ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা

বরাদ্দকৃত প্রকল্পগুলোতে অনিয়মের অভিযোগ সড়ক নির্মাণের এক মাসের মধ্যেই বিলীন

ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনজুর হোসেন বুলবুল কর্তৃক বরাদ্দকৃত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে একটি সড়ক নির্মাণের এক মাসের মধ্যেই একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া ইটের রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের রাস্তা নির্মাণের ১০ দিনের মধ্যেই রাস্তাটির বিভিন্ন অংশ ধসে গিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে আরেকটি রাস্তা নির্মাণের সময় কৃষকদের ভর্তুকি দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। বিভিন্ন প্রকল্পের পিআইসি করা হয়েছে সংসদ সদস্যর কাছের লোকজনদের। এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম হলেও ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায় ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মনজুর হোসেন বুলবুল বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ প্রদান করেন। অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা/কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নিচুপাড়া ইমরুলের বাড়ি থেকে কাশেমের বাড়ির অভিমুখে মাটির রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের ৩য় কিস্তির বরাদ্দের পরিমাণ দশ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) ইফতেখার আলম। আরেকটি প্রকল্প চরবাকাইল খাঁন জাহান মুন্সীর বাড়ি থেকে মাহামুদ খানের বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তায় মাটির কাজ ও ইটের সলিং নির্মাণ কাজের বরাদ্দ দেয়া হয় দশ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল। টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নজির আহম্মেদের বাড়ি থেকে চরডাঙ্গা আলমগীর হোসেনের বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দশ লাখ টাকা।

এছাড়া পানাইল ছরোয়ার জুমাদ্দারের বাড়ি থেকে সোনাউল্লাহর বাড়ির পাশে পাকা রাস্তা পর্যন্ত ইটের সলিংকরণ ও প্যালাসাইডিং নির্মাণ কাজে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। পানাইল কবরস্থানে মাটি ভরাটের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) সুলতান মাহামুদ। এছাড়া চরকাতলাসুর ৭ নং ওয়ার্ড কালভার্ট হয়ে শাহাদত খান এর বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয় দুই লাখ টাকা। এছাড়া পানাইল পশ্চিম পাড়ার আলী মোল্যার বাড়ি থেকে মুরাদ জমাদ্দারের বাড়ি পর্যন্ত ইটের রাস্তা নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ ছাড়াও চরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ ভরাট প্রকল্পে ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয়।

সরেজমিনে টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নিচুপাড়া ইমরুলের বাড়ি থেকে কাশেমের বাড়ির অভিমুখে মাটির রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছে বিলের মধ্যে নিচু জায়গায়। ইতোমধ্যেই পানি বাড়ায় একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া রাস্তাটিতে কোনরকমে মাটি ফেলা হয়েছে। সমানও করা হয়নি রাস্তাটি।

স্থানীয় বাসিন্দা ওবায়দুর রহমান বলেন, বিলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তাটি নিচু হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে। পানি বাড়ায় ইতোমধ্যেই রাস্তাটির মাঝের একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে। জনসাধারণের যাতায়াতের সুবিধার জন্য রাস্তাটি নির্মাণ করা হলেও এখন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রাস্তা পারাপার হতে পানির মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে হয়। রাস্তাটি নির্মাণে অনিয়ম হয়েছে। এ বিষয়ে এমপি মহোদয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) ইফতেখার আলম। তার সঙ্গে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে ফোন রিসিভ করেন তার মেয়ে। তিনি বলেন, আব্বু বাসায় নেই। কখন আসবেন তিনি জানেন না বলে ফোনটির লাইন কেটে দেন।

সরেজমিনে টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নজির আহম্মেদের বাড়ি থেকে চরডাঙ্গা আলমগীর হোসেনের বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তাটির মাঝখানে একটি অংশ কেটে রাখা হয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, ওই খানে একটি কালভার্ট বসানো হবে এজন্য কেটে রাখা হয়েছে। ওই সড়ক দিয়েও চলাচল করতে মাজা সমান পানি পার হয়ে পারাপার হতে হয় জনসাধারণকে। এদিকে এই রাস্তাটি নির্মাণের সময় যে মাটি লেগেছিল, মাটি নেয়া হয়েছিল রাস্তার পাশের জমি থেকে। ওই সময় জমির মালিকদের বলা হয়েছিল ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে, কিন্তু নামমাত্র ক্ষতিপূরণ তাদের দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী।

স্থানীয় বাসিন্দা রমজান শেখ বলেন, রাস্তা নির্মাণের সময় আমাদের বলা হয়েছিল তোমাদের জমি থেকে মাটি দেও, তোমাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। কিন্তু রাস্তা নির্মাণের পর নামমাত্র ১ হাজার, ২ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যাদের জমি থেকে মাটি নেয়া হয়েছে সেই জায়গায় এখন হাঁটুপানি হয়ে গেছে। কোন ফসল উৎপাদন করতে পারব না আমরা। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরা। তিনি আরও বলেন, এই রাস্তাটি নির্মাণের সময় সংসদ সদস্যর চাচাতো ভাই দেখাশোনা করেছেন। এ কারণে ভয়ে কেউ কিছু বলেনি।

এছাড়া পানাইল পশ্চিম পাড়ার আলী মোল্যার বাড়ি থেকে মুরাদ জমাদ্দারের বাড়ি পর্যন্ত ইটের রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তাটির বিভিন্ন অংশ ধসে গেছে। রাস্তা নির্মাণের মাত্র দশ দিনের মধ্যেই ধসে গেছে একাধিক জায়গা। ওই রাস্তা দিয়ে স্থানীয়দের এখন হেঁটে চলাচল করতেও সমস্যা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা লিমন শেখ বলেন, রাস্তাটি নির্মাণের দশ দিনের মধ্যেই বিভিন্ন অংশ ধসে গেছে। চলাচলে খুব কষ্ট হচ্ছে। ভ্যানে কোন মালামাল বাড়িতে আনতে পারছি না। এর চেয়ে মাটির রাস্তাই আমাদের ভালো ছিল। তিনি বলেন, প্রকল্পটির পিআইসি ছিলেন খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল। রাস্তা ধসে যাওয়ার পর পরই তাকে আমরা বলেছি, কিন্তু এখনও রাস্তা সংস্কারের কাজ করেনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মনজুর হোসেন বুলবুল কর্তৃক বরাদ্দকৃত প্রকল্পগুলোর বেশিভাগ প্রকল্পের পিআইসি রয়েছেন খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল। স্থানীয়দের অভিযোগ সংসদ সদস্যর আস্থাভাজন হওয়ায় বেশিরভাগ নির্মাণ কাজই করে থাকেন খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল। আর বেশিরভাগ কাজেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চায় না। বিভিন্ন প্রকল্পের পিআইসি খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল বলেন, পানাইল এলাকায় যে ইটের সলিং এর রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে ওই এলাকা নিচু হওয়ায় আশপাশের বাড়ি থেকে বৃষ্টির ঢলের পানি এসে রাস্তার ওপরে বেকু মেশিন দিয়ে কেটে ফেলানো নতুন বালি ধসে যায়। তবে ওই ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু মেরামত করা হচ্ছে। অন্যান্য প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ম মেনেই প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে, তবে কিছু প্রকল্প নিচু এলাকায় হওয়ায় সমস্যা হয়েছে, সেগুলো সমাধান করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজে কোন অনিয়ম করা হয়নি।

পানাইল কবরস্থানে মাটি ভরাটের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটিতেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) সুলতান মাহামুদ। তিনি বলেন, এখনও প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। বৃষ্টির কারণে মাটি ভরাটের কাজ সাময়িক বন্ধ রয়েছে। অনিয়মের প্রশ্নই আসে না। সঠিকভাবেই কাজ সম্পন্ন করা হবে।

টগরবন্দ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিক ফকির বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সংসদ সদস্যর কোন যোগাযোগ নেই। সংসদ সদস্য তার নিজস্ব কিছু লোকজন দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজগুলো করিয়ে থাকেন। তিনি আরও বলেন, এ কারণে উন্নয়নমূলক কোন কাজের ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর রাখি না। অনিয়ম হলেও আমরা দেখতে যাই না। প্রতিবাদ করেও কোন লাভ নেই।

আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম আকরাম হোসেন বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এমপি মহোদয়ের কোন যোগাযোগ নেই। তিনি স্থানীয় বিএনপি, জামায়াতের লোকজনদের নিয়ে চলাফেরা করে থাকেন। আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মীর সঙ্গে তার কোন কথাবার্তাও হয় না। তিনি বলেন, এলাকায় তার কিছু নিজস্ব লোকজন রয়েছে তাদের নামেই প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ দেয়া হয়। এমনকি একেকজনের নামের একাধিক প্রকল্পও দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে লোকমুখে শুনেছি। যেহেতু তিনি আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না, সে কারণে ওই কাজগুলোর ব্যাপারে আমরা কোন খোঁজখবর রাখি না।

প্রকল্পের নির্মাণকাজের বিষয়ে আলফাডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহিদুল হাসান বলেন, এমপি মহোদয় একজন সজ্জন ব্যক্তি। এলাকায় অনেক উন্নয়ন কাজ করছেন তিনি। বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়মের ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছে। আমি বর্তমানে ঢাকায় আছি, এলাকায় গিয়ে সব প্রকল্প পরিদর্শন করব। যারা এই প্রকল্পগুলোর কাজ করছেন তারা যদি অনিয়ম করে থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অঃ দাঃ) প্রনব পান্ডে বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ লোকমুখে শুনেছি। প্রকল্পগুলোর বিল এখনও দেয়া হয়নি। সরেজমিনে গিয়ে কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করে বিল প্রদান করা হবে। আলফাডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদ এলাহী বলেন, এই প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ একটু দেরিতে আসায় বর্ষা মৌসুমেই কাজ করতে হচ্ছে। এ কারণে কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা হয়েছে বলে শুনেছি। কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি, চলমান রয়েছে। কাজ শেষ হলে সরেজমিনে পরিদর্শন শেষেই বিল প্রদান করা হবে। অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। নিয়ম অনুযায়ী যেভাবে প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করার কথা সেভাবেই পিআইসিদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেয়া হবে। তারপরই বিল প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে কথা বলতে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মনজুর হোসেন বুলবুলের মোবাইলে (০১৭৬৬-৬৯৬০৯৯, ০১৭১৫-২৪০০৭৭) একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

তবে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মনজুর হোসেন বুলবুলের এপিএস মমিন ইমনের সঙ্গে মোবাইলে কথা হলে তিনি জানান, কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কিছু প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান রয়েছে। কিছু জায়গায় বর্ষার পানির কারণে সমস্যা হয়েছে, সেগুলো দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

রবিবার, ১৮ জুলাই ২০২১ , ৩ শ্রাবন ১৪২৮ ৭ জিলহজ ১৪৪২

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা

বরাদ্দকৃত প্রকল্পগুলোতে অনিয়মের অভিযোগ সড়ক নির্মাণের এক মাসের মধ্যেই বিলীন

কে এম রুবেল, ফরিদপুর

image

ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনজুর হোসেন বুলবুল কর্তৃক বরাদ্দকৃত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে একটি সড়ক নির্মাণের এক মাসের মধ্যেই একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া ইটের রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের রাস্তা নির্মাণের ১০ দিনের মধ্যেই রাস্তাটির বিভিন্ন অংশ ধসে গিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে আরেকটি রাস্তা নির্মাণের সময় কৃষকদের ভর্তুকি দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। বিভিন্ন প্রকল্পের পিআইসি করা হয়েছে সংসদ সদস্যর কাছের লোকজনদের। এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম হলেও ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায় ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মনজুর হোসেন বুলবুল বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ প্রদান করেন। অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা/কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নিচুপাড়া ইমরুলের বাড়ি থেকে কাশেমের বাড়ির অভিমুখে মাটির রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের ৩য় কিস্তির বরাদ্দের পরিমাণ দশ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) ইফতেখার আলম। আরেকটি প্রকল্প চরবাকাইল খাঁন জাহান মুন্সীর বাড়ি থেকে মাহামুদ খানের বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তায় মাটির কাজ ও ইটের সলিং নির্মাণ কাজের বরাদ্দ দেয়া হয় দশ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল। টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নজির আহম্মেদের বাড়ি থেকে চরডাঙ্গা আলমগীর হোসেনের বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দশ লাখ টাকা।

এছাড়া পানাইল ছরোয়ার জুমাদ্দারের বাড়ি থেকে সোনাউল্লাহর বাড়ির পাশে পাকা রাস্তা পর্যন্ত ইটের সলিংকরণ ও প্যালাসাইডিং নির্মাণ কাজে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। পানাইল কবরস্থানে মাটি ভরাটের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) সুলতান মাহামুদ। এছাড়া চরকাতলাসুর ৭ নং ওয়ার্ড কালভার্ট হয়ে শাহাদত খান এর বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয় দুই লাখ টাকা। এছাড়া পানাইল পশ্চিম পাড়ার আলী মোল্যার বাড়ি থেকে মুরাদ জমাদ্দারের বাড়ি পর্যন্ত ইটের রাস্তা নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ ছাড়াও চরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ ভরাট প্রকল্পে ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয়।

সরেজমিনে টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নিচুপাড়া ইমরুলের বাড়ি থেকে কাশেমের বাড়ির অভিমুখে মাটির রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছে বিলের মধ্যে নিচু জায়গায়। ইতোমধ্যেই পানি বাড়ায় একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া রাস্তাটিতে কোনরকমে মাটি ফেলা হয়েছে। সমানও করা হয়নি রাস্তাটি।

স্থানীয় বাসিন্দা ওবায়দুর রহমান বলেন, বিলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। রাস্তাটি নিচু হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে। পানি বাড়ায় ইতোমধ্যেই রাস্তাটির মাঝের একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে। জনসাধারণের যাতায়াতের সুবিধার জন্য রাস্তাটি নির্মাণ করা হলেও এখন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রাস্তা পারাপার হতে পানির মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে হয়। রাস্তাটি নির্মাণে অনিয়ম হয়েছে। এ বিষয়ে এমপি মহোদয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

ওই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) ইফতেখার আলম। তার সঙ্গে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে ফোন রিসিভ করেন তার মেয়ে। তিনি বলেন, আব্বু বাসায় নেই। কখন আসবেন তিনি জানেন না বলে ফোনটির লাইন কেটে দেন।

সরেজমিনে টগরবন্দ ইউনিয়নের পানাইল নজির আহম্মেদের বাড়ি থেকে চরডাঙ্গা আলমগীর হোসেনের বাড়ি পর্যন্ত মাটির রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তাটির মাঝখানে একটি অংশ কেটে রাখা হয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, ওই খানে একটি কালভার্ট বসানো হবে এজন্য কেটে রাখা হয়েছে। ওই সড়ক দিয়েও চলাচল করতে মাজা সমান পানি পার হয়ে পারাপার হতে হয় জনসাধারণকে। এদিকে এই রাস্তাটি নির্মাণের সময় যে মাটি লেগেছিল, মাটি নেয়া হয়েছিল রাস্তার পাশের জমি থেকে। ওই সময় জমির মালিকদের বলা হয়েছিল ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে, কিন্তু নামমাত্র ক্ষতিপূরণ তাদের দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী।

স্থানীয় বাসিন্দা রমজান শেখ বলেন, রাস্তা নির্মাণের সময় আমাদের বলা হয়েছিল তোমাদের জমি থেকে মাটি দেও, তোমাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। কিন্তু রাস্তা নির্মাণের পর নামমাত্র ১ হাজার, ২ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যাদের জমি থেকে মাটি নেয়া হয়েছে সেই জায়গায় এখন হাঁটুপানি হয়ে গেছে। কোন ফসল উৎপাদন করতে পারব না আমরা। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরা। তিনি আরও বলেন, এই রাস্তাটি নির্মাণের সময় সংসদ সদস্যর চাচাতো ভাই দেখাশোনা করেছেন। এ কারণে ভয়ে কেউ কিছু বলেনি।

এছাড়া পানাইল পশ্চিম পাড়ার আলী মোল্যার বাড়ি থেকে মুরাদ জমাদ্দারের বাড়ি পর্যন্ত ইটের রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তাটির বিভিন্ন অংশ ধসে গেছে। রাস্তা নির্মাণের মাত্র দশ দিনের মধ্যেই ধসে গেছে একাধিক জায়গা। ওই রাস্তা দিয়ে স্থানীয়দের এখন হেঁটে চলাচল করতেও সমস্যা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা লিমন শেখ বলেন, রাস্তাটি নির্মাণের দশ দিনের মধ্যেই বিভিন্ন অংশ ধসে গেছে। চলাচলে খুব কষ্ট হচ্ছে। ভ্যানে কোন মালামাল বাড়িতে আনতে পারছি না। এর চেয়ে মাটির রাস্তাই আমাদের ভালো ছিল। তিনি বলেন, প্রকল্পটির পিআইসি ছিলেন খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল। রাস্তা ধসে যাওয়ার পর পরই তাকে আমরা বলেছি, কিন্তু এখনও রাস্তা সংস্কারের কাজ করেনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মনজুর হোসেন বুলবুল কর্তৃক বরাদ্দকৃত প্রকল্পগুলোর বেশিভাগ প্রকল্পের পিআইসি রয়েছেন খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল। স্থানীয়দের অভিযোগ সংসদ সদস্যর আস্থাভাজন হওয়ায় বেশিরভাগ নির্মাণ কাজই করে থাকেন খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল। আর বেশিরভাগ কাজেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চায় না। বিভিন্ন প্রকল্পের পিআইসি খন্দকার জাহিদুল ইসলাম ওরফে জয় বকুল বলেন, পানাইল এলাকায় যে ইটের সলিং এর রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে ওই এলাকা নিচু হওয়ায় আশপাশের বাড়ি থেকে বৃষ্টির ঢলের পানি এসে রাস্তার ওপরে বেকু মেশিন দিয়ে কেটে ফেলানো নতুন বালি ধসে যায়। তবে ওই ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু মেরামত করা হচ্ছে। অন্যান্য প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ম মেনেই প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে, তবে কিছু প্রকল্প নিচু এলাকায় হওয়ায় সমস্যা হয়েছে, সেগুলো সমাধান করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজে কোন অনিয়ম করা হয়নি।

পানাইল কবরস্থানে মাটি ভরাটের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় পাঁচ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটিতেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি (পিআইসি) সুলতান মাহামুদ। তিনি বলেন, এখনও প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। বৃষ্টির কারণে মাটি ভরাটের কাজ সাময়িক বন্ধ রয়েছে। অনিয়মের প্রশ্নই আসে না। সঠিকভাবেই কাজ সম্পন্ন করা হবে।

টগরবন্দ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিক ফকির বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সংসদ সদস্যর কোন যোগাযোগ নেই। সংসদ সদস্য তার নিজস্ব কিছু লোকজন দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজগুলো করিয়ে থাকেন। তিনি আরও বলেন, এ কারণে উন্নয়নমূলক কোন কাজের ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর রাখি না। অনিয়ম হলেও আমরা দেখতে যাই না। প্রতিবাদ করেও কোন লাভ নেই।

আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম আকরাম হোসেন বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এমপি মহোদয়ের কোন যোগাযোগ নেই। তিনি স্থানীয় বিএনপি, জামায়াতের লোকজনদের নিয়ে চলাফেরা করে থাকেন। আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মীর সঙ্গে তার কোন কথাবার্তাও হয় না। তিনি বলেন, এলাকায় তার কিছু নিজস্ব লোকজন রয়েছে তাদের নামেই প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ দেয়া হয়। এমনকি একেকজনের নামের একাধিক প্রকল্পও দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে লোকমুখে শুনেছি। যেহেতু তিনি আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না, সে কারণে ওই কাজগুলোর ব্যাপারে আমরা কোন খোঁজখবর রাখি না।

প্রকল্পের নির্মাণকাজের বিষয়ে আলফাডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহিদুল হাসান বলেন, এমপি মহোদয় একজন সজ্জন ব্যক্তি। এলাকায় অনেক উন্নয়ন কাজ করছেন তিনি। বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়মের ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছে। আমি বর্তমানে ঢাকায় আছি, এলাকায় গিয়ে সব প্রকল্প পরিদর্শন করব। যারা এই প্রকল্পগুলোর কাজ করছেন তারা যদি অনিয়ম করে থাকে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অঃ দাঃ) প্রনব পান্ডে বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ লোকমুখে শুনেছি। প্রকল্পগুলোর বিল এখনও দেয়া হয়নি। সরেজমিনে গিয়ে কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করে বিল প্রদান করা হবে। আলফাডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদ এলাহী বলেন, এই প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ একটু দেরিতে আসায় বর্ষা মৌসুমেই কাজ করতে হচ্ছে। এ কারণে কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা হয়েছে বলে শুনেছি। কাজ এখনও সম্পন্ন হয়নি, চলমান রয়েছে। কাজ শেষ হলে সরেজমিনে পরিদর্শন শেষেই বিল প্রদান করা হবে। অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। নিয়ম অনুযায়ী যেভাবে প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করার কথা সেভাবেই পিআইসিদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেয়া হবে। তারপরই বিল প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে কথা বলতে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মনজুর হোসেন বুলবুলের মোবাইলে (০১৭৬৬-৬৯৬০৯৯, ০১৭১৫-২৪০০৭৭) একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

তবে ফরিদপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. মনজুর হোসেন বুলবুলের এপিএস মমিন ইমনের সঙ্গে মোবাইলে কথা হলে তিনি জানান, কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে, কিছু প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান রয়েছে। কিছু জায়গায় বর্ষার পানির কারণে সমস্যা হয়েছে, সেগুলো দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।