মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন

সন্ধ্যা রানী সাহা

আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো প্রচলিত প্রশাসন ব্যবস্থার মতো top to bottom পদ্ধতিতে কাজ করতে অভ্যস্ত। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, বাজেটিং, স্টাফিং ইত্যাদি এভাবেই চলছে। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাগুলোও এই পদ্ধতিতে প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে bottom to topপদ্ধতির ব্যবহার নেই এমনটি বলা যাবে না। সরকার এ পদ্ধতিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহকে সিøপ পরিকল্পনা (SLIP: School Level Improvement Plan) এবং সিøপের বাজেট প্রণয়ন, ছোটখাটো মেরামতের কাজ, শিক্ষা কমিটি, নিলাম কমিটি তে বিদ্যালয় প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বাজেট প্রণয়ন ইত্যাদি কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছে। এই কাজগুলোকে যথাযথভাবে সম্পাদনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাপর প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ পালনেও বিদ্যালয়সমূহ সক্ষমতা অর্জন করে চলেছে। আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন যেসব কাজ করে থাকে তার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য হলো পরিকল্পনা প্রণয়ন। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আগামী এক বছরে কী কী কাজ করবে, কখন কখন করবে, কে বাস্তবায়ন করবে এসবের বিবরণ সংবলিত বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকে। পরিকল্পনা প্রণয়নকালে সর্তকতা অবলম্বন করা বাঞ্চনীয়। বাস্তবায়নযোগ্য নয় এমন কোন কাজের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে শুধু শুধু অফিস কক্ষে ঝুলিয়ে রাখা কাম্য নয়। অর্থাৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন কালে SMART বিষয়টি মনে রাখতে হবে। SMART বলতে S=Specific, M= Measurable, A= Achievable, R= Reliable, T= Time bound বুঝানো হয়েছে।

বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়নের মতো সিটিজেনস চার্টার তৈরি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিদ্যালয় থেকে কী ধরনের সেবা জনগণকে প্রদান করা হবে, কখন করা হবে, কে করবে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা সম্বলিত প্রদর্শন যোগ্য লিখিত বিবরণী হলো সিটিজেন চার্টার। এটি দৃশ্যমান স্থানে স্থাপন করতে হবে। মা-সমাবেশ, অভিভাবক- সমাবেশ, ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভা ইত্যাদিতে সিটিজেনস চার্টার বিষয়ে জনগণকে অবহিত করা প্রয়োজন। অভিভাবকদের অনেকে নিরক্ষর বিধায় বিদ্যালয় থেকে কখন কী ধরনের সেবা তারা পেতে পারেন তা তাদের অবশ্যই জানাতে হবে। কারণ শিক্ষার জন্য উপবৃত্তির অর্থ প্রাপ্তির বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে প্রতারকরা কৌশলে অভিভাবকদের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ আত্মসাৎ করতে পারে। অতএব সিটিজেন চার্টার বিষয়ে জনসাধারণকে অবহিত করার কাজটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনকে বাধ্যতামূলকভাবেই করতে হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনের পরিধি ব্যাপক। তাই এর গুরুত্ব আলাদাভাবে জনসাধারণকে অবগত করানো প্রয়োজন। শিক্ষকদের যথাসময়ে আগমন-প্রস্থান নিশ্চিতকরণ, যথাযথ পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা, নৈমিত্তিকসহ অন্যান্য ছুটির গ্রহণের প্রবণতা হ্রাসকরণ, বিদ্যালয় যথাসময়ে খোলা, বন্ধ করা, জাতীয় পতাকা উঠানো-নামানো, সময়মত ঘণ্টা বাজানো, দৈনিক সমাবেশ, বিভিন্ন জাতীয় দিবসসমূহ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন, শ্রেণীকাজ পরিচালনা করা; এ সবই প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ। একটি বিদ্যালয়ের সফলতা অনেকাংশেই উল্লেখিত কাজগুলোর যথানিয়মে করার ওপর নির্ভর করে। যেমন- দৈনিক সমাবেশ নিয়মিত করা হলে সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন সমবেতভাবে পড়ালেখা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা নৈতিকতা, সম্প্রীতি, শারীরিক কসরত, বিদ্যালয়ের নিয়ম শৃঙ্খলা, ইত্যাদি সমন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নত চরিত্র গঠনের মানসিকতা, গভীর মনসংযোগ, নান্দনিকতা, পরমতসহিষ্ণুতা অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যৌক্তিক চিন্তা, বিজ্ঞান মনস্কতা ইত্যাদি গুণাবলি বিকশিত হওয়ার সুযোগ এখান থেকেই শুরু হয়। সুতরাং বিদ্যালয়-প্রশাসন এসব কাজ নিয়মিতভাবে পরিচালনা করে সমাজের কাছে বিদ্যালয়কে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে। অনুরূপভাবে শিক্ষকদের যথাসময়ে আগমন-প্রস্থানও আদর্শ বিদ্যালয়ের জন্য জরুরি। অতএব প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনই শিক্ষার্থীদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এই প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে যে কোনো প্রকার অসঙ্গতি শিক্ষার্থীর জীবনে ঘোর অমানিশা নিয়ে আসতে পারে। এ বিষয়ে stake holder দের সতর্ক করাও বিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ।

