ভূমধ্যসাগরে বাংলাদেশি নাগরিক উদ্ধার প্রসঙ্গে

গত বুধবার ভূমধ্যসাগরে ভাসতে থাকা ২৬৪ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে তিউনেসিয়ার কোস্টগার্ড। উদ্ধারকৃতদের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।

ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইউরোপে যাওয়ার এই রুট থেকে প্রায়ই বাংলাদেশি নাগরিকদের উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া এসব মানুষের মূল লক্ষ্য থাকে ইতালি যাওয়া। তারা ভাবে, কোনভাবে ইতালি বা ইউরোপের কোন দেশ গিয়ে পা রাখতে পারলে তাদের জীবনের মোড় ঘুরে যাবে, আর্থিক সচ্ছলতা আসবে, তাদের আয়-রোজগারে পরিবারের সদস্যদের জীবন-মানের উন্নয়ন ঘটবে।

অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য দেশের একশ্রেণীর মানুষ বড় ধরনের দুটি ঝুঁকি নেয়। এর প্রথম ঝুঁকিটা নেয় দেশে থেকেই। সহায়-সম্বল বিক্রি করে, ধার-কর্য করে লাখ লাখ টাকা দালালদের হাতে তুলে দেয়। তাদের অনেকেই জানে, এই টাকা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তাদের যাওয়ার উপায়টা অবৈধ, পথটা বিপদসংকুল, বিদেশে গিয়ে কাজ নাও মিলতে পারে। এসব জেনেও অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ায় অনেকেই। দালালরাও তাদের প্রলুব্ধ করে। ইতালি বা ইউরোপের কোন দেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া মানুষ একদিকে দালালদের প্রলোভনের ফাঁদ এড়াতে পারে না, অন্যদিকে সচ্ছল-স্বচ্ছন্দ জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারে না।

সর্বস্ব বিক্রি করার পর বিদেশ যাত্রা শুরু হলেই তাদের দ্বিতীয় ঝুঁকিটি নিতে হয়, সেটা হলো জীবনের ঝুঁকি। অবৈধ উপায়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য তাদের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়, পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। রুটভেদে মরুভূমি, গহীন জঙ্গল বা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হয়। যাত্রাপথে অনেকেই মারা যায়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে বিভিন্ন দেশের ৮১৩ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের অনেকেই বাংলাদেশি। যাদের উদ্ধার করা হয় তাদের ঠাঁই হয় এমন আশ্রয় শিবিরিগুলোতে যেখানে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ থাকে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে তিউনিসিয়ায় বিভিন্ন আশ্রয় শিবির ও হোটেলে ৭০৭ বাংলাদেশি রয়েছে।

অবর্ণনীয় দুর্ভোগ শেষে অনেকেই সৌভাগ্যক্রমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুরু হয় তাদের আরেক দুর্ভোগ। তাদের অনেকে নিয়মিত কাজ পান না, আবার কাজ পেলেও বেতন আকর্ষণীয় নয়। অনাহরে-অর্ধাহারে দিন কাটে অনেকেরই। তারপরও তারা দেশে ফিরতে চান না। কারণ যাওয়ার সময় তারা সর্বস্ব বিক্রি করে গেছে, বা ঋণ করেছে। শূন্য হাতে শুধু প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে কী করব এই তাদের ভাবনা। আবার অনেকে ঋণের বোঝা নিয়েই ফেরে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় শুধুমাত্র গত মে মাসেই দেশে ফিরেছেন ১৬০ জন বাংলাদেশি। তাছাড়া ২০১৫ সালের পর থকে এ পর্যন্ত ভূধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ২ হাজার ৯০০ বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছে এ সংস্থার সহায়তায়।

বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাত্রা ঝামেলাপূর্ণ, অনিরাপদ এবং ব্যয়ও বেশি। এর বড় একটি কারণ মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের দৌরাত্ম্য। এই চক্রটিকে নির্মূল করতে হবে। বৈধ পথে বিদেশ যাওয়া সহজ করতে হবে এবং খরচ নাগালের মধ্যে আনতে হবে।

দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশের মধ্যে বিদেশ নিয়ে এক ধরনের মোহ বা উচ্চকাক্সক্ষা রয়েছে। তাদের এই মোহ ভাঙতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, কোনমতে একটি দেশে গিয়ে হাজির হলেই সমস্যার সমাধান হবে না। কাজ করার প্রয়োজনীয় দক্ষতা-যোগ্যতা থাকতে হবে। এজন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। আর বিদেশে যেতে হবে বৈধ পথে। কারণ বৈধ পথে বিদেশ গেলে যেমন খরচ কম হয়, তেমন দুর্ভোগও পোহাতে হয় না।

