। দরকার উন্নতমানের সড়ক। স্থলবন্দরগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। এক্ষেত্রে প্রাপ্ত বরাদ্দও অপ্রতুল।

স্থলবন্দর নির্মাণে অর্থ সংকটের পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও রয়েছে। উক্ত নির্মাণ কাজের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, নৌ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জড়িত থাকে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে কাগজপত্র অনুমোদন নিতে অনেক সময় অপচয় হয়। এ কারণেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু হয় না। স্থলবন্দরগুলোর আয় বাড়াতে হলে এগুলোর দক্ষতা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার বিকল্প নেই। সমস্যাটি দ্বিমুখী। স্থলবন্দরগুলোর দক্ষতা না বাড়ালে আয় বাড়ানো যাবে না, আবার আয় না বাড়লে অবকাঠামোগত উন্নয়নও কঠিন হবে বৈকি। বর্তমানে স্থলবন্দর ছাড়া বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন দিয়েও পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। এসব শুল্ক স্টেশনের ব্যয় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে সব পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে স্থলবন্দর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করলে আয় অবশ্যই বাড়বে। মনে রাখা দরকার, বন্দরকে বলা হয়- অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতীক। স্থল, সমুদ্র কিংবা বিমানবন্দর কোনোটিরই গুরুত্ব আসলে কম নয়। তবে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে স্থলবন্দরগুলোর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। আর স্থলবন্দরগুলোর সার্বিক উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াবার কোনো বিকল্প নেই। সরকারের উচিত- জনস্বার্থেই স্থলবন্দরের উন্নয়নে যথাযথ বাজেট বরাদ্দ করা। মূলত সব সমস্যা সমাধানে চাই সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা তথা সততা।

বন্দরগুলোর বিভিন্ন অনিয়ম ও সমস্যা দূরীকরণার্থে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা ও সংস্কারে আশু মনোযোগ দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।

মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব দক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। কাজের গুণগত মান বৃদ্ধিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে হবে। বন্দরসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়কে একটি একক ও সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতায়নপূর্বক তার দায়িত্বকে কার্যকর ও কাঠামোগত আইনি সংস্কারের আওতায় আনতে হবে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কাজগুলোকে সুদৃঢ় আইনি কাঠামোতে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার আবশ্যক।

পর্যবেক্ষণ, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনাকে নিবিড় ও কার্যকর করতে হবে নিজস্ব টিমের মাধ্যমে।

অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে।

সর্বোপরি নিচে বর্ণিত প্রস্তাবনা ও সুপারিশসমূহকেও বিবেচনায় আনতে হবে-

ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ভিসা ব্যবস্থার সমন্বয়।

একটি কার্যকর আঞ্চলিক ট্রানজিট সৃষ্টি।

আমদানি-রপ্তানির কাগজপত্রগুলো যৌক্তিক ও ডিজিটাল করা।

অবকাঠামোর নকশাগুলো আন্তর্জাতিক মানের করা।

পরিবহন সেবার প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা।

স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যুক্ত করা।

বাংলাদেশ ও ভারতে অফ বর্ডার কাস্টম সুবিধা নিশ্চিত করা।

স্থানীয় বাজারের সঙ্গে আঞ্চলিক করিডোরের সমন্বয় ঘটানো।

রপ্তানিমুখী ভ্যালু চেইনে লজিস্টিকসের দুর্বলতাগুলো দূর করা এবং

রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের ভ্যালু চেইনে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

উপরোল্লিখিত প্রস্তাবনা ও সুপারিশের আলোকে বিষয়গুলোর আলোকে অবকাঠামোগত ত্রুটি, নীতি ও বিধিমালার সংস্কার, শুল্কায়ন ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে এর সমাধান করতে হবে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে বৈধপথে সুষ্ঠু ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রীসাধারণের চলাচল এবং মালামাল পরিবহন প্রতিবেশী দেশের একটি মৌলিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে যাত্রীদের সেবা প্রদান এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের জন্য নৈতিক ও মানবিকও বটে। বন্দরসমূহে যাত্রী হয়রানি ও ভোগান্তির মতো ঘটনা ঘটলে যাত্রীসেবার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং সেই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করে। যাত্রী সাধারণের যাতায়াত ব্যবস্থাকে ইচ্ছে করলেই সহজীকরণ করা সম্ভব। আর দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতা থেকে অনেক জটিল সমস্যারও সমাধান হয়ে থাকে।

সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে হয়রানি বা হঠকারি মনোভাব কিছুতেই কাম্য নয়। প্রয়োজনে উচ্চপর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ভোগান্তি ও দুর্ভোগ অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। সর্বোপরি বিভিন্ন বন্দর ও ইমিগ্রেশনে শৃৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির আলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এছাড়া বন্দরে যে সমস্ত অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও শৈথিল্য পরিলক্ষিত হয় তাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারি ও তদারকি ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। অদক্ষতা হচ্ছে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার মূল সূত্র। কাজেই দক্ষতা, শৃঙ্খলা পেশাগত দায়িত্ব, ন্যয়-নিষ্ঠা অনুশীলনপূর্বক দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন্দরকে গতিশীল করে মালামাল পরিবহন ও যাত্রীবান্ধব করতে হবে। বন্দরকে সুন্দর ও যাতায়াতবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বিতভাবে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

image

গত এক দশকে দেশের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে মানুষ ও পণ্য পরিবহন বেড়েছে কয়েকগুণ

আরও খবর
মহাশূন্যে জমাট লড়াই
মূলধারায় ফেরাতে হবে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে

শুক্রবার, ২৫ জুন ২০২১ , ১১ আষাঢ় ১৪২৮ ১৩ জিলকদ ১৪৪২

স্থলবন্দরগুলোর সমস্যা ও সম্ভাবনা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

image

গত এক দশকে দেশের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে মানুষ ও পণ্য পরিবহন বেড়েছে কয়েকগুণ

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। স্থলবন্দর কর্তৃক ব্যবহার উপযোগী, অবকাঠামো উন্নয়ন, পণ্য লোডিং-আনলোডিং, পণ্য সংরক্ষণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ঘোষিত ১৮১টি শুল্ক স্টেশনের মধ্যে ২৪টি স্থল শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করে, যার মধ্যে ১২টি চালু রয়েছে এবং বাকি ১২টি চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। ১২টি চালু বন্দরের মধ্যে বেনাপোল, বুড়িমারী, আখাউড়া, ভোমরা, নাকুগাঁও, তামাবিল, সোনাহাটসহ এই সাতটি বন্দর সরাসরি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। বাকি পাঁচটি যথাক্রমে- সোনামসজিদ, হিলি, বাংলাবান্ধা, টেকনাফ ও বিবিরবাজার বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে বিওটি ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। আরো ১২টি নতুন স্থলবন্দর নির্মাণাধীন রয়েছে। স্থলবন্দরসমূহের মধ্যে বেনাপোল স্থলবন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থলপথে সম্পাদিত মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯০ ভাগই বেনাপোল স্থলবন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে সীমান্তে কাজ করতে হয়। এজন্য তাদের অনেক জমি অধিগ্রহণ এবং অবকাঠামো নির্মাণকাজ হাতে নিতে হয়। জমি অধিগ্রহণে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পরিণতিতে বার্ষিক উন্নয়ন অগ্রগতি মন্থর হয়ে যায়, সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রভাব ফেলে। তাছাড়া ত্রিদেশীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় অন্য দেশের ভূরাজনৈতিক বিষয়াদি বন্দরের কার্যক্রমেও প্রভাব সৃষ্টি করে। অনেক সময় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি প্রস্তুত থাকলেও অন্যদেশ যদি তার স্থলবন্দরের ভালোভাবে উন্নতি না করে, তাহলে বাংলাদেশে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এর পুরো সুফল ঘরে তুলতে পারে না। এজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত কার্যকর ব্যবস্থা, যা উভয় পক্ষ বা সকল পক্ষের জন্য অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করে।

গত এক দশকে দেশের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে মানুষ ও পণ্য পরিবহন বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে স্থলবন্দর সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন বন্দর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কারোনাকালে স্থলবন্দরে পণ্য পরিবহন সীমিত। কিন্তু করোনার পর যখন ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হয়ে আসবে, তখন পণ্য ও যাত্রী পরিবহন বাড়বে। অতএব এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। স্থলবন্দগুলোর আয় যেমন বেড়েছে তেমনি এর কাজের বিস্তৃতিও বেড়েছে। বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের কারণে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে আমদানি এবং রপ্তানি দুটিই বেড়েছে। আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থলবন্দরের গতিশীলতাও বেড়েছে, সেই সঙ্গে আয়ও বেড়েছে। বন্দরের সার্বিক কর্মকান্ডও বাড়ছে- সে কারণে জনবলও বাড়াতে হচ্ছে। নতুন নতুন অবকাঠামো বাড়াতে হচ্ছে। সব কিছু মিলে স্থলবন্দরগুলোর সার্বিক কর্মচাঞ্চল্য আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে স্থলবন্দরগুলো ২৫ ভাগ অবদান রাখছে। বছরে আয় করছে ২০০ কোটি টাকারও বেশি। সরকারি কোষাগারে প্রতিবছর ভ্যাট-ট্যাক্সসহ অন্যান্য চার্জবাবদ জমা দিচ্ছে ৩০-৪০ কোটি টাকা। স্থলবন্দরগুলোতে প্রচুর পণ্য আসছে এবং যাচ্ছে। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির ২০-২৫ শতাংশ স্থলবন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া করা হয়।

বন্দরগুলো আরো গতিশীল ও কার্যকর করার পক্ষেও আছে নানা সমস্যা। যেমন- যশোরের বেনাপোল, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, দিনাজপুরের হিলি, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা, কক্সবাজারের টেকনাফ এবং সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের অবকাঠামো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আজও দুর্বল। বন্দরগুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করে সক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। যতদূর জানা যায়, বেনাপোল ছাড়া অন্যান্য স্থলবন্দরে আধুনিক পার্কিং ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত গুদামঘর, ওজনযন্ত্র, ব্যাংকিং সুবিধা ইত্যাদি নাই। ফলে সীমান্ত অতিক্রমকালে বন্দরের আনুষ্ঠানিকতায় বিলম্ব হয়। এতে দেখা যায়, পণ্যবাহী ট্রাকের দীর্ঘ সারি। বেড়ে যায় পরিবহন ব্যয়; যা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া বন্দরগুলোর কাজ-কর্ম গতিশীল করতে পণ্যখালাস পদ্ধতিতে আধুনিকতার ছাপ থাকা প্রয়োজন। কাগজপত্র কম্পিউটারাইজড করা দরকার। দরকার উন্নতমানের সড়ক। স্থলবন্দরগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। এক্ষেত্রে প্রাপ্ত বরাদ্দও অপ্রতুল।

স্থলবন্দর নির্মাণে অর্থ সংকটের পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও রয়েছে। উক্ত নির্মাণ কাজের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, নৌ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জড়িত থাকে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে কাগজপত্র অনুমোদন নিতে অনেক সময় অপচয় হয়। এ কারণেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু হয় না। স্থলবন্দরগুলোর আয় বাড়াতে হলে এগুলোর দক্ষতা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার বিকল্প নেই। সমস্যাটি দ্বিমুখী। স্থলবন্দরগুলোর দক্ষতা না বাড়ালে আয় বাড়ানো যাবে না, আবার আয় না বাড়লে অবকাঠামোগত উন্নয়নও কঠিন হবে বৈকি। বর্তমানে স্থলবন্দর ছাড়া বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন দিয়েও পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। এসব শুল্ক স্টেশনের ব্যয় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে সব পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে স্থলবন্দর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করলে আয় অবশ্যই বাড়বে। মনে রাখা দরকার, বন্দরকে বলা হয়- অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতীক। স্থল, সমুদ্র কিংবা বিমানবন্দর কোনোটিরই গুরুত্ব আসলে কম নয়। তবে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে স্থলবন্দরগুলোর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। আর স্থলবন্দরগুলোর সার্বিক উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াবার কোনো বিকল্প নেই। সরকারের উচিত- জনস্বার্থেই স্থলবন্দরের উন্নয়নে যথাযথ বাজেট বরাদ্দ করা। মূলত সব সমস্যা সমাধানে চাই সদিচ্ছা ও সক্রিয়তা তথা সততা।

বন্দরগুলোর বিভিন্ন অনিয়ম ও সমস্যা দূরীকরণার্থে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা ও সংস্কারে আশু মনোযোগ দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।

মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব দক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। কাজের গুণগত মান বৃদ্ধিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে হবে। বন্দরসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়কে একটি একক ও সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতায়নপূর্বক তার দায়িত্বকে কার্যকর ও কাঠামোগত আইনি সংস্কারের আওতায় আনতে হবে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কাজগুলোকে সুদৃঢ় আইনি কাঠামোতে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার আবশ্যক।

পর্যবেক্ষণ, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনাকে নিবিড় ও কার্যকর করতে হবে নিজস্ব টিমের মাধ্যমে।

অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে।

সর্বোপরি নিচে বর্ণিত প্রস্তাবনা ও সুপারিশসমূহকেও বিবেচনায় আনতে হবে-

ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ভিসা ব্যবস্থার সমন্বয়।

একটি কার্যকর আঞ্চলিক ট্রানজিট সৃষ্টি।

আমদানি-রপ্তানির কাগজপত্রগুলো যৌক্তিক ও ডিজিটাল করা।

অবকাঠামোর নকশাগুলো আন্তর্জাতিক মানের করা।

পরিবহন সেবার প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা।

স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যুক্ত করা।

বাংলাদেশ ও ভারতে অফ বর্ডার কাস্টম সুবিধা নিশ্চিত করা।

স্থানীয় বাজারের সঙ্গে আঞ্চলিক করিডোরের সমন্বয় ঘটানো।

রপ্তানিমুখী ভ্যালু চেইনে লজিস্টিকসের দুর্বলতাগুলো দূর করা এবং

রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের ভ্যালু চেইনে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

উপরোল্লিখিত প্রস্তাবনা ও সুপারিশের আলোকে বিষয়গুলোর আলোকে অবকাঠামোগত ত্রুটি, নীতি ও বিধিমালার সংস্কার, শুল্কায়ন ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে এর সমাধান করতে হবে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে বৈধপথে সুষ্ঠু ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রীসাধারণের চলাচল এবং মালামাল পরিবহন প্রতিবেশী দেশের একটি মৌলিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে যাত্রীদের সেবা প্রদান এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের জন্য নৈতিক ও মানবিকও বটে। বন্দরসমূহে যাত্রী হয়রানি ও ভোগান্তির মতো ঘটনা ঘটলে যাত্রীসেবার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং সেই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করে। যাত্রী সাধারণের যাতায়াত ব্যবস্থাকে ইচ্ছে করলেই সহজীকরণ করা সম্ভব। আর দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতা থেকে অনেক জটিল সমস্যারও সমাধান হয়ে থাকে।

সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে হয়রানি বা হঠকারি মনোভাব কিছুতেই কাম্য নয়। প্রয়োজনে উচ্চপর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ভোগান্তি ও দুর্ভোগ অবসানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। সর্বোপরি বিভিন্ন বন্দর ও ইমিগ্রেশনে শৃৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির আলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এছাড়া বন্দরে যে সমস্ত অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা ও শৈথিল্য পরিলক্ষিত হয় তাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারি ও তদারকি ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। অদক্ষতা হচ্ছে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার মূল সূত্র। কাজেই দক্ষতা, শৃঙ্খলা পেশাগত দায়িত্ব, ন্যয়-নিষ্ঠা অনুশীলনপূর্বক দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বন্দরকে গতিশীল করে মালামাল পরিবহন ও যাত্রীবান্ধব করতে হবে। বন্দরকে সুন্দর ও যাতায়াতবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বিতভাবে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]