আদিবাসীদের শ্মশানও দখল হয়ে গেল

মিথুশিলাক মুরমু

দেশে যারা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু রয়েছে, তারা চারদিক থেকে শুনতে পাচ্ছে যে- শান্তি নেই, শান্তি নেই। তাদের জীবনযাপন প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রশ্ন দাঁড়ায়, কে বা কারা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের স্বাভাবিক জীবনচক্রকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে! আমার প্রতিবেশী কি আমার প্রতি বন্ধুবৎসল আচরণ করেন। কিংবা আমার আয়-উন্নতি, অগ্রগতি, ভালো-মন্দের বিষয়টিকে বাঁকা চোখে দেখেন? পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে আমরা শুনেছি- অতীতে দেশে পারস্পারিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, লেনদেন, আস্থা, ভালোবাসা, ধর্মীয় বা জাতিগত ভিন্নতা তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। একে-অপরের অভাব-অভিযোগ, দুর্যোগ অথবা সংকটে পাশে দাঁড়িয়েছে, সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু আজ সেটির কোন কিছুই নেই; নেই মমতাবোধ ও মনুষ্যত্ববোধও।

নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার চন্দননগর এলাকায় শ্মশানের জায়গা দখল করে ফসলের জমি ও পুকুরের আয়তন বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খালেকুজ্জামান ওরফে তোতা। গত ১৪ সেপ্টেম্বর এলাকার আদিবাসীরা এর প্রতিবাদে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং জমি উদ্ধারার্থে নওগাঁ প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন। জানা যায়, চন্দননগর দরগাপাড়া এলাকায় লালমাটি পুকুর নামে একটি সরকারি পুকুর রয়েছে। বহু বছর ধরে স্থানীয় চন্দননগর দরগাপাড়া ও তাতিহার গ্রামের আদিবাসীরা এই পুকুরের উত্তর পাড়ের প্রায় ৬০ শতাংশ জমি মহাশ্মশান হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। প্রায় ১৫/১৬ বছর ধরে সরকারি ওই পুকুরটি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে আসছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও চন্দননগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খালেকুজ্জামান। সম্প্রতি শ্মশান হিসেবে ব্যবহৃত পুকুরপাড় ও তৎসংলগ্ন জমির বেশ কিছু অংশ কেটে পুকুরে পরিণত করেন তিনি। বেশকিছু কবরও পুকুরের মধ্যে চলে গেছে। এতে আদিবাসীরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন।

আদিবাসীরা ওই শ্মশানে স্বজনদের মৃতদেহ সৎকার করতে গেলে সাবেক চেয়ারম্যান ও তার লোকজন আদিবাসীদের বাধা দিয়ে আসছেন। সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেও এ বিষয়ে কোন প্রতিকার পাননি আদিবাসীরা। অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা খালেকুজ্জামান অভিযোগটি অস্বীকার করে সদর্পে বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন। যে জায়গার কথা বলা হচ্ছে, সেটা শ্মশান নয়। ওই জায়গা খাস সম্পত্তি। কোন দিনই ওই জায়গা কবরস্থান কিংবা শ্মশান ছিল না। শ্মশানের জায়গা হলে আমি কোনদিনই জোরজবদস্তি করতাম না। আমি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চন্দননগরের চেয়ারম্যান ছিলাম। কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না আমি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার নষ্ট করেছি।’ বর্তমান চেয়ারম্যান বদিউজ্জামানের বক্তব্যে অবশ্য এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মেলে। তিনি বলেছেন, ‘খালেকুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরেই শ্মশানের জায়গাটি দখলের চেষ্টা করে আসছিলেন। প্রায় তিন মাস আগে শ্মশানের জায়গার একটা বড় অংশ কেটে পুকুরে পরিণত করেন তিনি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেয়ে তিনি দুই পক্ষকে নিয়ে বসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খালেকুজ্জামান সালিশে বসতে রাজি না হওয়ায় বিষয়টি ওই অবস্থাতেই রয়েছে। বিষয়টির দ্রুত একটা সমাধান হওয়া উচিত।’

আওয়ামী লীগ নেতা খালেকুজ্জামান ২০ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি জানেন কোথাকার জমি খাস এবং কোথাকার জমিকে সহজে দখল করা যায়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘদিন এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সেবাদান করেছেন, সুনাম অর্জন করেছেন; তাহলে কেন খাসজমিকে তিনি টার্গেট করলেন। খাসজমির মালিক তো সরকার। একজন মানবতাবাদী নেতা কখনোই স্থানীয় এবং জনসাধারণের অমঙ্গল কামনা করেন না। বিশ^াস করি, যুগ-যুগান্ত সরকারি পুকুরে মাছ চাষ করলেও আদিবাসীরা মাছ চাষে বিঘœ সৃষ্টি করেনি; বরং পুকুরের মাছ যাতে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে অধিক নজরদান করেছে। আদিবাসীরা প্রতিবেশীর ক্ষতি করতে কখনোই উদ্যোত হয়নি, উল্টো তারা উচ্ছেদ, দেশত্যাগের হুমকির শিকার হয়ে থাকেন। ২০ বছর চেয়ারম্যানের অভিজ্ঞতায় খালেকুজ্জামান উপলব্ধি করেছেন, নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় আদিবাসীদের শ্মশানের আশপাশ জায়গাটি দখল এবং দু’একটি কবরও যদি নিশ্চিহ্ন হয়; তারপরেও আদিবাসীরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হবে। চেয়ারম্যানের অনুমানই সঠিক হয়েছে, আদিবাসীরা লাঠিসোঠা নিয়ে উদ্ধার করতে নেমে পড়েনিনি বরং শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন।

দেশের আইনে অর্থাৎ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ২৯৬ বর্ণিত রয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তির অনুভূতিকে আহত করার উদ্দেশ্যে, কিংবা অন্য কোন ব্যক্তির ধর্মের অবমাননা করার উদ্দেশ্যে, অথবা অন্য কোন ব্যক্তির অনুভূতি আহত হতে পারে বা অন্য কোন ব্যক্তির ধর্মের অবমাননা হতে পারে জানা সত্ত্বেও, কোন উপাসনাস্থলে বা সমাধিস্থলে বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের জন্য আলাদাভাবে রক্ষিত স্থান বা মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষ রাখার জন্য আলাদাভাবে রক্ষিত স্থানে অনধিকার প্রবেশ করে, তবে সে ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিদ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’

সাবেক চেয়ারম্যান বক্তব্যকে বর্তমান চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খণ্ডন করেছেন। স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, সাবেক চেয়ারম্যান অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং দেশবিরোধী, আইনবিরোধী কাজ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যকে ক্ষুণ্ণ করে বিচ্ছিন্নতাকে উসকে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ঘ. তে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা।’ ৭. ‘নর-নারী, ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান এবং তাদের উন্নত জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ প্রদান’। ৮. ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সাধন’। এবং ১০.৩-এ বর্ণিত রয়েছে- সকল ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে স্ব স্ব ধর্ম পালন করতে পারবে। রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না এবং কোন উপাসনালয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আলোচনা চলবে না। কোন ধর্ম, সম্প্রদায় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কখনও কোন অবস্থান নেয়া যাবে না। ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে। ধর্মীয় বিশ^াসের কারণে সব ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা প্রতিহত এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে’। তাহলে একজন আওয়ামী লীগ নেতার এহেন কর্মকাণ্ড কী দলীয় সর্বোপরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থি নয়!

দেশের স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বরাবরই উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে। নওগাঁর নিয়ামতপুর পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা সত্যিই সন্দেহজনক। তাহলে কী প্রশাসনের বিবেক অবরুদ্ধ হয়ে গেছে! ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে! একজন নাগরিক আইনের আশ্রয় নেবে, ন্যায্য বিচার প্রাপ্তি সহযোগিতা করবে প্রশাসন, বোধকরি এটিই তো হওয়া দরকার। কিন্তু কেন বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপ্রত্তি, অর্থ বৈভব নাকি অন্য কিছু! আইনের প্রতি আদিবাসীদের যে শ্রদ্ধা, আস্থা ও ভালোবাসা রয়েছে, সেটি যেন হারিয়ে না যায়। আইনের প্রতি আস্থা হারানোর নৈতিক দায়ভার প্রশাসন এড়িয়ে যেতে পারে না।

আদিবাসীরা কোথায় শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পাদন করবে? এটি তো দেশের জন্য লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। একজন বিবেকবান মানুষ কখনোই জনসাধারণের ব্যবহৃত খাসজমিকে দখল করতে পারেন না। তিনিই তো আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা বা খাসজমি শ্মশান হিসেবে ব্যবহারের পথ বাতলে দিতে পারতেন! যেহেতু তিনি সরকারি খাস দখল করেছেন, আইন অমান্য করেছেন; আইনের মুখোমুখি করা আবশ্যিক। আমাদের প্রত্যাশা হলো- আদিবাসীরা বংশপরম্পরায় যে খাস জায়গাটিকে শ্মশান হিসেবে ব্যবহার করে আসছে, সেটিকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। জীবনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পাদন যেন শান্তিপূর্ণ, ভক্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে হতে পারে।

সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ , ৫ আশ্বিন ১৪২৮ ১১ সফর ১৪৪৩

আদিবাসীদের শ্মশানও দখল হয়ে গেল

মিথুশিলাক মুরমু

দেশে যারা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু রয়েছে, তারা চারদিক থেকে শুনতে পাচ্ছে যে- শান্তি নেই, শান্তি নেই। তাদের জীবনযাপন প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রশ্ন দাঁড়ায়, কে বা কারা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের স্বাভাবিক জীবনচক্রকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে! আমার প্রতিবেশী কি আমার প্রতি বন্ধুবৎসল আচরণ করেন। কিংবা আমার আয়-উন্নতি, অগ্রগতি, ভালো-মন্দের বিষয়টিকে বাঁকা চোখে দেখেন? পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে আমরা শুনেছি- অতীতে দেশে পারস্পারিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, লেনদেন, আস্থা, ভালোবাসা, ধর্মীয় বা জাতিগত ভিন্নতা তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। একে-অপরের অভাব-অভিযোগ, দুর্যোগ অথবা সংকটে পাশে দাঁড়িয়েছে, সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু আজ সেটির কোন কিছুই নেই; নেই মমতাবোধ ও মনুষ্যত্ববোধও।

নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার চন্দননগর এলাকায় শ্মশানের জায়গা দখল করে ফসলের জমি ও পুকুরের আয়তন বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খালেকুজ্জামান ওরফে তোতা। গত ১৪ সেপ্টেম্বর এলাকার আদিবাসীরা এর প্রতিবাদে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং জমি উদ্ধারার্থে নওগাঁ প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন। জানা যায়, চন্দননগর দরগাপাড়া এলাকায় লালমাটি পুকুর নামে একটি সরকারি পুকুর রয়েছে। বহু বছর ধরে স্থানীয় চন্দননগর দরগাপাড়া ও তাতিহার গ্রামের আদিবাসীরা এই পুকুরের উত্তর পাড়ের প্রায় ৬০ শতাংশ জমি মহাশ্মশান হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। প্রায় ১৫/১৬ বছর ধরে সরকারি ওই পুকুরটি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে আসছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও চন্দননগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খালেকুজ্জামান। সম্প্রতি শ্মশান হিসেবে ব্যবহৃত পুকুরপাড় ও তৎসংলগ্ন জমির বেশ কিছু অংশ কেটে পুকুরে পরিণত করেন তিনি। বেশকিছু কবরও পুকুরের মধ্যে চলে গেছে। এতে আদিবাসীরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন।

আদিবাসীরা ওই শ্মশানে স্বজনদের মৃতদেহ সৎকার করতে গেলে সাবেক চেয়ারম্যান ও তার লোকজন আদিবাসীদের বাধা দিয়ে আসছেন। সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেও এ বিষয়ে কোন প্রতিকার পাননি আদিবাসীরা। অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা খালেকুজ্জামান অভিযোগটি অস্বীকার করে সদর্পে বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন। যে জায়গার কথা বলা হচ্ছে, সেটা শ্মশান নয়। ওই জায়গা খাস সম্পত্তি। কোন দিনই ওই জায়গা কবরস্থান কিংবা শ্মশান ছিল না। শ্মশানের জায়গা হলে আমি কোনদিনই জোরজবদস্তি করতাম না। আমি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চন্দননগরের চেয়ারম্যান ছিলাম। কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না আমি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অধিকার নষ্ট করেছি।’ বর্তমান চেয়ারম্যান বদিউজ্জামানের বক্তব্যে অবশ্য এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মেলে। তিনি বলেছেন, ‘খালেকুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরেই শ্মশানের জায়গাটি দখলের চেষ্টা করে আসছিলেন। প্রায় তিন মাস আগে শ্মশানের জায়গার একটা বড় অংশ কেটে পুকুরে পরিণত করেন তিনি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেয়ে তিনি দুই পক্ষকে নিয়ে বসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খালেকুজ্জামান সালিশে বসতে রাজি না হওয়ায় বিষয়টি ওই অবস্থাতেই রয়েছে। বিষয়টির দ্রুত একটা সমাধান হওয়া উচিত।’

