কুয়াকাটা পর্যটন সৈকত প্রায় গিলে খাচ্ছে সাগর

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ সাগর সৈকতসহ পুরো এলাকাটি এখন সাগর প্রায় গিলে ফেলছে। ৪০ বছর আগে সাগর কোথায় ছিল, তা আর এখন কেউ বলতে পারবে না। সাগর তীরের বিখ্যাত নারকেল গাছের বাগান এখন আর নেই। বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঢেউয়ে সৈকতের অবশিষ্টাংশ বিলীন হওয়া থেকে রক্ষার জন্য প্রায় সাড়ে ৯শ’ কোটি টাকার একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা’ পুনর্গঠনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ফেরত পাঠান হয়েছে।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলীসহ দায়িত্বশীল মহল এ মাসের মধ্যেই সংশোধনীসহ প্রস্তাবনাটি পুনরায় বোর্ডে প্রেরণের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা কমিশনসহ একনেকে অনুমোদনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দায়িত্বশীল মহল। ফলে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনার কথাও বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল মহল। ফলে আগামী জুলাইÑআগস্টে দরপত্র আহ্বান করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সমুদ্র সৈকতটি বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তা রক্ষার কাজ শুরুর সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল মহল।

পটুয়াখালির সর্ব দক্ষিণে কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত উপমহাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার প্রধান বাধা হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের ক্রমাগত ভাঙন। পর্যটনকেন্দ্রটির মূল অকর্ষণ সি-বিচের পূর্বের রাবনাবাদ ও পশ্চিম প্রান্তের আন্ধারমানিক চ্যানেলের স্রোত গতি পরিবর্তন করায় ১৯৯৮ সাল থেকে ভাঙন শুরু হয়। প্রথমে ঢেউয়ের আঘাতে বছরে এক মিটার করে সি-বিচ বিলীন হতে শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে সে সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে তেমন কোন উদ্বেগ বা কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না। বহু পরে যখন সাগরের সৈকত সৌন্দর্য হারাতে শুরু করে তখন পানি উন্নয়ন বোর্ডেও টনক নড়লে ২০১০ সাল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সীমিত কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় জিউ টিউব ও সিসি ব্লক ফেলে মূল সি-বিচটি সাগরের ঢেউ থেকে রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও তার কোনটিই কার্যকর ফল দেয়নি। ফলে বিপুল অর্থ ব্যয় করেও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে রক্ষার বিষয়টি ফলপ্রসূ হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রায়শই সংবাদ প্রকাশের ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টনক নড়ে। ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে কুয়াকাটায় একাধিকবার মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ সমাবেশও হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী, সচিবরা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত দেখতে এসে প্রকাশিত ও প্রচারিত খবরগুলোর সত্যতা দেখতে পায়। একপর্যায়ে বিষয়টি পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর নজরে এলে তিনি সরজমিনে কুয়াকাটা সফর করে এ লক্ষ্যে একটি পারিপূর্র্ণ মডেল স্টাডিসহ জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন। তার প্রেক্ষিতে আধা সরকারি নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আইডব্লিউএম’-এর মাধ্যমে পরিপূর্ণ জরিপ ও সম্ভব্যতা সমিক্ষা শেষে কুয়াকাটার সৈকত রক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

আইডব্লিউএম এ লক্ষ্যে তার প্রস্তাবনায় কুয়াকাটা উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রন বাধ থেকে সি-বিচ পর্যন্ত প্রায় ৭০টি গ্রোয়েনের মাধ্যমে ভাঙন রোধের প্রস্তাব দিয়েছে। গ্রোয়েনগুলোতে জিও টেক্সটাইলের ওপর ৪৫ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার সাইজের সিসি ব্লক সন্নিবেশ করা হবে। মূল সি-বিচ রক্ষায় দুই প্রান্তের রাবনাবাদ ও আন্দামানিক চ্যানেল পর্যন্ত প্রায় ১১ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার এলাকায় সিসি ব্লকের সাহায্যে গ্রোয়েনগুলো নির্মিত হবে।

প্রকল্পের আওতায় কুয়াকাটা সৈকতে একটি আদর্শ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে ‘ওয়াকিং-বে’ ছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ‘লাইফ গার্ড স্টেশন’, বসার স্থান, ট্রইল, পার্কিং ল্যান্ডস্কেপ ও টয়লেট নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্পটির জন্য আইডব্লিউএম ৬৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করলেও পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৯৪৯ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্র্থেই তা বাস্তবায়িত করা হবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নের তদরকিও করবে আইডব্লিউএম।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় জোনের প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম জানান, সরকার কুয়াকাটা সৈকতকে ভাঙন থেকে রক্ষা করাসহ একটি আদর্শ সমুদ্র সৈকত হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহী। পানি উন্নয়ন বোর্ডও সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী সার্বক্ষণিক প্রকল্পটির খোঁজখবর রাখছেন বলেও জানান তিনি।

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ , ৫ আশ্বিন ১৪২৮ ১১ সফর ১৪৪৩

