চট্টগ্রামে ভারী শিল্পাঞ্চলে সাড়ে তিন শতাধিক অবৈধ দোকান

বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কালুরঘাট ভারী শিল্পাঞ্চলে দেশি-বিদেশি মিলে ১২শ শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু সড়ক, ড্রেন-নালা দখল করে গড়ে ওঠেছে অন্তত সাড়ে তিন শতাধিক অবৈধ দোকান। এই বিসিক শিল্প এলাকার সড়ক, উপ-সড়ক দখল করে গড়ে ওঠা এসব অবৈধ দোকানের জায়গা পরিমাপের ভিত্তিতে দোকানপ্রতি দিনে একশ থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। এসব চাঁদা নেয় স্থানীয় সরকারদলীয় ছাত্র-যুবলীগের গুটিকয়েক নেতা। এছাড়াও পুলিশের নামেও দৈনিক ৫০ হাজার হারে চাঁদা উত্তোলন করা হয়। এদিকে এসব দোকাট-পাট ওঠার কারণে এ শিল্পাঞ্চলটি গিঞ্জি-বস্তি এলাকায় পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ এবং সরকারদলীয় ছাত্র-যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তোলা হয় অবৈধ দোকান থেকে। গুটিকয়েক নেতা-পাতি নেতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে শিল্পোদ্যোক্তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারদলীয় ছাত্র-যুবলীগের নামধারী কয়েকজন নেতা-পাতি নেতা রাস্তা দখল করে এসব দোকান বসিয়েছে। দোকানের জায়গার পরিমাপ অনুযায়ী একশ’ থেকে তিনশ’ টাকা চাঁদা দিতে হয়। দেখা যায়, সড়ক-উপসড়ক মিলে ৩৫০টির বেশি দোকান রয়েছে। গড়ে ১৫০ টাকা করে হিসাব করলে দিনে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৫শ টাকা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানদাররা বলেন, ছাত্রলীগের নামধারী মামুন (বরিশাল বাজার) ও রাশেদ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বেশিরভাগ দোকান। দখল-বেদখল ও চাঁদাবাজি নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে প্রায়শই সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। দুইপক্ষের মধ্যে একাধিকবার গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে চাঁদা নেয় সাজ্জাদ, করিম, রহিম ও জাহাঙ্গীর। ছাত্র ও যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে শিল্পাঞ্চল থেকে নিয়মিত চাঁদা উত্তোলন করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দোকানি জানান, রাস্তা দখল- বেদখল নিয়ে গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রায়ই সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা লেগে থাকে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সীমানায় গিয়ে চাঁদা তোলার জের ধরে এসব ঘটনা ঘটে। বিচ্ছিন্ন গ্রুপ থাকলেও মামুন ও রাশেদ গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার, দখল-বেদখল ও চাঁদাবাজির জের ধরে একাধিকবার গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে।

জানা গেছে, ১৯৫০ সালে কর্ণফুলী নদীর তীরে এ শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর কালুরঘাট শিল্পাঞ্চল শুধু চট্টগ্রামে নয়, পুরো দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলে রূপ নেয়। দেশি-বিদেশি অনেক শিল্প-উদ্যোক্তারা এখানে কারখানা স্থাপনা করে। ছোট-বড় মিলে প্রায় ১২শ শিল্প-কারখানা রয়েছে এখানে। পেপসিকো, কোকাকোলা, রেকিট বেনকিজার, ইউনিলিভার বাংলাদেশ, বার্জার বাংলাদেশ লিমিটেডসহ বিশ^বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানির কারখানা রয়েছে এখানে। এছাড়াও দেশের বৃহৎ গার্মেন্টস, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, সিমেন্ট শিল্প কারখানা অবস্থিত। এছাড়াও দেশের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, সংসদ সদস্য, মন্ত্রীর শিল্প-কারখানাও রয়েছে। কিন্তু চলাচলের সড়ক, ড্রেন-নালা দখল করে ঝুপড়ি দোকানে শ্রী-রূপহীন হয়ে পড়েছে এই শিল্প-কারখানা। বিশেষ করে গুটিকয়েক নেতা-পাতি নেতার কাছে যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে শিল্পোদ্যোক্তারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, আরাকান সড়ক থেকে শিল্পনগরীতে ঢুকতেই বিড়ম্বনার শুরু হয়। বিসিক সড়কের মোড় ঘুরতেই রাস্তায় অবৈধ ব্যাটারি রিকশা আর ট্যাক্সির স্ট্যান্ড। নিয়মিত যানজট লেগে থাকে। এরপর শিল্পাঞ্চলের রুট ধরে ভেতরে যাওয়ার পথে চোখে পড়ে রাস্তার দুই ধারে নানা ধরনের খুঁপড়ি দোকান। সড়কের শেষ প্রান্তে চোখ যেন ছানাবরা অবস্থা। রাস্তা দখল করে দুই ধারে বসানো হয়েছে সারি সারি দোকানপাট। রীতিমতো যেন বস্তি এলাকা। অথচ এই শিল্পাঞ্চলে রয়েছে বিশ^বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানির অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন শিল্প কারখানার গা ঘেঁষেই অবৈধভাবে ঝুপড়ি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। এসব দোকানে পানির পাইপ লাইন সংযোগও রয়েছে।

