করোনায় মৃতদের সৎকারে নিরলস ‘ওরা ১৫ জন’

১ বছরে ৬০ দেহ সমাহিত

বৈশ্বিক করোনায় কুষ্টিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি খুবই নাজুক। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা ও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। হাসপাতালে করোনা রোগীদের বেড শেষ এখন হাসপাতালের করিডোরে নিচে রোগীদের রাখা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। যারা নিজেদের জীবনবাজি রেখে নিজেদের অর্থ ও সময় ব্যয় করে এ কাজটি করে যাচ্ছেন। তারা হচ্ছেন, কুষ্টিয়ার কয়েকজন আলেম।

করোনার এই মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন কাফনের কাজটি করছেন শহরের কয়েকজন আলেম। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আলেমদের এই দলটি প্রায় ৬০টি করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ দাফন করেছেন। করোনা ভয়ে মৃত ব্যক্তির নিকটজন ও স্বজনেরা কাছে ভিড়ছে না সেখানে এই আলেমদের দলটি নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাক পেলেই চলে যাচ্ছেন করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশের কাছে। লাশ ধোয়ানো, কাফনের কাপড় পড়ানো, জানাজা নামাজ আর দাফনের কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে ইতোমধ্যে জেলাব্যাপী সর্বস্তরের মানুষের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

২০২০ সালে মার্চ মাসে করোনার শুরু থেকেই করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে মানুষের মাঝে চরম ভীতি সঞ্চার হয়েছিল। জেলায় হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় গোসল করানো থেকে শুরু করে লাশ দাফনের ক্ষেত্রে মারাত্মক জীবনের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে সকলেই পিছপা হয়েছিল। তখনই কুষ্টিয়া শহরের কুঠিপাড়া মোমতাজুল উলুম মাদ্রাসার মোহতামিম মুফতি আরিফুজ্জামান কয়েকজন আলেমকে সঙ্গে নিয়ে একটি টিম গঠন করেন। যাদের কাজ হবে করোনায় মৃতদের বাড়ি বা হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে গোসল থেকে শুরু করে গোরস্তানে দাফনের মতো কাজগুলো করা। প্রথম দিকে নানান ঝুঁকি ও বাঁধার সম্মুখীন হলেও এখন স্বাচ্ছন্দ্যেই কাজ করতে পারছেন তারা। মুফতি আরিফুজ্জামান বলেন, জীবনের ঝুঁকি থাকলেও ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে আমাদের এই কাজটি করতে হবে এমন দৃঢ়তা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। শুরুটা এত সহজ ছিল না। শুরুতেই এলাকাবাসীর সহযোগিতা পায়নি। পিপি ছিল না। নিজেরা কিনে কাজ শুরু করি। তখন কোন গাড়ি ছিল না।

আমরা লাশ দাফন শেষে মাদ্রাসায় ফিরলে সেখানে এলাকাবাসীর বাঁধার সম্মুখীন হয়। পরবর্তীতে এলাকার কিছু মানুষের সহযোগিতায় আমরা এলাকায় প্রবেশের অনুমতি পায়। তবে এখন আর সেই বাঁধা নেই। তিনি জানান, আমরা এ পর্যন্ত ৫৮টি মুসলমান আর ২ জন হিন্দুর সৎকারের সুযোগ পেয়েছি। তিনি জানান-১৫ জনের একটি স্বেচ্ছসেবক দল নিয়েই আমাদের কার্যক্রম। ইতোমধ্যে আমাদের এই কার্যক্রমের জন্য যশোরের ‘খেদমতে খলক ফাউন্ডেশন’ একটি মিনি এ্যাম্বুলেন্স দিয়েছে যা দিয়ে আমরা বিনামূল্যে করোনায় আক্রান্ত রোগীসহ আরও ১০ প্রকারের মানুষের সহযোগিতা করে আসছি। গতমাসে ইবি থানার হরিনারায়নপুর এলাকার একজন হিন্দু ব্যবসায়ী করোনায় মারা গেলে আমরা কুষ্টিয়া হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে এলাকায় যাওয়ার পথে বাধাগ্রস্ত হয়। সেখানে একটি ব্রিজে বাঁশবেধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এলাকাবাসী। আমরা এ্যাম্বুলেন্স থেকে সেই লাশ কাঁধে করে কয়েক মাইল দূরে শ্মশানে নিয়ে দাহ করার যাবতীয় ব্যবস্থা করি। কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কুষ্টিয়ার কয়েকজন আলেমের করোনাকালীন এই কর্মকা- ইতিবাচক। তারা জীবনের ঝুকি নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ও হাসপাতালে যেয়ে লাশ এনে নিস্বার্থভাবে দাফনের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন যা প্রশংসনীয়। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সোনিয়া কাওকাবিন জানান-করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল কিন্তু আলেমদের দল নিজেদের দায়িত্বে এই কাজগুলো করে আমাদেরকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে রেখেছেন। আমরা তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি।

রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১ , ২৭ আষাঢ় ১৪২৮ ২৯ জিলক্বদ ১৪৪২

