অন্ধকার অতল গহ্বরে আফগান জনগণ

মনজুরুল হক

গরম তেলের কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলিতে পড়েছে আফগান জনগণ! আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে কুড়ি বছর পর আবার তালেবানের খপ্পরে পড়েছে তারা? না। গত ষাট বছর ধরেই এক চুল্লি থেকে আরেক চুলিতে একবার পড়ছে, পুড়ছে, আবার অন্য চুলিতে ভস্মীভূত হচ্ছে। এসব কোন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নয়, সে দেশের ক্ষমতালিপ্সু বর্বর লোভী কূপমণ্ডুক রাজনীতিবিদ আর গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের নৃশংস কামড়াকামড়ির ফলাফল আজকের এই নির্মম পরিণতি।

আফগান জনগণের দুর্দশার ইতিহাস আজকের নয়। সেই বাইজেন্টাইন আমল এবং তারও আগে থেকে। এ নিয়ে গত ১৫ আগস্ট তালেবানের নতুন করে ক্ষমতা দখলের পর থেকে এন্তার লেখালিখি হয়েছে। আফগানিস্তানের ইতিহাসও লেখা হয়েছে। গত শতকের ষাটের দশকে জহির শাহ ক্ষমতায় থাকার সময়টাকে আফগান জনগণের ‘সুখের কাল’ বলা যেতে পারে। এর পরের নাটকীয় পরিবর্তনগুলো এতটাই নাটকীয় যা শুধু ফিকশনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জহির শাহকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করেন দাউদ খান। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও আফগানিস্তান একটা স্টাবল এবং সুন্দর জনপদ ছিল। আফগানরা ইয়োরোপ-আমেরিকায় পড়াশোনা করতে যেত। সত্তরের দশকে সে দেশের মেয়েরা অন্য আর দশটা দেশের মতো আধুনিত বেশভূষায় লেখাপড়া, চাকরি-বাকরি করত। প্রচুর পরিমাণে বিদেশি পর্যটক আসত পাঞ্জশির উপত্যকার সুমিষ্ট পানির জনপদে। আফগান পপ মিউজিক নাম করেছিল বিশ্ব দরবারে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে যে কোন দেশের সঙ্গে তুল্য হতো আফগানিস্তান।

এরপর পরই ক্ষমতায় আসেন নুর মোহাম্মাদ তারাকি। তিনি লেখাপড়া করেছেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। স্বভাবতই মার্কসবাদে দীক্ষিত ছিলেন। তিনি ক্ষমতায় বসেই আফগানিস্তানকে একটি আদর্শ সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। দিকে দিকে মার্কসবাদের আদর্শ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তিনি আফগান জনগণের ভালোবাসা পেলেও পুরো আফগানিস্তান করায়ত্ত করতে পারেননি। আফগানিস্তানের ভূস্বামী আর গোষ্ঠীপ্রধান ধনিক শ্রেণী তারাকির মার্কসবাদী দর্শন কখনও মেনে নেয়নি। তারা এর প্রতিরোধ হিসাবে গোঁড়া ধর্মীয় হাতিয়ারকে সম্বল করে গড়ে তোলে মুজাহেদিন বাহিনী। ঠিক সেই সময়ে ইরাকে, পাকিস্তানে ইসলামপন্থিরা ক্ষমতায় আসীন হয়। তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় আফগানিস্তানে দ্রুত বেড়ে ওঠে মুজাহেদিন। মুজাহেদিনরা ক্ষমতার নমুনা দেখায় হেরাত প্রদেশে নির্মম নৃশংসতা চালিয়ে। রাতারাতি ২৫ হাজার আফগান জনগণকে প্রাণ দিতে হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নূর মোহাম্মাদ তারাকির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হাফিজুল্লাহ আমীনকে ক্ষমতায় বসায়। ধীরে ধীরে আফগানিস্তানে সোভিয়েত অংশীদারিত্ব বাড়তে থাকে। ইতি মধ্যে সোভিয়েত নেতা হিসাবে অভিষিক্ত হন মিখাইল গরভাচেভ।

১৯৭৯ সালে আমীনকে হঠিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয় নজিবুল্লাহকে। একদিকে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদতে আমীন, পরে নজিবুল্লাহর অধীনে আফগান শহুরে জনগণ, অন্যদিকে ইরাক, ইরান, পাকিস্তান আর আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে ক্ষমতা সংহত করতে থাকে মুজাহেদিন। চকচকে নতুন অস্ত্র, অঢেল টাকা আর পাকিস্তানে নিরাপদ আশ্রয় থেকে এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইএয়ের তত্ত্বাবধায়নে গড়ে ওঠা মুজাহেদিন দ্রুত কাবুল দখল করে। নৃশংসভাবে হত্যা করে তিন দিন লাইটপোস্টে ঝুলতে থাকেন নজিবুল্লাহর মৃতদেহ।

মনে হলো এবার আফগানিস্তানে শান্তি ফিরবে। কিন্তু না। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন মনে করেছিল ‘আফগানিস্তানকে বেজ-লাইন ধরে বিশ্বের এই অঞ্চলে সমাজতান্ত্রিক বলয় তৈরি করা যাবে’, তেমনি পাকিস্তান-ইরান-আমেরিকা-সৌদি আরব মনে করল আফগানিস্তানে ধর্মীয় শাসন কায়েম করে আফগানিস্তানকে ঘাঁটি বানিয়ে পুরো বিশ্বে ইসলামের পতাকা উত্তলন করা হবে। মুজাহেদিন ক্ষমতা দখলের পর পরই আফগানিস্তানের পেছনে হাঁটা শুরু। আর সেটা এতটাই যে, দেশের খোল-নলচে রাতারাতি বদলে গেল। সারা দেশের কোথাও আর একটিও লাল পতাকা দেখা গেল না। নারীরা চলে গেল বুরখার অবগুণ্ঠনে। পথে-ঘাটে আর কোন নারী নেই। মোটের ওপর আফগানিস্তানে চালু হলো দেড় হাজার বছরের পুরোনো ইসলামী শরিয়াহ্্।

এর পরের ইতিহাস আরও দ্রুত বিকোশিত। সৌদি আরব ধেকে বিতাড়িত বিন লাদেন মুজাহেদিনের ‘অতিথি’ হয়ে আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেঁড়ে তৈরে করে ‘আল কায়েদা’। নৃশংসতম সন্ত্রাসী বাহিনী। এই আল কায়েদার হামলায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে ২ হাজার ৬০০ মানুষের করুণ মৃত্যু হলে আমেরিকা ক্রুর প্রতিশোধ নেয়। আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠিয়ে দখল করে নেয়। বিন লাদেনকে হত্যা করে। এবং টানা ২০ বছর আমেরিকা আর তার সহযোগী ব্রিটিশ, ফ্রান্স আফগানিস্তান শাসন করে।

কিন্তু গত ২০ বছরেও আমেরিকা আফগানিস্তানকে স্টাবল করতে পারেনি, কারণ একের পর এক সরকার বদল হলেও আকণ্ঠ দুর্নীতি আর চুরি-ডাকাতি করে সাহায্যের পুরো টাকাটাই হজম করেছে। জনগণের কোন কল্যাণ হয়নি। আর সে কারণে জনগণের মধ্যে আবারও রেজিম চেঞ্জ মানসিকতা বিস্তার হতে থাকে। এর মধ্যে পাকিস্তান সর্বশক্তি নিয়োগ করে ফের তালেবান সৃষ্টি করে। এবং পাকিস্তান-ইরান-সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ধীরে ধীরে তালেবান শক্তি সঞ্চয় করে। এদিকে দুর্নীতিবাজ গনি সরকারের ওপর থেকে আমেরিকা আস্থা তুলে নেয়। আমেরিকায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন হওয়ার পর বাইডেন সরকার আফগানে সহায়তা আর দীর্ঘায়িত করতে চায় না। তারই ফলশ্রুতিতে ২০২০ সালে কাতারের দোহায় আমেরিকা-সৌদি আরব-তালেবান চুক্তি করে। সেই চুক্তি বলে তালেবানরা বিনা রক্তপাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে গত ১৫ আগস্ট।

তারপর? তারপর কী বিপর্যয় শেষ? না। নতুন করে শুরু। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে স্পষ্টত দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করে চলেছে। নারীদের ফের অন্তপুরে বন্দী করেছে। গনি সরকারের প্রশিক্ষিত তিন লাখ সৈন্য কাঠের পুতুলের মতো অস্ত্র সারেন্ডার করেছে। অনেকে পালিয়ে গেছে। অনেকেই তালেবানে নাম লিখিয়েছে। আর চরম দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপিরা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেঁচেছে। তারপরও গোটা আফগানিস্তান তালেবানের দখলে যায়নি। প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট আরুল্লাহ সালেহ এবং ‘আফগান সিংহ’খ্যাত আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে এবং হাজারিসহ আরও কয়েকটি গোষ্ঠী মিলে পাঞ্জশিরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সালাহ স্পষ্ট করেছেন-তিনি সংবিধান অনুযায়ী বর্তমানে আফগান প্রেসিডেন্ট। তাকে মদত দিচ্ছে ভারত। আর তালেবানের পেছনে তো পাকিস্তান-ইরান-সৌদি আরব আছেই। আছে চির শত্রু রাশিয়া এবং নতুন সম্প্রসারণবাদী নয়া চীন। এই অবস্থায় একটা আনস্টেবল তালেবান সরকার কতদিন টিকবে তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন-আফগান জনগণ বাঁচবে কীভাবে?

প্রায় সব ব্যাংক বন্ধ। সীমিত পরিমাণ টাকা শুধু তোলা যায়। ব্যবসা-বাণিয্য পুরোপুরি বন্ধ। দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। খাবার নেই, পানি নেই। হাসপাতালগুলোতে ওষুধ নেই। সাহায্য মিশনের লোকজন প্রাণভয়ে দেশ ছেড়েছে। এরই মধ্যে চীনের সাড়ে ৩ লাখ ডলার আর জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিশ্রতি কতটা কাজে লাগবেÑ তা সময়ই বলে দেবে। তবে আন্তোনিও গুতেরেস যেভাবে বিচলিত হলেন তাতে বোঝায় যাচ্ছে আফগানিস্তানের জনগণ ভীষণ কষ্টে আছে। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোকে অবিলম্বে সাহায্য পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে টুইটারে সালেহ লিখেছেন, ‘আফগানিস্তানের সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্টের মৃত্যু, অনুপস্থিতি, পদত্যাগ বা পলায়নের ক্ষেত্রে ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট কেয়ারটেকার প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। আমি এখন নিজের দেশেই আছি। আমি বৈধ কেয়ারটেকার প্রেসিডেন্ট। সব নেতার সমর্থন ও মত নেয়ার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার কথা শুনছেন, তাদের আমি হতাশ করব না। আমি কোনদিন তালেবানের সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকব না। ‘আমার মাটিতে মানুষের সঙ্গে থাকব। তার একটি কারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। ধর্মের ওপর আমার বিশ্বাস রয়েছে। পাকিস্তানের মদতপুষ্ট আগ্রাসন এবং বর্বর একনায়তন্ত্রের বিরোধিতা করছি।’

পাঞ্জশির পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে সালেহ জাতিসংঘের কাছে একটি চিঠিতে বলেন, তালেবানদের অর্থনৈতিক অবরোধ, টেলিযোগাযোগ বন্ধের কারণে পাঞ্জশির প্রদেশ এবং বাঘলান প্রদেশের তিনটি আন্দ্রাব জেলা জুড়ে ব্যাপক আকারে মানবিক সংকট দেখা দিচ্ছে। “স্থানীয় নারী, শিশু, বযস্ক এবং প্রায় ১০ হাজার হাজার অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিসহ যারা কাবুল ও অন্যান্য বড় শহর পতনের পর পঞ্জশিরে এসেছিল তারাও এই উপত্যকায় আটকে আছে এবং এই অমানবিক পরিণতি ভোগ করছে।”

২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানকে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরও দেশটিতে প্রতিষ্ঠা হয়নি শান্তি, মানুষ নিরাপদ বোধ করে না এই দেশে, দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত দেশটির রাজনীতি আর অর্থনীতি। লাখ লাখ কোটি ডলার ব্যয়ের পরও এখনও আফগানিস্তান বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর একটি।

