হাওরে পানি কমায় পর্যটকে ভাটা : আয় কমেছে মাঝিদের

গত তিন-চার বছর ধরে দেশের অন্যতম ব্যস্ত পর্যটন এলাকার গুরুত্ব পাচ্ছে কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চল। তবে এখানে প্রধানত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ভরা বর্ষাকালে পর্যটকদের ব্যাপক সমাগম লক্ষ্য করা যায়। তখন হাওরে ছড়িয়ে থাকা ২৫টি নদীর আলাদা কোন অস্তিত্ব বোঝা যায় না। বর্ষার পানিতে নদীগুলোর পাড় ডুবে পুরো হাওরাঞ্চল একাকার হয়ে যায়। তখন আলাদা কোন নৌপথেরও অস্তিত্ব থাকে না। পুরো হাওর জুড়েই ছুটে চলে ছোটবড় সব নৌযান। এই তিন মাস দিগন্ত জোড়া হাওরাঞ্চল অথৈ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে সগরের রূপ ধারণ করে। হাওরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অপর প্রান্তে তাকালে কোন গ্রামের চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়বে না। মনে হবে যেন অপর প্রান্তে হাওরের স্বচ্ছ পানিতে মাথা ঢুকিয়ে অবগাহন করছে নীলাকাশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হাওরের অলসিজন বা অলওয়েদার সড়ক। এসবের আকর্ষণেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার পর্যটক। এখন হাওরে ভাটার টান পড়েছে। পানি কমে যাচ্ছে। ফলে পর্যটকদের আনাগোনাও অনেক কমে গেছে। ভরা বর্ষায় পর্যটকদের নিয়ে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা পুরো হাওর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াতো। এখন ভাটার টানে অধিকাংশ নৌকাই ঘাটে নোঙর ফেলে অলস বসে থাকে। তবে হাওরাঞ্চলকে সরকারিভাবে একটি অনন্য পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা এবং একটি উড়াল সেতুর কথা ভাবা হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গভীর হাওরের বুক চিরে তৈরি হয়েছে প্রায় ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম সংযোগ সড়ক। এর সুদৃশ্য জিরো পয়েন্ট নির্মিত হয়েছে মিঠামইন প্রান্তে। আর এবার থেকে মিঠামইনে চালু হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নামে পর্যটকদের দৃষ্টিনন্দন আবাসন পল্লী। অনেক পর্যটক পরিবার নিয়ে এখানে অবস্থান করে দু’তিন দিন হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। কারণ, বিশাল এ হাওর একদিনে দেখে এর কূলকিনারা বোঝার কারও সাধ্য নেই। আর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে এই হাওরের বুকে সড়কের নয়নাভিরাম দৃশ্য আর প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের সৌন্দর্য প্রচার হবার কারণেই মূলত বিভিন্ন এলাকার পর্যটকরা ছুটে আসছেন। তারা প্রধানত নিকলীর বেড়িবাঁধ এবং করিমগঞ্জের বালিখলা ঘাট থেকেই গভীর হাওরের উদ্দেশ্যে নৌভ্রমণে বের হন। ধারণ ক্ষমতা ভেদে একেকটি নৌকা ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকায় দিনব্যাপী ভাড়া হয়। এর ফলে হাওরাঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ যেখানে এক সময় বছরের ৬ মাস বেকার জীবন কাটাতো, তাদের এক ধরনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। স্থানীয় হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও ব্যবসা বেড়েছে।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই হাওরের পানিতে ভাটার টান পড়ে। স্থানে বিশাল বিশাল চরের মত ফসলি জমিগুলো ভেসে ওঠে। পানির উচ্চতা কমে গিয়ে নদীর পাড়গুলোও ভেসে ওঠে। তখন হাওরের সাগরসম চেহারাটা যেন কোথায় হারিয়ে যায়। ফলে পর্যটকদের আকর্ষণেও ভাটার টান পড়ে। যে কারণে শত শত নৌযানের আয়রোজগারেও তখন ভাটা পড়ে যায়। এসময় অল্প সংখ্যক পর্যটক আসলে তাদের নিয়ে এক ধরনের কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। এসময় নৌযানগুলোর ভাড়াও অনেক কমে যায়। ঘাটের দোকানপাটেও মন্দা নেমে আসে।

জেলা শহরের সঙ্গে হাওরের অলসিজন সড়কের সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি উড়াল সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। সড়ক ও সেতু বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। আর এটি মিঠামইন সদর থেকে মিঠামইনে বাস্তবায়নাধীন সেনানিবাস হয়ে করিমগঞ্জের মরিচখালী এলাকায় কিশোরগঞ্জ-মরিচখালী সড়কে এসে যুক্ত হবে।

এটি নির্মাণ হলে তখন সারা বছরই গাড়ি হাঁকিয়ে হাওরে বেড়ানো যাবে। বর্ষাকালে নৌভ্রমণ, আর শুষ্ক মৌসুমে গাড়ি ভ্রমণের মাধ্যমে হাওরের নানামাত্রিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। কারণ বর্ষাকালের পর্যটকরা কেবল হাওরের একটি রূপ দেখতে পান। বছরের অন্যান্য মৌসুমে একেক সময় হাওরের রূপ বৈচিত্র্যে একেক রকম পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বর্ষার পানি নেমে যাবার পর দেখা যাবে মাছ শিকারের মহোৎসব। এদিকে পর্যটন কর্পোরেশনও হাওরাঞ্চলকে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশের হাওর সমৃদ্ধ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকসহ সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কয়েক দফা ভার্চুয়াল সভাও করেছে। মন্ত্রী, সচিব এবং পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়াম্যানসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ হাওরের পর্যটন সম্ভাবনা এবং সরকরের পদক্ষেপ নিয়ে ভার্চুয়াল সভায় ধারণা দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞ দল এসে হাওরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনও করে গেছে। ফলে একটি বহুমুখী পর্যটন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই বিশাল হাওরাঞ্চল হয়ে উঠবে বিশ্বের বুকে নতুন ধরনের লোকেশনের এক অনন্য পর্যটন এলাকা।

রবিবার, ১০ অক্টোবর ২০২১ , ২৫ আশ্বিন ১৪২৮ ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

হাওরে পানি কমায় পর্যটকে ভাটা : আয় কমেছে মাঝিদের

মোস্তফা কামাল, কিশোরগঞ্জ

image

কিশোরগঞ্জ : পর্যটক না থাকায় বালিখলা ঘাটে বেঁধে রাখা সারিবদ্ধ নৌকা -সংবাদ

গত তিন-চার বছর ধরে দেশের অন্যতম ব্যস্ত পর্যটন এলাকার গুরুত্ব পাচ্ছে কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চল। তবে এখানে প্রধানত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ভরা বর্ষাকালে পর্যটকদের ব্যাপক সমাগম লক্ষ্য করা যায়। তখন হাওরে ছড়িয়ে থাকা ২৫টি নদীর আলাদা কোন অস্তিত্ব বোঝা যায় না। বর্ষার পানিতে নদীগুলোর পাড় ডুবে পুরো হাওরাঞ্চল একাকার হয়ে যায়। তখন আলাদা কোন নৌপথেরও অস্তিত্ব থাকে না। পুরো হাওর জুড়েই ছুটে চলে ছোটবড় সব নৌযান। এই তিন মাস দিগন্ত জোড়া হাওরাঞ্চল অথৈ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে সগরের রূপ ধারণ করে। হাওরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অপর প্রান্তে তাকালে কোন গ্রামের চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়বে না। মনে হবে যেন অপর প্রান্তে হাওরের স্বচ্ছ পানিতে মাথা ঢুকিয়ে অবগাহন করছে নীলাকাশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হাওরের অলসিজন বা অলওয়েদার সড়ক। এসবের আকর্ষণেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার পর্যটক। এখন হাওরে ভাটার টান পড়েছে। পানি কমে যাচ্ছে। ফলে পর্যটকদের আনাগোনাও অনেক কমে গেছে। ভরা বর্ষায় পর্যটকদের নিয়ে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা পুরো হাওর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াতো। এখন ভাটার টানে অধিকাংশ নৌকাই ঘাটে নোঙর ফেলে অলস বসে থাকে। তবে হাওরাঞ্চলকে সরকারিভাবে একটি অনন্য পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা এবং একটি উড়াল সেতুর কথা ভাবা হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গভীর হাওরের বুক চিরে তৈরি হয়েছে প্রায় ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম সংযোগ সড়ক। এর সুদৃশ্য জিরো পয়েন্ট নির্মিত হয়েছে মিঠামইন প্রান্তে। আর এবার থেকে মিঠামইনে চালু হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নামে পর্যটকদের দৃষ্টিনন্দন আবাসন পল্লী। অনেক পর্যটক পরিবার নিয়ে এখানে অবস্থান করে দু’তিন দিন হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। কারণ, বিশাল এ হাওর একদিনে দেখে এর কূলকিনারা বোঝার কারও সাধ্য নেই। আর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে এই হাওরের বুকে সড়কের নয়নাভিরাম দৃশ্য আর প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের সৌন্দর্য প্রচার হবার কারণেই মূলত বিভিন্ন এলাকার পর্যটকরা ছুটে আসছেন। তারা প্রধানত নিকলীর বেড়িবাঁধ এবং করিমগঞ্জের বালিখলা ঘাট থেকেই গভীর হাওরের উদ্দেশ্যে নৌভ্রমণে বের হন। ধারণ ক্ষমতা ভেদে একেকটি নৌকা ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকায় দিনব্যাপী ভাড়া হয়। এর ফলে হাওরাঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ যেখানে এক সময় বছরের ৬ মাস বেকার জীবন কাটাতো, তাদের এক ধরনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। স্থানীয় হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও ব্যবসা বেড়েছে।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই হাওরের পানিতে ভাটার টান পড়ে। স্থানে বিশাল বিশাল চরের মত ফসলি জমিগুলো ভেসে ওঠে। পানির উচ্চতা কমে গিয়ে নদীর পাড়গুলোও ভেসে ওঠে। তখন হাওরের সাগরসম চেহারাটা যেন কোথায় হারিয়ে যায়। ফলে পর্যটকদের আকর্ষণেও ভাটার টান পড়ে। যে কারণে শত শত নৌযানের আয়রোজগারেও তখন ভাটা পড়ে যায়। এসময় অল্প সংখ্যক পর্যটক আসলে তাদের নিয়ে এক ধরনের কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। এসময় নৌযানগুলোর ভাড়াও অনেক কমে যায়। ঘাটের দোকানপাটেও মন্দা নেমে আসে।

জেলা শহরের সঙ্গে হাওরের অলসিজন সড়কের সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি উড়াল সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। সড়ক ও সেতু বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। আর এটি মিঠামইন সদর থেকে মিঠামইনে বাস্তবায়নাধীন সেনানিবাস হয়ে করিমগঞ্জের মরিচখালী এলাকায় কিশোরগঞ্জ-মরিচখালী সড়কে এসে যুক্ত হবে।

এটি নির্মাণ হলে তখন সারা বছরই গাড়ি হাঁকিয়ে হাওরে বেড়ানো যাবে। বর্ষাকালে নৌভ্রমণ, আর শুষ্ক মৌসুমে গাড়ি ভ্রমণের মাধ্যমে হাওরের নানামাত্রিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। কারণ বর্ষাকালের পর্যটকরা কেবল হাওরের একটি রূপ দেখতে পান। বছরের অন্যান্য মৌসুমে একেক সময় হাওরের রূপ বৈচিত্র্যে একেক রকম পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বর্ষার পানি নেমে যাবার পর দেখা যাবে মাছ শিকারের মহোৎসব। এদিকে পর্যটন কর্পোরেশনও হাওরাঞ্চলকে একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশের হাওর সমৃদ্ধ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকসহ সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কয়েক দফা ভার্চুয়াল সভাও করেছে। মন্ত্রী, সচিব এবং পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়াম্যানসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ হাওরের পর্যটন সম্ভাবনা এবং সরকরের পদক্ষেপ নিয়ে ভার্চুয়াল সভায় ধারণা দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞ দল এসে হাওরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনও করে গেছে। ফলে একটি বহুমুখী পর্যটন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই বিশাল হাওরাঞ্চল হয়ে উঠবে বিশ্বের বুকে নতুন ধরনের লোকেশনের এক অনন্য পর্যটন এলাকা।