পরোয়ানা জারির ৮ মাসেও গ্রেপ্তার হননি পুলিশ কর্মকর্তা

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আল ইমরানের বিরুদ্ধে স্ত্রীর দায়ের করা যৌতুক আইনের মামলায় আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর দীর্ঘ আট মাসেও গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। উল্টো ওই পুলিশ কর্মকর্তা মেট্রোপলিটন পুলিশের গাড়ি ব্যবহার করে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে দীর্ঘ দিনেও চাকরি থেকে বরখাস্ত বা বিভাগীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় স্ত্রী ও স্বজনরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এদিকে যৌতুক মামলার আসামি সহকারী পুলিশ কমিশনারের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার মির্জারকোট এলাকায় হওয়ায় পাটগ্রাম থানার ওসি ওমর ফারুখের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমরা ওয়ারেন্ট পেয়েছি। আসামির বাড়িতে কয়েকবার গিয়ে জানতে পেরেছি, আসামি বাড়িতে আসেন না। সে কারণে তাকে পলাতক দেখিয়ে আদালতে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আল ইমরান, পিতা আবুল হোসেন, বাড়ি লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার মির্জার কোট এলাকায়। তার সঙ্গে ২০১১ সালে রেজিস্ট্রি কাবিনমূলে পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলা শহরের মুন্সিপাড়া মহল্লার আবদুল গফরের মেয়ে আরিফা আখতার গোধলীর বিয়ে হয়।

মামলায় বাদিনী অভিযোগ করেন, তার সঙ্গে আল ইমরানের যখন বিয়ে হয়, তখন সে ছাত্র ছিল। সে কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে তাদের বাড়িতে তুলে নেয়নি। তার পরেও বিয়ের পর কখনও বাসাভাড়া নিয়ে, আবার বেশিরভাগ সময় আমার পিতার বাড়িতে থেকে ঘর-সংসার করে। চাকরি হলেই তাকে ঘরে তুলে নেবে বলে বারবার আশ্বাস দেয়। চাকরি হওয়ার পর আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ও আমার স্বজনরা অনুরোধ করলে সে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে। সম্প্রতি সে বেশ কিছুদিন ধরে বিশ লাখ টাকা এবং ফ্ল্যাট যৌতুক হিসেবে দাবি করতে থাকে। এতে পরিবার এবং তার স্ত্রী সম্মত না হওয়ায় আল ইমরান তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। অবশেষে ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি স্ত্রীর স্বজনরা স্বামী আল ইমরান ও তার বাবাসহ স্বজনদের তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনে বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে। আল ইমরান তার বাবাসহ স্বজনরা ওই তারিখে তাদের বাড়িতে এসে নগদ ২০ লাখ টাকা ও একটি ফ্ল্যাট যৌতুক হিসেবে দাবি করে এবং যৌতুক প্রদান না করলে স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করবে না বলে বাড়ি থেকে চলে যায়।

বাধ্য হয়ে এ ঘটনায় সহকারী পুলিশ কমিশনার আল ইমরানের স্ত্রী গোধুলী বাদী হয়ে কুড়িগ্রাম সদর আমলী আদালতে যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ এর ৩ ধারায় মামলা দায়ের করে। বিজ্ঞ আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ শেষে আসামিকে আদালতে ১২/৪/২০ তারিখে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারির আদেশ দেন। জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোশারফ হোসেন এ আদেশ দেন। (যার মামলা নম্বর সিআর ৮৫/২০০০ইং।)

কিন্তু, আদালতের আদেশ অনুযায়ী আসামী আল ইমরান আদালতে হাজির না হওয়ায় আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন এবং মামলার পরবর্তী তারিখ ছিল গতকাল ১৫ ফেরুয়ারি। কিন্তু, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর গতকাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট মাসেও আসামি আদালতে হাজির হয়নি। এমনকি, লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানা পুলিশ আসামি আল ইমরানকে গ্রেপ্তার করারও কোন উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো পাটগ্রাম থানার ওসি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে কর্মরত জেনেও তাকে পলাতক দেখিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে বলে স্বজনদের অভিযোগ।

সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল আলীম মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার সহকারী পুলিশ কমিশনার আল ইমরানের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে শুনেছেন। তবে তার কাছে কোন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসেনি বলে জানান।

অন্যদিকে মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি পারিবারিক ঘটনা। আরএমপির একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার নেতৃত্বে বিষয়টি মীমাংসা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সেখানে আল ইমরান ও তার স্ত্রী গোধুলীও উপস্থিত ছিল। কিন্তু কোন সুরাহা করা সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে অভিযুক্ত সহকারী পুলিশ কমিশনার আল ইমরানের সঙ্গে তার সরকারি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তার বিরুদ্ধে স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ হয়েছে- এ বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি পারিবারিক, তাই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাক বলে ফোনের লাইন কেটে দেন। তিনি আর বিস্তারিত কিছুই জানাতে রাজি হননি।

এদিকে একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশের কাজ হলো, আদালতের আদেশ প্রতিপালন করা। সেখানে আট মাস আগে একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরও তিনি কীভাবে স্বপদে বহাল থাকেন? আর চাকরি করছেন, বিষয়টি জানার পরও কেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? এটা পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। সবচেয়ে বড় কথা, একজনের অপকর্মের দায় পুরো পুলিশ বাহিনী নিতে পারে না বলে জানান তিনি।

শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১ , ৩১ আশ্বিন ১৪২৮ ০৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