করোনায় মৃতদের সৎকারে নিরলস ‘ওরা ১৫ জন’

১ বছরে ৬০ দেহ সমাহিত

জেলা বার্তা পরিবেশক, কুষ্টিয়া

বৈশ্বিক করোনায় কুষ্টিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি খুবই নাজুক। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা ও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে। হাসপাতালে করোনা রোগীদের বেড শেষ এখন হাসপাতালের করিডোরে নিচে রোগীদের রাখা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। যারা নিজেদের জীবনবাজি রেখে নিজেদের অর্থ ও সময় ব্যয় করে এ কাজটি করে যাচ্ছেন। তারা হচ্ছেন, কুষ্টিয়ার কয়েকজন আলেম।

করোনার এই মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন কাফনের কাজটি করছেন শহরের কয়েকজন আলেম। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আলেমদের এই দলটি প্রায় ৬০টি করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ দাফন করেছেন। করোনা ভয়ে মৃত ব্যক্তির নিকটজন ও স্বজনেরা কাছে ভিড়ছে না সেখানে এই আলেমদের দলটি নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাক পেলেই চলে যাচ্ছেন করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশের কাছে। লাশ ধোয়ানো, কাফনের কাপড় পড়ানো, জানাজা নামাজ আর দাফনের কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে ইতোমধ্যে জেলাব্যাপী সর্বস্তরের মানুষের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

২০২০ সালে মার্চ মাসে করোনার শুরু থেকেই করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে মানুষের মাঝে চরম ভীতি সঞ্চার হয়েছিল। জেলায় হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় গোসল করানো থেকে শুরু করে লাশ দাফনের ক্ষেত্রে মারাত্মক জীবনের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে সকলেই পিছপা হয়েছিল। তখনই কুষ্টিয়া শহরের কুঠিপাড়া মোমতাজুল উলুম মাদ্রাসার মোহতামিম মুফতি আরিফুজ্জামান কয়েকজন আলেমকে সঙ্গে নিয়ে একটি টিম গঠন করেন। যাদের কাজ হবে করোনায় মৃতদের বাড়ি বা হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে গোসল থেকে শুরু করে গোরস্তানে দাফনের মতো কাজগুলো করা। প্রথম দিকে নানান ঝুঁকি ও বাঁধার সম্মুখীন হলেও এখন স্বাচ্ছন্দ্যেই কাজ করতে পারছেন তারা। মুফতি আরিফুজ্জামান বলেন, জীবনের ঝুঁকি থাকলেও ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে আমাদের এই কাজটি করতে হবে এমন দৃঢ়তা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। শুরুটা এত সহজ ছিল না। শুরুতেই এলাকাবাসীর সহযোগিতা পায়নি। পিপি ছিল না। নিজেরা কিনে কাজ শুরু করি। তখন কোন গাড়ি ছিল না।

আমরা লাশ দাফন শেষে মাদ্রাসায় ফিরলে সেখানে এলাকাবাসীর বাঁধার সম্মুখীন হয়। পরবর্তীতে এলাকার কিছু মানুষের সহযোগিতায় আমরা এলাকায় প্রবেশের অনুমতি পায়। তবে এখন আর সেই বাঁধা নেই। তিনি জানান, আমরা এ পর্যন্ত ৫৮টি মুসলমান আর ২ জন হিন্দুর সৎকারের সুযোগ পেয়েছি। তিনি জানান-১৫ জনের একটি স্বেচ্ছসেবক দল নিয়েই আমাদের কার্যক্রম। ইতোমধ্যে আমাদের এই কার্যক্রমের জন্য যশোরের ‘খেদমতে খলক ফাউন্ডেশন’ একটি মিনি এ্যাম্বুলেন্স দিয়েছে যা দিয়ে আমরা বিনামূল্যে করোনায় আক্রান্ত রোগীসহ আরও ১০ প্রকারের মানুষের সহযোগিতা করে আসছি। গতমাসে ইবি থানার হরিনারায়নপুর এলাকার একজন হিন্দু ব্যবসায়ী করোনায় মারা গেলে আমরা কুষ্টিয়া হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে এলাকায় যাওয়ার পথে বাধাগ্রস্ত হয়। সেখানে একটি ব্রিজে বাঁশবেধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এলাকাবাসী। আমরা এ্যাম্বুলেন্স থেকে সেই লাশ কাঁধে করে কয়েক মাইল দূরে শ্মশানে নিয়ে দাহ করার যাবতীয় ব্যবস্থা করি। কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কুষ্টিয়ার কয়েকজন আলেমের করোনাকালীন এই কর্মকা- ইতিবাচক। তারা জীবনের ঝুকি নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ও হাসপাতালে যেয়ে লাশ এনে নিস্বার্থভাবে দাফনের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন যা প্রশংসনীয়। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সোনিয়া কাওকাবিন জানান-করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল কিন্তু আলেমদের দল নিজেদের দায়িত্বে এই কাজগুলো করে আমাদেরকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে রেখেছেন। আমরা তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি।