অচেনা হামলাকারীদের সঙ্গে ছিল মই হাতুড়ি পাথর

কুমিল্লায় নানুয়াদীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে হামলার পর নগরীর বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীদের অনেকের কাঁধেই ছিল ব্যাগ। সঙ্গে ছিল মই, হাতুড়ি ও পাথর। ওইদিন হামলা চালানো হয় নগরীর কমপক্ষে আটটি মন্দিরে। কিন্তু, হামলাকারীরা অচেনা হওয়ায় তাদের কাউকেই চিনতে পারেননি স্থানীয় লোকজন। তিনদিনেও চিহ্নিত করা যায়নি হামলাকারীদের। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অচেনা এসব লোকজন জড়ো হয়ে নগরীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপে গিয়ে হামলা করেছে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয়দের মাঝে। হামলার পর থেকে প্রতিটি মন্দির ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হলেও সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকজনদের মাঝে এখনও আতঙ্ক কাটেনি। আর এমন ঘটনাটিকে পরিকল্পিত হামলা বলছেন পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ। তারা এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানান।

জানা যায়, কোরআন অবমাননার অভিযোগে গত বুধবার সকালে নগরীর নানুয়াদীঘির পাড় এলাকায় অস্থায়ী পূজামণ্ডপে হামলা চালানো হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে নগরীর অন্যান্য মণ্ডপেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। নানুয়াদীঘি থেকে এক কিলোমিটারের মতো দূরে নগরীর কাপড়িয়াপট্টি এলাকায় অবস্থিত শ্রী শ্রী চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দির। মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারাধন চক্রবর্তী বলেন, নানুয়াদীঘিতে ভাঙচুর শেষ হওয়ার আগেই বেলা ১১টার দিকে এই কালীমন্দিরে প্রথম হামলা হয়। এরপর হামলা হয় আরও দুই দফায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শ্রী শ্রী চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরের পাশ্ববর্তী সনাতন ধর্মাবলম্বী বাসিন্দারা জানান, হামলার দিন বুধবার বিকেল তখন সাড়ে ৩টা। আকস্মিকভাবে মন্দিরের প্রধান ফটক টপকে এসে মন্দিরের মণ্ডপে এসে জড়ো হয় পাঁচ-ছয়শ লোক। এর মধ্যে দুটি প্রতিমাকে মণ্ডপ থেকে টেনে-হিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেখানে নিয়ে আগুন দেয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যেই প্রতিমাগুলোতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বাদ দেয়া হয়নি মন্দিরের অন্য প্রতিমাগুলোকেও। এভাবেই ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে দুর্বৃত্তরা। ভয়ে তখন ঘর থেকে কেউ বের হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ মন্দিরের বিশাল লোহার ফটকটি প্রথম দুই দফা হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছিল। তৃতীয় দফায় বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে হামলাকারীরা মই নিয়ে এসে লোহার ফটক টপকে মন্দিরে প্রবেশ করে। এরপর হাতুড়ি দিয়ে তালা ভেঙে মন্দিরের ফটকটি খুলে দেয়।

এ সময় পাঁচ-ছয়শ হামলাকারী ভেতরে ঢুকে তাণ্ডব চালায়। এতে আহত হন ঢাকি রবি চন্দ্র বাদ্যকর। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু লোকজন বেলা ১১টা থেকেই মন্দিরে হামলার চেষ্টা করছিল। একটু পর পর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। বিকেল ৩টার দিকে মই নিয়ে এসে তারা প্রধান ফটক টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর হাতুড়ি দিয়ে প্রথমে গেটের তালা ভেঙে ফেলা হয়। মন্দিরের পাশ্ববর্তী বাড়ির বাসিন্দা অধীর সাহা বলেন, এমন ঘটনা তিনি কখনও দেখেননি। এখানে শৈশব, কিশোর পেরিয়ে বড় হলেও হামলাকারীদের কাউকে তিনি চিনতে পারেননি। হামলাকারীরা যেভাবে মই, হাতুড়ি, পেট্রোল নিয়ে এসেছিল, তা কল্পনাও করতে পারি না। পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এদিকে স্টিলের তৈরি মন্দিরের প্রধান ফটক পার হতে বাঁশের মই কীভাবে এসেছে, এ নিয়েও কোন ধারণা দিতে পারেননি স্থানীয় লোকজন। নানুয়াদীঘির পাড় থেকে এক কিলোমিটারের কম দূরত্বে গাছতলা কালীমন্দির। সেখানকার হিন্দুরাও জানান, সেখানে হামলায়ও তাদের এলাকার কেউ ছিল না। মন্দির কমিটির সহ-সভাপতি সজল কুমার চন্দ বলেন, নানুয়াদীঘির মন্দিরে হামলার খবর পেয়েই তাদের এলাকার যুবকরা একত্রিত হয়ে মন্দিরে অবস্থান করে এবং মন্দির ভবনের দরজায় তালা মেরে দেয়া হয়।

