ময়না তদন্ত, স্থানীয় পুলিশ বলছে আত্মহত্যা, পরে পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে এলো খুন

ঘটনা ২০১৬ সালের। রাজশাহীর বোয়ালমারিতে। এক যুবক ও এক যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায় সেখানকার হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে। যুবকের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল। আর নারীর লাশ বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল।

ঘটনার পর মামলাও হয়েছিল। মামলাটির বাদী একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি ওই মৃত তরুণীর বাবা। ওই সময় তিনি গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত ছিলেন।

মৃতদেহের ময়না তদন্ত হলো, তাতে বলা হলো আত্মহত্যা। পুলিশও তদন্ত করল। আর তারপর থানা পুলিশÑ‘কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায়’ –ঐ ময়না তদন্তের ওপর ‘ভিত্তি করেই’ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দিলÑআতœহত্যা।

কিন্তু থানা পুলিশের প্রতিবেদনে আদালত সন্তুষ্ট না হওয়ায় মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআইকে তদন্তের আদেশ দেয়। পিবিআইয়ের তদন্ত টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বেশ কিছুদিন পর রাজশাহী জেলার পিবিআই তদন্ত করে দেখল ওটা ছিল হত্যাকা-। ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ওই দুই খুন। সাবেক প্রেমিক ও তার সহযোগী/বন্ধুরা মিলে পরিকল্পিত ভাবে হত্যাকা- ঘটিয়েছে।

মামলার বাদী গোয়েন্দা কর্মকর্তার মেয়ে সুমাইয়া নাসরিন ও তার বন্ধু মিজানুর রহমান। তারা সেদিন হোটেল নাইস ইণ্টারন্যাশনালে ছিলেন। আর এ খবর পেয়ে সুমাইয়ার সাবেক প্রেমিক ও তার বন্ধুসহ কয়েকজন ওই হোটেলে যান। তারা গোপনে খবর পেয়ে পরিকল্পিত ভাবে হোটেল নাইসের পাশের একটি ভবনের ছাদ দিয়ে একটু নিচে নেমে হোটেলের জানালা খুলে তাদের কক্ষে ঢুকে। ওই সময় মিজান হোটেলের বাইরে ছিল। আর সুমাইয়া হোটেল রুমে অবস্থান করছিল। তখন অভিযুক্তরা সুমাইয়াকে দিয়ে মিজানকে ফোন করে। মিজান সুমাইয়ার ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি হোটেলে গিয়ে রুমে ঢুকলে অভিযুক্তরা সুমাইয়ার বন্ধু মিজানকে জাপটে ধরে। এরপর হোটেল রুমে সুমাইয়ার সামনে মিজানকে প্রচ- মারপিট করে। একপর্যায়ে রুমের ভিতরে সুমাইয়ার ওড়না নিয়ে মিজানের গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে। মিজানের লাশ ফেলে রেখে হোটেল কক্ষে অভিযুক্ত রাহাত ও আল-আমিন সুমাইয়াকে ধর্ষণ করে। এরপর তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। দুজনকে হত্যার পর মিজানের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। আর সুমাইয়ার লাশ হোটেলে বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। এ সবই বেরিয়ে এসেছে পিবিআইয়ের তদন্তে। পিবিআই আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৪ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

গ্রেফতারকৃতরা হলো, সুমাইয়ার বন্ধু আল-আমিন, বোরহানুল কবির, আহসান হাবিব ও রাহাত মাহমুদ। তারা সবাই ওই সময় ছাত্র ছিল।

শুধু এই ঘটনাই নয়, এরকম ১৩টি ‘আত্মহত্যার’ ঘটনার অধিকতর তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই দেখছে ওগুলো সবগুলোই ছিল হত্যাকা-। তারা অনেক অপরাধীকেই গ্রেফতার করেছে ও হত্যাকা-ে ব্যবহৃত আলামত জব্দ করেছে। আর এসব মামলার অনেক অভিযুক্তই আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাছের সঙ্গে রশিতে ঝুলন্ত একটি লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ত্রিশাল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

এ ঘটনায়ও ময়না তদন্তে বলা হয় এটা আত্মহত্যা। এ মামলার বাদীর অভিযোগ থাকার পরও থানা পুলিশ নিয়মিত বা অপমৃত্যুর মামলা না নিয়ে সাধারণ ডাইরি (জিডি) নিয়ে ময়না তদন্তের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঘটনার নিষ্পত্তি করে।

আদালত থানা পুলিশের প্রতিবেদন গ্রহণ না করে নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দেয়। ত্রিশাল থানা মামলাটি তদন্ত শুরু করেছিল। তবে বাদী থানা পুলিশের তদন্তে অনাস্থা পোষণ করলে আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। পিবিআইয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত মেম্বার পদপ্রার্থী কাইয়ুমসহ ১১ জন মিলে ঘটনার দিন রাতে মোনায়েম মেম্বারকে স্থানীয় তারা মিয়া ওরফে তারুর বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে। পরে লাশ গাছের ডালে রশিতে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে।

