মহাশূন্যে জমাট লড়াই

শঙ্কর প্রসাদ দে

বিংশ শতক সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে থাকবে দুটো বিশ্বযুদ্ধ ও জাপানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের জন্য। অন্যদিকে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চন্দ্রে মনুষ্য পদচিহ্নসহ অন্যান্য মহাকাশ অভিযানের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর সময়টিতে আমেরিকার পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে পারমাণবিক বোমা চলে আসার পর পৃথিবী দখলের মনস্তাত্বিক লড়াইয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। গোটা পৃথিবীর দখলদারিত্ব থেকে ব্রিটিশ, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগিজদের চূড়ান্ত স্থায়ী পরিসমাপ্তি ঘটে। নতুন সমীকরণে পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ চলে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক কর্তৃত্বে। বাকি পৃথিবীর ওপর অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব আরোপ করল আমেরিকা। দু’পরাশক্তি সমানে সমান হওয়ায় বড় আকারের যুদ্ধের সম্ভাবনা চিরদিনের জন্য তিরোহিত হলো। আজকের বাস্তবতায় বোঝা যায় নিকট ভবিষ্যতে পৃথিবীতে আর বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা নেই। একাত্তরে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে বহু কারণ থাকার পরও বিশ্বযুদ্ধ ঘটানোর সাহস কেউ দেখায়নি। এতবড়ো জটিল সামরিক ফিল্ড নিকট ভবিষ্যতে হবে বলেও মনে হয় না।

বিংশ শতকের প্রথম চমক হলো ১৯৬১ সালের ১১ এপ্রিল ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশ যাত্র। মানুষের চিন্তার জগৎটাই আমুল পরিবর্তিত হয়ে মহাকাশপানে ধাবিত হলো। সমাজতান্ত্রিক রূশ নাগরিক গ্যাগারিন কক্ষপথে গোটা পৃথিবীকে চক্কর দিয়েছিল ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটে। এরপর আমেরিকাবাসী মেধার অপমানে ভুগছিল। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মার্কিন নভোযান অ্যাপেলো- ১১ চাঁদের মাটি স্পর্শ করলে রচিত হলো নতুন ইতিহাস। নীল আর্মস্ট্রংয়ের প্রথম পদক্ষেপটি ছিল মেধার বিজয়। লক্ষ লক্ষ প্রাণীর মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে শুধু বুদ্ধিমান প্রাণী বলে। চন্দ্র, মঙ্গলসহ সব ধরনের মহাশূন্য অভিযান মূলত মেধার প্রতিযোগিতা। আন্তঃনক্ষত্রীয় মহাকাশ যান ভয়েজার ১, ভয়েজার ২ এখন গ্যালাক্সি অতিক্রম করে ছুটে চলেছে অনন্তের পথে। বিজ্ঞানীদের প্রধান লক্ষ্য হলো আরেকটি পৃথিবী আবিষ্কার করা। ওই দ্বিতীয় পৃথিবীতে মানুষের মতো উন্নত প্রজাতি (এলিয়েন) যদি নাও থাকে, তবে মানুষ যেন সেখানে গিয়ে বসতি গড়তে পারে।

১৭ জুন ২০২১ সকাল ৯টা ২২ মিনিটে শেন জু- ১২ নামীয় মহাকাশ যানটি যাত্রা শুরু করে চীনের গোবি মরুভূমিতে অবস্থিত উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে। যানটির নভোচারীরা হলেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দলনেতা নি হাইসেং, লি ই বোমিং ও একেবারে নতুন ট্যাং হং বে। গন্তব্য গত এপ্রিলে মহাকাশে প্রেরিত ও স্থাপিত অসমাপ্ত মহাকাশ স্টেশন ‘তিয়েন’। স্টেশনটির ওজন ৭০ টন। এতেই বোঝা যায় ‘তিয়েন’ নামের মহাকাশযানটি আয়তনেও বিশাল। এই মহাকাশ স্টেশনে দীর্ঘদিন থাকার জন্য নভোচারীদের খাদ্য, পোশাক, ওষুধপত্র ও ব্যায়ামের সামগ্রী পাঠানো হয়েছে একটি কার্গো রকেটে করে মে মাসে। রকেটটি সুবোধ বালকের মতো লাগেজ বক্স স্টেশনের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে সুনসান হেলেদুলে চলে আসে পৃথিবীতে। ‘তিয়েন’ মহাকাশ স্টেশনটি আমাদের মাথার উপরে দিব্যি আরামসে বসে আছে ৩৮০ কিমি. উচ্চতায়। সাত ঘণ্টা পর মহাকাশচারীদের নিয়ে শেনঝু- ১২ যুগলবন্দি হয় তিয়েনের সঙ্গে। এরপর ধীরে ধীরে প্রবেশ করে ‘তিয়েনের’ অভ্যন্তরে, এটিকে বলা হয় ডকিং। উৎসুক মানুষের একটাই জিজ্ঞাসা, এটি নিয়ে এতো হৈ চৈ কেন? কারণ আছে! প্রথমত গত অর্ধশতকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে চাইছেন ওজন স্তর অতিক্রম করে মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীতে আঘাত হানছে কিনা? দ্বিতীয়ত জিজ্ঞাসা হলো মহাকাশ থেকে মহাকাশ স্টেশন ব্যবহার করে চন্দ্রাভিযান, মঙ্গলাভিযান সম্ভব কিনা? তৃতীয় উদ্দেশ্য হলো, মহাকাশে সদ্য তৈরি জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ দিয়ে বিশ্বব্রহ্মান্ড কত সহজে পর্যবেক্ষন করা যায়।

পৃথিবীতে মানুষ বসবাসের একটি সাধারণ উপাত্ত হলো, সূর্যরশ্মির অনেক ক্ষতিকর উপাদান ওজনস্তরে আটকা পড়ে ভূ-পৃষ্ঠে আসতে পারে না। এখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বুঝতে চাইছেন, ওজনস্তরের ওপরে কি ধরনের ক্ষতিকর রশ্মি আটকা পড়ে। ওজনস্তরের নিচের ক্ষতিকর রশ্মি ও উপরের ক্ষতিকর রশ্মির তুলনামূলক বিশ্লেষণে ধরা পড়বে কোন রশ্মি মানব শরীরে ক্যান্সার দানাবাধার জন্য দায়ী। ক্যান্সারের নানা ধরনের ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে এবং তা দিয়ে মানুষকে কিছুটা উপশম দেয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেন ক্যান্সারের মতো মরণঘাতি রোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার কারণ এখনও অজ্ঞাত। ধারণা করা হচ্ছে ক্যান্সার কেন সৃষ্টি হয়, কেন মানবকোষ অস্বাভাবিক আচরণ করে মৃত্যু ত্বরান্বিত করছে, তার কারণ উদ্ভাবন সহজ হবে মহাশূন্য গবেষণায়। চীন ঘোষণা করেছে ক্যান্সার গবেষণায় তারা পৃথিবীর সব দেশের বিজ্ঞানীদের ‘তিয়েনে’ স্বাগত জানাবে।

দ্বিতীয়ত ‘তিয়েন’ স্টেশনটিকে গ্রাউন্ড স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করে চাঁদে বা মঙ্গলে বা বিশ্বব্রহ্মান্ডে নভোযান উৎক্ষেপণ কীভাবে সম্ভব? এটি গত দু’দশক ধরে বহুল প্রত্যাশিত একটি বৈজ্ঞানিক চিন্তা। পৃথিবীর উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলো থেকে যেমন রকেট উড়ানো হচ্ছে তেমনি অদূর ভবিষ্যতে মহাকাশ স্টেশন থেকেও রকেট উৎক্ষেপণ করা গেলে, তা হবে অনেক সহজ এবং সাশ্রয়ী। এটি সফল হলে পরবর্তীতে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকেও রকেট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা সামনে এসে যাবে।

তৃতীয়ত; হাবল টেলিস্কোপ প্রথমে পৃথিবীতে স্থাপন করে মহাশূন্য পর্যবেক্ষণ করে বিশ্বব্রহ্মান্ড পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। এটা অনেকটা জলের নিচ থেকে পৃথিবী দেখার মতো। জলের ওপর থেকে যেমন ক্যামেরায় পৃথিবী পরিষ্কার দেখা যায় তেমনি মহাশূন্যে হাবল টেলিস্কোপ স্থাপন করে বিশ্বব্রহ্মান্ড দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে পরিষ্কার। এখন আমেরিকা জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেছে এবং এটি নিকট ভবিষ্যতে আমেরিকা, রাশিয়া, ইউ, জাপান কর্তৃক স্থাপিত প্রথম মহাশূন্য স্টেশনে স্থাপন করা হবে। এই প্রকল্পে আমেরিকা এবং রুশ বিজ্ঞানীরা নেতৃত্ব দিয়ে একেযোগে কাজ করে চলেছেন।

বর্তমানে মহাশূন্য কর্মকান্ডে জড়িত আছে আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা, ইলন মাক্সের স্পেস এক্স, ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা ও চীনা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। প্রথম মহাশূন্য স্টেশন পরিচালনা করছে শুধু আমেরিকা, রাশিয়া, ইইউ, জাপানের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে। চীন গত কয়েক বছর ধরে দ্বিতীয় মহাকাশ স্টেশন স্থাপনের জন্য বারবার আমেরিকার কাছে প্রযুক্তিগত সহায়তা চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আমেরিকান সরকার বলেছে, চীন মহাশূন্য স্টেশন ব্যবহার করে গোটা পৃথিবীর ওপর সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চাচ্ছে। অগত্যা চীন রাশিয়ার দ্বারস্থ হলো।

১৯৪৯ সালে চীনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সব ধরনের সাহায্য নিয়ে চীনের পাশে দাঁড়িয়েছিল নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে। এবারও রাশিয়া পাশে দাঁড়ালো। রাশিয়ান প্রযুক্তিগত জ্ঞানভান্ডার নিয়ে একঝাক বিজ্ঞানী যোগ দিল চীনা মহাকাশ গবেষণা সংস্থায়। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থ, জনবল ও মনোবলের সঙ্গে যোগ হলো রুশ কারিগরি সহায়তা। চীনের নভোচারীরা পৌঁছে গেল দ্বিতীয় মহাশূন্য স্টেশন ‘তিয়েনে’। তিন নভোচারী একনাগাড়ে তিন মাস থাকবেন কক্ষপথে। এরপর তারা চলে আসবেন আরেক গ্রুপ নভোচারীর হাতে স্টেশনের ভার দিয়ে। জয় হোক বিজ্ঞানের। জয় হোক প্রযুক্তির। এগিয়ে যাক মানব সভ্যতা।

[লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট]

spdey2011@gmail.com

শুক্রবার, ২৫ জুন ২০২১ , ১১ আষাঢ় ১৪২৮ ১৩ জিলকদ ১৪৪২

মহাশূন্যে জমাট লড়াই

শঙ্কর প্রসাদ দে

image

চীনের মহাকাশ যান শেনঝু-১২

বিংশ শতক সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে থাকবে দুটো বিশ্বযুদ্ধ ও জাপানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের জন্য। অন্যদিকে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চন্দ্রে মনুষ্য পদচিহ্নসহ অন্যান্য মহাকাশ অভিযানের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর সময়টিতে আমেরিকার পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে পারমাণবিক বোমা চলে আসার পর পৃথিবী দখলের মনস্তাত্বিক লড়াইয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। গোটা পৃথিবীর দখলদারিত্ব থেকে ব্রিটিশ, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগিজদের চূড়ান্ত স্থায়ী পরিসমাপ্তি ঘটে। নতুন সমীকরণে পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ চলে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক কর্তৃত্বে। বাকি পৃথিবীর ওপর অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব আরোপ করল আমেরিকা। দু’পরাশক্তি সমানে সমান হওয়ায় বড় আকারের যুদ্ধের সম্ভাবনা চিরদিনের জন্য তিরোহিত হলো। আজকের বাস্তবতায় বোঝা যায় নিকট ভবিষ্যতে পৃথিবীতে আর বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা নেই। একাত্তরে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে বহু কারণ থাকার পরও বিশ্বযুদ্ধ ঘটানোর সাহস কেউ দেখায়নি। এতবড়ো জটিল সামরিক ফিল্ড নিকট ভবিষ্যতে হবে বলেও মনে হয় না।

বিংশ শতকের প্রথম চমক হলো ১৯৬১ সালের ১১ এপ্রিল ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশ যাত্র। মানুষের চিন্তার জগৎটাই আমুল পরিবর্তিত হয়ে মহাকাশপানে ধাবিত হলো। সমাজতান্ত্রিক রূশ নাগরিক গ্যাগারিন কক্ষপথে গোটা পৃথিবীকে চক্কর দিয়েছিল ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটে। এরপর আমেরিকাবাসী মেধার অপমানে ভুগছিল। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মার্কিন নভোযান অ্যাপেলো- ১১ চাঁদের মাটি স্পর্শ করলে রচিত হলো নতুন ইতিহাস। নীল আর্মস্ট্রংয়ের প্রথম পদক্ষেপটি ছিল মেধার বিজয়। লক্ষ লক্ষ প্রাণীর মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে শুধু বুদ্ধিমান প্রাণী বলে। চন্দ্র, মঙ্গলসহ সব ধরনের মহাশূন্য অভিযান মূলত মেধার প্রতিযোগিতা। আন্তঃনক্ষত্রীয় মহাকাশ যান ভয়েজার ১, ভয়েজার ২ এখন গ্যালাক্সি অতিক্রম করে ছুটে চলেছে অনন্তের পথে। বিজ্ঞানীদের প্রধান লক্ষ্য হলো আরেকটি পৃথিবী আবিষ্কার করা। ওই দ্বিতীয় পৃথিবীতে মানুষের মতো উন্নত প্রজাতি (এলিয়েন) যদি নাও থাকে, তবে মানুষ যেন সেখানে গিয়ে বসতি গড়তে পারে।

১৭ জুন ২০২১ সকাল ৯টা ২২ মিনিটে শেন জু- ১২ নামীয় মহাকাশ যানটি যাত্রা শুরু করে চীনের গোবি মরুভূমিতে অবস্থিত উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে। যানটির নভোচারীরা হলেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দলনেতা নি হাইসেং, লি ই বোমিং ও একেবারে নতুন ট্যাং হং বে। গন্তব্য গত এপ্রিলে মহাকাশে প্রেরিত ও স্থাপিত অসমাপ্ত মহাকাশ স্টেশন ‘তিয়েন’। স্টেশনটির ওজন ৭০ টন। এতেই বোঝা যায় ‘তিয়েন’ নামের মহাকাশযানটি আয়তনেও বিশাল। এই মহাকাশ স্টেশনে দীর্ঘদিন থাকার জন্য নভোচারীদের খাদ্য, পোশাক, ওষুধপত্র ও ব্যায়ামের সামগ্রী পাঠানো হয়েছে একটি কার্গো রকেটে করে মে মাসে। রকেটটি সুবোধ বালকের মতো লাগেজ বক্স স্টেশনের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে সুনসান হেলেদুলে চলে আসে পৃথিবীতে। ‘তিয়েন’ মহাকাশ স্টেশনটি আমাদের মাথার উপরে দিব্যি আরামসে বসে আছে ৩৮০ কিমি. উচ্চতায়। সাত ঘণ্টা পর মহাকাশচারীদের নিয়ে শেনঝু- ১২ যুগলবন্দি হয় তিয়েনের সঙ্গে। এরপর ধীরে ধীরে প্রবেশ করে ‘তিয়েনের’ অভ্যন্তরে, এটিকে বলা হয় ডকিং। উৎসুক মানুষের একটাই জিজ্ঞাসা, এটি নিয়ে এতো হৈ চৈ কেন? কারণ আছে! প্রথমত গত অর্ধশতকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে চাইছেন ওজন স্তর অতিক্রম করে মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীতে আঘাত হানছে কিনা? দ্বিতীয়ত জিজ্ঞাসা হলো মহাকাশ থেকে মহাকাশ স্টেশন ব্যবহার করে চন্দ্রাভিযান, মঙ্গলাভিযান সম্ভব কিনা? তৃতীয় উদ্দেশ্য হলো, মহাকাশে সদ্য তৈরি জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ দিয়ে বিশ্বব্রহ্মান্ড কত সহজে পর্যবেক্ষন করা যায়।

পৃথিবীতে মানুষ বসবাসের একটি সাধারণ উপাত্ত হলো, সূর্যরশ্মির অনেক ক্ষতিকর উপাদান ওজনস্তরে আটকা পড়ে ভূ-পৃষ্ঠে আসতে পারে না। এখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বুঝতে চাইছেন, ওজনস্তরের ওপরে কি ধরনের ক্ষতিকর রশ্মি আটকা পড়ে। ওজনস্তরের নিচের ক্ষতিকর রশ্মি ও উপরের ক্ষতিকর রশ্মির তুলনামূলক বিশ্লেষণে ধরা পড়বে কোন রশ্মি মানব শরীরে ক্যান্সার দানাবাধার জন্য দায়ী। ক্যান্সারের নানা ধরনের ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে এবং তা দিয়ে মানুষকে কিছুটা উপশম দেয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেন ক্যান্সারের মতো মরণঘাতি রোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার কারণ এখনও অজ্ঞাত। ধারণা করা হচ্ছে ক্যান্সার কেন সৃষ্টি হয়, কেন মানবকোষ অস্বাভাবিক আচরণ করে মৃত্যু ত্বরান্বিত করছে, তার কারণ উদ্ভাবন সহজ হবে মহাশূন্য গবেষণায়। চীন ঘোষণা করেছে ক্যান্সার গবেষণায় তারা পৃথিবীর সব দেশের বিজ্ঞানীদের ‘তিয়েনে’ স্বাগত জানাবে।

দ্বিতীয়ত ‘তিয়েন’ স্টেশনটিকে গ্রাউন্ড স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করে চাঁদে বা মঙ্গলে বা বিশ্বব্রহ্মান্ডে নভোযান উৎক্ষেপণ কীভাবে সম্ভব? এটি গত দু’দশক ধরে বহুল প্রত্যাশিত একটি বৈজ্ঞানিক চিন্তা। পৃথিবীর উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলো থেকে যেমন রকেট উড়ানো হচ্ছে তেমনি অদূর ভবিষ্যতে মহাকাশ স্টেশন থেকেও রকেট উৎক্ষেপণ করা গেলে, তা হবে অনেক সহজ এবং সাশ্রয়ী। এটি সফল হলে পরবর্তীতে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকেও রকেট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা সামনে এসে যাবে।

তৃতীয়ত; হাবল টেলিস্কোপ প্রথমে পৃথিবীতে স্থাপন করে মহাশূন্য পর্যবেক্ষণ করে বিশ্বব্রহ্মান্ড পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। এটা অনেকটা জলের নিচ থেকে পৃথিবী দেখার মতো। জলের ওপর থেকে যেমন ক্যামেরায় পৃথিবী পরিষ্কার দেখা যায় তেমনি মহাশূন্যে হাবল টেলিস্কোপ স্থাপন করে বিশ্বব্রহ্মান্ড দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে পরিষ্কার। এখন আমেরিকা জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেছে এবং এটি নিকট ভবিষ্যতে আমেরিকা, রাশিয়া, ইউ, জাপান কর্তৃক স্থাপিত প্রথম মহাশূন্য স্টেশনে স্থাপন করা হবে। এই প্রকল্পে আমেরিকা এবং রুশ বিজ্ঞানীরা নেতৃত্ব দিয়ে একেযোগে কাজ করে চলেছেন।

বর্তমানে মহাশূন্য কর্মকান্ডে জড়িত আছে আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা, ইলন মাক্সের স্পেস এক্স, ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা ও চীনা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। প্রথম মহাশূন্য স্টেশন পরিচালনা করছে শুধু আমেরিকা, রাশিয়া, ইইউ, জাপানের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে। চীন গত কয়েক বছর ধরে দ্বিতীয় মহাকাশ স্টেশন স্থাপনের জন্য বারবার আমেরিকার কাছে প্রযুক্তিগত সহায়তা চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আমেরিকান সরকার বলেছে, চীন মহাশূন্য স্টেশন ব্যবহার করে গোটা পৃথিবীর ওপর সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চাচ্ছে। অগত্যা চীন রাশিয়ার দ্বারস্থ হলো।

১৯৪৯ সালে চীনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সব ধরনের সাহায্য নিয়ে চীনের পাশে দাঁড়িয়েছিল নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে। এবারও রাশিয়া পাশে দাঁড়ালো। রাশিয়ান প্রযুক্তিগত জ্ঞানভান্ডার নিয়ে একঝাক বিজ্ঞানী যোগ দিল চীনা মহাকাশ গবেষণা সংস্থায়। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থ, জনবল ও মনোবলের সঙ্গে যোগ হলো রুশ কারিগরি সহায়তা। চীনের নভোচারীরা পৌঁছে গেল দ্বিতীয় মহাশূন্য স্টেশন ‘তিয়েনে’। তিন নভোচারী একনাগাড়ে তিন মাস থাকবেন কক্ষপথে। এরপর তারা চলে আসবেন আরেক গ্রুপ নভোচারীর হাতে স্টেশনের ভার দিয়ে। জয় হোক বিজ্ঞানের। জয় হোক প্রযুক্তির। এগিয়ে যাক মানব সভ্যতা।

[লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট]

spdey2011@gmail.com