করোনাকালে প্রাথমিক শিক্ষা

সন্ধ্যা রানী সাহা

অনলাইন ক্লাস কখনও শ্রেণীকক্ষের ক্লাসের বিকল্প হতে পারে না, বিশেষ করে আমাদের দেশে তো নয়ই। ২০২০ সালের ১৭ মার্চের পর থেকে স্কুল বন্ধ। করোনার করাল থাবা থেকে রক্ষা পেতে বাধ্য হয়েই এ (অনলইন ক্লাস) ব্যবস্থা নিতে হয়। কোনো প্রকার পূর্ব-প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বর্তমানে এ বিষয়ে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু অভিভাবকদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, অসচেতনতা, এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাসস্থান পরিবর্তনের কারণে অনলাইন পড়াশোনা তেমন সার্বজনীন রূপ নিতে পারছে না। এ কারণে বিকল্প চিন্তা হিসাবে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক বিধি মেনে শিক্ষার্থীদের বাড়িবাড়ি গিয়ে শিক্ষকরা যেন পাঠদান করতে পারেন, এ বিষয়ে জুন ২০২০ সালে উপজেলা পরিষদের (কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ) মাসিক সমন্বয় সভায় অনুমতি প্রার্থনা করা হয়। বিষয়টি উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভার রেজুলেশনে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়। অনুমতি পাওয়ার পর প্রধান শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এরিয়াগুলোকে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার জন্য বলা হয়। যাতে করে তারা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক বিধি মেনে পাঠদান করতে পারে।

প্রধান শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় কামারখন্দ উপজেলায় জুন ২০২০ সাল থেকেই অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠদান কার্যক্রম (অফলাইন) পরিচালনা করতে থাকেন। এরূপ অফলাইন এবং অনলাইন পাঠদান কার্যক্রমের সংরক্ষিত রেকর্ডের ভিত্তিতে ২০২০ সালের পাঠসমাপ্তি ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হয়। ২০২১ সালে দৈনন্দিন পাঠ বিভাজন অর্থাৎ সিলেবাস প্রণয়ন করে তা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আগের মতোই শিক্ষকরা তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে।

৩০ এপ্রিল ২০২১ “কোভিড-১৯ এর কারণে অন্তর্বর্তীকালীন পাঠপরিকল্পনা” আসে। কোভিডকালীন ইতোমধ্যে পাঠপরিকল্পনা-২০২১ অব্যাহত রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিকবিধি অনুসরণপূর্বক “বাড়ির কাজ” প্রদানের উদ্দেশ্যে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ), ময়মনসিংহ থেকে বিশেষ কার্যক্রম প্রণয়ন করা হয়। এটি কামারখন্দ উপজেলায় সম্প্রতি চালুকৃত বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠদান কার্যক্রমকে আরও গতিশীল এবং সহজ করে দিয়েছে। এই বাড়ির কাজগুলো শিক্ষকরা তাদের নিয়মিত বাড়ি বাড়ি গমনপূর্বক শিক্ষাদানের সময় অনয়াশেই পৌঁছে দিচ্ছে। এবং কাজ শেষে শিটগুলো সংগ্রহ করে বিদ্যালয়ে এনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য পৃথক পৃথক প্রোফাইল তৈরি করে রাখছে।

শুরুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর কাজটা সহজ ছিল না। যেমন সহকারী শিক্ষকদের অনেকেই কর্মস্থলে ছিল না। সহকর্মীদের অনেকই বলতো, “ক’দিন পর স্কুল খুলে যাবে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়িয়ে কি হবে”। কেউবা কর্তৃপক্ষের ক্ষোভের কারণ হওয়া অস্বাভাবিক নয় ভেবেও ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। যাহোক ৩০ এপ্রিল ২০২১ ওয়ার্কশিট এবং অ্যাকটিভিটি শিট এর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আমাদের জুম মিটিংএ বলা হয়। এভাবে কার্যক্রম শুরু করতেই সারাদেশে তা ছড়িয়ে যায়। অতএব অনলাইন কার্যক্রমের কার্যকারিতা যে কত সহজ এবং সার্বজনীন তা চাক্ষুষ প্রমাণিত হয়। অথচ অতীতে এ ধরনের কার্যক্রম মাঠে নিয়ে যেতে অনেক কসরত করতে হয়েছে।

এখন “নেপ” প্রণীত বাড়ির কাজ, যা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওয়ার্কশিট এবং তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে অ্যাকটিভিটি শিট নামে সরবরাহ করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক শিক্ষকরা এই শিটগুলো ভিত্তি করে গুগলমিটের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছে। কাজেই এখনই সময় শিক্ষকদের মোটিভেট করার। ফলে তারা যেন করোনার ক্ষতি পূরণে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করতে পারে। এ ব্যাপারে উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তাগণকেও মাঠে নামানো যায়। শুধু কি পড়াশোনা! করোনা থেকে রক্ষার উপায়, স্বাস্থ্যপুষ্টি, সামাজিক নিরাপত্তা, বাল্যবিবাহ নিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করাও জরুরি। এজন্য কামারখন্দ উপজেলায় শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ভিজিট কর্মসূচি পরিচালনার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক বিধি বজায় রেখে সীমিত আকারে মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ এবং উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। ফলে এ এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোন মেয়ে শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত বাল্যবিবাহের শিকার হয়নি। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হারও আগের মতো স্বাভাবিক।

অনলাইন কার্যক্রম একেবারে নতুন কিছু নয়। এজন্য সারা পৃথিবীতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব নেই। তবে সেগুলোর শুরুটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে। আমাদের দেশে প্রচলিত দূরশিক্ষণ পদ্ধতি বর্তমানের অনলাইনেরই পূর্ব-সংস্করণ বলা যায়। সাম্প্রতিক করোনা-পরিস্থিতিতে অনলাইন পদ্ধতিই একমাত্র শিক্ষাদান পদ্ধতি বলে সবাই মনে করছে। কিন্তু এ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে এবং কিছু কিছু বিকল্প পদ্ধতি বা সহযোগী পদ্ধতির কথা ভাবা হচ্ছে তা আগেই বলেছি।

আমাদের পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা যে চিহ্নিত অর্জনযোগ্য ২৯টি যোগ্যতা (জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি) অর্জন করবে বলে নির্ধারিত রয়েছে যেগুলোকে প্রাথমিক শিক্ষার প্রান্তিক যোগ্যতা বলা হয়। এই প্রান্তিক যোগ্যতাগুলোর মধ্যে ২০ নম্বর যোগ্যতাটি বর্তমান কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলাবিষয়ক বলা যায়। তা হলো প্রতিকূলতা ও দুর্যোগ সম্বন্ধে জানা এবং মোকাবিলায় দক্ষ ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া। আর আট নম্বর প্রান্তিক যোগ্যতাটি প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্বন্ধে জানা ও প্রয়োগের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা। অতএব কোভিড-১৯ সংক্রান্ত দুর্দশা থেকে মৃক্তির জন্য আমাদের ৮ ও ২০ নম্বর যোগ্যতা অবশ্যই অর্জন করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের এই আট নম্বর প্রান্তিক যোগ্যতাটি অর্জন করানোর উদ্দেশ্যে সরকার সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ল্যাপটপ ও মাল্টিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করা হয়েছে। শিক্ষকবৃন্দের আইসিটিবিষয়ক প্রশিক্ষণ চলছে। সরকার থেকে ইন্টারনেটের বিল প্রদান করা হচ্ছে। সরকারের অপরাপর বরাদ্দগুলোও অব্যাহত। এখন প্রত্যাশা- শিক্ষকবৃন্দ যেন স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক বিধি মেনে তাদের চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে করোনার ক্ষতিপূরণে শিক্ষার্থীদের সর্বতোভাবে সাহায্য করে। কারণ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত এসডিজি এর ১৭টি লক্ষ্যের চতুর্থতম, যা ২০৩০ সালের মধ্যে অবশ্যই বাংলাদেশকে সে লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তথা শিশুদের কোভিড-১৯ এর বিপদ থেকে রক্ষা, সুশিক্ষা নিশ্চিত করা এবং অভিভাবকদের সচেতন করার উদ্দেশ্যে শিক্ষকবৃন্দ ভার্চুয়াল (অনলাইন) মাধ্যমে পাঠদান, অভিভাবক সমাবেশ এবং মা সমাবেশ পরিচালনা করবে। যে সব ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল যোগাযোগের কোনো উপায় নেই সে সব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক বিধি মেনে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে সেবাদান করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এসব ক্ষেত্রে এতিম এবং অসহায় শিশুরা যেন কোনোক্রমেই বৈষম্যের শিকার না হয়। অভিভাবকদের জানিয়ে দিতে হবে তারা যেন প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় শিশুকে পড়তে বসায়। শিশুর পড়ার জায়গাটি যেন ঘরের অন্য স্থানের তুলনায় আলো-বাতাস পূর্ণ হয়। বাবা-মা পড়াতে অক্ষম হলে পড়তে পারা বড় ভাইবোন বা পাশের বাড়ির বড়রাও এ ব্যাপারে যেন সাহায্য করতে পারে। পাশাপাশি সংসদ টিভিতে প্রচারিত “ঘরে বসে শিখি” শিক্ষা কার্যক্রম যেন প্রত্যেক শিক্ষার্থী দেখে এবং রেডিওতে প্রচারিত শ্রেণী কার্যক্রম শোনে। এ বিষয়গুলো শিক্ষকবৃন্দ নিশ্চিত করবে। সুযোগ বুঝে তারা মোবাইল ফোনে প্রতিদিন কিছু শিক্ষার্থীদের পাঠবিষয়ক পরামর্শ দান করবে। শিক্ষার্থীরাও যেন অনায়াশে শিক্ষকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে পাঠবিষয়ক আলাপ করতে আগ্রহী থাকে সে ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ এই কোভিডজনিত মহামারিকালে শিক্ষকবৃন্দকে নানাভাবে অতন্দ্র প্রহরীর মতো শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা চাই। পাশাপাশি আবার ভার্চুয়াল ক্লাসের বিপরীতে শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির খারাপ দিকে আগ্রহী হয়ে পড়ছে কি না-তাও দেখা উচিত। শিক্ষকরা তাদের ওপর অর্পিত এ সব নতুন দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে কি না-সে ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি দরকার। তবে তারা শিক্ষকদের এ বিষয়ে কোনো ধরনের জোর-জবরদস্তি না করে সহযোগিতা করবে এটাই কাম্য।

ইউনিসেফের কোভিড-১৯ গ্লোবাল এডুকেশন রিকোভারি ট্রাকার, বিশ্বব্যাঙ্ক ও জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি বিশ্বে স্কুল বন্ধের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। তারা দেশে দেশে বাড়িতে অথবা স্কুলে পাঠদানের বিষয়টিও পর্যবেক্ষণ করছে। আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো বলেছে স্কুল বন্ধ থাকায় বিশ্বজুড়ে শিশু নিপীড়ন এবং শিশুদের অধিকার লংঘন অনেকভাবে বেড়ে গেছে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এনজিও কিডস-রাইটস এর বার্ষিক জরিপ মতে... বিশ্বে ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু শিক্ষার্থী এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুলে যেতে পারছে না। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ শিশুর দূরশিক্ষণ (অনলাইন) পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই। আবার বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনার ধাক্কা লাগায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের উপকরণগত ঘাটতিতে পড়েছে বাড়তি ১৪ কোটি ২০ লাখ শিশু। অর্থাৎ সারা বিশ্বের শিশুরাই বিরাট স্বাস্থ্য ও শিক্ষাগত ঝুঁকিতে আছে।

কোভিড-১৯ থেকে জীবন বাঁচাতে যেমন ঘরে থাকা প্রয়োজন তেমনি এই জীবনকে সঠিকভাবে গঠনের জন্য প্রতিটি ঘরকে স্কুলে পরিণত করাও অপরিহার্য। দক্ষ এবং গতিশীল শিক্ষকবৃন্দ অভিভাবকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এ কাজটি সহজেই করতে পারে।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

খামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]