মূলত বৈদেশিক সাহায্যের ওপরই নির্ভর করে দেশটির অর্থনীতি। করোনা, খরা, নিম্ন আয়, আমদানি-রপ্তানি কমায় দেশটিতে বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্থলবন্দর দিয়ে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় দেশটিতে আরও বাড়বে খাদ্যপণ্যের দাম। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এয়ারলাইন্সকেও আফগানিস্তানের রুট পরিবর্তন করে অন্য রুটে বিমান পরিচালনা করতে হচ্ছে।

দুই দশক তাড়া খেয়ে বেড়ানো সেই তালেবানই এখন আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তাই আফগানিস্তানের সরকারব্যবস্থা পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের এই লাখ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এখন হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ অবকাঠামো প্রকল্পে ২০০১ সাল থেকে ১৪ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।

৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় হলেও এই প্রকল্পের ফলাফল শূন্য। আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল তালেবানসহ অন্য সশস্ত্র সংগঠন আল কায়েদা আর আইএসআইএলকে প্রতিহত করার জন্য। এই গোষ্ঠীগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি ছিল, কিন্তু সেই তালেবান এখন আইএস দমনের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে কর্তৃত্ব করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আফগানিস্তানের রিজার্ভের কোটি কোটি ডলার আছে। এ বিষয়ে মার্কিন এক মুখপাত্র জানান, কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ যা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মজুত আছে, কখনোই তালেবানের হাতে তুলে দেয়া হবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানায়, ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ৯৪০ কোটি ডলার রিজার্ভ আছে আইএমএফের কাছে।

এই সংকটের চেয়েও বড় সংকট পাকিস্তান, যা তারা এখনও বুঝতে পারছে না। তাই তালেবান ক্ষমতা দখলের পর যখন কেয়ারটেকার সরকার গড়তে পারছিল না, তখনই পাকিস্তানের আইএসআই প্রধান কাবুল সফর করেন। যদিও পাকিস্তানি মন্ত্রী-সাংবাদিকরা এটাকে স্রেফ রুটিন সফর বলছেন, কিন্তু এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে সফরটা ভীষণভাবে পক্ষপাতিত্বমূলক। তার সফরের পর পরই তালেবান একটা কেয়ারটেকার সরকার ঘোষণা করেছে। এখন আফগান জনগণের সামনে সব চেয়ে বড় বিপদ অনাহার আর মৃত্যু। তারা কি খেয়ে বাঁচবে সেটাই বড় প্রশ্ন। এক একটা রুটির লঙ্গরখানায় এক টুকরো রুটির জন্য খুনোখুনি হওয়ার মতো দশা। দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ দুই বেলা খেতে পাচ্ছে না। সামনে শীত আসছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে শীতে, নিমিউনিয়ায়, অনাহারে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে।

এই মুহূর্তে কে আফগানিস্তানের আসল দাবিদার, কার শক্তি বেশি, কে কোন অঞ্চল দখলে রাখবে, কারা ইসলামকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেবে, ধর্মঢাল দিয়ে কারা এইসব অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাবে, আমেরিকা কি পেল, পাকিস্তানের সামনে কোন বিপদ, বাংলাদেশ কোন রকম বিপদে আছে কিনা, ভারতের শঙ্কিত হওয়ার কিছু আছে কিনা, বিশ্ব রাজনীতি এখন এই অঞ্চলে কোন দাবা খেলবে ... প্রশ্নগুলোর চেয়েও ভয়ঙ্কর বাস্তবতা হলো আফগানিস্তানের জনগণকে এসব ইজম আর পক্ষ-বিপক্ষ গুলে খাওয়ালেও তারা বাঁচবে না। তাদের দরকার খাদ্য। আর তার জন্য প্রতিশ্রুতি নয়, আশ্বাস নয়, ইন্সট্যানটলি দরকার ক্যাশ টাকা, যা দিয়ে খাবার কেনা যাবে। আর খাবারের যথেষ্ট পরিমাণ মজুত। এটায় ব্যর্থ হলে আফগান জনগণ মরতে শুরু করলে ওখানে যে মানবিক বিপর্যয় শুরু হবে এবং তা থেকে যে নৈরাজ্য শুরু হবে তা আগের যে কোন বিপর্যয় থেকেও বড় বিপর্যয়। তা শুধু আফগানিস্তানকে নয় পুরো এই অঞ্চলটাকেও নাড়িয়ে দেবে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ , ৫ আশ্বিন ১৪২৮ ১১ সফর ১৪৪৩

অন্ধকার অতল গহ্বরে আফগান জনগণ

মনজুরুল হক

গরম তেলের কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলিতে পড়েছে আফগান জনগণ! আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে কুড়ি বছর পর আবার তালেবানের খপ্পরে পড়েছে তারা? না। গত ষাট বছর ধরেই এক চুল্লি থেকে আরেক চুলিতে একবার পড়ছে, পুড়ছে, আবার অন্য চুলিতে ভস্মীভূত হচ্ছে। এসব কোন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নয়, সে দেশের ক্ষমতালিপ্সু বর্বর লোভী কূপমণ্ডুক রাজনীতিবিদ আর গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের নৃশংস কামড়াকামড়ির ফলাফল আজকের এই নির্মম পরিণতি।

আফগান জনগণের দুর্দশার ইতিহাস আজকের নয়। সেই বাইজেন্টাইন আমল এবং তারও আগে থেকে। এ নিয়ে গত ১৫ আগস্ট তালেবানের নতুন করে ক্ষমতা দখলের পর থেকে এন্তার লেখালিখি হয়েছে। আফগানিস্তানের ইতিহাসও লেখা হয়েছে। গত শতকের ষাটের দশকে জহির শাহ ক্ষমতায় থাকার সময়টাকে আফগান জনগণের ‘সুখের কাল’ বলা যেতে পারে। এর পরের নাটকীয় পরিবর্তনগুলো এতটাই নাটকীয় যা শুধু ফিকশনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জহির শাহকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করেন দাউদ খান। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও আফগানিস্তান একটা স্টাবল এবং সুন্দর জনপদ ছিল। আফগানরা ইয়োরোপ-আমেরিকায় পড়াশোনা করতে যেত। সত্তরের দশকে সে দেশের মেয়েরা অন্য আর দশটা দেশের মতো আধুনিত বেশভূষায় লেখাপড়া, চাকরি-বাকরি করত। প্রচুর পরিমাণে বিদেশি পর্যটক আসত পাঞ্জশির উপত্যকার সুমিষ্ট পানির জনপদে। আফগান পপ মিউজিক নাম করেছিল বিশ্ব দরবারে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে যে কোন দেশের সঙ্গে তুল্য হতো আফগানিস্তান।

এরপর পরই ক্ষমতায় আসেন নুর মোহাম্মাদ তারাকি। তিনি লেখাপড়া করেছেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। স্বভাবতই মার্কসবাদে দীক্ষিত ছিলেন। তিনি ক্ষমতায় বসেই আফগানিস্তানকে একটি আদর্শ সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। দিকে দিকে মার্কসবাদের আদর্শ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তিনি আফগান জনগণের ভালোবাসা পেলেও পুরো আফগানিস্তান করায়ত্ত করতে পারেননি। আফগানিস্তানের ভূস্বামী আর গোষ্ঠীপ্রধান ধনিক শ্রেণী তারাকির মার্কসবাদী দর্শন কখনও মেনে নেয়নি। তারা এর প্রতিরোধ হিসাবে গোঁড়া ধর্মীয় হাতিয়ারকে সম্বল করে গড়ে তোলে মুজাহেদিন বাহিনী। ঠিক সেই সময়ে ইরাকে, পাকিস্তানে ইসলামপন্থিরা ক্ষমতায় আসীন হয়। তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় আফগানিস্তানে দ্রুত বেড়ে ওঠে মুজাহেদিন। মুজাহেদিনরা ক্ষমতার নমুনা দেখায় হেরাত প্রদেশে নির্মম নৃশংসতা চালিয়ে। রাতারাতি ২৫ হাজার আফগান জনগণকে প্রাণ দিতে হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নূর মোহাম্মাদ তারাকির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হাফিজুল্লাহ আমীনকে ক্ষমতায় বসায়। ধীরে ধীরে আফগানিস্তানে সোভিয়েত অংশীদারিত্ব বাড়তে থাকে। ইতি মধ্যে সোভিয়েত নেতা হিসাবে অভিষিক্ত হন মিখাইল গরভাচেভ।