একইভাবে পাশের শিব মন্দিরেও তালা দেয়া হয়। দুপুর ২টার দিকে ২৫-৩০ বছর বয়সের কয়েকশ লোক একযোগে এসে হামলা চালায়। অথচ এরা কেউ এই এলাকার নয়। তাদের অনেকের কাঁধেই ছিল স্কুলব্যাগ বা হাতে বাজারের ব্যাগ। এই ব্যাগগুলো থেকে পাথর বের করে বৃষ্টির মতো মন্দিরের দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এলাকার যুবকরা প্রতিরোধ করতে দাঁড়ালেও হামলাকারীরা সংখ্যায় অনেক হওয়ায় তাদের সামনে টিকতে পারেনি। মন্দির প্রাঙ্গণে সাজসজ্জার সব উপকরণ লণ্ডভণ্ডসহ বাতি, ব্যানার ভেঙেচুরে দিয়ে যায়। এ সময় মন্দিরের সদস্য রবি মজুমদার পাশের শিব মন্দিরটি তালাবদ্ধ করতে গিয়ে হামলার মুখে পড়েন।

হামলাকারীদের হাতে লাঠিসোঁটা ছাড়াও বিভিন্ন আকারের ধারালো অস্ত্রও ছিল। মন্দির ছাড়াও পাশ্ববর্তী কয়েকটি হিন্দুদের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। টিনের বেড়া কুপিয়ে কাটার চেষ্টাও করা হলে এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে হামলাকারীরা চলে যায়। মাস্টারপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিল্পী চক্রবর্তী বলেন, পাড়ার ছেলেরা সবাই মিলে প্রতিরোধ করেছে বলে রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু শিশু-কিশোররা খুবই ভয় পেয়েছে। আতঙ্কে হামলার দিন রাতে এই হিন্দু পরিবারের কেউই এলাকায় ছিল না। নগরীর আশপাশে যার-যার আত্মীয়ের বাড়িতে রাত কাটিয়েছেন।

সরেজমিনে গতকাল বিকেলে নগরীর কাপড়িয়াপট্টি এলাকায় শ্রী শ্রী চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, দুর্গোৎসবকে ঘিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে আনন্দ থাকলেও এবার তাদের সেই আনন্দে ভাটা পড়েছে। এখানে ৩৫টি পরিবার বসবাস করলেও উৎসব ঘিরে নেই তেমন আনন্দ-উচ্ছ্বাস। শিশু থেকে বয়োঃবৃদ্ধ সবাই নির্বাক ও নিস্তব্ধ। অপলক দৃষ্টিতে মন্দিরের কাছে বসে রয়েছেন। প্রতিমা বিসর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, পুড়ে যাওয়া প্রতিমার অংশবিশেষ বিসর্জন দিয়েছি। উৎসবে এমন ঘটনা ঘটবে, আমরা তা কল্পনাও করিনি। শুধু পূজামণ্ডপের প্রতিমাই নয়, স্থায়ী মন্দিরের প্রতিমাও ভাঙচুর করা হয়েছে। মন্দিরের সামনের সড়কে সাইনবোর্ডে যেসব হিন্দুদের নাম রয়েছে, তাদের সাইনবোর্ডও ভাঙচুর করা হয়েছে। এমন ঘটনায় হতবাক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল পাল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সব ধর্মকেই শ্রদ্ধা করে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর অপপ্রচার চালিয়ে আমাদের উৎসবকে নস্যাৎ করা হয়েছে। মন্দিরে কোরআন শরিফ রেখে আমাদের এ বৃহত্তম উৎসবকে নস্যাৎ করব, মানুষ কীভাবে এটা বিশ্বাস করেছে। আমরা মনে করি, এটা পরিকল্পিত এবং ষড়যন্ত্র। কে কোন দল করে এটা বড় বিষয় নয়, ষড়যন্ত্রকারীরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা হোক, যাতে করে আর কেউ ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে না পারে।’ এদিকে প্রতিমা বিসর্জন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পাশাপাশি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে অবস্থান করেন। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত জানান, ‘শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন করতে এবং অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে গতকাল দিনব্যাপী আমাদের দলীয় লোকজন মাঠে ছিল।’

শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১ , ৩১ আশ্বিন ১৪২৮ ০৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