রাজনৈতিক ও পূর্বশত্রুতার জেরে ওই হত্যাকা-। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে মোনায়েম মেম্বারকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে গলা টিপে হত্যা করে তার প্রতিপক্ষ। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় ময়না তদন্ত করতে গিয়ে চিকিৎসক তার প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ঘটনাটি আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু বলে উল্লেখ করেছেন।

এ ঘটনায় পিবিআই ৫ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। এরমধ্যে তিনজন আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। পিবিআই এই হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অটোরিকশা (সিএনজি) ও অন্যান্য আলামত উদ্ধার করেছে। পিবিআই তদন্ত শেষে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিটও দিয়েছে।

এভাবে বগুড়া জেলার শেরপুর থানার একটি মামলা, ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানার একটি মামলা, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার চকবাজার থানার একটি মামলা, গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার একটি মামলা, শ্রীপুর মডেল থানার একটি মামলা, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানার একটি মামলা, ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানার একটি মামলা, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার একটি মামলা, টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর থানার একটি মামলা, রংপুরের একটি মামলা ও গোপালগঞ্জ জেলার একটিসহ এই ধরনের ১৩টি মামলা পিবিআইয়ের তদন্তে রহস্য উদঘাটন ও হত্যা মামলা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এসব মামলায় ময়না তদন্তে আত্মহত্যা বলা হলেও পিবিআইয়ের তদন্তে পরিকল্পিত খুন বলে প্রমাণ হয়েছে।

পিবিআই কর্তৃপক্ষ তাদের মতামতে বলেছে, “ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের ফরেনসিক বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। ময়না তদন্ত করতে পারবে ওই সব ডাক্তারদের কী কী প্রশিক্ষণ থাকা দরকার সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার।”

“ময়না তদন্ত যেহেতু একটি বিশেষ ধরনের আইনগত দায়িত্ব এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক সাক্ষ্য Ñ এ কাজের গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আলাদা স্থান দরকার। ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতালে একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আবশ্যই থাকতে হবে। আর ময়না তদন্ত রিপোর্ট পেতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়। এতে মামলার তদন্তের ধারাবাহিকতায় বিঘœ ঘটে।”

বলা হয়, ময়না তদন্তে ডাক্তাররা ডোমদের সাহায্য নিয়ে থাকেন। অথচ ডোমদের দায়িত্ব ময়না তদন্তের জন্য মৃতদেহ প্রস্তুত করে ডাক্তারের কাছে উপস্থাপন করা। কোন কোন ক্ষেত্রে ময়না তদন্তের পর রাসায়নিক পরীক্ষকের মতামত ভিন্ন হলে সেক্ষেত্রে বিশেষ বোর্ড গঠন করে চূড়ান্ত মতামত নেয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে ময়না তদন্ত রিপোর্ট বা পোস্টমর্টেম রিপোর্টের পাশাপাশি অন্যান্য তদন্ত সহায়ক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে সঠিক, বস্তনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার তার লিখিত প্রতিবেদনে বলেছেন, “সঠিক ময়না তদন্ত না হওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রধান কারণ হলো ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের ফরেনসিক এর ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনা না থাকা। তদন্তের ক্ষেত্রে সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর পিবিআইয়ের টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বাদী-বিবাদীসহ সবার সঙ্গে কথা বলে মামলার ক্লু উদঘাটন করেছে।

একজন অভিজ্ঞ ডোম সংবাদকে জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা ডোম ছিল। তাদের কাছ থেকে এবং জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখে এখন ডোম হিসেবে কাজ করছেন। তাদের আলাদা কোন প্রশিক্ষণ নেই। তার মতে ঢাকায় ময়না তদন্ত ভালো হলেও ঢাকার বাইরে সমস্যা হচ্ছে। সেখানে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের অভাব রয়েছে।

একজন সাবেক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সংবাদকে বলেন, “ময়না তদন্তের ইনভেস্টিগেশন ঠিকমতো না হওয়ায় বা ত্রুটি থাকায় সমস্যা হচ্ছে। আগে ময়না তদন্ত ছাড়াও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সব কিছু বিবেচনা করে প্রতিবেদন দিত। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। যার কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। আর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের অভাবও রয়েছে। জেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ নেই। কলেজগুলোতে বিশেষজ্ঞ থাকলেও জেলা হাসপাতালে নেই। সেখানে ত্রুটি হতে পারে।”

রবিবার, ১০ অক্টোবর ২০২১ , ২৫ আশ্বিন ১৪২৮ ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

ময়না তদন্ত, স্থানীয় পুলিশ বলছে আত্মহত্যা, পরে পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে এলো খুন

বাকী বিল্লাহ

ঘটনা ২০১৬ সালের। রাজশাহীর বোয়ালমারিতে। এক যুবক ও এক যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায় সেখানকার হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে। যুবকের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল। আর নারীর লাশ বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল।

ঘটনার পর মামলাও হয়েছিল। মামলাটির বাদী একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি ওই মৃত তরুণীর বাবা। ওই সময় তিনি গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত ছিলেন।

মৃতদেহের ময়না তদন্ত হলো, তাতে বলা হলো আত্মহত্যা। পুলিশও তদন্ত করল। আর তারপর থানা পুলিশÑ‘কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায়’ –ঐ ময়না তদন্তের ওপর ‘ভিত্তি করেই’ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দিলÑআতœহত্যা।

কিন্তু থানা পুলিশের প্রতিবেদনে আদালত সন্তুষ্ট না হওয়ায় মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআইকে তদন্তের আদেশ দেয়। পিবিআইয়ের তদন্ত টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বেশ কিছুদিন পর রাজশাহী জেলার পিবিআই তদন্ত করে দেখল ওটা ছিল হত্যাকা-। ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ওই দুই খুন। সাবেক প্রেমিক ও তার সহযোগী/বন্ধুরা মিলে পরিকল্পিত ভাবে হত্যাকা- ঘটিয়েছে।

মামলার বাদী গোয়েন্দা কর্মকর্তার মেয়ে সুমাইয়া নাসরিন ও তার বন্ধু মিজানুর রহমান। তারা সেদিন হোটেল নাইস ইণ্টারন্যাশনালে ছিলেন। আর এ খবর পেয়ে সুমাইয়ার সাবেক প্রেমিক ও তার বন্ধুসহ কয়েকজন ওই হোটেলে যান। তারা গোপনে খবর পেয়ে পরিকল্পিত ভাবে হোটেল নাইসের পাশের একটি ভবনের ছাদ দিয়ে একটু নিচে নেমে হোটেলের জানালা খুলে তাদের কক্ষে ঢুকে। ওই সময় মিজান হোটেলের বাইরে ছিল। আর সুমাইয়া হোটেল রুমে অবস্থান করছিল। তখন অভিযুক্তরা সুমাইয়াকে দিয়ে মিজানকে ফোন করে। মিজান সুমাইয়ার ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি হোটেলে গিয়ে রুমে ঢুকলে অভিযুক্তরা সুমাইয়ার বন্ধু মিজানকে জাপটে ধরে। এরপর হোটেল রুমে সুমাইয়ার সামনে মিজানকে প্রচ- মারপিট করে। একপর্যায়ে রুমের ভিতরে সুমাইয়ার ওড়না নিয়ে মিজানের গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে। মিজানের লাশ ফেলে রেখে হোটেল কক্ষে অভিযুক্ত রাহাত ও আল-আমিন সুমাইয়াকে ধর্ষণ করে। এরপর তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। দুজনকে হত্যার পর মিজানের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। আর সুমাইয়ার লাশ হোটেলে বিছানায় বালিশ চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। এ সবই বেরিয়ে এসেছে পিবিআইয়ের তদন্তে। পিবিআই আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৪ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

গ্রেফতারকৃতরা হলো, সুমাইয়ার বন্ধু আল-আমিন, বোরহানুল কবির, আহসান হাবিব ও রাহাত মাহমুদ। তারা সবাই ওই সময় ছাত্র ছিল।

শুধু এই ঘটনাই নয়, এরকম ১৩টি ‘আত্মহত্যার’ ঘটনার অধিকতর তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই দেখছে ওগুলো সবগুলোই ছিল হত্যাকা-। তারা অনেক অপরাধীকেই গ্রেফতার করেছে ও হত্যাকা-ে ব্যবহৃত আলামত জব্দ করেছে। আর এসব মামলার অনেক অভিযুক্তই আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাছের সঙ্গে রশিতে ঝুলন্ত একটি লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ত্রিশাল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

এ ঘটনায়ও ময়না তদন্তে বলা হয় এটা আত্মহত্যা। এ মামলার বাদীর অভিযোগ থাকার পরও থানা পুলিশ নিয়মিত বা অপমৃত্যুর মামলা না নিয়ে সাধারণ ডাইরি (জিডি) নিয়ে ময়না তদন্তের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঘটনার নিষ্পত্তি করে।

