মাথাপিছু আয়

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যানুযায়ী ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে দুই হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার, যা গত বছর ছিল এক হাজার ৯৬১ দশমিক ৬১৪ ডলার। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানায় সংস্থাটি।

এক দশক আগেও ২০১০-১১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৮২৫ ডলার। নিসন্দেহে অনেক এগিয়েছে। বিশেষজ্ঞদে মতে, বাস্তবতার সঙ্গে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কোন মিল নেই। কারা এই টাকার মালিক হচ্ছে? সাধারণ মানুষের আয় কি বাড়লো? মাথাপিছু জিডিপি বাড়লেই যে সার্বিক অর্থনীতি এগিয়ে, তা বলা যাবে না। কারণ, মাথাপিছু জিডিপির মধ্যে জীবনযাত্রার মানের অনেক সূচক অন্তর্ভুক্ত থাকে না। ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) সূচকে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে মাথাপিছু জিডিপি বেশি হওয়াও অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়ার একটি পূর্ব লক্ষণ।

প্রশ্ন হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ার পরেও কি দেশের মানুষ সুবিধা পাচ্ছে? গত বছরের জুন মাসে প্রকাশিত ব্র্যাকের জরিপে দেখা যায়, সোয়া পাঁচ কোটি মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বছরের শুরুতে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপ মতে, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ।

অক্টোবরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, করোনায় সারাদেশের মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। গত এপ্রিলে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে দেশে নতুন করে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হয়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা আগের বছরের জুন পর্যন্ত ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।

গত মে মাসে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) তথ্যমতে, করোনা মহামারীর কারণে গত এক বছরে ৬২ শতাংশ মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছেন। আর করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে গত এক বছরেরও বেশি সময়ে বিদেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। গত জুলাই মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সন্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। এছাড়া গত বছর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে বেকারত্বের হার ২২ শতাংশের ওপরে চলে যায়।

মুদ্রাস্ফীতি দেখে মনে হয় না এই মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হার ঠিক আছে। বাজারে সব জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কেবল পেটের দায় মেটানোর জন্যই সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়লে দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে কেন, পেটের দায় মেটাতে গিয়ে তাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে কেন, তাহলে এ মাথাপিছু আয় বাড়ার সুফল কারা ভোগ করছে?

অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রবৃদ্ধির হিসাবে দেশ অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু, এই প্রবৃদ্ধির ফলে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সব মানুষ লাভবান হয়নি। বৈষম্য এমনভাবে বাড়ছে যে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল একটা ক্ষুদ্র ধনাঢ্য গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে জমছে। আর এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ সম্প্রতি দেশে কোটিপতি বৃদ্ধির হিসাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ছয় মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ছয় হাজার ২৮টি, যা ১৯৭২ সালে ছিল মাত্র পাঁচটি। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই হিসাব লাখ ছুঁইছুঁই করছে (৯৯ হাজার ৯১৮টি)। ফলে ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরিব হয়ছে আরও গরিব।

মাথাপিছু আয় বা প্রবৃদ্ধি বাড়া দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার একটা সূচক। আয় বাড়লেই যে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে- বিষয়টি তা নয়। উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেয়ার জন্য সম্পদের সুষম বণ্টন জরুরি। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের মাথাপিছু আয় বাড়লে বা উন্নয়ন হলেও বৈষম্য বাড়ে। বৈষম্য থাকলে প্রবৃদ্ধি ৯-১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব নয়। গত কয়েক বছরে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ গতি আছে। অবশ্য বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র বা অন্য কোন মতবাদ এলেই আয়বৈষম্য দূর করতে পারবে, সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না। আবার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমদের দেশের আয়বৈষম্য পুরোপুরি দূর করা অসম্ভব নয়। আর এই আয়বৈষম্য কমানোর একটি উপায় হচ্ছে, সঠিকভাবে কর আদায়।

কিন্তু, অভিযোগ আছে সুষম আয় বণ্টনের কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে না। মানুষের আয় যত বেশি হবে, তার করও তত বেশি দেয়ার কথা। কিন্তু, দেশে ধনবান মানুষরা কর ফাঁকি দেন। যে কারণে দেশে একদিকে ধনীর সংখাও বাড়ছে, অন্যদিকে দারিদ্র্যের সংখ্যাও বাড়ছে। আশা করব, সরকার সম্পদের সুষম বণ্টনের কাজে মনোযোগী হবে।

শনিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২১ , ৩১ আশ্বিন ১৪২৮ ০৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

মাথাপিছু আয়

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যানুযায়ী ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে দুই হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার, যা গত বছর ছিল এক হাজার ৯৬১ দশমিক ৬১৪ ডলার। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানায় সংস্থাটি।

এক দশক আগেও ২০১০-১১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৮২৫ ডলার। নিসন্দেহে অনেক এগিয়েছে। বিশেষজ্ঞদে মতে, বাস্তবতার সঙ্গে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কোন মিল নেই। কারা এই টাকার মালিক হচ্ছে? সাধারণ মানুষের আয় কি বাড়লো? মাথাপিছু জিডিপি বাড়লেই যে সার্বিক অর্থনীতি এগিয়ে, তা বলা যাবে না। কারণ, মাথাপিছু জিডিপির মধ্যে জীবনযাত্রার মানের অনেক সূচক অন্তর্ভুক্ত থাকে না। ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) সূচকে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে মাথাপিছু জিডিপি বেশি হওয়াও অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়ার একটি পূর্ব লক্ষণ।

প্রশ্ন হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ার পরেও কি দেশের মানুষ সুবিধা পাচ্ছে? গত বছরের জুন মাসে প্রকাশিত ব্র্যাকের জরিপে দেখা যায়, সোয়া পাঁচ কোটি মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বছরের শুরুতে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপ মতে, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ।

অক্টোবরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, করোনায় সারাদেশের মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। গত এপ্রিলে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে দেশে নতুন করে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হয়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা আগের বছরের জুন পর্যন্ত ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।

গত মে মাসে প্রকাশিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) তথ্যমতে, করোনা মহামারীর কারণে গত এক বছরে ৬২ শতাংশ মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছেন। আর করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবে গত এক বছরেরও বেশি সময়ে বিদেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। গত জুলাই মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সন্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। এছাড়া গত বছর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে বেকারত্বের হার ২২ শতাংশের ওপরে চলে যায়।

মুদ্রাস্ফীতি দেখে মনে হয় না এই মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হার ঠিক আছে। বাজারে সব জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কেবল পেটের দায় মেটানোর জন্যই সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়লে দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে কেন, পেটের দায় মেটাতে গিয়ে তাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে কেন, তাহলে এ মাথাপিছু আয় বাড়ার সুফল কারা ভোগ করছে?

অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রবৃদ্ধির হিসাবে দেশ অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু, এই প্রবৃদ্ধির ফলে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সব মানুষ লাভবান হয়নি। বৈষম্য এমনভাবে বাড়ছে যে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল একটা ক্ষুদ্র ধনাঢ্য গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে জমছে। আর এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ সম্প্রতি দেশে কোটিপতি বৃদ্ধির হিসাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ছয় মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ছয় হাজার ২৮টি, যা ১৯৭২ সালে ছিল মাত্র পাঁচটি। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই হিসাব লাখ ছুঁইছুঁই করছে (৯৯ হাজার ৯১৮টি)। ফলে ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরিব হয়ছে আরও গরিব।

মাথাপিছু আয় বা প্রবৃদ্ধি বাড়া দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার একটা সূচক। আয় বাড়লেই যে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে- বিষয়টি তা নয়। উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেয়ার জন্য সম্পদের সুষম বণ্টন জরুরি। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের মাথাপিছু আয় বাড়লে বা উন্নয়ন হলেও বৈষম্য বাড়ে। বৈষম্য থাকলে প্রবৃদ্ধি ৯-১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব নয়। গত কয়েক বছরে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ গতি আছে। অবশ্য বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র বা অন্য কোন মতবাদ এলেই আয়বৈষম্য দূর করতে পারবে, সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না। আবার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমদের দেশের আয়বৈষম্য পুরোপুরি দূর করা অসম্ভব নয়। আর এই আয়বৈষম্য কমানোর একটি উপায় হচ্ছে, সঠিকভাবে কর আদায়।

কিন্তু, অভিযোগ আছে সুষম আয় বণ্টনের কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে না। মানুষের আয় যত বেশি হবে, তার করও তত বেশি দেয়ার কথা। কিন্তু, দেশে ধনবান মানুষরা কর ফাঁকি দেন। যে কারণে দেশে একদিকে ধনীর সংখাও বাড়ছে, অন্যদিকে দারিদ্র্যের সংখ্যাও বাড়ছে। আশা করব, সরকার সম্পদের সুষম বণ্টনের কাজে মনোযোগী হবে।