রবিবার, ২৭ জুন ২০২১ , ১৩ আষাঢ় ১৪২৮ ১৫ জিলক্বদ ১৪৪২

করোনাকালে প্রাথমিক শিক্ষা

সন্ধ্যা রানী সাহা

অনলাইন ক্লাস কখনও শ্রেণীকক্ষের ক্লাসের বিকল্প হতে পারে না, বিশেষ করে আমাদের দেশে তো নয়ই। ২০২০ সালের ১৭ মার্চের পর থেকে স্কুল বন্ধ। করোনার করাল থাবা থেকে রক্ষা পেতে বাধ্য হয়েই এ (অনলইন ক্লাস) ব্যবস্থা নিতে হয়। কোনো প্রকার পূর্ব-প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বর্তমানে এ বিষয়ে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু অভিভাবকদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, অসচেতনতা, এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাসস্থান পরিবর্তনের কারণে অনলাইন পড়াশোনা তেমন সার্বজনীন রূপ নিতে পারছে না। এ কারণে বিকল্প চিন্তা হিসাবে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক বিধি মেনে শিক্ষার্থীদের বাড়িবাড়ি গিয়ে শিক্ষকরা যেন পাঠদান করতে পারেন, এ বিষয়ে জুন ২০২০ সালে উপজেলা পরিষদের (কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ) মাসিক সমন্বয় সভায় অনুমতি প্রার্থনা করা হয়। বিষয়টি উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভার রেজুলেশনে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়। অনুমতি পাওয়ার পর প্রধান শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এরিয়াগুলোকে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার জন্য বলা হয়। যাতে করে তারা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক বিধি মেনে পাঠদান করতে পারে।

প্রধান শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় কামারখন্দ উপজেলায় জুন ২০২০ সাল থেকেই অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠদান কার্যক্রম (অফলাইন) পরিচালনা করতে থাকেন। এরূপ অফলাইন এবং অনলাইন পাঠদান কার্যক্রমের সংরক্ষিত রেকর্ডের ভিত্তিতে ২০২০ সালের পাঠসমাপ্তি ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হয়। ২০২১ সালে দৈনন্দিন পাঠ বিভাজন অর্থাৎ সিলেবাস প্রণয়ন করে তা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আগের মতোই শিক্ষকরা তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে।

৩০ এপ্রিল ২০২১ “কোভিড-১৯ এর কারণে অন্তর্বর্তীকালীন পাঠপরিকল্পনা” আসে। কোভিডকালীন ইতোমধ্যে পাঠপরিকল্পনা-২০২১ অব্যাহত রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিকবিধি অনুসরণপূর্বক “বাড়ির কাজ” প্রদানের উদ্দেশ্যে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ), ময়মনসিংহ থেকে বিশেষ কার্যক্রম প্রণয়ন করা হয়। এটি কামারখন্দ উপজেলায় সম্প্রতি চালুকৃত বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠদান কার্যক্রমকে আরও গতিশীল এবং সহজ করে দিয়েছে। এই বাড়ির কাজগুলো শিক্ষকরা তাদের নিয়মিত বাড়ি বাড়ি গমনপূর্বক শিক্ষাদানের সময় অনয়াশেই পৌঁছে দিচ্ছে। এবং কাজ শেষে শিটগুলো সংগ্রহ করে বিদ্যালয়ে এনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য পৃথক পৃথক প্রোফাইল তৈরি করে রাখছে।

শুরুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর কাজটা সহজ ছিল না। যেমন সহকারী শিক্ষকদের অনেকেই কর্মস্থলে ছিল না। সহকর্মীদের অনেকই বলতো, “ক’দিন পর স্কুল খুলে যাবে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়িয়ে কি হবে”। কেউবা কর্তৃপক্ষের ক্ষোভের কারণ হওয়া অস্বাভাবিক নয় ভেবেও ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। যাহোক ৩০ এপ্রিল ২০২১ ওয়ার্কশিট এবং অ্যাকটিভিটি শিট এর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আমাদের জুম মিটিংএ বলা হয়। এভাবে কার্যক্রম শুরু করতেই সারাদেশে তা ছড়িয়ে যায়। অতএব অনলাইন কার্যক্রমের কার্যকারিতা যে কত সহজ এবং সার্বজনীন তা চাক্ষুষ প্রমাণিত হয়। অথচ অতীতে এ ধরনের কার্যক্রম মাঠে নিয়ে যেতে অনেক কসরত করতে হয়েছে।

এখন “নেপ” প্রণীত বাড়ির কাজ, যা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওয়ার্কশিট এবং তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে অ্যাকটিভিটি শিট নামে সরবরাহ করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক শিক্ষকরা এই শিটগুলো ভিত্তি করে গুগলমিটের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছে। কাজেই এখনই সময় শিক্ষকদের মোটিভেট করার। ফলে তারা যেন করোনার ক্ষতি পূরণে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করতে পারে। এ ব্যাপারে উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তাগণকেও মাঠে নামানো যায়। শুধু কি পড়াশোনা! করোনা থেকে রক্ষার উপায়, স্বাস্থ্যপুষ্টি, সামাজিক নিরাপত্তা, বাল্যবিবাহ নিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করাও জরুরি। এজন্য কামারখন্দ উপজেলায় শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ভিজিট কর্মসূচি পরিচালনার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক বিধি বজায় রেখে সীমিত আকারে মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ এবং উঠান বৈঠক করা হচ্ছে। ফলে এ এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোন মেয়ে শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত বাল্যবিবাহের শিকার হয়নি। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হারও আগের মতো স্বাভাবিক।

অনলাইন কার্যক্রম একেবারে নতুন কিছু নয়। এজন্য সারা পৃথিবীতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব নেই। তবে সেগুলোর শুরুটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে। আমাদের দেশে প্রচলিত দূরশিক্ষণ পদ্ধতি বর্তমানের অনলাইনেরই পূর্ব-সংস্করণ বলা যায়। সাম্প্রতিক করোনা-পরিস্থিতিতে অনলাইন পদ্ধতিই একমাত্র শিক্ষাদান পদ্ধতি বলে সবাই মনে করছে। কিন্তু এ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে এবং কিছু কিছু বিকল্প পদ্ধতি বা সহযোগী পদ্ধতির কথা ভাবা হচ্ছে তা আগেই বলেছি।