রবিবার, ২৭ জুন ২০২১ , ১৩ আষাঢ় ১৪২৮ ১৫ জিলক্বদ ১৪৪২

ভূমধ্যসাগরে বাংলাদেশি নাগরিক উদ্ধার প্রসঙ্গে

গত বুধবার ভূমধ্যসাগরে ভাসতে থাকা ২৬৪ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে তিউনেসিয়ার কোস্টগার্ড। উদ্ধারকৃতদের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।

ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইউরোপে যাওয়ার এই রুট থেকে প্রায়ই বাংলাদেশি নাগরিকদের উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া এসব মানুষের মূল লক্ষ্য থাকে ইতালি যাওয়া। তারা ভাবে, কোনভাবে ইতালি বা ইউরোপের কোন দেশ গিয়ে পা রাখতে পারলে তাদের জীবনের মোড় ঘুরে যাবে, আর্থিক সচ্ছলতা আসবে, তাদের আয়-রোজগারে পরিবারের সদস্যদের জীবন-মানের উন্নয়ন ঘটবে।

অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য দেশের একশ্রেণীর মানুষ বড় ধরনের দুটি ঝুঁকি নেয়। এর প্রথম ঝুঁকিটা নেয় দেশে থেকেই। সহায়-সম্বল বিক্রি করে, ধার-কর্য করে লাখ লাখ টাকা দালালদের হাতে তুলে দেয়। তাদের অনেকেই জানে, এই টাকা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তাদের যাওয়ার উপায়টা অবৈধ, পথটা বিপদসংকুল, বিদেশে গিয়ে কাজ নাও মিলতে পারে। এসব জেনেও অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ায় অনেকেই। দালালরাও তাদের প্রলুব্ধ করে। ইতালি বা ইউরোপের কোন দেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া মানুষ একদিকে দালালদের প্রলোভনের ফাঁদ এড়াতে পারে না, অন্যদিকে সচ্ছল-স্বচ্ছন্দ জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারে না।

সর্বস্ব বিক্রি করার পর বিদেশ যাত্রা শুরু হলেই তাদের দ্বিতীয় ঝুঁকিটি নিতে হয়, সেটা হলো জীবনের ঝুঁকি। অবৈধ উপায়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য তাদের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়, পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। রুটভেদে মরুভূমি, গহীন জঙ্গল বা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হয়। যাত্রাপথে অনেকেই মারা যায়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে বিভিন্ন দেশের ৮১৩ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের অনেকেই বাংলাদেশি। যাদের উদ্ধার করা হয় তাদের ঠাঁই হয় এমন আশ্রয় শিবিরিগুলোতে যেখানে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ থাকে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে তিউনিসিয়ায় বিভিন্ন আশ্রয় শিবির ও হোটেলে ৭০৭ বাংলাদেশি রয়েছে।

অবর্ণনীয় দুর্ভোগ শেষে অনেকেই সৌভাগ্যক্রমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুরু হয় তাদের আরেক দুর্ভোগ। তাদের অনেকে নিয়মিত কাজ পান না, আবার কাজ পেলেও বেতন আকর্ষণীয় নয়। অনাহরে-অর্ধাহারে দিন কাটে অনেকেরই। তারপরও তারা দেশে ফিরতে চান না। কারণ যাওয়ার সময় তারা সর্বস্ব বিক্রি করে গেছে, বা ঋণ করেছে। শূন্য হাতে শুধু প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে কী করব এই তাদের ভাবনা। আবার অনেকে ঋণের বোঝা নিয়েই ফেরে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় শুধুমাত্র গত মে মাসেই দেশে ফিরেছেন ১৬০ জন বাংলাদেশি। তাছাড়া ২০১৫ সালের পর থকে এ পর্যন্ত ভূধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ২ হাজার ৯০০ বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছে এ সংস্থার সহায়তায়।

বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাত্রা ঝামেলাপূর্ণ, অনিরাপদ এবং ব্যয়ও বেশি। এর বড় একটি কারণ মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের দৌরাত্ম্য। এই চক্রটিকে নির্মূল করতে হবে। বৈধ পথে বিদেশ যাওয়া সহজ করতে হবে এবং খরচ নাগালের মধ্যে আনতে হবে।

দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশের মধ্যে বিদেশ নিয়ে এক ধরনের মোহ বা উচ্চকাক্সক্ষা রয়েছে। তাদের এই মোহ ভাঙতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, কোনমতে একটি দেশে গিয়ে হাজির হলেই সমস্যার সমাধান হবে না। কাজ করার প্রয়োজনীয় দক্ষতা-যোগ্যতা থাকতে হবে। এজন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। আর বিদেশে যেতে হবে বৈধ পথে। কারণ বৈধ পথে বিদেশ গেলে যেমন খরচ কম হয়, তেমন দুর্ভোগও পোহাতে হয় না।