রবীন্দ্রনাথের চুলও লম্বা ছিল

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ শিক্ষার্থীর মাথার চুল কেটে দেয়ায় অভিযুক্ত শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিনের পদত্যাগ দাবি করে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর, বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের সদস্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে গেলেও ছাত্ররা আন্দোলন থামায়নি। শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থগিত হওয়া পারীক্ষার সময়সূচি নিয়ে চেয়ারম্যান ও সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের সাথে কয়েকজন শিক্ষার্থীর বাগবিতণ্ডা হয়। বাগবিতণ্ডার সময় কয়েকজন শিক্ষার্থীর চুল কেটে ছোট করে নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে পরীক্ষার হলে আসতে বলেন শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন; কিন্তু পরদিন হলে প্রবেশের সময় ১৪ জন ছাত্র চুল না কাটানোর কারণে তাদের সামনের অংশের চুল কেটে দেন তিনি। একজন ছাত্র এই অপমান সহ্য করতে না পেরে তার কক্ষে গিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে; সতীর্থরা রুমের তালা ভেঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়।

এ ঘটনার সাথে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৯৭ সালের কথা, তখন অধ্যক্ষ ছিলেন মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান। কড়া শাসন ব্যবস্থা। টুপি পরা বাধ্যতামূলক; ছাত্রদের চুল রাখতে হবে এমন আকারের যাতে দুই আঙ্গুল দিয়ে ধরা না যায়। আমার ছেলে তানভীর আহমেদ অর্ণব আইডিয়াল স্কুলের ছাত্র। তার মাথার চুল নির্ধারিত দৈর্ঘের চেয়ে একটু লম্বা হওয়ায় টুপি খুলে মাথায় ডাস্টার দিয়ে বাড়ি দেয়া হয়; আস্তে নয়, অনেক জোরে। এ ঘটনাটি জানতে পারি যখন সে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়। দীর্ঘদিন সে আর চুল কাটেনি, পিঠে এসে তার চুল পড়তো। আমার আত্মীয়স্বজনের তা পছন্দ হচ্ছিলো না, কিন্তু আমার ছেলে অনড়। ১৯৯৭ সনের ঘটনাটি তাকে লম্বা চুল রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছে, মনে হলো সে লম্বা চুল রেখে আইডিয়াল স্কুলের প্রশাসনিক নীতির প্রতিবাদ করছে। ঠিক একইভাবে যাদের চুলের মুঠি ধরা যায় এমন ১৪ জনের সামনের চুল কেটে দিয়েছেন ফারহানা ইয়াসমিন।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমার ছেলে অর্ণবের মতো বাচ্চা নয়, যুবক। চুল কাটার সময় প্রতিবাদ না করে রুমের ভেতর আত্মহত্যা করতে গেল কেন? ব্যক্তিগত বিষয়ে একজন শিক্ষকের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ তো সহজেই করা যেত। ডাস্টার দিয়ে পিটানোর চেয়ে চুল কেটে দেয়া বেশি অপমানজনক; তাই ছাত্রদের আন্দোলন যথার্থ। ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন না করলে ভাষা আন্দোলন হতো না, ছাত্রছাত্রীরা মিছিল না করলে স্বৈরশাসনের পতন হতো না, তারা বুকের রক্ত না দিলে মুক্তিযুদ্ধ এখন বেগবান হতো না; অথচ অন্যায়ভাবে চুলকাটার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোন ভুক্তভোগী প্রতিবাদ করলো না। কেন প্রতিবাদ করলো না? আসলে প্রতিবাদ করা যায় না; কারণ একজন শিক্ষক ইচ্ছে করলে যে কোন ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা জীবন ধ্বংস করে দিতে পারেন। পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পাওয়ার যোগ্য কোন ছাত্র বা ছাত্রীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ফলাফলে সীমাবদ্ধ করে দিতে পারেন। এ একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকায় রাস্তায় বিপ্লবী একজন ছাত্রও ক্লাস শিক্ষকের কাছে নতজানু, একজন ছাত্রী শিক্ষকের যেন হেনস্তার প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। ছাত্ররা জানতো যে, চুলকাটার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করলে তাদের পরীক্ষায় খাতা ঠিকমত মূল্যায়ন হতো না।

শিক্ষকদের এই স্বৈরচারী মনোভাব সর্বত্র; নামকরা অনেক স্কুল এবং কলেজের প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ পুলিশি আচরণ করে থাকেন। এদের সামরিক শাসন শুধু ছাত্রছাত্রীদের ওপর নয়, অভিভাবকদের ওপরও। স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা, ক্লাস শিক্ষকের দুর্ব্যবহার, পরীক্ষার খাতা ঠিকমত মূল্যায়ন না হওয়া ইত্যাদি অভিযোগ নিয়ে গেলে সাথে সাথে বলে দেয়া হয়, ‘আপনার সন্তান অন্য স্কুলে নিয়ে যান’। সবাই নামকরা স্কুলে সন্তানদের পড়াতে চান, এই সুযোগটি স্কুলের শিক্ষকেরা কাজে লাগান। প্রাইভেট পড়া ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষার খাতার অতিমূল্যায়নের অভিযোগ অধিকাংশ অভিভাবকের। কোন ছাত্র বা ছাত্রী কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে সাধারণত অভিযোগ করে না, কোন অভিযোগ নিয়ে মা-বাবা স্কুলে যাবে- এ কথা শুনলেই ছাত্রছাত্রীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। আমি একটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম প্রায় সাত বছর, আরেকটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলাম দুই টার্ম এবং টাকশাল স্কুলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলাম প্রায় দশ বছর। এছাড়াও কলেজ ও স্কুলে শখের বশে শিক্ষকতা করেছি। তিনটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাথে মেশার চেষ্টা করেছি, বিভিন্ন শিক্ষকের পড়ার দক্ষতা ও আচরণ নিয়ে তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, কিন্তু কোন শিক্ষক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে তাদের চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি।

আমাদের সমাজে চুল বড় থাকলে বলা হয় মস্তান, সন্ত্রাসী বা বখাটে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অপরাধীর সংখ্যা খুবই কম যাদের চুল বড়; প্রকৃত অপরাধীরা চুল বড় রাখে না, কারণ বড় চুল রাখলে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। সমাজের বেশিরভাগ মানুষের চুল ছোট বিধায় অপরাধ করে ছোট চুল নিয়ে সমাজের অন্য দশজন মানুষের মাঝে মিশে থাকা অপরাধীর জন্য সহজ। গায়ক, অভিনেতা, মডেল, শিক্ষক, খেলোয়াড়সহ সকল পেশাতেই অসংখ্য বিখ্যাত লোক আছে যাদের চুল বড় বা গায়ে ট্যাটু আছে। উন্নত দেশে চাকরি করার জন্য কাজের দক্ষতা বিবেচনা করা হয়; চুল, দাড়ির ইত্যাদির মতো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে পলিসি করা হয় না। ছেলেদের ছোট চুল থাকার ধারণা নতুন; ১৫০ থেকে ২০০ বছর বা তার আগে গেলেই দেখা যাবে, পৃথিবীর বেশিরভাগ ছেলেদের চুল বড় ছিল। সমগ্র মানবজাতির ইতিহাস বিবেচনা করলে ২০০ বছর খুব অল্প সময়। চুলের পাশাপাশি দাড়ির দৈর্ঘ্য বা ফ্যাশন নিয়েও অনেকে স্পর্শকাতর। দাড়ির দৈর্ঘের ওপর ভিত্তি করে অনেককে বলা হয় জঙ্গি। চুল দড়ির ওপর ভিত্তি করে মানুষের চরিত্রের বিচার উজবুকি মনোভঙ্গির পরিচায়ক।

পাঠাওয়ের প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশের ফাহিম সালেহকে আমেরিকায় হত্যা করার পর বিভিন্ন মিডিয়ায় তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো; তার সবুজ রং করা চুল নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য ছিলো না। অথচ সমসাময়িক আরেকটি ঘটনায় বাংলাদেশে টিকটক অপুর রং করা সবুজ চুল পুলিশ থানায় নিয়ে কেটে দিয়েছিলো। নিম্নবিত্ত থেকে উঠে আসা অপুর চুলের রং করাকে সমাজের মধ্যবিত্তরাও সহ্য করতে পারেনি। পাশ্চাত্যের কোন দেশে হলে অপুর চুল কাটার জন্য হয়তো শত কোটি টাকা জরিমানা দিতে হতো।

পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসনামলেও এমন ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ হওয়ার পরও সামরিক শাসনামলে পথে-ঘাটে ছেলেদের লম্বা চুল কেটে দেয়ার নজির রয়েছে। শুধু চুল কাটা নয়, শাড়ি পরিহিতা নারীর যেখানে শরীর দেখা গেছে সেখানে আলকাতরা মাখানো হয়েছে। ছেলেমেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়েও অনেক বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হয়। আমাদের সমাজে লালিত মূল্যবোধ নির্ধারিত, এর বাইরে গেলেই নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। আমার মতো বয়সীদের অনেকে ব্যান্ডসংগীত পছন্দ করি না; আমার নয়, অনেকের ধারণা, ব্যান্ডসঙ্গীত প্রচলিত নীতিবোধের বিরোধী। তবে ব্যান্ডসংগীতও সংস্কৃতির একটি অংশ এবং সমাজের একটি বড় অংশের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ চুল বড় না ছোট রাখবে, চুলে রং করবে না করবে নাÑ তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। এর সাথে সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া অন্যায় এবং অসভ্যতা। কারণ এ সমাজের লোকেরাই নজরুলের ঝাঁকড়া চুল নিয়ে গর্ব করে। কয়েকটি হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চুলও বড় ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিও সম্ভবত ফারহানা ইয়াসমিন দেখেননি; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের চুলই যেখানে বড় ছিল সেখানে তার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চুল কেটে দেয়া হাস্যকর।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ১০ অক্টোবর ২০২১ , ২৫ আশ্বিন ১৪২৮ ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

রবীন্দ্রনাথের চুলও লম্বা ছিল

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ শিক্ষার্থীর মাথার চুল কেটে দেয়ায় অভিযুক্ত শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিনের পদত্যাগ দাবি করে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর, বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের সদস্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে গেলেও ছাত্ররা আন্দোলন থামায়নি। শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থগিত হওয়া পারীক্ষার সময়সূচি নিয়ে চেয়ারম্যান ও সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন বাতেনের সাথে কয়েকজন শিক্ষার্থীর বাগবিতণ্ডা হয়। বাগবিতণ্ডার সময় কয়েকজন শিক্ষার্থীর চুল কেটে ছোট করে নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে পরীক্ষার হলে আসতে বলেন শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন; কিন্তু পরদিন হলে প্রবেশের সময় ১৪ জন ছাত্র চুল না কাটানোর কারণে তাদের সামনের অংশের চুল কেটে দেন তিনি। একজন ছাত্র এই অপমান সহ্য করতে না পেরে তার কক্ষে গিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে; সতীর্থরা রুমের তালা ভেঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়।

এ ঘটনার সাথে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৯৭ সালের কথা, তখন অধ্যক্ষ ছিলেন মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান। কড়া শাসন ব্যবস্থা। টুপি পরা বাধ্যতামূলক; ছাত্রদের চুল রাখতে হবে এমন আকারের যাতে দুই আঙ্গুল দিয়ে ধরা না যায়। আমার ছেলে তানভীর আহমেদ অর্ণব আইডিয়াল স্কুলের ছাত্র। তার মাথার চুল নির্ধারিত দৈর্ঘের চেয়ে একটু লম্বা হওয়ায় টুপি খুলে মাথায় ডাস্টার দিয়ে বাড়ি দেয়া হয়; আস্তে নয়, অনেক জোরে। এ ঘটনাটি জানতে পারি যখন সে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়। দীর্ঘদিন সে আর চুল কাটেনি, পিঠে এসে তার চুল পড়তো। আমার আত্মীয়স্বজনের তা পছন্দ হচ্ছিলো না, কিন্তু আমার ছেলে অনড়। ১৯৯৭ সনের ঘটনাটি তাকে লম্বা চুল রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছে, মনে হলো সে লম্বা চুল রেখে আইডিয়াল স্কুলের প্রশাসনিক নীতির প্রতিবাদ করছে। ঠিক একইভাবে যাদের চুলের মুঠি ধরা যায় এমন ১৪ জনের সামনের চুল কেটে দিয়েছেন ফারহানা ইয়াসমিন।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমার ছেলে অর্ণবের মতো বাচ্চা নয়, যুবক। চুল কাটার সময় প্রতিবাদ না করে রুমের ভেতর আত্মহত্যা করতে গেল কেন? ব্যক্তিগত বিষয়ে একজন শিক্ষকের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ তো সহজেই করা যেত। ডাস্টার দিয়ে পিটানোর চেয়ে চুল কেটে দেয়া বেশি অপমানজনক; তাই ছাত্রদের আন্দোলন যথার্থ। ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন না করলে ভাষা আন্দোলন হতো না, ছাত্রছাত্রীরা মিছিল না করলে স্বৈরশাসনের পতন হতো না, তারা বুকের রক্ত না দিলে মুক্তিযুদ্ধ এখন বেগবান হতো না; অথচ অন্যায়ভাবে চুলকাটার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোন ভুক্তভোগী প্রতিবাদ করলো না। কেন প্রতিবাদ করলো না? আসলে প্রতিবাদ করা যায় না; কারণ একজন শিক্ষক ইচ্ছে করলে যে কোন ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা জীবন ধ্বংস করে দিতে পারেন। পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পাওয়ার যোগ্য কোন ছাত্র বা ছাত্রীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ফলাফলে সীমাবদ্ধ করে দিতে পারেন। এ একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকায় রাস্তায় বিপ্লবী একজন ছাত্রও ক্লাস শিক্ষকের কাছে নতজানু, একজন ছাত্রী শিক্ষকের যেন হেনস্তার প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। ছাত্ররা জানতো যে, চুলকাটার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করলে তাদের পরীক্ষায় খাতা ঠিকমত মূল্যায়ন হতো না।

শিক্ষকদের এই স্বৈরচারী মনোভাব সর্বত্র; নামকরা অনেক স্কুল এবং কলেজের প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ পুলিশি আচরণ করে থাকেন। এদের সামরিক শাসন শুধু ছাত্রছাত্রীদের ওপর নয়, অভিভাবকদের ওপরও। স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা, ক্লাস শিক্ষকের দুর্ব্যবহার, পরীক্ষার খাতা ঠিকমত মূল্যায়ন না হওয়া ইত্যাদি অভিযোগ নিয়ে গেলে সাথে সাথে বলে দেয়া হয়, ‘আপনার সন্তান অন্য স্কুলে নিয়ে যান’। সবাই নামকরা স্কুলে সন্তানদের পড়াতে চান, এই সুযোগটি স্কুলের শিক্ষকেরা কাজে লাগান। প্রাইভেট পড়া ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষার খাতার অতিমূল্যায়নের অভিযোগ অধিকাংশ অভিভাবকের। কোন ছাত্র বা ছাত্রী কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে সাধারণত অভিযোগ করে না, কোন অভিযোগ নিয়ে মা-বাবা স্কুলে যাবে- এ কথা শুনলেই ছাত্রছাত্রীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। আমি একটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম প্রায় সাত বছর, আরেকটি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলাম দুই টার্ম এবং টাকশাল স্কুলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলাম প্রায় দশ বছর। এছাড়াও কলেজ ও স্কুলে শখের বশে শিক্ষকতা করেছি। তিনটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাথে মেশার চেষ্টা করেছি, বিভিন্ন শিক্ষকের পড়ার দক্ষতা ও আচরণ নিয়ে তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, কিন্তু কোন শিক্ষক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে তাদের চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি।

আমাদের সমাজে চুল বড় থাকলে বলা হয় মস্তান, সন্ত্রাসী বা বখাটে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অপরাধীর সংখ্যা খুবই কম যাদের চুল বড়; প্রকৃত অপরাধীরা চুল বড় রাখে না, কারণ বড় চুল রাখলে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। সমাজের বেশিরভাগ মানুষের চুল ছোট বিধায় অপরাধ করে ছোট চুল নিয়ে সমাজের অন্য দশজন মানুষের মাঝে মিশে থাকা অপরাধীর জন্য সহজ। গায়ক, অভিনেতা, মডেল, শিক্ষক, খেলোয়াড়সহ সকল পেশাতেই অসংখ্য বিখ্যাত লোক আছে যাদের চুল বড় বা গায়ে ট্যাটু আছে। উন্নত দেশে চাকরি করার জন্য কাজের দক্ষতা বিবেচনা করা হয়; চুল, দাড়ির ইত্যাদির মতো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে পলিসি করা হয় না। ছেলেদের ছোট চুল থাকার ধারণা নতুন; ১৫০ থেকে ২০০ বছর বা তার আগে গেলেই দেখা যাবে, পৃথিবীর বেশিরভাগ ছেলেদের চুল বড় ছিল। সমগ্র মানবজাতির ইতিহাস বিবেচনা করলে ২০০ বছর খুব অল্প সময়। চুলের পাশাপাশি দাড়ির দৈর্ঘ্য বা ফ্যাশন নিয়েও অনেকে স্পর্শকাতর। দাড়ির দৈর্ঘের ওপর ভিত্তি করে অনেককে বলা হয় জঙ্গি। চুল দড়ির ওপর ভিত্তি করে মানুষের চরিত্রের বিচার উজবুকি মনোভঙ্গির পরিচায়ক।

পাঠাওয়ের প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশের ফাহিম সালেহকে আমেরিকায় হত্যা করার পর বিভিন্ন মিডিয়ায় তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো; তার সবুজ রং করা চুল নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য ছিলো না। অথচ সমসাময়িক আরেকটি ঘটনায় বাংলাদেশে টিকটক অপুর রং করা সবুজ চুল পুলিশ থানায় নিয়ে কেটে দিয়েছিলো। নিম্নবিত্ত থেকে উঠে আসা অপুর চুলের রং করাকে সমাজের মধ্যবিত্তরাও সহ্য করতে পারেনি। পাশ্চাত্যের কোন দেশে হলে অপুর চুল কাটার জন্য হয়তো শত কোটি টাকা জরিমানা দিতে হতো।

পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসনামলেও এমন ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ হওয়ার পরও সামরিক শাসনামলে পথে-ঘাটে ছেলেদের লম্বা চুল কেটে দেয়ার নজির রয়েছে। শুধু চুল কাটা নয়, শাড়ি পরিহিতা নারীর যেখানে শরীর দেখা গেছে সেখানে আলকাতরা মাখানো হয়েছে। ছেলেমেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়েও অনেক বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হয়। আমাদের সমাজে লালিত মূল্যবোধ নির্ধারিত, এর বাইরে গেলেই নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। আমার মতো বয়সীদের অনেকে ব্যান্ডসংগীত পছন্দ করি না; আমার নয়, অনেকের ধারণা, ব্যান্ডসঙ্গীত প্রচলিত নীতিবোধের বিরোধী। তবে ব্যান্ডসংগীতও সংস্কৃতির একটি অংশ এবং সমাজের একটি বড় অংশের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ চুল বড় না ছোট রাখবে, চুলে রং করবে না করবে নাÑ তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। এর সাথে সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া অন্যায় এবং অসভ্যতা। কারণ এ সমাজের লোকেরাই নজরুলের ঝাঁকড়া চুল নিয়ে গর্ব করে। কয়েকটি হাদিস থেকে জানা যায়, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চুলও বড় ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিও সম্ভবত ফারহানা ইয়াসমিন দেখেননি; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের চুলই যেখানে বড় ছিল সেখানে তার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চুল কেটে দেয়া হাস্যকর।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com