আমাদের পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা যে চিহ্নিত অর্জনযোগ্য ২৯টি যোগ্যতা (জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি) অর্জন করবে বলে নির্ধারিত রয়েছে যেগুলোকে প্রাথমিক শিক্ষার প্রান্তিক যোগ্যতা বলা হয়। এই প্রান্তিক যোগ্যতাগুলোর মধ্যে ২০ নম্বর যোগ্যতাটি বর্তমান কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলাবিষয়ক বলা যায়। তা হলো প্রতিকূলতা ও দুর্যোগ সম্বন্ধে জানা এবং মোকাবিলায় দক্ষ ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া। আর আট নম্বর প্রান্তিক যোগ্যতাটি প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্বন্ধে জানা ও প্রয়োগের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা। অতএব কোভিড-১৯ সংক্রান্ত দুর্দশা থেকে মৃক্তির জন্য আমাদের ৮ ও ২০ নম্বর যোগ্যতা অবশ্যই অর্জন করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের এই আট নম্বর প্রান্তিক যোগ্যতাটি অর্জন করানোর উদ্দেশ্যে সরকার সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ল্যাপটপ ও মাল্টিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করা হয়েছে। শিক্ষকবৃন্দের আইসিটিবিষয়ক প্রশিক্ষণ চলছে। সরকার থেকে ইন্টারনেটের বিল প্রদান করা হচ্ছে। সরকারের অপরাপর বরাদ্দগুলোও অব্যাহত। এখন প্রত্যাশা- শিক্ষকবৃন্দ যেন স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক বিধি মেনে তাদের চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে করোনার ক্ষতিপূরণে শিক্ষার্থীদের সর্বতোভাবে সাহায্য করে। কারণ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত এসডিজি এর ১৭টি লক্ষ্যের চতুর্থতম, যা ২০৩০ সালের মধ্যে অবশ্যই বাংলাদেশকে সে লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তথা শিশুদের কোভিড-১৯ এর বিপদ থেকে রক্ষা, সুশিক্ষা নিশ্চিত করা এবং অভিভাবকদের সচেতন করার উদ্দেশ্যে শিক্ষকবৃন্দ ভার্চুয়াল (অনলাইন) মাধ্যমে পাঠদান, অভিভাবক সমাবেশ এবং মা সমাবেশ পরিচালনা করবে। যে সব ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল যোগাযোগের কোনো উপায় নেই সে সব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক বিধি মেনে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে সেবাদান করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এসব ক্ষেত্রে এতিম এবং অসহায় শিশুরা যেন কোনোক্রমেই বৈষম্যের শিকার না হয়। অভিভাবকদের জানিয়ে দিতে হবে তারা যেন প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় শিশুকে পড়তে বসায়। শিশুর পড়ার জায়গাটি যেন ঘরের অন্য স্থানের তুলনায় আলো-বাতাস পূর্ণ হয়। বাবা-মা পড়াতে অক্ষম হলে পড়তে পারা বড় ভাইবোন বা পাশের বাড়ির বড়রাও এ ব্যাপারে যেন সাহায্য করতে পারে। পাশাপাশি সংসদ টিভিতে প্রচারিত “ঘরে বসে শিখি” শিক্ষা কার্যক্রম যেন প্রত্যেক শিক্ষার্থী দেখে এবং রেডিওতে প্রচারিত শ্রেণী কার্যক্রম শোনে। এ বিষয়গুলো শিক্ষকবৃন্দ নিশ্চিত করবে। সুযোগ বুঝে তারা মোবাইল ফোনে প্রতিদিন কিছু শিক্ষার্থীদের পাঠবিষয়ক পরামর্শ দান করবে। শিক্ষার্থীরাও যেন অনায়াশে শিক্ষকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে পাঠবিষয়ক আলাপ করতে আগ্রহী থাকে সে ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ এই কোভিডজনিত মহামারিকালে শিক্ষকবৃন্দকে নানাভাবে অতন্দ্র প্রহরীর মতো শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা চাই। পাশাপাশি আবার ভার্চুয়াল ক্লাসের বিপরীতে শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির খারাপ দিকে আগ্রহী হয়ে পড়ছে কি না-তাও দেখা উচিত। শিক্ষকরা তাদের ওপর অর্পিত এ সব নতুন দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে কি না-সে ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি দরকার। তবে তারা শিক্ষকদের এ বিষয়ে কোনো ধরনের জোর-জবরদস্তি না করে সহযোগিতা করবে এটাই কাম্য।

ইউনিসেফের কোভিড-১৯ গ্লোবাল এডুকেশন রিকোভারি ট্রাকার, বিশ্বব্যাঙ্ক ও জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি বিশ্বে স্কুল বন্ধের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। তারা দেশে দেশে বাড়িতে অথবা স্কুলে পাঠদানের বিষয়টিও পর্যবেক্ষণ করছে। আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো বলেছে স্কুল বন্ধ থাকায় বিশ্বজুড়ে শিশু নিপীড়ন এবং শিশুদের অধিকার লংঘন অনেকভাবে বেড়ে গেছে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এনজিও কিডস-রাইটস এর বার্ষিক জরিপ মতে... বিশ্বে ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু শিক্ষার্থী এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুলে যেতে পারছে না। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ শিশুর দূরশিক্ষণ (অনলাইন) পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই। আবার বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনার ধাক্কা লাগায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের উপকরণগত ঘাটতিতে পড়েছে বাড়তি ১৪ কোটি ২০ লাখ শিশু। অর্থাৎ সারা বিশ্বের শিশুরাই বিরাট স্বাস্থ্য ও শিক্ষাগত ঝুঁকিতে আছে।

কোভিড-১৯ থেকে জীবন বাঁচাতে যেমন ঘরে থাকা প্রয়োজন তেমনি এই জীবনকে সঠিকভাবে গঠনের জন্য প্রতিটি ঘরকে স্কুলে পরিণত করাও অপরিহার্য। দক্ষ এবং গতিশীল শিক্ষকবৃন্দ অভিভাবকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এ কাজটি সহজেই করতে পারে।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

খামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]