অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে প্রতারণা করে অঢেল সম্পদের মালিক কাদের

আব্দুল কাদের মাঝির শিক্ষাগত যোগ্যতা ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু প্রতারণামূলকভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইডি কার্ড বানিয়ে, ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে, গাড়িতে স্টিকার ও ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগিয়ে নিজেকে জাহির করেন তিনি অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদের চৌধুরী ওরফে চৌধুরী সাহেব। রাজধানীর গুলশানের জব্বার টাওয়ারে ৬ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি কার্যালয় রয়েছে তার। এছাড়া কারওয়ান বাজারে তার রয়েছে আরেকটি কার্যালয়। তিনি মিরপুর ৬ নম্বরে থাকেন। গুলশান ও মিরপুরে তার একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে।

গাজীপুরের বোর্ডবাজারে নয়তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি ও পূবাইলে ৮ বিঘা জমিতে একটি বাগানবাড়ি রয়েছে তার। ঢাকায় আব্দুল কাদের অতিরিক্ত সচিব সেজে কোটি টাকার বেশি মূল্যের গাড়িতে চড়েন। গাড়ির সামনে-পেছনে কাচে লাগানো বাংলাদেশ সচিবালয় স্টিকার এবং ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড। অঢেল সম্পত্তির মালিক ভুঁইফোড় আব্দুল কাদেরের বৈধ কোন আয় নেই। তিনি বিভিন্ন মানুষকে কোটি টাকার ব্যাংক লোন পাইয়ে দেয়া ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পাইয়ে দেয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করে আসছিলেন।

মূলত দীর্ঘ ১৪ বছর ধরেই এসব প্রতারণা, ধাপ্পাবাজি, চাপাবাজি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন এই প্রতারক। সম্প্রতি ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর এবং গুলশান থেকে প্রতারক কাদেরসহ চারজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরা বিভাগ। গ্রেফতার অন্য তিনজন হলো-প্রতারক কাদেরের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছোঁয়া, কাদেরের সততা প্রপার্টিজের ম্যানেজার শহিদুল আলম এবং অফিস সহায়ক আনিসুর রহমান।

অভিযানে কাদেরের মিরপুরের বাসা থেকে মন্ত্রণালয়ের স্টিকার যুক্ত প্রাডো গাড়ি ও অতিরিক্ত সচিবের ভুয়া আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড এবং তার কোমরে থাকা একটি অবৈধ বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও এক রাউন্ড গুলিসহ প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, আব্দুল কাদের গুলশান এক নম্বরের জব্বার টাওয়ারের প্রায় ৬ হাজার স্কয়ার ফিট আয়তনের একটি অফিসে বসতেন। স্টিকার যুক্ত গাড়িতে করে তিনি প্রায়ই সচিবালয়ে ঢুকতেন। অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। ডাচ-বাংলা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার। এসব অ্যাকাউন্টে লাখ লাখ টাকাও রয়েছে। ঠিকাদার জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার আগে প্রতারক আব্দুল কাদের গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করতেন।

এখন গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করা অসুবিধা হওয়ায় তিনি নিজেই অস্ত্র এবং ওয়াকিটকি নিয়ে চলাফেরা করতেন। প্রতারক কাদেরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঢাকা ট্রেড কর্পোরেশন, জমিদার ট্রেডিং, সামীন এন্টারপ্রাইজ, চৌধুরী গ্রুপ, হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন, সততা প্রোপার্টিজ, ডানা লজিস্টিকস ও ডানা মটর্স ইত্যাদি। প্রতারক কাদের বড় রকমের প্রতারণা করেন হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশনের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের’ মাধ্যমে। ২০০৪-২০০৬ সালে দেশের শত শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি এবং খামার তৈরির নামে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

ডিবি কর্মকর্তা হাফিজ আক্তার আরও বলেন, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২০ কোটি বা তদূর্ধ্ব টাকার লোন পাইয়ে দেয়ার নামে প্রতারণা করতেন। এক্ষেত্রে তার মার্কেটিংয়ের লোকজন বিভিন্ন ঠিকাদার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট করতেন। সম্ভাব্য মক্কেলদের কাছ থেকে প্রথমেই প্রতারক আব্দুল কাদের ৫০ হাজার টাকা কনসালটেন্সি ফি নিতেন। প্রোফাইল বানানোর জন্য নিতেন ২ থেকে ১০ লাখ টাকা। ২০ কোটি বা তদূর্র্ধ্ব অঙ্কের লোন পাইয়ে দিতে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে টাকা নিতেন মক্কেলদের কাছ থেকে। পরবর্তীতে কাউকে লোন করিয়ে দিতে না পারলেও হাতিয়ে নেয়া লাখ লাখ টাকার অংশবিশেষ দিয়ে ঋণ হিসেবে দিতেন।

সরকার পরিচালিত বিভিন্ন প্রজেক্টের শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি পেয়েছেন বলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতেন কাদের এবং সেগুলোর বিপরীতে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়ার্ক অর্ডার বিক্রি করতেন। তা ছাড়া ঠিকাদারদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা জামানত রেখে দিত যেগুলো দিয়ে আবার তিনি প্রতারণা করতেন। কাদেরের আরও কৌশল হলো-তিনি বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে চাকরি দেয়ার নাম করে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এছাড়াও সততা প্রপার্টিজের নামে তিনি জমি এবং স্থাপনা কেনার জন্য নামমাত্র কিছু টাকা বায়না দিয়ে চুক্তি সম্পাদন করে যেগুলো দিয়ে পরবর্তীতে মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে টাকা আদায় করে থাকেন। এই কাজগুলো করার জন্য কাদের নিজেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি গর্ব করে বলেন, বিভিন্ন বাহিনী এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তার সহকর্মী, বন্ধু এবং অনুজরা কর্মরত থাকায় কেউ তার কিছু করতে পারবেন না।

হাফিজ আক্তার বলেন, প্রতারক আব্দুল কাদের নিজেকে ধনকুবের প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের নিয়োগপ্রাপ্ত লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে দাবি করেন। এ পরিচয় দিয়ে টাকা-পয়সা কোন ব্যাপার না বলে চাকরিপ্রার্থী ও ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। আব্দুল কাদের ও তার স্ত্রী এবং তার সহযোগীদের নামে পল্লবী থানায় অস্ত্র মামলা, তেজগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা হয়েছে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতি, বিভিন্ন প্রতারণার, ব্যাংকে নিয়োগ বিষয়ে কমপক্ষে অর্ধ ডজন মামলা রয়েছে।

এদিকে ভুয়া অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পরিচয় দেয়া আব্দুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে ধনকুবের মুসা বিন শমসেরকে (প্রিন্স মুসা) জিজ্ঞাসাবাদ করবে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ইতোমধ্যে তাকে রাজধানীর মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে হাজির হতে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের মাধ্যমে চিঠি দেয়া হয়েছে। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার হারুন-অর-রশীদ বলেন, আব্দুল কাদেরের সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের নানা ব্যবসায়িক সম্পর্কের চুক্তিপত্রসহ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এমনকি মুসা বিন শমসেরের একটি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করতেন তিনি। তাদের মধ্যে কী সম্পর্ক এবং প্রতারণার সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না-তা জানতেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, কাদেরের প্রতিষ্ঠানে শমসেরের একাধিক ছবি টাঙানো রয়েছে। তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন শমসেরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাডভাইজার হিসেবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতারক আব্দুল কাদেরের কাছ থেকে মুসা বিন শমসের ও তার স্ত্রীর সঙ্গে করা কিছু চুক্তিপত্র উদ্ধার করা হয়। এসব বিষয় জানতেই মূলত শমসেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি আরও বলেন, আব্দুল কাদেরের আদি বাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ভূমিহীন এক কৃষক পরিবারে। তার বাবা জীবিকার সন্ধানে সন্দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছিলেন। মাছ ধরে ও মাঝির কাজ করে জীবিকা উপার্জন করতেন। এমন ভূমিহীন ভাসমান আব্দুল কাদেরের ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

রবিবার, ১০ অক্টোবর ২০২১ , ২৫ আশ্বিন ১৪২৮ ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে প্রতারণা করে অঢেল সম্পদের মালিক কাদের

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার প্রতারক কাদের ও তার স্ত্রী -সংবাদ

আব্দুল কাদের মাঝির শিক্ষাগত যোগ্যতা ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু প্রতারণামূলকভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আইডি কার্ড বানিয়ে, ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে, গাড়িতে স্টিকার ও ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগিয়ে নিজেকে জাহির করেন তিনি অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদের চৌধুরী ওরফে চৌধুরী সাহেব। রাজধানীর গুলশানের জব্বার টাওয়ারে ৬ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি কার্যালয় রয়েছে তার। এছাড়া কারওয়ান বাজারে তার রয়েছে আরেকটি কার্যালয়। তিনি মিরপুর ৬ নম্বরে থাকেন। গুলশান ও মিরপুরে তার একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে।

গাজীপুরের বোর্ডবাজারে নয়তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি ও পূবাইলে ৮ বিঘা জমিতে একটি বাগানবাড়ি রয়েছে তার। ঢাকায় আব্দুল কাদের অতিরিক্ত সচিব সেজে কোটি টাকার বেশি মূল্যের গাড়িতে চড়েন। গাড়ির সামনে-পেছনে কাচে লাগানো বাংলাদেশ সচিবালয় স্টিকার এবং ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড। অঢেল সম্পত্তির মালিক ভুঁইফোড় আব্দুল কাদেরের বৈধ কোন আয় নেই। তিনি বিভিন্ন মানুষকে কোটি টাকার ব্যাংক লোন পাইয়ে দেয়া ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পাইয়ে দেয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করে আসছিলেন।

মূলত দীর্ঘ ১৪ বছর ধরেই এসব প্রতারণা, ধাপ্পাবাজি, চাপাবাজি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন এই প্রতারক। সম্প্রতি ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর এবং গুলশান থেকে প্রতারক কাদেরসহ চারজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরা বিভাগ। গ্রেফতার অন্য তিনজন হলো-প্রতারক কাদেরের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছোঁয়া, কাদেরের সততা প্রপার্টিজের ম্যানেজার শহিদুল আলম এবং অফিস সহায়ক আনিসুর রহমান।

অভিযানে কাদেরের মিরপুরের বাসা থেকে মন্ত্রণালয়ের স্টিকার যুক্ত প্রাডো গাড়ি ও অতিরিক্ত সচিবের ভুয়া আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড এবং তার কোমরে থাকা একটি অবৈধ বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও এক রাউন্ড গুলিসহ প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার।

তিনি বলেন, আব্দুল কাদের গুলশান এক নম্বরের জব্বার টাওয়ারের প্রায় ৬ হাজার স্কয়ার ফিট আয়তনের একটি অফিসে বসতেন। স্টিকার যুক্ত গাড়িতে করে তিনি প্রায়ই সচিবালয়ে ঢুকতেন। অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। ডাচ-বাংলা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার। এসব অ্যাকাউন্টে লাখ লাখ টাকাও রয়েছে। ঠিকাদার জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার আগে প্রতারক আব্দুল কাদের গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করতেন।

এখন গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করা অসুবিধা হওয়ায় তিনি নিজেই অস্ত্র এবং ওয়াকিটকি নিয়ে চলাফেরা করতেন। প্রতারক কাদেরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঢাকা ট্রেড কর্পোরেশন, জমিদার ট্রেডিং, সামীন এন্টারপ্রাইজ, চৌধুরী গ্রুপ, হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন, সততা প্রোপার্টিজ, ডানা লজিস্টিকস ও ডানা মটর্স ইত্যাদি। প্রতারক কাদের বড় রকমের প্রতারণা করেন হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশনের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের’ মাধ্যমে। ২০০৪-২০০৬ সালে দেশের শত শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি এবং খামার তৈরির নামে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

ডিবি কর্মকর্তা হাফিজ আক্তার আরও বলেন, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২০ কোটি বা তদূর্ধ্ব টাকার লোন পাইয়ে দেয়ার নামে প্রতারণা করতেন। এক্ষেত্রে তার মার্কেটিংয়ের লোকজন বিভিন্ন ঠিকাদার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট করতেন। সম্ভাব্য মক্কেলদের কাছ থেকে প্রথমেই প্রতারক আব্দুল কাদের ৫০ হাজার টাকা কনসালটেন্সি ফি নিতেন। প্রোফাইল বানানোর জন্য নিতেন ২ থেকে ১০ লাখ টাকা। ২০ কোটি বা তদূর্র্ধ্ব অঙ্কের লোন পাইয়ে দিতে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে টাকা নিতেন মক্কেলদের কাছ থেকে। পরবর্তীতে কাউকে লোন করিয়ে দিতে না পারলেও হাতিয়ে নেয়া লাখ লাখ টাকার অংশবিশেষ দিয়ে ঋণ হিসেবে দিতেন।

সরকার পরিচালিত বিভিন্ন প্রজেক্টের শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি পেয়েছেন বলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতেন কাদের এবং সেগুলোর বিপরীতে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়ার্ক অর্ডার বিক্রি করতেন। তা ছাড়া ঠিকাদারদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা জামানত রেখে দিত যেগুলো দিয়ে আবার তিনি প্রতারণা করতেন। কাদেরের আরও কৌশল হলো-তিনি বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে চাকরি দেয়ার নাম করে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এছাড়াও সততা প্রপার্টিজের নামে তিনি জমি এবং স্থাপনা কেনার জন্য নামমাত্র কিছু টাকা বায়না দিয়ে চুক্তি সম্পাদন করে যেগুলো দিয়ে পরবর্তীতে মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে টাকা আদায় করে থাকেন। এই কাজগুলো করার জন্য কাদের নিজেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি গর্ব করে বলেন, বিভিন্ন বাহিনী এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তার সহকর্মী, বন্ধু এবং অনুজরা কর্মরত থাকায় কেউ তার কিছু করতে পারবেন না।

হাফিজ আক্তার বলেন, প্রতারক আব্দুল কাদের নিজেকে ধনকুবের প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের নিয়োগপ্রাপ্ত লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে দাবি করেন। এ পরিচয় দিয়ে টাকা-পয়সা কোন ব্যাপার না বলে চাকরিপ্রার্থী ও ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। আব্দুল কাদের ও তার স্ত্রী এবং তার সহযোগীদের নামে পল্লবী থানায় অস্ত্র মামলা, তেজগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা হয়েছে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতি, বিভিন্ন প্রতারণার, ব্যাংকে নিয়োগ বিষয়ে কমপক্ষে অর্ধ ডজন মামলা রয়েছে।

এদিকে ভুয়া অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পরিচয় দেয়া আব্দুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে ধনকুবের মুসা বিন শমসেরকে (প্রিন্স মুসা) জিজ্ঞাসাবাদ করবে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ইতোমধ্যে তাকে রাজধানীর মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে হাজির হতে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের মাধ্যমে চিঠি দেয়া হয়েছে। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার হারুন-অর-রশীদ বলেন, আব্দুল কাদেরের সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের নানা ব্যবসায়িক সম্পর্কের চুক্তিপত্রসহ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এমনকি মুসা বিন শমসেরের একটি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করতেন তিনি। তাদের মধ্যে কী সম্পর্ক এবং প্রতারণার সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না-তা জানতেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, কাদেরের প্রতিষ্ঠানে শমসেরের একাধিক ছবি টাঙানো রয়েছে। তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন শমসেরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাডভাইজার হিসেবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতারক আব্দুল কাদেরের কাছ থেকে মুসা বিন শমসের ও তার স্ত্রীর সঙ্গে করা কিছু চুক্তিপত্র উদ্ধার করা হয়। এসব বিষয় জানতেই মূলত শমসেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি আরও বলেন, আব্দুল কাদেরের আদি বাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ভূমিহীন এক কৃষক পরিবারে। তার বাবা জীবিকার সন্ধানে সন্দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছিলেন। মাছ ধরে ও মাঝির কাজ করে জীবিকা উপার্জন করতেন। এমন ভূমিহীন ভাসমান আব্দুল কাদেরের ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ।