আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক

সাড়ে ছয় বছরে ১৭২০ জনের মৃত্যু

গত সাড়ে ৬ বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ১৭২০ জন ব্যক্তি। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় সন্দেহভাহন হিসেবে গ্রেপ্তার ব্যক্তি। তারা কথিত বন্দুকযদ্ধে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে শারীরিক নির্যতানে মারা গেছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসক বলছে ২০১৫ সাল থেকে গতকাল ২৬ জুন পর্যন্ত এসব মৃত্যুর মধ্যে গ্রেপ্তারের আগে বা পরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ১৬৫০ জন। আর রিমান্ড হেফাজতে, কারাগারে, থানা হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ৭০ জন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আটকের পর নির্যাতন ও নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। থানা হেফাজত, কারাগার, রিমান্ড হেফাজতে আটক বা গ্রেপ্তার থাকা ব্যক্তিদের মৃত্যুর ঘটনায় কোন বিচার হচ্ছে না।

তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে বা হেফাজতে মৃত্যুর কোন কোন ঘটনায় মামলা হলেও সেই মামলার তদন্ত, বিচারিক কার্যক্রম হিমাগারে পড়ে আছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগে তাদের সহকর্মীদের দিয়ে এসব ঘটনার তদন্ত করানোর কারণে সঠিক তদন্ত হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে কোন পরিবারের একজন মারা গেলে মামলা করার উদ্যোগ নেয়ার পর অন্যদের তুলে নিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে।

নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের সমর্থনে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ‘বাংলাদেশে নির্যাতনের পরিস্থিতি : নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে প্রতিবন্ধকতাসমূহ‘ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেডআই খান পান্না, মো. আসাদুজ্জামান, আসক মানবাধিকার কর্মী মো. নূর খান, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোহম্মদ গোলাম সারওয়ার প্রমুখ। সেখানে এসব তথ্য-উপাত্ত উঠে আসে।

পরিসংখ্যান বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃত গ্রেপ্তারের আগে ও পরে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা হেফাজতে ২০১৫ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ১৯২ জন আর শারীরিক নির্যাতনে হত্যকান্ডের শিকার হয়েছে ১১ জন। ২০১৬ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ১৯৫ জন, শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১০ জন। ২০১৭ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ১৬২ জন শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১২ জন। ২০১৮ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ৪৬৬ জন আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ৬ জন। ২০১৯ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ৩৮৮ জন আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১২ জন। ২০২০ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ২২২ জন আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১৬ জন। চলতি বছরের গতকাল পর্যন্ত বিচার বহির্র্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ৩০ জন আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ৩ জন।

বক্তরা বলেন, অধিকাংশ সময় ভুক্তভোগী বা তার পরিবার নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আইনের আশ্রয় নেয়া তথা মামলা করার সাহস পান না। যারা সাহস করে মামলা করেছেন তারা নানা পর্যায়ে হয়রানি ও হুমকির শিকার হচ্ছেন, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে নানা প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহম্মদ গোলাম সারওয়ার বলেন, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু আইন ২০১৩ একটি অত্যন্ত চমৎকার আইন যা মূলত সংবিধান ও জাতিসংঘ নির্যাতনবিরোধী সনদের আলোকে প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এটির সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন করার কথা বলা হলেও তা করা হচ্ছে না, কিন্তু কেন করা হচ্ছে না সেটার ব্যাখ্যাও দেয়া হচ্ছে না। নির্যাতনের ঘটনাগুলোর তদন্তের দায়িত্ব পুলিশকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না বলে ২০১৯ সালে জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি একটি স্বাধীন তদন্ত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেছে, এখন পর্যন্ত যার কোন অগ্রগতি নেই।

অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার একই সূত্রে গাঁথা। একটি ছাড়া অন্যটি পরিপূর্ণভাবে অর্জন সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা বর্তমানে উন্নয়নকে প্রাধাণ্য দিচ্ছি অন্যসব কিছুকে দমিয়ে, পাশ কাটিয়ে। আইন আছে কিন্তু আইনের আশ্রয় নিতে সবাই ভয় পাচ্ছে। জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না, তাদের নানাভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।

মানবাধিকার কর্মী মো. নূর খান বলেন, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড, গুম এবং হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু একটি নিত্যনৈমিত্ত্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ এ বিষয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে এমন সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয় যারা এসব বিষয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তুলবে না, সরকারকে বিব্রত করবে না। এ কঠিন পরিস্থিতিতে নির্যাতিত ও তাদের পরিবারের অধিকার রক্ষায় বিচ্ছিন্নভাবে নয়, একযোগে সামগ্রিক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং আসকের সাবেক চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না বলেন, শাসন ও উন্নয়ন হতে হবে জনগণমুখী। আমরা এখন বিপরীত দিকে হাঁটছি যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সামগ্রিক লড়াইয়ের ওপর জোর দেন।

আসকের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামাল বলেন, জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার বহু আগে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে নির্যাতনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেয়া যাবে না কিংবা তাহার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। অথচ আটক বা গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব, বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য দ্বারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করার অভিযোগের তথ্য ও খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।

আলোচনায় বলা হয়, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড ও নির্যাতন বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সংবিধান, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ প্রদান করতে হবে। নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে প্রতিটি আটক ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাগুলো অনুসরন করতে হবে। এ পর্যন্ত সংঘটিত সব গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ এবং এ ধরনের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং কমিশনকে তার ম্যান্ডেট বাস্তবায়নের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।

‘ডাক্তারি পরীক্ষাসহ বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, ডাক্তারি পরীক্ষার ক্ষেত্রে নির্যাতনবিষয়ক (শারীরিক এবং মানসিক) ধারণা আছে এমন ডাক্তারদের সংশ্লিষ্ট পদে পদায়ন করতে হবে। ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সাক্ষী-সুরক্ষা আইন দ্রুততার সঙ্গে প্রণয়ন করা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করা। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে এ ধরনের ঘটনায় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে যে সংশয় রয়েছে তা দূর করা। কমিশন থেকে কর্তৃপক্ষকে প্রদত্ত চিঠি ও সুপারিশের বিপরীতে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া। নির্যাতন বন্ধে কমিশন সম্পর্কে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির দেয়া সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

রবিবার, ২৭ জুন ২০২১ , ১৩ আষাঢ় ১৪২৮ ১৫ জিলক্বদ ১৪৪২

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক

সাড়ে ছয় বছরে ১৭২০ জনের মৃত্যু

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

গত সাড়ে ৬ বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ১৭২০ জন ব্যক্তি। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় সন্দেহভাহন হিসেবে গ্রেপ্তার ব্যক্তি। তারা কথিত বন্দুকযদ্ধে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে শারীরিক নির্যতানে মারা গেছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসক বলছে ২০১৫ সাল থেকে গতকাল ২৬ জুন পর্যন্ত এসব মৃত্যুর মধ্যে গ্রেপ্তারের আগে বা পরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ১৬৫০ জন। আর রিমান্ড হেফাজতে, কারাগারে, থানা হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ৭০ জন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আটকের পর নির্যাতন ও নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। থানা হেফাজত, কারাগার, রিমান্ড হেফাজতে আটক বা গ্রেপ্তার থাকা ব্যক্তিদের মৃত্যুর ঘটনায় কোন বিচার হচ্ছে না।

তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে বা হেফাজতে মৃত্যুর কোন কোন ঘটনায় মামলা হলেও সেই মামলার তদন্ত, বিচারিক কার্যক্রম হিমাগারে পড়ে আছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগে তাদের সহকর্মীদের দিয়ে এসব ঘটনার তদন্ত করানোর কারণে সঠিক তদন্ত হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে কোন পরিবারের একজন মারা গেলে মামলা করার উদ্যোগ নেয়ার পর অন্যদের তুলে নিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে।

নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের সমর্থনে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ‘বাংলাদেশে নির্যাতনের পরিস্থিতি : নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে প্রতিবন্ধকতাসমূহ‘ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেডআই খান পান্না, মো. আসাদুজ্জামান, আসক মানবাধিকার কর্মী মো. নূর খান, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোহম্মদ গোলাম সারওয়ার প্রমুখ। সেখানে এসব তথ্য-উপাত্ত উঠে আসে।

পরিসংখ্যান বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃত গ্রেপ্তারের আগে ও পরে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা হেফাজতে ২০১৫ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ১৯২ জন আর শারীরিক নির্যাতনে হত্যকান্ডের শিকার হয়েছে ১১ জন। ২০১৬ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ১৯৫ জন, শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১০ জন। ২০১৭ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ১৬২ জন শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১২ জন। ২০১৮ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ৪৬৬ জন আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ৬ জন। ২০১৯ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ৩৮৮ জন আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১২ জন। ২০২০ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ২২২ জন আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ১৬ জন। চলতি বছরের গতকাল পর্যন্ত বিচার বহির্র্ভূত হত্যকান্ডের শিকার হয়েছেন ৩০ জন আর শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছেন ৩ জন।

বক্তরা বলেন, অধিকাংশ সময় ভুক্তভোগী বা তার পরিবার নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আইনের আশ্রয় নেয়া তথা মামলা করার সাহস পান না। যারা সাহস করে মামলা করেছেন তারা নানা পর্যায়ে হয়রানি ও হুমকির শিকার হচ্ছেন, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে নানা প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহম্মদ গোলাম সারওয়ার বলেন, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু আইন ২০১৩ একটি অত্যন্ত চমৎকার আইন যা মূলত সংবিধান ও জাতিসংঘ নির্যাতনবিরোধী সনদের আলোকে প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এটির সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন করার কথা বলা হলেও তা করা হচ্ছে না, কিন্তু কেন করা হচ্ছে না সেটার ব্যাখ্যাও দেয়া হচ্ছে না। নির্যাতনের ঘটনাগুলোর তদন্তের দায়িত্ব পুলিশকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না বলে ২০১৯ সালে জাতিসংঘের তদন্ত কমিটি একটি স্বাধীন তদন্ত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেছে, এখন পর্যন্ত যার কোন অগ্রগতি নেই।

অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার একই সূত্রে গাঁথা। একটি ছাড়া অন্যটি পরিপূর্ণভাবে অর্জন সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা বর্তমানে উন্নয়নকে প্রাধাণ্য দিচ্ছি অন্যসব কিছুকে দমিয়ে, পাশ কাটিয়ে। আইন আছে কিন্তু আইনের আশ্রয় নিতে সবাই ভয় পাচ্ছে। জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না, তাদের নানাভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।

মানবাধিকার কর্মী মো. নূর খান বলেন, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড, গুম এবং হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু একটি নিত্যনৈমিত্ত্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ এ বিষয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে এমন সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয় যারা এসব বিষয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তুলবে না, সরকারকে বিব্রত করবে না। এ কঠিন পরিস্থিতিতে নির্যাতিত ও তাদের পরিবারের অধিকার রক্ষায় বিচ্ছিন্নভাবে নয়, একযোগে সামগ্রিক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং আসকের সাবেক চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না বলেন, শাসন ও উন্নয়ন হতে হবে জনগণমুখী। আমরা এখন বিপরীত দিকে হাঁটছি যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সামগ্রিক লড়াইয়ের ওপর জোর দেন।

আসকের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামাল বলেন, জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার বহু আগে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে নির্যাতনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেয়া যাবে না কিংবা তাহার সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। অথচ আটক বা গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব, বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য দ্বারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করার অভিযোগের তথ্য ও খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।

আলোচনায় বলা হয়, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড ও নির্যাতন বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সংবিধান, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ প্রদান করতে হবে। নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে প্রতিটি আটক ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাগুলো অনুসরন করতে হবে। এ পর্যন্ত সংঘটিত সব গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ এবং এ ধরনের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং কমিশনকে তার ম্যান্ডেট বাস্তবায়নের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।

‘ডাক্তারি পরীক্ষাসহ বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, ডাক্তারি পরীক্ষার ক্ষেত্রে নির্যাতনবিষয়ক (শারীরিক এবং মানসিক) ধারণা আছে এমন ডাক্তারদের সংশ্লিষ্ট পদে পদায়ন করতে হবে। ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সাক্ষী-সুরক্ষা আইন দ্রুততার সঙ্গে প্রণয়ন করা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করা। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে এ ধরনের ঘটনায় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে যে সংশয় রয়েছে তা দূর করা। কমিশন থেকে কর্তৃপক্ষকে প্রদত্ত চিঠি ও সুপারিশের বিপরীতে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া। নির্যাতন বন্ধে কমিশন সম্পর্কে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির দেয়া সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।