বিসিক সড়কের চর রাঙ্গামাটিয়া এলাকায় দেখা যায়, অবৈধ দোকানপাটের পাশে গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ। আর হামিদচর অংশে রয়েছে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ। এসব সংগঠনে ৫-৭ জন করে লোক বসানো রয়েছে। টেলিভিশন দেখে চা-নাস্তা আর সিগারেট ফুঁকছেন তারা। একদিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ, অন্যদিকে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ- মাঝখানে সড়কজুড়ে অন্তত তিন শতাধিক অবৈধ দোকানপাট। সিএন্ডবি থেকে বিসিক এলাকায় প্রবেশের প্রধান সড়ক দখল করে গড়ে ওঠেছে দোকানঘর। বাদামতল, এফআইডিসিসহ কয়েকটি শিল্প-কারখানার দেয়াল ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে কাঁচা সবজি, চায়ের দোকান। নানা-ড্রেন ও সড়ক দখল করে এসব দোকান নির্মাণ করা হয়েছে।

সোমবার, ১১ অক্টোবর ২০২১ , ২৬ আশ্বিন ১৪২৮ ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

চট্টগ্রামে ভারী শিল্পাঞ্চলে সাড়ে তিন শতাধিক অবৈধ দোকান

নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম ব্যুরো

বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কালুরঘাট ভারী শিল্পাঞ্চলে দেশি-বিদেশি মিলে ১২শ শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু সড়ক, ড্রেন-নালা দখল করে গড়ে ওঠেছে অন্তত সাড়ে তিন শতাধিক অবৈধ দোকান। এই বিসিক শিল্প এলাকার সড়ক, উপ-সড়ক দখল করে গড়ে ওঠা এসব অবৈধ দোকানের জায়গা পরিমাপের ভিত্তিতে দোকানপ্রতি দিনে একশ থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। এসব চাঁদা নেয় স্থানীয় সরকারদলীয় ছাত্র-যুবলীগের গুটিকয়েক নেতা। এছাড়াও পুলিশের নামেও দৈনিক ৫০ হাজার হারে চাঁদা উত্তোলন করা হয়। এদিকে এসব দোকাট-পাট ওঠার কারণে এ শিল্পাঞ্চলটি গিঞ্জি-বস্তি এলাকায় পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ এবং সরকারদলীয় ছাত্র-যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তোলা হয় অবৈধ দোকান থেকে। গুটিকয়েক নেতা-পাতি নেতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে শিল্পোদ্যোক্তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারদলীয় ছাত্র-যুবলীগের নামধারী কয়েকজন নেতা-পাতি নেতা রাস্তা দখল করে এসব দোকান বসিয়েছে। দোকানের জায়গার পরিমাপ অনুযায়ী একশ’ থেকে তিনশ’ টাকা চাঁদা দিতে হয়। দেখা যায়, সড়ক-উপসড়ক মিলে ৩৫০টির বেশি দোকান রয়েছে। গড়ে ১৫০ টাকা করে হিসাব করলে দিনে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৫শ টাকা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও দোকানদাররা বলেন, ছাত্রলীগের নামধারী মামুন (বরিশাল বাজার) ও রাশেদ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বেশিরভাগ দোকান। দখল-বেদখল ও চাঁদাবাজি নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে প্রায়শই সংঘাত-সংঘর্ষ হয়। দুইপক্ষের মধ্যে একাধিকবার গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে চাঁদা নেয় সাজ্জাদ, করিম, রহিম ও জাহাঙ্গীর। ছাত্র ও যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে শিল্পাঞ্চল থেকে নিয়মিত চাঁদা উত্তোলন করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দোকানি জানান, রাস্তা দখল- বেদখল নিয়ে গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রায়ই সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা লেগে থাকে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সীমানায় গিয়ে চাঁদা তোলার জের ধরে এসব ঘটনা ঘটে। বিচ্ছিন্ন গ্রুপ থাকলেও মামুন ও রাশেদ গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার, দখল-বেদখল ও চাঁদাবাজির জের ধরে একাধিকবার গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে।

জানা গেছে, ১৯৫০ সালে কর্ণফুলী নদীর তীরে এ শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর কালুরঘাট শিল্পাঞ্চল শুধু চট্টগ্রামে নয়, পুরো দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলে রূপ নেয়। দেশি-বিদেশি অনেক শিল্প-উদ্যোক্তারা এখানে কারখানা স্থাপনা করে। ছোট-বড় মিলে প্রায় ১২শ শিল্প-কারখানা রয়েছে এখানে। পেপসিকো, কোকাকোলা, রেকিট বেনকিজার, ইউনিলিভার বাংলাদেশ, বার্জার বাংলাদেশ লিমিটেডসহ বিশ^বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানির কারখানা রয়েছে এখানে। এছাড়াও দেশের বৃহৎ গার্মেন্টস, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, সিমেন্ট শিল্প কারখানা অবস্থিত। এছাড়াও দেশের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, সংসদ সদস্য, মন্ত্রীর শিল্প-কারখানাও রয়েছে। কিন্তু চলাচলের সড়ক, ড্রেন-নালা দখল করে ঝুপড়ি দোকানে শ্রী-রূপহীন হয়ে পড়েছে এই শিল্প-কারখানা। বিশেষ করে গুটিকয়েক নেতা-পাতি নেতার কাছে যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে শিল্পোদ্যোক্তারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, আরাকান সড়ক থেকে শিল্পনগরীতে ঢুকতেই বিড়ম্বনার শুরু হয়। বিসিক সড়কের মোড় ঘুরতেই রাস্তায় অবৈধ ব্যাটারি রিকশা আর ট্যাক্সির স্ট্যান্ড। নিয়মিত যানজট লেগে থাকে। এরপর শিল্পাঞ্চলের রুট ধরে ভেতরে যাওয়ার পথে চোখে পড়ে রাস্তার দুই ধারে নানা ধরনের খুঁপড়ি দোকান। সড়কের শেষ প্রান্তে চোখ যেন ছানাবরা অবস্থা। রাস্তা দখল করে দুই ধারে বসানো হয়েছে সারি সারি দোকানপাট। রীতিমতো যেন বস্তি এলাকা। অথচ এই শিল্পাঞ্চলে রয়েছে বিশ^বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানির অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন শিল্প কারখানার গা ঘেঁষেই অবৈধভাবে ঝুপড়ি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। এসব দোকানে পানির পাইপ লাইন সংযোগও রয়েছে।

বিসিক সড়কের চর রাঙ্গামাটিয়া এলাকায় দেখা যায়, অবৈধ দোকানপাটের পাশে গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ। আর হামিদচর অংশে রয়েছে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ। এসব সংগঠনে ৫-৭ জন করে লোক বসানো রয়েছে। টেলিভিশন দেখে চা-নাস্তা আর সিগারেট ফুঁকছেন তারা। একদিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ, অন্যদিকে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ- মাঝখানে সড়কজুড়ে অন্তত তিন শতাধিক অবৈধ দোকানপাট। সিএন্ডবি থেকে বিসিক এলাকায় প্রবেশের প্রধান সড়ক দখল করে গড়ে ওঠেছে দোকানঘর। বাদামতল, এফআইডিসিসহ কয়েকটি শিল্প-কারখানার দেয়াল ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে কাঁচা সবজি, চায়ের দোকান। নানা-ড্রেন ও সড়ক দখল করে এসব দোকান নির্মাণ করা হয়েছে।