১৯৭৯ সালে আমীনকে হঠিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয় নজিবুল্লাহকে। একদিকে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদতে আমীন, পরে নজিবুল্লাহর অধীনে আফগান শহুরে জনগণ, অন্যদিকে ইরাক, ইরান, পাকিস্তান আর আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে ক্ষমতা সংহত করতে থাকে মুজাহেদিন। চকচকে নতুন অস্ত্র, অঢেল টাকা আর পাকিস্তানে নিরাপদ আশ্রয় থেকে এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইএয়ের তত্ত্বাবধায়নে গড়ে ওঠা মুজাহেদিন দ্রুত কাবুল দখল করে। নৃশংসভাবে হত্যা করে তিন দিন লাইটপোস্টে ঝুলতে থাকেন নজিবুল্লাহর মৃতদেহ।

মনে হলো এবার আফগানিস্তানে শান্তি ফিরবে। কিন্তু না। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন মনে করেছিল ‘আফগানিস্তানকে বেজ-লাইন ধরে বিশ্বের এই অঞ্চলে সমাজতান্ত্রিক বলয় তৈরি করা যাবে’, তেমনি পাকিস্তান-ইরান-আমেরিকা-সৌদি আরব মনে করল আফগানিস্তানে ধর্মীয় শাসন কায়েম করে আফগানিস্তানকে ঘাঁটি বানিয়ে পুরো বিশ্বে ইসলামের পতাকা উত্তলন করা হবে। মুজাহেদিন ক্ষমতা দখলের পর পরই আফগানিস্তানের পেছনে হাঁটা শুরু। আর সেটা এতটাই যে, দেশের খোল-নলচে রাতারাতি বদলে গেল। সারা দেশের কোথাও আর একটিও লাল পতাকা দেখা গেল না। নারীরা চলে গেল বুরখার অবগুণ্ঠনে। পথে-ঘাটে আর কোন নারী নেই। মোটের ওপর আফগানিস্তানে চালু হলো দেড় হাজার বছরের পুরোনো ইসলামী শরিয়াহ্্।

এর পরের ইতিহাস আরও দ্রুত বিকোশিত। সৌদি আরব ধেকে বিতাড়িত বিন লাদেন মুজাহেদিনের ‘অতিথি’ হয়ে আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেঁড়ে তৈরে করে ‘আল কায়েদা’। নৃশংসতম সন্ত্রাসী বাহিনী। এই আল কায়েদার হামলায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে ২ হাজার ৬০০ মানুষের করুণ মৃত্যু হলে আমেরিকা ক্রুর প্রতিশোধ নেয়। আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠিয়ে দখল করে নেয়। বিন লাদেনকে হত্যা করে। এবং টানা ২০ বছর আমেরিকা আর তার সহযোগী ব্রিটিশ, ফ্রান্স আফগানিস্তান শাসন করে।

কিন্তু গত ২০ বছরেও আমেরিকা আফগানিস্তানকে স্টাবল করতে পারেনি, কারণ একের পর এক সরকার বদল হলেও আকণ্ঠ দুর্নীতি আর চুরি-ডাকাতি করে সাহায্যের পুরো টাকাটাই হজম করেছে। জনগণের কোন কল্যাণ হয়নি। আর সে কারণে জনগণের মধ্যে আবারও রেজিম চেঞ্জ মানসিকতা বিস্তার হতে থাকে। এর মধ্যে পাকিস্তান সর্বশক্তি নিয়োগ করে ফের তালেবান সৃষ্টি করে। এবং পাকিস্তান-ইরান-সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ধীরে ধীরে তালেবান শক্তি সঞ্চয় করে। এদিকে দুর্নীতিবাজ গনি সরকারের ওপর থেকে আমেরিকা আস্থা তুলে নেয়। আমেরিকায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন হওয়ার পর বাইডেন সরকার আফগানে সহায়তা আর দীর্ঘায়িত করতে চায় না। তারই ফলশ্রুতিতে ২০২০ সালে কাতারের দোহায় আমেরিকা-সৌদি আরব-তালেবান চুক্তি করে। সেই চুক্তি বলে তালেবানরা বিনা রক্তপাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে গত ১৫ আগস্ট।

তারপর? তারপর কী বিপর্যয় শেষ? না। নতুন করে শুরু। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে স্পষ্টত দোহা চুক্তি লঙ্ঘন করে চলেছে। নারীদের ফের অন্তপুরে বন্দী করেছে। গনি সরকারের প্রশিক্ষিত তিন লাখ সৈন্য কাঠের পুতুলের মতো অস্ত্র সারেন্ডার করেছে। অনেকে পালিয়ে গেছে। অনেকেই তালেবানে নাম লিখিয়েছে। আর চরম দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপিরা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেঁচেছে। তারপরও গোটা আফগানিস্তান তালেবানের দখলে যায়নি। প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট আরুল্লাহ সালেহ এবং ‘আফগান সিংহ’খ্যাত আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে এবং হাজারিসহ আরও কয়েকটি গোষ্ঠী মিলে পাঞ্জশিরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সালাহ স্পষ্ট করেছেন-তিনি সংবিধান অনুযায়ী বর্তমানে আফগান প্রেসিডেন্ট। তাকে মদত দিচ্ছে ভারত। আর তালেবানের পেছনে তো পাকিস্তান-ইরান-সৌদি আরব আছেই। আছে চির শত্রু রাশিয়া এবং নতুন সম্প্রসারণবাদী নয়া চীন। এই অবস্থায় একটা আনস্টেবল তালেবান সরকার কতদিন টিকবে তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন-আফগান জনগণ বাঁচবে কীভাবে?

প্রায় সব ব্যাংক বন্ধ। সীমিত পরিমাণ টাকা শুধু তোলা যায়। ব্যবসা-বাণিয্য পুরোপুরি বন্ধ। দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। খাবার নেই, পানি নেই। হাসপাতালগুলোতে ওষুধ নেই। সাহায্য মিশনের লোকজন প্রাণভয়ে দেশ ছেড়েছে। এরই মধ্যে চীনের সাড়ে ৩ লাখ ডলার আর জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিশ্রতি কতটা কাজে লাগবেÑ তা সময়ই বলে দেবে। তবে আন্তোনিও গুতেরেস যেভাবে বিচলিত হলেন তাতে বোঝায় যাচ্ছে আফগানিস্তানের জনগণ ভীষণ কষ্টে আছে। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোকে অবিলম্বে সাহায্য পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে টুইটারে সালেহ লিখেছেন, ‘আফগানিস্তানের সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্টের মৃত্যু, অনুপস্থিতি, পদত্যাগ বা পলায়নের ক্ষেত্রে ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট কেয়ারটেকার প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। আমি এখন নিজের দেশেই আছি। আমি বৈধ কেয়ারটেকার প্রেসিডেন্ট। সব নেতার সমর্থন ও মত নেয়ার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার কথা শুনছেন, তাদের আমি হতাশ করব না। আমি কোনদিন তালেবানের সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকব না। ‘আমার মাটিতে মানুষের সঙ্গে থাকব। তার একটি কারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। ধর্মের ওপর আমার বিশ্বাস রয়েছে। পাকিস্তানের মদতপুষ্ট আগ্রাসন এবং বর্বর একনায়তন্ত্রের বিরোধিতা করছি।’

পাঞ্জশির পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে সালেহ জাতিসংঘের কাছে একটি চিঠিতে বলেন, তালেবানদের অর্থনৈতিক অবরোধ, টেলিযোগাযোগ বন্ধের কারণে পাঞ্জশির প্রদেশ এবং বাঘলান প্রদেশের তিনটি আন্দ্রাব জেলা জুড়ে ব্যাপক আকারে মানবিক সংকট দেখা দিচ্ছে। “স্থানীয় নারী, শিশু, বযস্ক এবং প্রায় ১০ হাজার হাজার অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিসহ যারা কাবুল ও অন্যান্য বড় শহর পতনের পর পঞ্জশিরে এসেছিল তারাও এই উপত্যকায় আটকে আছে এবং এই অমানবিক পরিণতি ভোগ করছে।”

২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানকে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরও দেশটিতে প্রতিষ্ঠা হয়নি শান্তি, মানুষ নিরাপদ বোধ করে না এই দেশে, দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত দেশটির রাজনীতি আর অর্থনীতি। লাখ লাখ কোটি ডলার ব্যয়ের পরও এখনও আফগানিস্তান বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর একটি।

মূলত বৈদেশিক সাহায্যের ওপরই নির্ভর করে দেশটির অর্থনীতি। করোনা, খরা, নিম্ন আয়, আমদানি-রপ্তানি কমায় দেশটিতে বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্থলবন্দর দিয়ে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় দেশটিতে আরও বাড়বে খাদ্যপণ্যের দাম। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এয়ারলাইন্সকেও আফগানিস্তানের রুট পরিবর্তন করে অন্য রুটে বিমান পরিচালনা করতে হচ্ছে।

দুই দশক তাড়া খেয়ে বেড়ানো সেই তালেবানই এখন আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তাই আফগানিস্তানের সরকারব্যবস্থা পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের এই লাখ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এখন হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ অবকাঠামো প্রকল্পে ২০০১ সাল থেকে ১৪ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।

৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় হলেও এই প্রকল্পের ফলাফল শূন্য। আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল তালেবানসহ অন্য সশস্ত্র সংগঠন আল কায়েদা আর আইএসআইএলকে প্রতিহত করার জন্য। এই গোষ্ঠীগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি ছিল, কিন্তু সেই তালেবান এখন আইএস দমনের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে কর্তৃত্ব করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আফগানিস্তানের রিজার্ভের কোটি কোটি ডলার আছে। এ বিষয়ে মার্কিন এক মুখপাত্র জানান, কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ যা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মজুত আছে, কখনোই তালেবানের হাতে তুলে দেয়া হবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানায়, ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ৯৪০ কোটি ডলার রিজার্ভ আছে আইএমএফের কাছে।

এই সংকটের চেয়েও বড় সংকট পাকিস্তান, যা তারা এখনও বুঝতে পারছে না। তাই তালেবান ক্ষমতা দখলের পর যখন কেয়ারটেকার সরকার গড়তে পারছিল না, তখনই পাকিস্তানের আইএসআই প্রধান কাবুল সফর করেন। যদিও পাকিস্তানি মন্ত্রী-সাংবাদিকরা এটাকে স্রেফ রুটিন সফর বলছেন, কিন্তু এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে সফরটা ভীষণভাবে পক্ষপাতিত্বমূলক। তার সফরের পর পরই তালেবান একটা কেয়ারটেকার সরকার ঘোষণা করেছে। এখন আফগান জনগণের সামনে সব চেয়ে বড় বিপদ অনাহার আর মৃত্যু। তারা কি খেয়ে বাঁচবে সেটাই বড় প্রশ্ন। এক একটা রুটির লঙ্গরখানায় এক টুকরো রুটির জন্য খুনোখুনি হওয়ার মতো দশা। দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ দুই বেলা খেতে পাচ্ছে না। সামনে শীত আসছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে শীতে, নিমিউনিয়ায়, অনাহারে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে।

এই মুহূর্তে কে আফগানিস্তানের আসল দাবিদার, কার শক্তি বেশি, কে কোন অঞ্চল দখলে রাখবে, কারা ইসলামকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেবে, ধর্মঢাল দিয়ে কারা এইসব অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাবে, আমেরিকা কি পেল, পাকিস্তানের সামনে কোন বিপদ, বাংলাদেশ কোন রকম বিপদে আছে কিনা, ভারতের শঙ্কিত হওয়ার কিছু আছে কিনা, বিশ্ব রাজনীতি এখন এই অঞ্চলে কোন দাবা খেলবে ... প্রশ্নগুলোর চেয়েও ভয়ঙ্কর বাস্তবতা হলো আফগানিস্তানের জনগণকে এসব ইজম আর পক্ষ-বিপক্ষ গুলে খাওয়ালেও তারা বাঁচবে না। তাদের দরকার খাদ্য। আর তার জন্য প্রতিশ্রুতি নয়, আশ্বাস নয়, ইন্সট্যানটলি দরকার ক্যাশ টাকা, যা দিয়ে খাবার কেনা যাবে। আর খাবারের যথেষ্ট পরিমাণ মজুত। এটায় ব্যর্থ হলে আফগান জনগণ মরতে শুরু করলে ওখানে যে মানবিক বিপর্যয় শুরু হবে এবং তা থেকে যে নৈরাজ্য শুরু হবে তা আগের যে কোন বিপর্যয় থেকেও বড় বিপর্যয়। তা শুধু আফগানিস্তানকে নয় পুরো এই অঞ্চলটাকেও নাড়িয়ে দেবে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]