বিনিয়োগকারীর ভাবনায় শেয়ারবাজারে বাজেটের প্রভাব

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম

মাহাবুব সাহেব একজন মধ্যম মানের বিনিয়োগকারী। শেয়ার ব্যবসায় ২০ বছর ধরে জড়িত। ইদানীং তিনি খুব চিন্তিত। বাজেটোত্তর শেয়ারবাজার ভালো যাবে নাকি মন্দ। তবে ঘুরে ফিরে সেই একই কথা-কালোটাকা সাদা করা প্রসঙ্গ। ভাবটা এরকম-শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ যদি না থাকে তবে শেয়ারবাজারে আবার পতন শুরু হবে। ইতোমধ্যে হাতে থাকা বেশিরভাগ শেয়ার লসে বিক্রিও করে দিয়েছেন এবং পর্যবেক্ষণ মুডে রয়েছেন। দেখছেন সূচকের গতি-প্রকৃতি। নিশ্চয়ই সূচক কিছু কমবে। সুযোগমতো কম দামে আবার কিনে নিবেন।

মাহাবুব সাহেব যা ভেবেছিলেন তাই হলো। বাজেট-পরবর্তী কার্যদিবসে সূচকের অল্পকিছু পতন হলো। ৬ জুন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৫ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩৮ পয়েন্টে। মাহাবুব সাহেবের দূরদর্শন মিলে গেল। সে নিজেকে দূরদর্শী ভাবা শুরু করলেন এবং আরও বড় পতনের অপেক্ষায় রইলেন।

কিন্তু তিনি লক্ষ করলেন, ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারের দামে তেমন কোনো হেরফের হলো না। এটাই তো স্বাভাবিক, পতনের বাজারে ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম তেমন কমে না। আবার উঠতি বাজারে খুব বেশি দাম বাড়েও না। অর্থাৎ বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ার কিনে তেমন লাভ করা যায় না। উল্লেখ্য, বাজারে সেদিন লেনদেনে রেকর্ড হলো- সাড়ে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন, যা টাকায় ২ হাজার ৬৬৯ কোটি। পরে অবশ্য ৯ জুন লেনদেনের এই রেকর্ড ভেঙে আবার রেকর্ড হয়। লেনদেন ছাড়িয়ে যায় ২৭০০ কোটি টাকা। এর আগে সর্বশেষ ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর এর চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে। লেনদেনের বিষয়টি মাহাবুব সাহেব তেমন পাত্তা দিলেন না। তাই তিনি বাজার আরও তলানির অপেক্ষায় রইলেন এবং ভাবতে থাকলেন-তলানি থেকে সূচক যখন আবার ঘুরে দাঁড়াবে তখন দেখেশুনে ভালো একটি আইটেম (স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ার যা সহজে ম্যানুপুলেট করা যায়) খুঁজে কিনে নিবেন। কারন, তার অভিজ্ঞতায় উঠতি বাজারে স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দাম দ্রুত বেড়ে কয়েকগুণ হয়। ফলে প্রচুর লাভ করা যায়। মাহাবুব সাহেব অপেক্ষা থাকুক। আমরা খুঁজে দেখি মাহাবুব সাহেবের সেই দুশ্চিন্তার জায়গা। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গ, যা নিয়ে মাহাবুব সাহেব গং খুব চিন্তিত।

অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, এই সুযোগ কেবল এই অর্থবছরের জন্য। তিনি অবশ্য কালোটাকাকে ‘কালো’ বলতে নারাজ। সেই অর্থমন্ত্রীই আবার প্রস্তাবিত বাজেটকে সামনে রেখে কিছুদিন আগে বলেছেন ‘যতদিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এ সুযোগ থাকবে’। তবে এবারের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু উল্লেখ না করলেও বিএসইসির চেয়ারম্যান বলছেন, এই সুবিধা থাকবে এবং বরাবর এরকমই হয়েছে। এবার কালোটাকা বিনিয়োগে চলতি অর্থবছরে শেয়ারবাজারে কী প্রভাব পড়েছে তা একটু ঘেটে দেখা যাক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১২ হাজার কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করেছেন ৯ হাজার ৯৩৪ জন করদাতা। এনবিআরের হিসাবে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে বৈধ করা মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত দেশে ১৭ বার এই সুযোগ পেয়েছেন করদাতারা। কিন্তু কালোটাকার মালিকরা তেমন সাড়া দেননি।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধের পরিধি আগের তুলনায় অনেক বিস্তৃত করা হয়েছিল। শুধু শেয়ারবাজারে এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ১০ শতাংশ কর দিয়ে বিনিয়োগের বিপরীতে অর্থ বৈধ করেছেন মাত্র ৩১১ জন করদাতা। তাদের বিনিয়োগকৃত টাকার পরিমাণ মাত্র ৪৩০ কোটি, যা এই সময়কালে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার মাত্র ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই বিনিয়োগ দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজেট পরবর্তী সপ্তাহের দৈনিক গড় ২ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা লেনদেনের মাত্র ১৭ শতাংশের মতো। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ শেয়ারবাজারের লেনদেন ও উত্থানের কোনো ভূমিকা রাখছে না। এটি একটি মনস্তাত্বিক ব্যাপার বৈ আর কিছু নয়, যা নিয়ে মাহাবুব সাহেবদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। এটি মাহাবুব সাহেবরা কেন বুঝেন না তা শেয়ারবাজার বোদ্ধাদের বোধগম্য নয়।

এছাড়া বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য যে বিষয়াদি চাওয়া হয়েছিল তার প্রায় সবগুলোই পাওয়া গেছে। বিশেষ করে করপোরেট কর কমানোর বিষয়। প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য করপোরেট করের হার আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। পাশাপাশি বন্ডের ক্ষেত্রে দুই শতাংশ কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে সিমেন্ট, প্রকৌশলসহ কিছু কোম্পানির উৎসের আগাম কর কর্তনের হারেও ছাড় দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। তাতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৩৬ কোম্পানির মধ্যে ১৭৩টি কোম্পানি সরাসরি করছাড়ের আওতায় পড়বে এবং প্রভাব পড়বে কোম্পানির মুনাফায়। ফলে কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ দেয়ার সক্ষমতা বেড়ে যাবে, যা নিঃসন্ধেহে কালোটাকা বিনিয়োগ সুযোগের চেয়ে অনেক বেশি বাজারকে প্রভাবিত করবে।

ব্যাংক-বীমাসহ যে ১৬৩ কোম্পানির শেয়ারের করপোরেট কর অপরিবর্তিত রেখেছেন, বাজার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, স্বল্পমূলধনী সেই বীমা খাতের কোম্পানির শেয়ারের দাম-দর বাড়ার শীর্ষে। মাহাবুব সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আবারও ছোট একটি আইটেম দেখে বিনিয়োগে যাবেন। দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেলে বিক্রি করে মুনাফা হাতিয়ে নিবেন। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রস্তাবিত বাজেটে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট যথা : ট্রেজারি বন্ড, সুকুক, ডেরিভেটিভ, অপশনের লেনদেন চালু করা। এসএমই ও এটিবি বোর্ড চালু করা, ইটিএফ চালু করা, ওপেন ইন্ড মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত করা, শেয়ারবাজারের সহায়ক ইকোসিস্টেম ও সার্বিক সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন এবং স্টক এক্সচেঞ্জকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য অর্থমন্ত্রী সূদৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