আদালত থানা পুলিশের প্রতিবেদন গ্রহণ না করে নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দেয়। ত্রিশাল থানা মামলাটি তদন্ত শুরু করেছিল। তবে বাদী থানা পুলিশের তদন্তে অনাস্থা পোষণ করলে আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। পিবিআইয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত মেম্বার পদপ্রার্থী কাইয়ুমসহ ১১ জন মিলে ঘটনার দিন রাতে মোনায়েম মেম্বারকে স্থানীয় তারা মিয়া ওরফে তারুর বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে। পরে লাশ গাছের ডালে রশিতে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে।

রাজনৈতিক ও পূর্বশত্রুতার জেরে ওই হত্যাকা-। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে মোনায়েম মেম্বারকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে গলা টিপে হত্যা করে তার প্রতিপক্ষ। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় ময়না তদন্ত করতে গিয়ে চিকিৎসক তার প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ঘটনাটি আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু বলে উল্লেখ করেছেন।

এ ঘটনায় পিবিআই ৫ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। এরমধ্যে তিনজন আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। পিবিআই এই হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অটোরিকশা (সিএনজি) ও অন্যান্য আলামত উদ্ধার করেছে। পিবিআই তদন্ত শেষে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিটও দিয়েছে।

এভাবে বগুড়া জেলার শেরপুর থানার একটি মামলা, ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানার একটি মামলা, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার চকবাজার থানার একটি মামলা, গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার একটি মামলা, শ্রীপুর মডেল থানার একটি মামলা, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানার একটি মামলা, ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানার একটি মামলা, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার একটি মামলা, টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর থানার একটি মামলা, রংপুরের একটি মামলা ও গোপালগঞ্জ জেলার একটিসহ এই ধরনের ১৩টি মামলা পিবিআইয়ের তদন্তে রহস্য উদঘাটন ও হত্যা মামলা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এসব মামলায় ময়না তদন্তে আত্মহত্যা বলা হলেও পিবিআইয়ের তদন্তে পরিকল্পিত খুন বলে প্রমাণ হয়েছে।

পিবিআই কর্তৃপক্ষ তাদের মতামতে বলেছে, “ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের ফরেনসিক বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। ময়না তদন্ত করতে পারবে ওই সব ডাক্তারদের কী কী প্রশিক্ষণ থাকা দরকার সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার।”

“ময়না তদন্ত যেহেতু একটি বিশেষ ধরনের আইনগত দায়িত্ব এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক সাক্ষ্য Ñ এ কাজের গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আলাদা স্থান দরকার। ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতালে একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আবশ্যই থাকতে হবে। আর ময়না তদন্ত রিপোর্ট পেতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়। এতে মামলার তদন্তের ধারাবাহিকতায় বিঘœ ঘটে।”

বলা হয়, ময়না তদন্তে ডাক্তাররা ডোমদের সাহায্য নিয়ে থাকেন। অথচ ডোমদের দায়িত্ব ময়না তদন্তের জন্য মৃতদেহ প্রস্তুত করে ডাক্তারের কাছে উপস্থাপন করা। কোন কোন ক্ষেত্রে ময়না তদন্তের পর রাসায়নিক পরীক্ষকের মতামত ভিন্ন হলে সেক্ষেত্রে বিশেষ বোর্ড গঠন করে চূড়ান্ত মতামত নেয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে ময়না তদন্ত রিপোর্ট বা পোস্টমর্টেম রিপোর্টের পাশাপাশি অন্যান্য তদন্ত সহায়ক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে সঠিক, বস্তনিষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার তার লিখিত প্রতিবেদনে বলেছেন, “সঠিক ময়না তদন্ত না হওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রধান কারণ হলো ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের ফরেনসিক এর ওপর যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনা না থাকা। তদন্তের ক্ষেত্রে সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর পিবিআইয়ের টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বাদী-বিবাদীসহ সবার সঙ্গে কথা বলে মামলার ক্লু উদঘাটন করেছে।

একজন অভিজ্ঞ ডোম সংবাদকে জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা ডোম ছিল। তাদের কাছ থেকে এবং জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখে এখন ডোম হিসেবে কাজ করছেন। তাদের আলাদা কোন প্রশিক্ষণ নেই। তার মতে ঢাকায় ময়না তদন্ত ভালো হলেও ঢাকার বাইরে সমস্যা হচ্ছে। সেখানে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের অভাব রয়েছে।

একজন সাবেক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সংবাদকে বলেন, “ময়না তদন্তের ইনভেস্টিগেশন ঠিকমতো না হওয়ায় বা ত্রুটি থাকায় সমস্যা হচ্ছে। আগে ময়না তদন্ত ছাড়াও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সব কিছু বিবেচনা করে প্রতিবেদন দিত। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। যার কারণে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। আর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের অভাবও রয়েছে। জেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ নেই। কলেজগুলোতে বিশেষজ্ঞ থাকলেও জেলা হাসপাতালে নেই। সেখানে ত্রুটি হতে পারে।”