কুমিল্লার ঘটনা

অচেনা হামলাকারীদের সঙ্গে ছিল মই হাতুড়ি পাথর

জেলা বার্তা পরিবেশক, কুমিল্লা

কুমিল্লায় নানুয়াদীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে হামলার পর নগরীর বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীদের অনেকের কাঁধেই ছিল ব্যাগ। সঙ্গে ছিল মই, হাতুড়ি ও পাথর। ওইদিন হামলা চালানো হয় নগরীর কমপক্ষে আটটি মন্দিরে। কিন্তু, হামলাকারীরা অচেনা হওয়ায় তাদের কাউকেই চিনতে পারেননি স্থানীয় লোকজন। তিনদিনেও চিহ্নিত করা যায়নি হামলাকারীদের। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অচেনা এসব লোকজন জড়ো হয়ে নগরীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপে গিয়ে হামলা করেছে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয়দের মাঝে। হামলার পর থেকে প্রতিটি মন্দির ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হলেও সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকজনদের মাঝে এখনও আতঙ্ক কাটেনি। আর এমন ঘটনাটিকে পরিকল্পিত হামলা বলছেন পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ। তারা এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানান।

জানা যায়, কোরআন অবমাননার অভিযোগে গত বুধবার সকালে নগরীর নানুয়াদীঘির পাড় এলাকায় অস্থায়ী পূজামণ্ডপে হামলা চালানো হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে নগরীর অন্যান্য মণ্ডপেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। নানুয়াদীঘি থেকে এক কিলোমিটারের মতো দূরে নগরীর কাপড়িয়াপট্টি এলাকায় অবস্থিত শ্রী শ্রী চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দির। মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারাধন চক্রবর্তী বলেন, নানুয়াদীঘিতে ভাঙচুর শেষ হওয়ার আগেই বেলা ১১টার দিকে এই কালীমন্দিরে প্রথম হামলা হয়। এরপর হামলা হয় আরও দুই দফায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শ্রী শ্রী চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরের পাশ্ববর্তী সনাতন ধর্মাবলম্বী বাসিন্দারা জানান, হামলার দিন বুধবার বিকেল তখন সাড়ে ৩টা। আকস্মিকভাবে মন্দিরের প্রধান ফটক টপকে এসে মন্দিরের মণ্ডপে এসে জড়ো হয় পাঁচ-ছয়শ লোক। এর মধ্যে দুটি প্রতিমাকে মণ্ডপ থেকে টেনে-হিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেখানে নিয়ে আগুন দেয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যেই প্রতিমাগুলোতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বাদ দেয়া হয়নি মন্দিরের অন্য প্রতিমাগুলোকেও। এভাবেই ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে দুর্বৃত্তরা। ভয়ে তখন ঘর থেকে কেউ বের হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ মন্দিরের বিশাল লোহার ফটকটি প্রথম দুই দফা হামলা ঠেকিয়ে দিয়েছিল। তৃতীয় দফায় বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে হামলাকারীরা মই নিয়ে এসে লোহার ফটক টপকে মন্দিরে প্রবেশ করে। এরপর হাতুড়ি দিয়ে তালা ভেঙে মন্দিরের ফটকটি খুলে দেয়।

এ সময় পাঁচ-ছয়শ হামলাকারী ভেতরে ঢুকে তাণ্ডব চালায়। এতে আহত হন ঢাকি রবি চন্দ্র বাদ্যকর। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু লোকজন বেলা ১১টা থেকেই মন্দিরে হামলার চেষ্টা করছিল। একটু পর পর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। বিকেল ৩টার দিকে মই নিয়ে এসে তারা প্রধান ফটক টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর হাতুড়ি দিয়ে প্রথমে গেটের তালা ভেঙে ফেলা হয়। মন্দিরের পাশ্ববর্তী বাড়ির বাসিন্দা অধীর সাহা বলেন, এমন ঘটনা তিনি কখনও দেখেননি। এখানে শৈশব, কিশোর পেরিয়ে বড় হলেও হামলাকারীদের কাউকে তিনি চিনতে পারেননি। হামলাকারীরা যেভাবে মই, হাতুড়ি, পেট্রোল নিয়ে এসেছিল, তা কল্পনাও করতে পারি না। পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এদিকে স্টিলের তৈরি মন্দিরের প্রধান ফটক পার হতে বাঁশের মই কীভাবে এসেছে, এ নিয়েও কোন ধারণা দিতে পারেননি স্থানীয় লোকজন। নানুয়াদীঘির পাড় থেকে এক কিলোমিটারের কম দূরত্বে গাছতলা কালীমন্দির। সেখানকার হিন্দুরাও জানান, সেখানে হামলায়ও তাদের এলাকার কেউ ছিল না। মন্দির কমিটির সহ-সভাপতি সজল কুমার চন্দ বলেন, নানুয়াদীঘির মন্দিরে হামলার খবর পেয়েই তাদের এলাকার যুবকরা একত্রিত হয়ে মন্দিরে অবস্থান করে এবং মন্দির ভবনের দরজায় তালা মেরে দেয়া হয়।