মাহাবুব সাহেব খুব বিচক্ষণ। তাই এবার তিনি সরকারের এই বাজেটের কথামালার ফাঁদে পা দিবেন না। তিনি ২০ বছরের অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী। এ রকম প্রতিশ্রুতি বহু দেখেছেন, আশান্বিত হয়েছেন। লাভের আশায় বিনিয়োগ করে উল্টো লস করেছেন। সে জানে বাজেটে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য থাকে। আবার আংশিক বাস্তবায়ন হলেও বাজারে এর প্রভাব পড়ে না। তাই তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বহু ভালো উদ্যোগ তিনি দেখেছেন। এবার সাবধান থাকবেন। কোনো মতেই দীর্ঘমেয়াদে মৌলভিত্তি শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন না। কারণ, তিনি ভালো করেই জানেন, আমাদের শেয়ারবাজার কখনও মৌলভিত্তির ওপর চলে না। এখানে কারসাজি ও গুজবই শেয়ার কেনাবেচায় বেশি প্রভাব ফেলে। মাহাবুব সাহেবের দর্শনই ঠিক। নতুবা কোন কারণ ছাড়া এক বছরে একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ গুণ ও ৬ মাসে ৭ গুণ বেড়ে যাওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। একমাত্র ‘কারসাজি’র মাধ্যমেই এটা সম্ভব। চাঙা বাজরে কারসাজি বেশি হয়। মাহাবুব সাহেবরা আবার বাজারের এই আচরণই পছন্দ করেন। নির্দিষ্ট কোন শেয়ার দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে চান না। খাত বুঝে, শেয়ারের ঊর্ধ্বমুখী টান দেখে বিনিয়োগ করে নিজেদের স্মার্ট বিনিয়োগকারী হিসেবে দাবি করেন। অবশেষে কারসাজির অংশ হন মাহাবুব সাহেবরা।

এভাবেই মাহাবুব সাহেবরা বহুকাল ধরে বিনিয়োগ করে আসছেন। জীবনের এই বয়সে এসে লাভ-লসের হিসাব কষছেন। দেখছেন লস বা ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেননি, শত অনিশ্চয়তা ও অব্যবস্থাপনার মধ্যেও আমাদের এই বাজারে উল্লেখযোগ্য

-সংখ্যক কোম্পানি রয়েছে যেখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে প্রচুর লাভ হয়েছে। বাজার বিশ্লেষণ এমনই বলছে। মাহাবুব সাহেবরা মাথা খাটান না। ধৈর্য ধরতে চান না। তারা শেয়ারবাজার থেকে খুব দ্রুত মুনাফা করতে চান। শেয়ারবাজারে জীবনের বড় একটি অংশ অতিবাহিত করলেন। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেননি, যে সত্যিকারের বিনিয়োগ করলেন কি? নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছেন, না অন্যের কথায় শেয়ার কিনেছেন। বছরের পর বছর শেয়ারবাজারে আছেন। কিন্তু বাজার থেকে কী শিক্ষা নিয়েছেন। হাউসে বসে শুধু প্রজেক্টরের স্ক্রিনে চেয়ে থাকেন। অপেক্ষায় থাকেন। সূচক দেখে বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগে শেয়ারের দরকে গুরুত্ব দেন। কোম্পানির মৌলভিত্তি, কোম্পানির ভ্যালু বা মূল্য বিবেচনায় নেন না। শেয়ারের দাম ও কোম্পানির ভ্যালুর মধ্যে পার্থক্য বোঝেন না। তারা জানেন না প্রকৃত বিনিয়োগকারী আর ফাটকাকারবারী বলতে কী বোঝায়।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারা শুধু এই বাজেটপর্বেই নয়-মুদ্রানীতি ঘোষণা, মহামারি, লকডাউন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, হেফাজতের আন্দোলন, জঙ্গি তৎপরতা, ঈদ-কোরবানির ছুটি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যা, খরা, শীত, আকাশে মেঘ, দেশে বিদেশি কোনো রাষ্ট্রীয় অতিথির আগমন, আগুন লাগা, বস্তি উচ্ছেদ এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো আত্মীয়স্বজন মারা যাওয়া, অর্থাৎ যে কোনো ঘটনার মধ্যেই তারা ইস্যু খুঁজেন। আর এসব দেখে তারা শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনাবেচার স্মার্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার পাল্লা ভারী করেন। তারা গুজবে-হুজুগে অন্যের প্ররোচনায় বিনিয়োগ করেন, যা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ নৈতিকতার কোন মানদন্ডেই যায় না। ফলে বাজারের মৌলিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাজার হয় অস্থিতিশীল। প্রচার করে বেড়ায় এটি জুয়াড়িদের বাজার। নিজেরা হতাশ হন এবং বাজারবিমুখ করেন দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগকারীদের।

[লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক]

monirulislammi888@gmail.com

রবিবার, ২৭ জুন ২০২১ , ১৩ আষাঢ় ১৪২৮ ১৫ জিলক্বদ ১৪৪২

বিনিয়োগকারীর ভাবনায় শেয়ারবাজারে বাজেটের প্রভাব

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম

মাহাবুব সাহেব একজন মধ্যম মানের বিনিয়োগকারী। শেয়ার ব্যবসায় ২০ বছর ধরে জড়িত। ইদানীং তিনি খুব চিন্তিত। বাজেটোত্তর শেয়ারবাজার ভালো যাবে নাকি মন্দ। তবে ঘুরে ফিরে সেই একই কথা-কালোটাকা সাদা করা প্রসঙ্গ। ভাবটা এরকম-শেয়ারবাজারে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ যদি না থাকে তবে শেয়ারবাজারে আবার পতন শুরু হবে। ইতোমধ্যে হাতে থাকা বেশিরভাগ শেয়ার লসে বিক্রিও করে দিয়েছেন এবং পর্যবেক্ষণ মুডে রয়েছেন। দেখছেন সূচকের গতি-প্রকৃতি। নিশ্চয়ই সূচক কিছু কমবে। সুযোগমতো কম দামে আবার কিনে নিবেন।

মাহাবুব সাহেব যা ভেবেছিলেন তাই হলো। বাজেট-পরবর্তী কার্যদিবসে সূচকের অল্পকিছু পতন হলো। ৬ জুন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৫ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩৮ পয়েন্টে। মাহাবুব সাহেবের দূরদর্শন মিলে গেল। সে নিজেকে দূরদর্শী ভাবা শুরু করলেন এবং আরও বড় পতনের অপেক্ষায় রইলেন।

কিন্তু তিনি লক্ষ করলেন, ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারের দামে তেমন কোনো হেরফের হলো না। এটাই তো স্বাভাবিক, পতনের বাজারে ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম তেমন কমে না। আবার উঠতি বাজারে খুব বেশি দাম বাড়েও না। অর্থাৎ বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ার কিনে তেমন লাভ করা যায় না। উল্লেখ্য, বাজারে সেদিন লেনদেনে রেকর্ড হলো- সাড়ে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন, যা টাকায় ২ হাজার ৬৬৯ কোটি। পরে অবশ্য ৯ জুন লেনদেনের এই রেকর্ড ভেঙে আবার রেকর্ড হয়। লেনদেন ছাড়িয়ে যায় ২৭০০ কোটি টাকা। এর আগে সর্বশেষ ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর এর চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে। লেনদেনের বিষয়টি মাহাবুব সাহেব তেমন পাত্তা দিলেন না। তাই তিনি বাজার আরও তলানির অপেক্ষায় রইলেন এবং ভাবতে থাকলেন-তলানি থেকে সূচক যখন আবার ঘুরে দাঁড়াবে তখন দেখেশুনে ভালো একটি আইটেম (স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ার যা সহজে ম্যানুপুলেট করা যায়) খুঁজে কিনে নিবেন। কারন, তার অভিজ্ঞতায় উঠতি বাজারে স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দাম দ্রুত বেড়ে কয়েকগুণ হয়। ফলে প্রচুর লাভ করা যায়। মাহাবুব সাহেব অপেক্ষা থাকুক। আমরা খুঁজে দেখি মাহাবুব সাহেবের সেই দুশ্চিন্তার জায়গা। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গ, যা নিয়ে মাহাবুব সাহেব গং খুব চিন্তিত।

অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, এই সুযোগ কেবল এই অর্থবছরের জন্য। তিনি অবশ্য কালোটাকাকে ‘কালো’ বলতে নারাজ। সেই অর্থমন্ত্রীই আবার প্রস্তাবিত বাজেটকে সামনে রেখে কিছুদিন আগে বলেছেন ‘যতদিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এ সুযোগ থাকবে’। তবে এবারের প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু উল্লেখ না করলেও বিএসইসির চেয়ারম্যান বলছেন, এই সুবিধা থাকবে এবং বরাবর এরকমই হয়েছে। এবার কালোটাকা বিনিয়োগে চলতি অর্থবছরে শেয়ারবাজারে কী প্রভাব পড়েছে তা একটু ঘেটে দেখা যাক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১২ হাজার কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করেছেন ৯ হাজার ৯৩৪ জন করদাতা। এনবিআরের হিসাবে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে বৈধ করা মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত দেশে ১৭ বার এই সুযোগ পেয়েছেন করদাতারা। কিন্তু কালোটাকার মালিকরা তেমন সাড়া দেননি।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধের পরিধি আগের তুলনায় অনেক বিস্তৃত করা হয়েছিল। শুধু শেয়ারবাজারে এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ১০ শতাংশ কর দিয়ে বিনিয়োগের বিপরীতে অর্থ বৈধ করেছেন মাত্র ৩১১ জন করদাতা। তাদের বিনিয়োগকৃত টাকার পরিমাণ মাত্র ৪৩০ কোটি, যা এই সময়কালে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার মাত্র ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই বিনিয়োগ দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজেট পরবর্তী সপ্তাহের দৈনিক গড় ২ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা লেনদেনের মাত্র ১৭ শতাংশের মতো। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ শেয়ারবাজারের লেনদেন ও উত্থানের কোনো ভূমিকা রাখছে না। এটি একটি মনস্তাত্বিক ব্যাপার বৈ আর কিছু নয়, যা নিয়ে মাহাবুব সাহেবদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। এটি মাহাবুব সাহেবরা কেন বুঝেন না তা শেয়ারবাজার বোদ্ধাদের বোধগম্য নয়।

এছাড়া বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য যে বিষয়াদি চাওয়া হয়েছিল তার প্রায় সবগুলোই পাওয়া গেছে। বিশেষ করে করপোরেট কর কমানোর বিষয়। প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য করপোরেট করের হার আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। পাশাপাশি বন্ডের ক্ষেত্রে দুই শতাংশ কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে সিমেন্ট, প্রকৌশলসহ কিছু কোম্পানির উৎসের আগাম কর কর্তনের হারেও ছাড় দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। তাতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৩৬ কোম্পানির মধ্যে ১৭৩টি কোম্পানি সরাসরি করছাড়ের আওতায় পড়বে এবং প্রভাব পড়বে কোম্পানির মুনাফায়। ফলে কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ দেয়ার সক্ষমতা বেড়ে যাবে, যা নিঃসন্ধেহে কালোটাকা বিনিয়োগ সুযোগের চেয়ে অনেক বেশি বাজারকে প্রভাবিত করবে।

ব্যাংক-বীমাসহ যে ১৬৩ কোম্পানির শেয়ারের করপোরেট কর অপরিবর্তিত রেখেছেন, বাজার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, স্বল্পমূলধনী সেই বীমা খাতের কোম্পানির শেয়ারের দাম-দর বাড়ার শীর্ষে। মাহাবুব সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আবারও ছোট একটি আইটেম দেখে বিনিয়োগে যাবেন। দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেলে বিক্রি করে মুনাফা হাতিয়ে নিবেন। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রস্তাবিত বাজেটে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট যথা : ট্রেজারি বন্ড, সুকুক, ডেরিভেটিভ, অপশনের লেনদেন চালু করা। এসএমই ও এটিবি বোর্ড চালু করা, ইটিএফ চালু করা, ওপেন ইন্ড মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত করা, শেয়ারবাজারের সহায়ক ইকোসিস্টেম ও সার্বিক সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন এবং স্টক এক্সচেঞ্জকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য অর্থমন্ত্রী সূদৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

মাহাবুব সাহেব খুব বিচক্ষণ। তাই এবার তিনি সরকারের এই বাজেটের কথামালার ফাঁদে পা দিবেন না। তিনি ২০ বছরের অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী। এ রকম প্রতিশ্রুতি বহু দেখেছেন, আশান্বিত হয়েছেন। লাভের আশায় বিনিয়োগ করে উল্টো লস করেছেন। সে জানে বাজেটে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য থাকে। আবার আংশিক বাস্তবায়ন হলেও বাজারে এর প্রভাব পড়ে না। তাই তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বহু ভালো উদ্যোগ তিনি দেখেছেন। এবার সাবধান থাকবেন। কোনো মতেই দীর্ঘমেয়াদে মৌলভিত্তি শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন না। কারণ, তিনি ভালো করেই জানেন, আমাদের শেয়ারবাজার কখনও মৌলভিত্তির ওপর চলে না। এখানে কারসাজি ও গুজবই শেয়ার কেনাবেচায় বেশি প্রভাব ফেলে। মাহাবুব সাহেবের দর্শনই ঠিক। নতুবা কোন কারণ ছাড়া এক বছরে একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ গুণ ও ৬ মাসে ৭ গুণ বেড়ে যাওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। একমাত্র ‘কারসাজি’র মাধ্যমেই এটা সম্ভব। চাঙা বাজরে কারসাজি বেশি হয়। মাহাবুব সাহেবরা আবার বাজারের এই আচরণই পছন্দ করেন। নির্দিষ্ট কোন শেয়ার দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে চান না। খাত বুঝে, শেয়ারের ঊর্ধ্বমুখী টান দেখে বিনিয়োগ করে নিজেদের স্মার্ট বিনিয়োগকারী হিসেবে দাবি করেন। অবশেষে কারসাজির অংশ হন মাহাবুব সাহেবরা।

এভাবেই মাহাবুব সাহেবরা বহুকাল ধরে বিনিয়োগ করে আসছেন। জীবনের এই বয়সে এসে লাভ-লসের হিসাব কষছেন। দেখছেন লস বা ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেননি, শত অনিশ্চয়তা ও অব্যবস্থাপনার মধ্যেও আমাদের এই বাজারে উল্লেখযোগ্য

-সংখ্যক কোম্পানি রয়েছে যেখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে প্রচুর লাভ হয়েছে। বাজার বিশ্লেষণ এমনই বলছে। মাহাবুব সাহেবরা মাথা খাটান না। ধৈর্য ধরতে চান না। তারা শেয়ারবাজার থেকে খুব দ্রুত মুনাফা করতে চান। শেয়ারবাজারে জীবনের বড় একটি অংশ অতিবাহিত করলেন। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেননি, যে সত্যিকারের বিনিয়োগ করলেন কি? নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছেন, না অন্যের কথায় শেয়ার কিনেছেন। বছরের পর বছর শেয়ারবাজারে আছেন। কিন্তু বাজার থেকে কী শিক্ষা নিয়েছেন। হাউসে বসে শুধু প্রজেক্টরের স্ক্রিনে চেয়ে থাকেন। অপেক্ষায় থাকেন। সূচক দেখে বিনিয়োগ করেন। বিনিয়োগে শেয়ারের দরকে গুরুত্ব দেন। কোম্পানির মৌলভিত্তি, কোম্পানির ভ্যালু বা মূল্য বিবেচনায় নেন না। শেয়ারের দাম ও কোম্পানির ভ্যালুর মধ্যে পার্থক্য বোঝেন না। তারা জানেন না প্রকৃত বিনিয়োগকারী আর ফাটকাকারবারী বলতে কী বোঝায়।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তারা শুধু এই বাজেটপর্বেই নয়-মুদ্রানীতি ঘোষণা, মহামারি, লকডাউন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, হেফাজতের আন্দোলন, জঙ্গি তৎপরতা, ঈদ-কোরবানির ছুটি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যা, খরা, শীত, আকাশে মেঘ, দেশে বিদেশি কোনো রাষ্ট্রীয় অতিথির আগমন, আগুন লাগা, বস্তি উচ্ছেদ এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো আত্মীয়স্বজন মারা যাওয়া, অর্থাৎ যে কোনো ঘটনার মধ্যেই তারা ইস্যু খুঁজেন। আর এসব দেখে তারা শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনাবেচার স্মার্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার পাল্লা ভারী করেন। তারা গুজবে-হুজুগে অন্যের প্ররোচনায় বিনিয়োগ করেন, যা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ নৈতিকতার কোন মানদন্ডেই যায় না। ফলে বাজারের মৌলিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাজার হয় অস্থিতিশীল। প্রচার করে বেড়ায় এটি জুয়াড়িদের বাজার। নিজেরা হতাশ হন এবং বাজারবিমুখ করেন দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগকারীদের।

[লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক]

monirulislammi888@gmail.com