সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৬ বছর

জনবিদ্রোহ কি ‘বাসি’ হয়?

পাভেল পার্থ

তেভাগা আন্দোলনের পরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার চন্ডীপুর সাঁওতাল গ্রামটি নিদারুণভাবে সাঁওতালশূন্য হয়ে যায়। দেশভাগের পর ভারতের মালদহ জেলা ও নদীভাঙনে দিয়াড় অঞ্চলের মুসলিমদের দখলে চলে যায় ঐতিহাসিক নাচোল কৃষক বিদ্রোহের রক্তমাখা এই সাঁওতাল গ্রাম। চন্ডীপুরের কাছেই নিজামপুর ইউনিয়নের এক ছোট গ্রাম বরেন্দা। বরেন্দা গ্রামের হস্্রু ওঁরাও, মাখোয়া পাহান, সমরা পাহান, লুগু ওঁরাও, বাওলা ওঁরাও, সমারী পাহান, মালতী পাহান, নগেন পাহানের মতো ঝরু পাহানও তখন ছিলেন এক নির্ভীক কিশোর তেভাগা-সৈনিক। তেভাগা-বিপ্লবীদের অধিকাংশই আজ আর নেই। বরেন্দা গ্রামে তেভাগার উত্তপ্ত স্মৃতি নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন নিজ ভূমিতে ভূমিহীন ঝরু পাহান (৯০)। উৎপাদিত ফসলের তিনভাগ করে একভাগ মহাজন, দুইভাগ কৃষক পাবে এই ছিল তেভাগা আন্দোলনের মূল সুর। কিন্তু প্রশ্নহীনভাবে মালতী পাহানরা কিছুই পাননি। এত রক্তপ্রবাহের পরও রাষ্ট্র কৃষকদের এই ন্যায্য দাবি মেনে নেয়নি। এখনও বরেন্দ্র অঞ্চলে অন্যায় আধি প্রধা টিকে আছে। রক্তজল করা ফসলের অর্ধেকভাগ এখনও ভূমিহীন কৃষককে তুলে দিতে হয় মহাজন ও জমির মালিককে। কিন্তু ঝরু পাহান বিশ্বাস করেন হুল বা তেভাগার মতো জনবিদ্রোহ কখনোই ‘পান্তা’ বা ‘বাসী’ হয় না। গরম ভাতের মতো জনবিদ্রোহ কাল থেকে কালে টগবগ হয়ে থাকে নিপীড়িত মাানুষের শিরায় শিরায়। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন বরেন্দ্র ভূমির সাহসী মানুষেরা গরম ভাতের ন্যায্য স্বাদ পাবে।

উত্তরবঙ্গের রাজশাহী বিভাগের ১৬টি জেলায় সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, পাহান, ভূঁইয়া, রাজোয়ার, তুরি, কর্মকার, মালো, মাহাতো, মালপাহাড়িয়া, গন্ড, পাটনি, বাগদি, মাহালী, মুসহর, কোল, রাজবংশী, কামার, ভুঁইমালি, কোচ, তেলী, গোড়াত, চাঁই, বাইছনী, লহরা, হাড়ি, ঘাটোয়াল, দোষাদ, চাড়াল, ডহরা, ভূমিজ, আঙ্গুয়াররাজোয়াড, বেতিয়া, নুনিয়াহাড়ি, রাজবংশী, পাহাড়িয়া, ভূঁইয়া, রবিদাস, রাই, বেদিয়াসহ প্রায় ৩৮টি জাতিসত্তার প্রায় ১৫ লাখেরও বেশি আদিবাসী বসবাস করেন। নিজের ভূমিতেই উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের ঐতিহাসিকভাবেই ভূমিহীন হতে বাধ্য করেছে রাষ্ট্র। এ কাজে রাষ্ট্র কখনো ব্যবহার করেছে বহিরাগত বাঙালিদের, কখনো রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতি, করপোরেট খনন, সামাজিক বাগানায়ন, উন্নয়ন প্রকল্প, সামরিক স্থাপনা, চুক্তিবদ্ধ বাণিজ্যিক ফসলের চাষ কি গণ-আন্দোলনের ওপর প্রবল আঘাত। ভানুবিল থেকে টংক কি তেভাগা কোথাও তাই আদিবাসী জনগণ তার মৌলিক উৎপাদন ব্যবস্থার অধিকার লাভ করেনি। আদিবাসীদের কাছ থেকে কৃষিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। লিখিত ইতিহাস অনুযায়ী হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে এই উপনিবেশিক মারদাঙ্গা শুরু করেছে ‘আধুনিক রাষ্ট্র’।

১৮৫৫ সনের ৩০ জুন ভারতের বর্তমান ঝাড়খ- রাজ্যের সাঁওতাল পরগণার সদর শহর বারহাইত এর কাছাকাছি ভাগনাডিহি গ্রামের নিপীড়িত সাঁওতাল পরিবারের চার ভাই সিধু-কানু-চাদ-ভৈরব মুর্মু এবং তাদের বোন ফুলমনি মুর্মুদের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল জুলুমবাজ ব্রিটিশ শাসন আর অন্যায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ গণপদযাত্রার সূচনা করে। পরবর্র্তীতে মূলত: সাঁওতাল আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ এই শ্রেণী সংগ্রামে অংশ নেয় স্থানীয় আদিবাসী এবং নিপীড়িত প্রান্তিক বাঙালিরাও। ঐতিহাসিকভাবে শ্রেণী নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়ালেও ১৮৫৫ সনের বিদ্রোহকেই সাঁওতাল জনগণ ‘হুল’ হিসেবে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করেন।

হুল কেবলমাত্র নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা এবং বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহই ছিল না, এটি একই কায়দায় বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে ফানা ফানা করে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ও মনোজাগতিক মুক্তির আহ্বানও ছিল। ইতিহাস গ্রন্থনের বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো সাঁওতাল বিদ্রোহকে শুধু একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় অত্যাচারিত প্রজাদের সশস্ত্র লড়াই হিসেবেই পাঠ করে, যা হুলের বহুপাক্ষিক বিস্তার এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের বিরাজমানতার ঐতিহাসকিতাকে আড়াল করে ফেলে। বাংলাদেশে ‘আরণ্য জনপদে’ নামে আদিবাসীদের নিয়ে বেশ ‘নামকরা’ একটি বই আছে। গ্রন্থটির লেখক আবদুস সাত্তার ১৮৫৫ সনের সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘হাঙ্গামা’ বলে উল্লেখ করেছেন। কার্ল মার্কস তার Notes on Indian History তে সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘গেরিলা যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০০ বাংলায় তার ‘ইংরাজের আতঙ্ক’ প্রবন্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হুলকে ‘সাঁওতাল উপবিপ্ল­ব’ বলেছেন। ভারতীয় ইতিহাসকার দিগম্বর চক্রবর্ত্তীই সাঁওতাল সমাজের বাইরের কেউ যিনি ১৮৯৫-৯৬ সনে লিখিত তার History of the Santal Hul (1988) পুস্তকে হুলকে প্রথম ‘হুল’ হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিলেন।

সাঁওতাল বিদ্রোহেরই এক গর্বিত উত্তরাধিকার সিপাহি বিদ্রোহ , মুন্ডা-তেভাগা-নানকার আন্দোলনসহ আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামও এই ঐতিহাসিক হুলেরই স্পর্ধিত উচ্চারণ। নিপীড়নমূলক ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে যে উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিল মেহনতি প্রান্তিক শ্রেণী লড়াকুদের জীবন থেকে। আজো সেই লড়াই থামে নি। আজো সাঁওতালসহ এদেশের প্রান্তিক মেহনতি মানুষের চূড়ান্ত মুক্তি আসেনি। আজও এদেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং মাতৃভাষার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। নিশ্চিত হয়নি ভূমি-বন-পরিবেশ-প্রাণসম্পদের নিজস্ব প্রথাগত জীবনের সার্বভৌম অধিকার। আজো আদিবাসীসহ দেশের গরিব মানুষ একই শোষণ-নিপীড়ন আর তথাকথিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার শিকার। আজও আদিবাসীদের প্রশ্নহীন মৃত্যু আর উদ্বাস্তুকরণ প্রক্রিয়া থামেনি।

জমিদারি আমল এবং ব্রিটিশ উপনিবেশ চলে গেলেও এখনও পর্যন্ত ভূমির ওপর নিশ্চিত হয়নি জনগণের আপন মালিকানা। রাষ্ট্রের আইন ও অন্যায় প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এখন আমাদের ভূমি ও জমি দখল করে রাখে বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি, যারা জনগণের জমির বুকের কলিজা থ্যাৎলে দিয়ে রাসায়নিক সার-বিষ-হাইব্রিড ও জিন প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত বিকৃত বীজের ব্যবসা করে। ভূমির বুক ছিন্ন ভিন্ন করতে সমকালে আরও যুক্ত হয়েছে বনবিভাগ, নিরাপত্তার নামে অধিগ্রহণ ও বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ, বাঙালি অভিবাসন ও দখল এবং প্রভাবশালীর জোর জবরদস্তি।

সাঁওতাল বিদ্রোহের এই ১৬৬ বছর পরও হুলের গর্বিত উত্তরাধিকার তেভাগা-বিপ্লবী ঝরু পাহানের কথাকেই সত্য বলে প্রমাণ করছে সংগঠিত সব সাহসী মানুষ কাল থেকে কালে। হুল থেকে তেভাগা কী বাগদাফার্ম আন্দোলন প্রমাণ করে জনগণের ন্যায্য বিদ্রোহ বাসী বা পান্তা হয়ে যায়নি। তেভাগা আন্দোলনে শহীদ হন শিবরাম মাঝি, কম্পরাম সিং। টংক আন্দোলনে রাশিমনি হাজং, সুসং দূর্গাপুরে সত্যবান হাজং, জুড়িতে অবিনাশ মুড়া, মধুপুরে গীদিতা রেমা বা পীরেন স্নাল, নওগাঁয় আলফ্রেড সরেন কী সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মে শহীদ শ্যামল হেমব্রম-মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু। দুরন্ত টগবগ বিদ্রোহ নিয়ে এরা সবাই দাঁড়িয়েছেন অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে। ঝরু পাহানদের স্বপ্নকে সত্যি করে তুলতে আসুন সব নিপীড়িত টগবগ এক করি। আদিবাসী ভূমি জুলুমের বিরুদ্ধে বুক পেতে দাঁড়াই। আর কত বছর পেরুলে নিজ জমির হক ফিরে পাবেন ঝরু পাহান? গরম ভাতের টগবগ দেখার মতো সাহস কি রাষ্ট্রের কখনো হবে না?

[লেখক : গবেষক]

animistbangla@yahoo.com

বুধবার, ৩০ জুন ২০২১ , ১৬ আষাঢ় ১৪২৮ ১৮ জিলক্বদ ১৪৪২

সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৬ বছর

জনবিদ্রোহ কি ‘বাসি’ হয়?

পাভেল পার্থ

image

তেভাগা আন্দোলনের পরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার চন্ডীপুর সাঁওতাল গ্রামটি নিদারুণভাবে সাঁওতালশূন্য হয়ে যায়। দেশভাগের পর ভারতের মালদহ জেলা ও নদীভাঙনে দিয়াড় অঞ্চলের মুসলিমদের দখলে চলে যায় ঐতিহাসিক নাচোল কৃষক বিদ্রোহের রক্তমাখা এই সাঁওতাল গ্রাম। চন্ডীপুরের কাছেই নিজামপুর ইউনিয়নের এক ছোট গ্রাম বরেন্দা। বরেন্দা গ্রামের হস্্রু ওঁরাও, মাখোয়া পাহান, সমরা পাহান, লুগু ওঁরাও, বাওলা ওঁরাও, সমারী পাহান, মালতী পাহান, নগেন পাহানের মতো ঝরু পাহানও তখন ছিলেন এক নির্ভীক কিশোর তেভাগা-সৈনিক। তেভাগা-বিপ্লবীদের অধিকাংশই আজ আর নেই। বরেন্দা গ্রামে তেভাগার উত্তপ্ত স্মৃতি নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন নিজ ভূমিতে ভূমিহীন ঝরু পাহান (৯০)। উৎপাদিত ফসলের তিনভাগ করে একভাগ মহাজন, দুইভাগ কৃষক পাবে এই ছিল তেভাগা আন্দোলনের মূল সুর। কিন্তু প্রশ্নহীনভাবে মালতী পাহানরা কিছুই পাননি। এত রক্তপ্রবাহের পরও রাষ্ট্র কৃষকদের এই ন্যায্য দাবি মেনে নেয়নি। এখনও বরেন্দ্র অঞ্চলে অন্যায় আধি প্রধা টিকে আছে। রক্তজল করা ফসলের অর্ধেকভাগ এখনও ভূমিহীন কৃষককে তুলে দিতে হয় মহাজন ও জমির মালিককে। কিন্তু ঝরু পাহান বিশ্বাস করেন হুল বা তেভাগার মতো জনবিদ্রোহ কখনোই ‘পান্তা’ বা ‘বাসী’ হয় না। গরম ভাতের মতো জনবিদ্রোহ কাল থেকে কালে টগবগ হয়ে থাকে নিপীড়িত মাানুষের শিরায় শিরায়। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন বরেন্দ্র ভূমির সাহসী মানুষেরা গরম ভাতের ন্যায্য স্বাদ পাবে।

উত্তরবঙ্গের রাজশাহী বিভাগের ১৬টি জেলায় সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, পাহান, ভূঁইয়া, রাজোয়ার, তুরি, কর্মকার, মালো, মাহাতো, মালপাহাড়িয়া, গন্ড, পাটনি, বাগদি, মাহালী, মুসহর, কোল, রাজবংশী, কামার, ভুঁইমালি, কোচ, তেলী, গোড়াত, চাঁই, বাইছনী, লহরা, হাড়ি, ঘাটোয়াল, দোষাদ, চাড়াল, ডহরা, ভূমিজ, আঙ্গুয়াররাজোয়াড, বেতিয়া, নুনিয়াহাড়ি, রাজবংশী, পাহাড়িয়া, ভূঁইয়া, রবিদাস, রাই, বেদিয়াসহ প্রায় ৩৮টি জাতিসত্তার প্রায় ১৫ লাখেরও বেশি আদিবাসী বসবাস করেন। নিজের ভূমিতেই উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের ঐতিহাসিকভাবেই ভূমিহীন হতে বাধ্য করেছে রাষ্ট্র। এ কাজে রাষ্ট্র কখনো ব্যবহার করেছে বহিরাগত বাঙালিদের, কখনো রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতি, করপোরেট খনন, সামাজিক বাগানায়ন, উন্নয়ন প্রকল্প, সামরিক স্থাপনা, চুক্তিবদ্ধ বাণিজ্যিক ফসলের চাষ কি গণ-আন্দোলনের ওপর প্রবল আঘাত। ভানুবিল থেকে টংক কি তেভাগা কোথাও তাই আদিবাসী জনগণ তার মৌলিক উৎপাদন ব্যবস্থার অধিকার লাভ করেনি। আদিবাসীদের কাছ থেকে কৃষিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। লিখিত ইতিহাস অনুযায়ী হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে এই উপনিবেশিক মারদাঙ্গা শুরু করেছে ‘আধুনিক রাষ্ট্র’।

১৮৫৫ সনের ৩০ জুন ভারতের বর্তমান ঝাড়খ- রাজ্যের সাঁওতাল পরগণার সদর শহর বারহাইত এর কাছাকাছি ভাগনাডিহি গ্রামের নিপীড়িত সাঁওতাল পরিবারের চার ভাই সিধু-কানু-চাদ-ভৈরব মুর্মু এবং তাদের বোন ফুলমনি মুর্মুদের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল জুলুমবাজ ব্রিটিশ শাসন আর অন্যায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ গণপদযাত্রার সূচনা করে। পরবর্র্তীতে মূলত: সাঁওতাল আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ এই শ্রেণী সংগ্রামে অংশ নেয় স্থানীয় আদিবাসী এবং নিপীড়িত প্রান্তিক বাঙালিরাও। ঐতিহাসিকভাবে শ্রেণী নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়ালেও ১৮৫৫ সনের বিদ্রোহকেই সাঁওতাল জনগণ ‘হুল’ হিসেবে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করেন।

হুল কেবলমাত্র নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা এবং বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহই ছিল না, এটি একই কায়দায় বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে ফানা ফানা করে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ও মনোজাগতিক মুক্তির আহ্বানও ছিল। ইতিহাস গ্রন্থনের বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো সাঁওতাল বিদ্রোহকে শুধু একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থায় অত্যাচারিত প্রজাদের সশস্ত্র লড়াই হিসেবেই পাঠ করে, যা হুলের বহুপাক্ষিক বিস্তার এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের বিরাজমানতার ঐতিহাসকিতাকে আড়াল করে ফেলে। বাংলাদেশে ‘আরণ্য জনপদে’ নামে আদিবাসীদের নিয়ে বেশ ‘নামকরা’ একটি বই আছে। গ্রন্থটির লেখক আবদুস সাত্তার ১৮৫৫ সনের সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘হাঙ্গামা’ বলে উল্লেখ করেছেন। কার্ল মার্কস তার Notes on Indian History তে সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘গেরিলা যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০০ বাংলায় তার ‘ইংরাজের আতঙ্ক’ প্রবন্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হুলকে ‘সাঁওতাল উপবিপ্ল­ব’ বলেছেন। ভারতীয় ইতিহাসকার দিগম্বর চক্রবর্ত্তীই সাঁওতাল সমাজের বাইরের কেউ যিনি ১৮৯৫-৯৬ সনে লিখিত তার History of the Santal Hul (1988) পুস্তকে হুলকে প্রথম ‘হুল’ হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিলেন।

সাঁওতাল বিদ্রোহেরই এক গর্বিত উত্তরাধিকার সিপাহি বিদ্রোহ , মুন্ডা-তেভাগা-নানকার আন্দোলনসহ আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামও এই ঐতিহাসিক হুলেরই স্পর্ধিত উচ্চারণ। নিপীড়নমূলক ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে যে উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিল মেহনতি প্রান্তিক শ্রেণী লড়াকুদের জীবন থেকে। আজো সেই লড়াই থামে নি। আজো সাঁওতালসহ এদেশের প্রান্তিক মেহনতি মানুষের চূড়ান্ত মুক্তি আসেনি। আজও এদেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং মাতৃভাষার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। নিশ্চিত হয়নি ভূমি-বন-পরিবেশ-প্রাণসম্পদের নিজস্ব প্রথাগত জীবনের সার্বভৌম অধিকার। আজো আদিবাসীসহ দেশের গরিব মানুষ একই শোষণ-নিপীড়ন আর তথাকথিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার শিকার। আজও আদিবাসীদের প্রশ্নহীন মৃত্যু আর উদ্বাস্তুকরণ প্রক্রিয়া থামেনি।

জমিদারি আমল এবং ব্রিটিশ উপনিবেশ চলে গেলেও এখনও পর্যন্ত ভূমির ওপর নিশ্চিত হয়নি জনগণের আপন মালিকানা। রাষ্ট্রের আইন ও অন্যায় প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এখন আমাদের ভূমি ও জমি দখল করে রাখে বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি, যারা জনগণের জমির বুকের কলিজা থ্যাৎলে দিয়ে রাসায়নিক সার-বিষ-হাইব্রিড ও জিন প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত বিকৃত বীজের ব্যবসা করে। ভূমির বুক ছিন্ন ভিন্ন করতে সমকালে আরও যুক্ত হয়েছে বনবিভাগ, নিরাপত্তার নামে অধিগ্রহণ ও বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ, বাঙালি অভিবাসন ও দখল এবং প্রভাবশালীর জোর জবরদস্তি।

সাঁওতাল বিদ্রোহের এই ১৬৬ বছর পরও হুলের গর্বিত উত্তরাধিকার তেভাগা-বিপ্লবী ঝরু পাহানের কথাকেই সত্য বলে প্রমাণ করছে সংগঠিত সব সাহসী মানুষ কাল থেকে কালে। হুল থেকে তেভাগা কী বাগদাফার্ম আন্দোলন প্রমাণ করে জনগণের ন্যায্য বিদ্রোহ বাসী বা পান্তা হয়ে যায়নি। তেভাগা আন্দোলনে শহীদ হন শিবরাম মাঝি, কম্পরাম সিং। টংক আন্দোলনে রাশিমনি হাজং, সুসং দূর্গাপুরে সত্যবান হাজং, জুড়িতে অবিনাশ মুড়া, মধুপুরে গীদিতা রেমা বা পীরেন স্নাল, নওগাঁয় আলফ্রেড সরেন কী সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মে শহীদ শ্যামল হেমব্রম-মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু। দুরন্ত টগবগ বিদ্রোহ নিয়ে এরা সবাই দাঁড়িয়েছেন অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে। ঝরু পাহানদের স্বপ্নকে সত্যি করে তুলতে আসুন সব নিপীড়িত টগবগ এক করি। আদিবাসী ভূমি জুলুমের বিরুদ্ধে বুক পেতে দাঁড়াই। আর কত বছর পেরুলে নিজ জমির হক ফিরে পাবেন ঝরু পাহান? গরম ভাতের টগবগ দেখার মতো সাহস কি রাষ্ট্রের কখনো হবে না?

[লেখক : গবেষক]

animistbangla@yahoo.com