আওয়ামী লীগ নেতা খালেকুজ্জামান ২০ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি জানেন কোথাকার জমি খাস এবং কোথাকার জমিকে সহজে দখল করা যায়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘদিন এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সেবাদান করেছেন, সুনাম অর্জন করেছেন; তাহলে কেন খাসজমিকে তিনি টার্গেট করলেন। খাসজমির মালিক তো সরকার। একজন মানবতাবাদী নেতা কখনোই স্থানীয় এবং জনসাধারণের অমঙ্গল কামনা করেন না। বিশ^াস করি, যুগ-যুগান্ত সরকারি পুকুরে মাছ চাষ করলেও আদিবাসীরা মাছ চাষে বিঘœ সৃষ্টি করেনি; বরং পুকুরের মাছ যাতে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে অধিক নজরদান করেছে। আদিবাসীরা প্রতিবেশীর ক্ষতি করতে কখনোই উদ্যোত হয়নি, উল্টো তারা উচ্ছেদ, দেশত্যাগের হুমকির শিকার হয়ে থাকেন। ২০ বছর চেয়ারম্যানের অভিজ্ঞতায় খালেকুজ্জামান উপলব্ধি করেছেন, নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় আদিবাসীদের শ্মশানের আশপাশ জায়গাটি দখল এবং দু’একটি কবরও যদি নিশ্চিহ্ন হয়; তারপরেও আদিবাসীরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হবে। চেয়ারম্যানের অনুমানই সঠিক হয়েছে, আদিবাসীরা লাঠিসোঠা নিয়ে উদ্ধার করতে নেমে পড়েনিনি বরং শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন।

দেশের আইনে অর্থাৎ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ২৯৬ বর্ণিত রয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তির অনুভূতিকে আহত করার উদ্দেশ্যে, কিংবা অন্য কোন ব্যক্তির ধর্মের অবমাননা করার উদ্দেশ্যে, অথবা অন্য কোন ব্যক্তির অনুভূতি আহত হতে পারে বা অন্য কোন ব্যক্তির ধর্মের অবমাননা হতে পারে জানা সত্ত্বেও, কোন উপাসনাস্থলে বা সমাধিস্থলে বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের জন্য আলাদাভাবে রক্ষিত স্থান বা মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষ রাখার জন্য আলাদাভাবে রক্ষিত স্থানে অনধিকার প্রবেশ করে, তবে সে ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে অথবা উভয়বিদ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’

সাবেক চেয়ারম্যান বক্তব্যকে বর্তমান চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খণ্ডন করেছেন। স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, সাবেক চেয়ারম্যান অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং দেশবিরোধী, আইনবিরোধী কাজ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্যকে ক্ষুণ্ণ করে বিচ্ছিন্নতাকে উসকে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ঘ. তে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা।’ ৭. ‘নর-নারী, ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান এবং তাদের উন্নত জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ প্রদান’। ৮. ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সাধন’। এবং ১০.৩-এ বর্ণিত রয়েছে- সকল ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে স্ব স্ব ধর্ম পালন করতে পারবে। রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না এবং কোন উপাসনালয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আলোচনা চলবে না। কোন ধর্ম, সম্প্রদায় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কখনও কোন অবস্থান নেয়া যাবে না। ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে। ধর্মীয় বিশ^াসের কারণে সব ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা প্রতিহত এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে’। তাহলে একজন আওয়ামী লীগ নেতার এহেন কর্মকাণ্ড কী দলীয় সর্বোপরি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থি নয়!

দেশের স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বরাবরই উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে। নওগাঁর নিয়ামতপুর পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা সত্যিই সন্দেহজনক। তাহলে কী প্রশাসনের বিবেক অবরুদ্ধ হয়ে গেছে! ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে! একজন নাগরিক আইনের আশ্রয় নেবে, ন্যায্য বিচার প্রাপ্তি সহযোগিতা করবে প্রশাসন, বোধকরি এটিই তো হওয়া দরকার। কিন্তু কেন বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপ্রত্তি, অর্থ বৈভব নাকি অন্য কিছু! আইনের প্রতি আদিবাসীদের যে শ্রদ্ধা, আস্থা ও ভালোবাসা রয়েছে, সেটি যেন হারিয়ে না যায়। আইনের প্রতি আস্থা হারানোর নৈতিক দায়ভার প্রশাসন এড়িয়ে যেতে পারে না।

আদিবাসীরা কোথায় শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পাদন করবে? এটি তো দেশের জন্য লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। একজন বিবেকবান মানুষ কখনোই জনসাধারণের ব্যবহৃত খাসজমিকে দখল করতে পারেন না। তিনিই তো আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা বা খাসজমি শ্মশান হিসেবে ব্যবহারের পথ বাতলে দিতে পারতেন! যেহেতু তিনি সরকারি খাস দখল করেছেন, আইন অমান্য করেছেন; আইনের মুখোমুখি করা আবশ্যিক। আমাদের প্রত্যাশা হলো- আদিবাসীরা বংশপরম্পরায় যে খাস জায়গাটিকে শ্মশান হিসেবে ব্যবহার করে আসছে, সেটিকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। জীবনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পাদন যেন শান্তিপূর্ণ, ভক্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে হতে পারে।