একইভাবে পাশের শিব মন্দিরেও তালা দেয়া হয়। দুপুর ২টার দিকে ২৫-৩০ বছর বয়সের কয়েকশ লোক একযোগে এসে হামলা চালায়। অথচ এরা কেউ এই এলাকার নয়। তাদের অনেকের কাঁধেই ছিল স্কুলব্যাগ বা হাতে বাজারের ব্যাগ। এই ব্যাগগুলো থেকে পাথর বের করে বৃষ্টির মতো মন্দিরের দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এলাকার যুবকরা প্রতিরোধ করতে দাঁড়ালেও হামলাকারীরা সংখ্যায় অনেক হওয়ায় তাদের সামনে টিকতে পারেনি। মন্দির প্রাঙ্গণে সাজসজ্জার সব উপকরণ লণ্ডভণ্ডসহ বাতি, ব্যানার ভেঙেচুরে দিয়ে যায়। এ সময় মন্দিরের সদস্য রবি মজুমদার পাশের শিব মন্দিরটি তালাবদ্ধ করতে গিয়ে হামলার মুখে পড়েন।

হামলাকারীদের হাতে লাঠিসোঁটা ছাড়াও বিভিন্ন আকারের ধারালো অস্ত্রও ছিল। মন্দির ছাড়াও পাশ্ববর্তী কয়েকটি হিন্দুদের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়। টিনের বেড়া কুপিয়ে কাটার চেষ্টাও করা হলে এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে হামলাকারীরা চলে যায়। মাস্টারপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিল্পী চক্রবর্তী বলেন, পাড়ার ছেলেরা সবাই মিলে প্রতিরোধ করেছে বলে রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু শিশু-কিশোররা খুবই ভয় পেয়েছে। আতঙ্কে হামলার দিন রাতে এই হিন্দু পরিবারের কেউই এলাকায় ছিল না। নগরীর আশপাশে যার-যার আত্মীয়ের বাড়িতে রাত কাটিয়েছেন।

সরেজমিনে গতকাল বিকেলে নগরীর কাপড়িয়াপট্টি এলাকায় শ্রী শ্রী চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, দুর্গোৎসবকে ঘিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে আনন্দ থাকলেও এবার তাদের সেই আনন্দে ভাটা পড়েছে। এখানে ৩৫টি পরিবার বসবাস করলেও উৎসব ঘিরে নেই তেমন আনন্দ-উচ্ছ্বাস। শিশু থেকে বয়োঃবৃদ্ধ সবাই নির্বাক ও নিস্তব্ধ। অপলক দৃষ্টিতে মন্দিরের কাছে বসে রয়েছেন। প্রতিমা বিসর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, পুড়ে যাওয়া প্রতিমার অংশবিশেষ বিসর্জন দিয়েছি। উৎসবে এমন ঘটনা ঘটবে, আমরা তা কল্পনাও করিনি। শুধু পূজামণ্ডপের প্রতিমাই নয়, স্থায়ী মন্দিরের প্রতিমাও ভাঙচুর করা হয়েছে। মন্দিরের সামনের সড়কে সাইনবোর্ডে যেসব হিন্দুদের নাম রয়েছে, তাদের সাইনবোর্ডও ভাঙচুর করা হয়েছে। এমন ঘটনায় হতবাক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল পাল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সব ধর্মকেই শ্রদ্ধা করে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর অপপ্রচার চালিয়ে আমাদের উৎসবকে নস্যাৎ করা হয়েছে। মন্দিরে কোরআন শরিফ রেখে আমাদের এ বৃহত্তম উৎসবকে নস্যাৎ করব, মানুষ কীভাবে এটা বিশ্বাস করেছে। আমরা মনে করি, এটা পরিকল্পিত এবং ষড়যন্ত্র। কে কোন দল করে এটা বড় বিষয় নয়, ষড়যন্ত্রকারীরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা হোক, যাতে করে আর কেউ ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে না পারে।’ এদিকে প্রতিমা বিসর্জন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পাশাপাশি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে অবস্থান করেন। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত জানান, ‘শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন করতে এবং অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে গতকাল দিনব্যাপী আমাদের দলীয় লোকজন মাঠে ছিল।’