স্ত্রীর যৌতুকের মামলা

পরোয়ানা জারির ৮ মাসেও গ্রেপ্তার হননি পুলিশ কর্মকর্তা

লিয়াকত আলী বাদল, রংপুর

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আল ইমরানের বিরুদ্ধে স্ত্রীর দায়ের করা যৌতুক আইনের মামলায় আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর দীর্ঘ আট মাসেও গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। উল্টো ওই পুলিশ কর্মকর্তা মেট্রোপলিটন পুলিশের গাড়ি ব্যবহার করে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে দীর্ঘ দিনেও চাকরি থেকে বরখাস্ত বা বিভাগীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় স্ত্রী ও স্বজনরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এদিকে যৌতুক মামলার আসামি সহকারী পুলিশ কমিশনারের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার মির্জারকোট এলাকায় হওয়ায় পাটগ্রাম থানার ওসি ওমর ফারুখের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমরা ওয়ারেন্ট পেয়েছি। আসামির বাড়িতে কয়েকবার গিয়ে জানতে পেরেছি, আসামি বাড়িতে আসেন না। সে কারণে তাকে পলাতক দেখিয়ে আদালতে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আল ইমরান, পিতা আবুল হোসেন, বাড়ি লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার মির্জার কোট এলাকায়। তার সঙ্গে ২০১১ সালে রেজিস্ট্রি কাবিনমূলে পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলা শহরের মুন্সিপাড়া মহল্লার আবদুল গফরের মেয়ে আরিফা আখতার গোধলীর বিয়ে হয়।

মামলায় বাদিনী অভিযোগ করেন, তার সঙ্গে আল ইমরানের যখন বিয়ে হয়, তখন সে ছাত্র ছিল। সে কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে তাদের বাড়িতে তুলে নেয়নি। তার পরেও বিয়ের পর কখনও বাসাভাড়া নিয়ে, আবার বেশিরভাগ সময় আমার পিতার বাড়িতে থেকে ঘর-সংসার করে। চাকরি হলেই তাকে ঘরে তুলে নেবে বলে বারবার আশ্বাস দেয়। চাকরি হওয়ার পর আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ও আমার স্বজনরা অনুরোধ করলে সে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে। সম্প্রতি সে বেশ কিছুদিন ধরে বিশ লাখ টাকা এবং ফ্ল্যাট যৌতুক হিসেবে দাবি করতে থাকে। এতে পরিবার এবং তার স্ত্রী সম্মত না হওয়ায় আল ইমরান তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। অবশেষে ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি স্ত্রীর স্বজনরা স্বামী আল ইমরান ও তার বাবাসহ স্বজনদের তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনে বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে। আল ইমরান তার বাবাসহ স্বজনরা ওই তারিখে তাদের বাড়িতে এসে নগদ ২০ লাখ টাকা ও একটি ফ্ল্যাট যৌতুক হিসেবে দাবি করে এবং যৌতুক প্রদান না করলে স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করবে না বলে বাড়ি থেকে চলে যায়।

বাধ্য হয়ে এ ঘটনায় সহকারী পুলিশ কমিশনার আল ইমরানের স্ত্রী গোধুলী বাদী হয়ে কুড়িগ্রাম সদর আমলী আদালতে যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ এর ৩ ধারায় মামলা দায়ের করে। বিজ্ঞ আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ শেষে আসামিকে আদালতে ১২/৪/২০ তারিখে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারির আদেশ দেন। জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোশারফ হোসেন এ আদেশ দেন। (যার মামলা নম্বর সিআর ৮৫/২০০০ইং।)

কিন্তু, আদালতের আদেশ অনুযায়ী আসামী আল ইমরান আদালতে হাজির না হওয়ায় আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন এবং মামলার পরবর্তী তারিখ ছিল গতকাল ১৫ ফেরুয়ারি। কিন্তু, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর গতকাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট মাসেও আসামি আদালতে হাজির হয়নি। এমনকি, লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানা পুলিশ আসামি আল ইমরানকে গ্রেপ্তার করারও কোন উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো পাটগ্রাম থানার ওসি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে কর্মরত জেনেও তাকে পলাতক দেখিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে বলে স্বজনদের অভিযোগ।

সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল আলীম মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার সহকারী পুলিশ কমিশনার আল ইমরানের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে শুনেছেন। তবে তার কাছে কোন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আসেনি বলে জানান।

অন্যদিকে মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি পারিবারিক ঘটনা। আরএমপির একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার নেতৃত্বে বিষয়টি মীমাংসা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সেখানে আল ইমরান ও তার স্ত্রী গোধুলীও উপস্থিত ছিল। কিন্তু কোন সুরাহা করা সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে অভিযুক্ত সহকারী পুলিশ কমিশনার আল ইমরানের সঙ্গে তার সরকারি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তার বিরুদ্ধে স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ হয়েছে- এ বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি পারিবারিক, তাই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাক বলে ফোনের লাইন কেটে দেন। তিনি আর বিস্তারিত কিছুই জানাতে রাজি হননি।

এদিকে একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশের কাজ হলো, আদালতের আদেশ প্রতিপালন করা। সেখানে আট মাস আগে একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরও তিনি কীভাবে স্বপদে বহাল থাকেন? আর চাকরি করছেন, বিষয়টি জানার পরও কেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? এটা পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। সবচেয়ে বড় কথা, একজনের অপকর্মের দায় পুরো পুলিশ বাহিনী নিতে পারে না বলে জানান তিনি।