কুয়াকাটা পর্যটন সৈকত প্রায় গিলে খাচ্ছে সাগর

মানবেন্দ্র বটব্যাল, বরিশাল

image

বরিশাল : ক্রমাগত ঢেউ গিলে খাচ্ছে পর্যটনকেন্দ্র সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত -সংবাদ

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ সাগর সৈকতসহ পুরো এলাকাটি এখন সাগর প্রায় গিলে ফেলছে। ৪০ বছর আগে সাগর কোথায় ছিল, তা আর এখন কেউ বলতে পারবে না। সাগর তীরের বিখ্যাত নারকেল গাছের বাগান এখন আর নেই। বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঢেউয়ে সৈকতের অবশিষ্টাংশ বিলীন হওয়া থেকে রক্ষার জন্য প্রায় সাড়ে ৯শ’ কোটি টাকার একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা’ পুনর্গঠনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ফেরত পাঠান হয়েছে।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলীসহ দায়িত্বশীল মহল এ মাসের মধ্যেই সংশোধনীসহ প্রস্তাবনাটি পুনরায় বোর্ডে প্রেরণের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা কমিশনসহ একনেকে অনুমোদনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দায়িত্বশীল মহল। ফলে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনার কথাও বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল মহল। ফলে আগামী জুলাইÑআগস্টে দরপত্র আহ্বান করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সমুদ্র সৈকতটি বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তা রক্ষার কাজ শুরুর সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল মহল।

পটুয়াখালির সর্ব দক্ষিণে কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত উপমহাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার প্রধান বাধা হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের ক্রমাগত ভাঙন। পর্যটনকেন্দ্রটির মূল অকর্ষণ সি-বিচের পূর্বের রাবনাবাদ ও পশ্চিম প্রান্তের আন্ধারমানিক চ্যানেলের স্রোত গতি পরিবর্তন করায় ১৯৯৮ সাল থেকে ভাঙন শুরু হয়। প্রথমে ঢেউয়ের আঘাতে বছরে এক মিটার করে সি-বিচ বিলীন হতে শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে সে সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে তেমন কোন উদ্বেগ বা কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না। বহু পরে যখন সাগরের সৈকত সৌন্দর্য হারাতে শুরু করে তখন পানি উন্নয়ন বোর্ডেও টনক নড়লে ২০১০ সাল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সীমিত কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় জিউ টিউব ও সিসি ব্লক ফেলে মূল সি-বিচটি সাগরের ঢেউ থেকে রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও তার কোনটিই কার্যকর ফল দেয়নি। ফলে বিপুল অর্থ ব্যয় করেও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে রক্ষার বিষয়টি ফলপ্রসূ হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রায়শই সংবাদ প্রকাশের ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টনক নড়ে। ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে কুয়াকাটায় একাধিকবার মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ সমাবেশও হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী, সচিবরা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত দেখতে এসে প্রকাশিত ও প্রচারিত খবরগুলোর সত্যতা দেখতে পায়। একপর্যায়ে বিষয়টি পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর নজরে এলে তিনি সরজমিনে কুয়াকাটা সফর করে এ লক্ষ্যে একটি পারিপূর্র্ণ মডেল স্টাডিসহ জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন। তার প্রেক্ষিতে আধা সরকারি নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আইডব্লিউএম’-এর মাধ্যমে পরিপূর্ণ জরিপ ও সম্ভব্যতা সমিক্ষা শেষে কুয়াকাটার সৈকত রক্ষায় একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

আইডব্লিউএম এ লক্ষ্যে তার প্রস্তাবনায় কুয়াকাটা উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রন বাধ থেকে সি-বিচ পর্যন্ত প্রায় ৭০টি গ্রোয়েনের মাধ্যমে ভাঙন রোধের প্রস্তাব দিয়েছে। গ্রোয়েনগুলোতে জিও টেক্সটাইলের ওপর ৪৫ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার সাইজের সিসি ব্লক সন্নিবেশ করা হবে। মূল সি-বিচ রক্ষায় দুই প্রান্তের রাবনাবাদ ও আন্দামানিক চ্যানেল পর্যন্ত প্রায় ১১ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার এলাকায় সিসি ব্লকের সাহায্যে গ্রোয়েনগুলো নির্মিত হবে।

প্রকল্পের আওতায় কুয়াকাটা সৈকতে একটি আদর্শ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে ‘ওয়াকিং-বে’ ছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ‘লাইফ গার্ড স্টেশন’, বসার স্থান, ট্রইল, পার্কিং ল্যান্ডস্কেপ ও টয়লেট নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্পটির জন্য আইডব্লিউএম ৬৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করলেও পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৯৪৯ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্র্থেই তা বাস্তবায়িত করা হবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নের তদরকিও করবে আইডব্লিউএম।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় জোনের প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম জানান, সরকার কুয়াকাটা সৈকতকে ভাঙন থেকে রক্ষা করাসহ একটি আদর্শ সমুদ্র সৈকত হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহী। পানি উন্নয়ন বোর্ডও সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী সার্বক্ষণিক প্রকল্পটির খোঁজখবর রাখছেন বলেও জানান তিনি।