সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক বছরে ব্যাংকে রাখা আমানতের হিসাবে কোটিপতি বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭টি। করোনার মধ্যেও এতোজন কোটিপতি হিসাব বৃদ্ধিকে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ধনীদের আয় বৈষম্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশের প্রবৃদ্ধি গুটিকয়েক মানুষ ভোগ করছেন। তাই কোটিপতি হিসাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ২৭২টি। করোনা সংক্রমণের আগে কোটি টাকার আমানতের হিসাব ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। অর্থাৎ এক বছরের কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭টি।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারছেন না। গুটিকয়েক ধনীর আয় বাড়ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয় তুলনামূলক বাড়ছে না। এতে চরম আয়বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।’
বিষয়টিকে দুইভাবে দেখছেন গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বিষয়টিকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, দেশে কোটিপতি বৃদ্ধি হওয়ায় মনে হতে পারে দেশে ধনী বাড়ছে অর্থাৎ দেশ উন্নত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কোটিপতি বাড়ছে মানে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিছু মানুষ গরিব হচ্ছে। আর আরও গভীরে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যারা কোটিপতি হচ্ছে তারা কিভাবে কোটিপতি হচ্ছে। তারা সৎপথে কোটিপতি হচ্ছে? অবশ্যই না। অনেকে অসৎ পথে ইনকাম করে ব্যাংকে রাখছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই রয়েছেন সরকারি আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তি। তাদের বেশিরভাগের আয়ই অবৈধ।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে আমানতকারীদের হিসাবে জমা ছিল ১৩ লাখ ৮৪ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের মার্চে এই ব্যাংকগুলোতে আমানত ছিল ১২ লাখ ১০ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। সেই হিসেবে গত বছরে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। আমানতকারীদের জমানো অর্থের প্রায় ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশই কোটিপতিদের দখলে। চলতি বছরের মার্চে তাদের হিসাবে জমা ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৫ লাখ ১৫ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। সেই হিসেবে এক বছরে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবগুলোর জমানো টাকা বেড়েছে ৮০ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা।
দেশের নীতিনির্ধারকরাদের এই আয়বৈষম্যের সৃষ্টির জন্য দায়ী করে মইনুল ইসলাম বলেন, ‘আয়বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকরাই দায়ী। বর্তমান সরকারের মন্ত্রিপরিষদে অধিকাংশই ব্যবসায়ীরা বসে আছেন। তাই তারা সাধারণ মানুষের বিষয়টি চিন্তা করেন না। তারা সাধারণ মানুষকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গল্প শুনিয়ে নিজেরা আখের গুছিয়ে নিচ্ছে।’
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। অনেকে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতেও আমানতকারীর সঙ্গে কোটি টাকা জমার হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২১ সালের মার্চ মাস শেষে ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৪ হাজার ২২৯টি। ৫ কোটি ১ টাকা থেকে ১০ কোটি পর্যন্ত জমা হিসাবের সংখ্যা ১০ হাজার ৪৯৯টি, ১০ কোটি ১ টাকা থেকে ১৫ কোটির টাকার হিসাব রয়েছে ৩ হাজার ৪৪৬টি, ১৫ কোটি ১ টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৬৯৩টি, ২০ কোটি ১ টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ৮১ জন, ২৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৭৬৬ জনের, ৩০ কোটি ১ টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩৮৮ জন এবং ৩৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে ২৯৬ জন আমানতকারী হিসাব রয়েছে। গত এক বছরে ৪০ কোটি এক টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০৪টি। আলোচিত সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে এক হাজার ৩৭০টিতে দাঁড়িয়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে।
সোমবার, ২৬ জুলাই ২০২১ , ১০ শ্রাবন ১৪২৮ ১৪ জিলহজ ১৪৪২
রেজাউল করিম
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক বছরে ব্যাংকে রাখা আমানতের হিসাবে কোটিপতি বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭টি। করোনার মধ্যেও এতোজন কোটিপতি হিসাব বৃদ্ধিকে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ধনীদের আয় বৈষম্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশের প্রবৃদ্ধি গুটিকয়েক মানুষ ভোগ করছেন। তাই কোটিপতি হিসাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ২৭২টি। করোনা সংক্রমণের আগে কোটি টাকার আমানতের হিসাব ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। অর্থাৎ এক বছরের কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭টি।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারছেন না। গুটিকয়েক ধনীর আয় বাড়ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আয় তুলনামূলক বাড়ছে না। এতে চরম আয়বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।’
বিষয়টিকে দুইভাবে দেখছেন গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বিষয়টিকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, দেশে কোটিপতি বৃদ্ধি হওয়ায় মনে হতে পারে দেশে ধনী বাড়ছে অর্থাৎ দেশ উন্নত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কোটিপতি বাড়ছে মানে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিছু মানুষ গরিব হচ্ছে। আর আরও গভীরে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যারা কোটিপতি হচ্ছে তারা কিভাবে কোটিপতি হচ্ছে। তারা সৎপথে কোটিপতি হচ্ছে? অবশ্যই না। অনেকে অসৎ পথে ইনকাম করে ব্যাংকে রাখছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই রয়েছেন সরকারি আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তি। তাদের বেশিরভাগের আয়ই অবৈধ।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে আমানতকারীদের হিসাবে জমা ছিল ১৩ লাখ ৮৪ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের মার্চে এই ব্যাংকগুলোতে আমানত ছিল ১২ লাখ ১০ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। সেই হিসেবে গত বছরে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। আমানতকারীদের জমানো অর্থের প্রায় ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশই কোটিপতিদের দখলে। চলতি বছরের মার্চে তাদের হিসাবে জমা ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৫ লাখ ১৫ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। সেই হিসেবে এক বছরে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবগুলোর জমানো টাকা বেড়েছে ৮০ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা।
দেশের নীতিনির্ধারকরাদের এই আয়বৈষম্যের সৃষ্টির জন্য দায়ী করে মইনুল ইসলাম বলেন, ‘আয়বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকরাই দায়ী। বর্তমান সরকারের মন্ত্রিপরিষদে অধিকাংশই ব্যবসায়ীরা বসে আছেন। তাই তারা সাধারণ মানুষের বিষয়টি চিন্তা করেন না। তারা সাধারণ মানুষকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গল্প শুনিয়ে নিজেরা আখের গুছিয়ে নিচ্ছে।’
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। অনেকে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতেও আমানতকারীর সঙ্গে কোটি টাকা জমার হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২১ সালের মার্চ মাস শেষে ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৪ হাজার ২২৯টি। ৫ কোটি ১ টাকা থেকে ১০ কোটি পর্যন্ত জমা হিসাবের সংখ্যা ১০ হাজার ৪৯৯টি, ১০ কোটি ১ টাকা থেকে ১৫ কোটির টাকার হিসাব রয়েছে ৩ হাজার ৪৪৬টি, ১৫ কোটি ১ টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৬৯৩টি, ২০ কোটি ১ টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ৮১ জন, ২৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ৭৬৬ জনের, ৩০ কোটি ১ টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩৮৮ জন এবং ৩৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে ২৯৬ জন আমানতকারী হিসাব রয়েছে। গত এক বছরে ৪০ কোটি এক টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০৪টি। আলোচিত সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে এক হাজার ৩৭০টিতে দাঁড়িয়েছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে।