সহসাই সংকট কাটছে না তৈরি পোশাক শিল্পে

করোনা সংক্রমণের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ

মহামারী করোনার কারণে ২০২০ সাল থেকেই সংকটে পড়েছে দেশের রপ্তানিতে বড় অবদান রাখা তৈরি পোশাক খাত। যদিও করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় চারটি প্যাকেজের আওতায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার সহায়তা দেয়া হয়েছে রপ্তানিমুখী এই শিল্প খাতকে। তবুও এই খাতে স্থীতিশীলতা আসছে না। এর পরও বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে লকডাউন চলছে, সেই লকডাউনে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবে আশার কথা, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকা প্রয়োগের হার বাড়ছে। টিকা যত দ্রুত দেয়া হবে তত দ্রুত করোনার ধাক্কা কেটে যাবে।

এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান বলেন, ‘গার্মেন্ট মালিক ও কারখানার শ্রমিক এবং সরকারের প্রচেষ্টায় তৈরি পোশাক খাত এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তবে করোনার কারণে রপ্তানিমুখী এই খাত ঘুরে দাঁড়াতেই পাচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতি যতদ্রুত ভালো হবে, এই খাতও ততদ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে।’

এ পর্যন্ত করোনায় তিন হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি অর্ডার বাতিল হয়েছে বলে তিনি জানান।

জানা গেছে, করোনার প্রভাব মোকাবিলায় গত বছর আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য প্রথমে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এই তহবিল বেড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাত উদ্যোক্তাদের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকার মূলধনী ঋণ সুবিধা এবং রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড ১৭ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়। পাশাপাশি প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট ফাইন্যান্সিং প্রকল্পে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানি খাত উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের তহবিল গঠন ছাড়াও সরকার নানা ধরনের কৌশল নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, নতুন বাজার অনুসন্ধান, নতুন নতুন মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন ও রপ্তানি খাতের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, জ্বালানি, বন্দর ও যোগাযোগ অবকাঠামোসহ সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যা নিরসন অন্যতম।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আগাম পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, শুধু চলতি অর্থবছর নয়, আগামী ২০২৩-২৪ সাল পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি খুব বেশি বাড়বে না। বর্তমান অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের সংশোধিত প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সেটা ধরা হয়েছে ১২ শতাংশ। সেখানে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ শিল্পে পণ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কাটছাঁট করা হয়েছে।

বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেন, রপ্তানি অর্ডার বাতিল হওয়ার পরও ফ্যাক্টরি খোলা রেখে ব্রেক ইভেন্ট মূল্যে পণ্য বিক্রি করছি। তবে তিনি আশা করছেন, চলতি অর্থবছরে গার্সেন্টস শিল্পে তিন হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের আয় হবে।

তার মতে, করোনায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। তিনি করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি ধরে রাখতে প্রণোদনার হার ৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৫ শতাংশ করার দাবি জানান।

তৈরি পোশাক খাতকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বন্ডের কার্যক্রম সহজ করার দাবি জানিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। তারা করোনাজনিত কারণে ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বৃদ্ধি করারও দাবি জানান। উদ্যোক্তারা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পোশাক শিল্প সংক্রান্ত ইস্যুগুলো সহজীকরণের উদ্যোগ নেয়া হলে তা এই শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে। তারা তৈরি পোশাক শিল্প খাতে ১৩৩টি রুগ্ন শিল্পের পুনর্বাসনে নীতিগত সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুরোধ জানান।

জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল চার হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের আয় ছিল তিন হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। এই হিসাবে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে চলতি অর্থবছরে। কিন্তু এখন সেটি কমিয়ে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি’র তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের জুলাই (২০২০) থেকে মে (২০২১) পর্যন্ত, এই ১১ মাসে আয় হয়েছে তিন হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। বাকি এক মাসে অবশিষ্ট ৫৮২ কোটি ডলার অর্জন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

চলমান মহামারীর কারণে বিশ্ববাণিজ্য এবং পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার হিসাবে ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকের বাজার ছিল ৪৮ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানে ২০১৯ সালে কমে ৪১ হাজার ৯০০ ডলারে নেমেছে। ২০২০ সালে বাজার আরও কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এরই একটি ধাক্কা এসেছে দেশের রপ্তানি খাতের ওপরে। ইপিবি’র হিসাবে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে চামড়া খাতের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমছে ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

রবিবার, ০৪ জুলাই ২০২১ , ২০ আষাঢ় ১৪২৮ ২২ জিলক্বদ ১৪৪২

সহসাই সংকট কাটছে না তৈরি পোশাক শিল্পে

করোনা সংক্রমণের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

image

মহামারী করোনার কারণে ২০২০ সাল থেকেই সংকটে পড়েছে দেশের রপ্তানিতে বড় অবদান রাখা তৈরি পোশাক খাত। যদিও করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় চারটি প্যাকেজের আওতায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার সহায়তা দেয়া হয়েছে রপ্তানিমুখী এই শিল্প খাতকে। তবুও এই খাতে স্থীতিশীলতা আসছে না। এর পরও বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে লকডাউন চলছে, সেই লকডাউনে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবে আশার কথা, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকা প্রয়োগের হার বাড়ছে। টিকা যত দ্রুত দেয়া হবে তত দ্রুত করোনার ধাক্কা কেটে যাবে।

এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান বলেন, ‘গার্মেন্ট মালিক ও কারখানার শ্রমিক এবং সরকারের প্রচেষ্টায় তৈরি পোশাক খাত এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তবে করোনার কারণে রপ্তানিমুখী এই খাত ঘুরে দাঁড়াতেই পাচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতি যতদ্রুত ভালো হবে, এই খাতও ততদ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে।’

এ পর্যন্ত করোনায় তিন হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি অর্ডার বাতিল হয়েছে বলে তিনি জানান।

জানা গেছে, করোনার প্রভাব মোকাবিলায় গত বছর আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য প্রথমে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এই তহবিল বেড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাত উদ্যোক্তাদের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকার মূলধনী ঋণ সুবিধা এবং রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড ১৭ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়। পাশাপাশি প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট ফাইন্যান্সিং প্রকল্পে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানি খাত উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের তহবিল গঠন ছাড়াও সরকার নানা ধরনের কৌশল নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, নতুন বাজার অনুসন্ধান, নতুন নতুন মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন ও রপ্তানি খাতের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, জ্বালানি, বন্দর ও যোগাযোগ অবকাঠামোসহ সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যা নিরসন অন্যতম।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আগাম পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, শুধু চলতি অর্থবছর নয়, আগামী ২০২৩-২৪ সাল পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি খুব বেশি বাড়বে না। বর্তমান অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের সংশোধিত প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সেটা ধরা হয়েছে ১২ শতাংশ। সেখানে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ শিল্পে পণ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কাটছাঁট করা হয়েছে।

বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেন, রপ্তানি অর্ডার বাতিল হওয়ার পরও ফ্যাক্টরি খোলা রেখে ব্রেক ইভেন্ট মূল্যে পণ্য বিক্রি করছি। তবে তিনি আশা করছেন, চলতি অর্থবছরে গার্সেন্টস শিল্পে তিন হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের আয় হবে।

তার মতে, করোনায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। তিনি করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি ধরে রাখতে প্রণোদনার হার ৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৫ শতাংশ করার দাবি জানান।

তৈরি পোশাক খাতকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বন্ডের কার্যক্রম সহজ করার দাবি জানিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। তারা করোনাজনিত কারণে ঋণ শ্রেণীকরণের সময়সীমা বৃদ্ধি করারও দাবি জানান। উদ্যোক্তারা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পোশাক শিল্প সংক্রান্ত ইস্যুগুলো সহজীকরণের উদ্যোগ নেয়া হলে তা এই শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে। তারা তৈরি পোশাক শিল্প খাতে ১৩৩টি রুগ্ন শিল্পের পুনর্বাসনে নীতিগত সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুরোধ জানান।

জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল চার হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের আয় ছিল তিন হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। এই হিসাবে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে চলতি অর্থবছরে। কিন্তু এখন সেটি কমিয়ে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি’র তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের জুলাই (২০২০) থেকে মে (২০২১) পর্যন্ত, এই ১১ মাসে আয় হয়েছে তিন হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। বাকি এক মাসে অবশিষ্ট ৫৮২ কোটি ডলার অর্জন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

চলমান মহামারীর কারণে বিশ্ববাণিজ্য এবং পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার হিসাবে ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকের বাজার ছিল ৪৮ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানে ২০১৯ সালে কমে ৪১ হাজার ৯০০ ডলারে নেমেছে। ২০২০ সালে বাজার আরও কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এরই একটি ধাক্কা এসেছে দেশের রপ্তানি খাতের ওপরে। ইপিবি’র হিসাবে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে চামড়া খাতের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমছে ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ।