সময় এখন স্টিম শিক্ষার

মাহমুদুল হাছান

বিশ্বে সভ্যতার ইতিহাসে সব উন্নতি ও অগ্রযাত্রার গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে কোন না কোন শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে তিনটি শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। প্রথম শিল্প বিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্প বিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণ। বর্তমানে আরেকটি শিল্প বিপ্লবের উদ্ভব হয়েছে; যা আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেটি হলো ডিজিটাল বিপ্লব। আর এটিকেই এখন বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ফোর আই আর (4IR)।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহীপ্রধান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে একটি প্রবন্ধে বলেছেন- ‘আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনো হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়াও।’

ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সূচিত হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। মানুষ যখন ইন্টারনেটের ব্যবহার মোটামুটি ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পেরেছে, নেট দুনিয়ায় তারা দক্ষভাবে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছে এবং সবার হাতে হাতে স্মার্টফোনের ব্যবহার সহজলভ্য হয়েছে, তখনই এ বিপ্লব সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

ডিজিটাল বিপ্লবের এ শক্তির চিত্রটি বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে- ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন এক দিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়, গুগলে ৪২০ কোটি বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়। এক যুগ আগেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়।

যেহেতু বৈশ্বিক শিল্পগুলো এখন উল্লেখযোগ্যভাবে তৃতীয় থেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে স্থানান্তরিত হচ্ছে, সেহেতু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এখন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্টিম (STEAM) শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। সায়েন্স বা বিজ্ঞান, টেকনোলজি বা প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশল, আর্ট বা চারুকলা এবং ম্যাথম্যাটিকস বা গণিত- এ পাঁচটি বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে স্টিম (STEAM) শিক্ষা। এটি শিক্ষাক্ষেত্রে উচ্চ প্রযুক্তিগত শিক্ষার সন্নিবেশ ঘটায়। এ বিষয়গুলো অসংখ্য ক্যারিয়ারের জন্য মূল ভিত্তি তৈরি করে, যাতে এরূপ ক্যারিয়ারও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে; যার অস্তিত্ব এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। স্টিম শিক্ষা ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেক বিষয়ের মুখ্য ধারণার বোধশক্তি উন্নত করে এবং প্রত্যেকটির মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্পর্ক সৃষ্টি করে গবেষণা, প্রায়োগিক ও প্রজেক্টভিত্তিক অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে সাহায্য করে; যার ফলে অতি-প্রয়োজনীয় সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি তীক্ষ্ম হয়। স্টিমশিক্ষার মূল বিষয়গুলো হচ্ছে- সৃজনশীলতা, কোন কিছু খুঁজে বের করার দক্ষতা, বিশ্লেষণ করা, টিমওয়ার্ক করার যোগ্যতা, যোগাযোগ জ্ঞান বৃদ্ধি, ডিজিটাল জ্ঞানের সম্ভার, সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে, লেখাপড়া আর শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ থাকে না। সৃজনশীলতা ও নতুনত্বের লালন-পালনের জন্য আমাদের বৈশ্বিক সব সুবিধার সমন্বয় ঘটিয়ে আমাদের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে সাজানো উচিত। আমাদের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি তাদের ব্যবহারিক দক্ষতা গড়ে তোলার জন্য বাস্তব-জীবনের প্রয়োগসিদ্ধ জ্ঞান সরবরাহ করতে হবে। প্রযুক্তিগত সমস্যা তরঙ্গ এবং উন্নত প্রযুক্তির উত্থানের ফলেই মূলত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এসেছে, যেখানে রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), মেশিন লার্নিং, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (ভিআর), ক্লাউড কম্পিউটিং, ডেটা এনালাইসিস এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ইত্যাদি নতুন নতুন চিন্তা, শিক্ষাদান পদ্ধতি রীতিমতো রূপান্তর করে চলেছে। ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশনের ফলে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকশিত হচ্ছে এবং তৈরি হচ্ছে চৌকস, প্রতিভাবান ও দক্ষ জনশক্তি। এভাবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিগুলো যখন কর্মক্ষেত্রে অভিযোজিত হয় তখন কাজ সম্পাদনের নতুন উপায় সক্রিয় করে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মূল্যবোধ তৈরির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রযুক্তি আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরিহার্য। প্রযুক্তি এবং শিক্ষার সংমিশ্রণ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অনেক ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯-এ ভাবনার জগতকে আরও প্রসারিত করেছে।

সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমগুলোতে অবিশ্বাস্য উদ্ভাবন, আইওটি, অটোমেশন, শৈল্পিক প্রচেষ্টাতে কম্পিউটারের ব্যবহার ইত্যাদি আমাদের মৌলিকভাবে শেখার, কাজ করার এবং জীবনযাত্রার মানে অনেক পরিবর্তন এনে চলেছে। আজকের স্টিম (STEAM) আগের স্টেমের (STEM) পরিবর্তিত সংস্করণ। স্টিম বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত- এ চারটি বিষয়ের সমন্বিত রূপ। এ তত্ত্বটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ২০০১ সালে। এখন ২০২১ সাল। আগামী প্রজন্মকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে আরেকটি শিল্প বা আর্ট যুক্ত হয়ে স্টেম (STEM) শিক্ষাটি স্টিম (STEAM) শিক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছে।

‘দ্য মিডিয়াম রিপোর্ট-২০২০’ এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত নোবেল বিজয়ী কোন না কোন শিল্পের অনুশীলন করে থাকেন। একজন সফল বিজ্ঞানীকে অন্য আরেকজন সফল বিজ্ঞানীর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, প্রত্যেকের গবেষণায় শিল্পচর্চা ভিন্ন ভিন্ন স্বকীয়তায় উন্নত ও ব্যতিক্রম। এটি বিজ্ঞানের সাফল্য এবং শিল্প সংযোগ যা স্টিম প্রবক্তাদের মাঝে এ বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে, প্রযুক্তির সঙ্গে আর্ট বা কলার সম্পর্ক সুনিবিড়। স্টিম শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা প্রায়োগিক শিক্ষায় নিযুক্ত হয়, পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকে। কারণ তারা চিন্তা-ভাবনামূলক ঝুঁকি নেয় এবং সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় কাজ করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, অনেক নিয়োগকর্তা, শিক্ষাবিদ এবং অভিভাবকরা বিশ্বাস করেন যে, স্টিম শিক্ষা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও যোগ্যতার উন্নতি সাধনের জন্য স্টেমের যাবতীয় অপূর্ণতাকে পূরণ করতে সহায়তা করে।

স্টিম শিক্ষার প্রবক্তারা মনে করেন যে, চারুকলা বা আর্ট, স্টেম শিক্ষায় অনুপস্থিত একটি অংশের সংযোজন, যা শিক্ষার্থীদের কেবল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বুঝতেই প্রস্তুত করে না, বরং কীভাবে তা শিখতে হয় এবং সৃজনশীল পদ্ধতিতে কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়, তা জানতে সাহায্য করে। একটি সফল স্টিম প্রোগ্রাম তৈরি করার জন্য, আর্টসকে একটি প্রামাণিক উপায়ে স্টেমের অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। এটি স্টেমে শুধু সৃজনশীলতা যুক্ত করার জন্য নয়, বরং বিশ্বের বাস্তব পরিস্থিতিতে শিল্পকে প্রয়োগ করার জন্য। উদাহরণস্বরূপ- যদি শিক্ষার্থীদের স্টেম প্রকল্পের আওতায় কোন অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়, তাহলে সেটিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে আর্ট বা শিল্পকলাকে সংযুক্ত করা হয়। আর এটিই হলো স্টিম শিক্ষা। সুতরাং স্টিম শিক্ষা মূলত শিক্ষার্থীদের ‘আউট সাইড দ্য বক্স’ চিন্তা করার দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (4IR) আমাদের সামগ্রিক জীবনযাপন প্রণালিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে চলেছে। আমরা কীভাবে সুন্দর জীবন পরিচালনা করতে পারি, নান্দনিকভাবে কাজ করতে পারি, শিক্ষার ধরন কেমন হবে, ভবিষ্যতে আমাদের করণীয় কী হতে পারে ইত্যাদির সবকিছুতেই ডিজিটাল বা শিল্প বিপ্লবের প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, প্রযুক্তি, কলা ও গণিতের (স্টিম) সমন্বিত শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনুশীলন চলছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশেষ করে করোনা প্যান্ডামিকের একালে স্টিম শিক্ষার আবশ্যকতা আমরা সবাই কমবেশি বুঝতে পেরেছি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করা যায়, আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী তা বুঝতে পেরেছে করোনার আবির্ভাবের কারণে। এটি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবেই সম্ভব হয়েছে।

সময় এখন স্টিম শিক্ষার। আগামী প্রজন্মকে একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি করতে স্টিম শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]

সোমবার, ২৮ জুন ২০২১ , ১৪ আষাঢ় ১৪২৮ ১৬ জিলক্বদ ১৪৪২

সময় এখন স্টিম শিক্ষার

মাহমুদুল হাছান

বিশ্বে সভ্যতার ইতিহাসে সব উন্নতি ও অগ্রযাত্রার গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে কোন না কোন শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে তিনটি শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। প্রথম শিল্প বিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্প বিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণ। বর্তমানে আরেকটি শিল্প বিপ্লবের উদ্ভব হয়েছে; যা আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেটি হলো ডিজিটাল বিপ্লব। আর এটিকেই এখন বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ফোর আই আর (4IR)।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহীপ্রধান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে একটি প্রবন্ধে বলেছেন- ‘আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনো হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়াও।’

ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সূচিত হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। মানুষ যখন ইন্টারনেটের ব্যবহার মোটামুটি ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পেরেছে, নেট দুনিয়ায় তারা দক্ষভাবে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছে এবং সবার হাতে হাতে স্মার্টফোনের ব্যবহার সহজলভ্য হয়েছে, তখনই এ বিপ্লব সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

ডিজিটাল বিপ্লবের এ শক্তির চিত্রটি বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে- ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন এক দিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়, গুগলে ৪২০ কোটি বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়। এক যুগ আগেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়।

যেহেতু বৈশ্বিক শিল্পগুলো এখন উল্লেখযোগ্যভাবে তৃতীয় থেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে স্থানান্তরিত হচ্ছে, সেহেতু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এখন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্টিম (STEAM) শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। সায়েন্স বা বিজ্ঞান, টেকনোলজি বা প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশল, আর্ট বা চারুকলা এবং ম্যাথম্যাটিকস বা গণিত- এ পাঁচটি বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে স্টিম (STEAM) শিক্ষা। এটি শিক্ষাক্ষেত্রে উচ্চ প্রযুক্তিগত শিক্ষার সন্নিবেশ ঘটায়। এ বিষয়গুলো অসংখ্য ক্যারিয়ারের জন্য মূল ভিত্তি তৈরি করে, যাতে এরূপ ক্যারিয়ারও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে; যার অস্তিত্ব এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। স্টিম শিক্ষা ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেক বিষয়ের মুখ্য ধারণার বোধশক্তি উন্নত করে এবং প্রত্যেকটির মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্পর্ক সৃষ্টি করে গবেষণা, প্রায়োগিক ও প্রজেক্টভিত্তিক অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে সাহায্য করে; যার ফলে অতি-প্রয়োজনীয় সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি তীক্ষ্ম হয়। স্টিমশিক্ষার মূল বিষয়গুলো হচ্ছে- সৃজনশীলতা, কোন কিছু খুঁজে বের করার দক্ষতা, বিশ্লেষণ করা, টিমওয়ার্ক করার যোগ্যতা, যোগাযোগ জ্ঞান বৃদ্ধি, ডিজিটাল জ্ঞানের সম্ভার, সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ যুগে, লেখাপড়া আর শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ থাকে না। সৃজনশীলতা ও নতুনত্বের লালন-পালনের জন্য আমাদের বৈশ্বিক সব সুবিধার সমন্বয় ঘটিয়ে আমাদের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে সাজানো উচিত। আমাদের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি তাদের ব্যবহারিক দক্ষতা গড়ে তোলার জন্য বাস্তব-জীবনের প্রয়োগসিদ্ধ জ্ঞান সরবরাহ করতে হবে। প্রযুক্তিগত সমস্যা তরঙ্গ এবং উন্নত প্রযুক্তির উত্থানের ফলেই মূলত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এসেছে, যেখানে রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), মেশিন লার্নিং, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (ভিআর), ক্লাউড কম্পিউটিং, ডেটা এনালাইসিস এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ইত্যাদি নতুন নতুন চিন্তা, শিক্ষাদান পদ্ধতি রীতিমতো রূপান্তর করে চলেছে। ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশনের ফলে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকশিত হচ্ছে এবং তৈরি হচ্ছে চৌকস, প্রতিভাবান ও দক্ষ জনশক্তি। এভাবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিগুলো যখন কর্মক্ষেত্রে অভিযোজিত হয় তখন কাজ সম্পাদনের নতুন উপায় সক্রিয় করে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মূল্যবোধ তৈরির নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রযুক্তি আজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরিহার্য। প্রযুক্তি এবং শিক্ষার সংমিশ্রণ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অনেক ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯-এ ভাবনার জগতকে আরও প্রসারিত করেছে।

সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমগুলোতে অবিশ্বাস্য উদ্ভাবন, আইওটি, অটোমেশন, শৈল্পিক প্রচেষ্টাতে কম্পিউটারের ব্যবহার ইত্যাদি আমাদের মৌলিকভাবে শেখার, কাজ করার এবং জীবনযাত্রার মানে অনেক পরিবর্তন এনে চলেছে। আজকের স্টিম (STEAM) আগের স্টেমের (STEM) পরিবর্তিত সংস্করণ। স্টিম বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত- এ চারটি বিষয়ের সমন্বিত রূপ। এ তত্ত্বটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ২০০১ সালে। এখন ২০২১ সাল। আগামী প্রজন্মকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে আরেকটি শিল্প বা আর্ট যুক্ত হয়ে স্টেম (STEM) শিক্ষাটি স্টিম (STEAM) শিক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছে।

‘দ্য মিডিয়াম রিপোর্ট-২০২০’ এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত নোবেল বিজয়ী কোন না কোন শিল্পের অনুশীলন করে থাকেন। একজন সফল বিজ্ঞানীকে অন্য আরেকজন সফল বিজ্ঞানীর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, প্রত্যেকের গবেষণায় শিল্পচর্চা ভিন্ন ভিন্ন স্বকীয়তায় উন্নত ও ব্যতিক্রম। এটি বিজ্ঞানের সাফল্য এবং শিল্প সংযোগ যা স্টিম প্রবক্তাদের মাঝে এ বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে, প্রযুক্তির সঙ্গে আর্ট বা কলার সম্পর্ক সুনিবিড়। স্টিম শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা প্রায়োগিক শিক্ষায় নিযুক্ত হয়, পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট থাকে। কারণ তারা চিন্তা-ভাবনামূলক ঝুঁকি নেয় এবং সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় কাজ করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, অনেক নিয়োগকর্তা, শিক্ষাবিদ এবং অভিভাবকরা বিশ্বাস করেন যে, স্টিম শিক্ষা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও যোগ্যতার উন্নতি সাধনের জন্য স্টেমের যাবতীয় অপূর্ণতাকে পূরণ করতে সহায়তা করে।

স্টিম শিক্ষার প্রবক্তারা মনে করেন যে, চারুকলা বা আর্ট, স্টেম শিক্ষায় অনুপস্থিত একটি অংশের সংযোজন, যা শিক্ষার্থীদের কেবল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত বুঝতেই প্রস্তুত করে না, বরং কীভাবে তা শিখতে হয় এবং সৃজনশীল পদ্ধতিতে কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়, তা জানতে সাহায্য করে। একটি সফল স্টিম প্রোগ্রাম তৈরি করার জন্য, আর্টসকে একটি প্রামাণিক উপায়ে স্টেমের অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। এটি স্টেমে শুধু সৃজনশীলতা যুক্ত করার জন্য নয়, বরং বিশ্বের বাস্তব পরিস্থিতিতে শিল্পকে প্রয়োগ করার জন্য। উদাহরণস্বরূপ- যদি শিক্ষার্থীদের স্টেম প্রকল্পের আওতায় কোন অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়, তাহলে সেটিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে আর্ট বা শিল্পকলাকে সংযুক্ত করা হয়। আর এটিই হলো স্টিম শিক্ষা। সুতরাং স্টিম শিক্ষা মূলত শিক্ষার্থীদের ‘আউট সাইড দ্য বক্স’ চিন্তা করার দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (4IR) আমাদের সামগ্রিক জীবনযাপন প্রণালিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে চলেছে। আমরা কীভাবে সুন্দর জীবন পরিচালনা করতে পারি, নান্দনিকভাবে কাজ করতে পারি, শিক্ষার ধরন কেমন হবে, ভবিষ্যতে আমাদের করণীয় কী হতে পারে ইত্যাদির সবকিছুতেই ডিজিটাল বা শিল্প বিপ্লবের প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, প্রযুক্তি, কলা ও গণিতের (স্টিম) সমন্বিত শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনুশীলন চলছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশেষ করে করোনা প্যান্ডামিকের একালে স্টিম শিক্ষার আবশ্যকতা আমরা সবাই কমবেশি বুঝতে পেরেছি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করা যায়, আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী তা বুঝতে পেরেছে করোনার আবির্ভাবের কারণে। এটি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবেই সম্ভব হয়েছে।

সময় এখন স্টিম শিক্ষার। আগামী প্রজন্মকে একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি করতে স্টিম শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]