... শিখন-শেখানোর উদ্দেশ্যেই মূলত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাই শিখন-শেখানো কাজ/শ্রেণী কাজ পরিচালনা বিদ্যালয় প্রশাসনের প্রধান কাজ। এছাড়াও শ্রেণীকক্ষে সব শিক্ষার্থীর প্রতি সমান মনোযোগ দিচ্ছেন কী না- সব শিক্ষার্থীর শিখনফল অর্জিত হচ্ছে কী না, শ্রেণীতে আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করছে কিনা, শ্রেণীকক্ষে সহজলভ্য উপকরণ এবং উপযুক্ত উদাহরণের সাহায্যে জীবন ঘনিষ্ঠ করে পাঠদান পরিচালনা করা হচ্ছে কী না, তা যাচাই করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনেরই অন্তর্ভুক্ত। এ সব কাজে কোন প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শন করলে বিদ্যালয় একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে।

অভিভাবকগণের সঙ্গে শিক্ষকদের সুসম্পর্ক শিখন অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। এই সম্পর্ক স্থাপন এবং বজায় রাখতে শিক্ষকবৃন্দকে হোমভিজিট, মা-সমাবেশ, অভিভাবক-সমাবেশ, জাতীয় দিবসমূহে যথার্থ ভূমিকা পালন, নিরপেক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি মূল্যায়ন, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রাখা, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট থাকা ইত্যাদি ভূমিকা পালন করতে হয়। বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন শিক্ষকের তদারকি এবং বাড়িতে অবস্থানকালে অভিভাবকদের দেখভাল উভয়ই সমানভাবে পরিচালিত হওয়া চাই। এ কাজে শিক্ষকগণকে নানাবিধ co-curricular activity তে পারদর্শী হতে হয়। যেমন- বিদ্যালয়ে একটি সচেতনতামূলক নাটকের আয়োজন করতে পারলে ভালো। কারণ পড়ালেখার পাশাপাশি নাটকের মহড়া/rehearsal কে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি শূন্যে রাখা সম্ভব। আর এ সব প্রক্রিয়া সফলভাবে পরিচালনা করাই হলো প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন। Staff meeting এবং বিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট কমিটির মিটিং বিদ্যালয় প্রশাসনের অত্যাবশ্যকীয় দুটি কাজ। বর্তমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থায় বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকগণ গাদাগাদি করে বসেন। এভাবে বসার ফলে অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আলাপ-সালাপে মগ্ন হয়ে পড়েন। এ অবস্থা বিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য সহায়ক নয়। শিক্ষকগণ আলাদা আলাদা কক্ষে অবস্থানের সুযোগ পেলে তারা শিখন শেখানো কলাকৌশল উদ্ভাবনে মনোযোগী হবেন। শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ মূল্যায়ন, পাঠ পরিকল্পনা তৈরি, উপকরণ তৈরি এবং সংরক্ষণ, শিক্ষার্থীদের শেখানো অনুশীলন, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য পৃথক প্রোফাইল তৈরি, অপারগ শিক্ষার্থীদের আলাদা করে নিজের কক্ষে এনে অতিরিক্ত সময় ধরে পাঠদান ইত্যাদি নানা কাজের প্রয়োজনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের ন্যায় পৃথক পৃথক কক্ষের ব্যবস্থাপনা এই বিশ্বায়নের যুগে যুক্তিযুক্ত।

কারণ শিক্ষকগণের যোগ্যতাবৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন। স্টাফ মিটিং যে কোন প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই মিটিংয়ে প্রধান শিক্ষক সহকারী শিক্ষকগণের পাঠদান পরিবীক্ষণের প্রেক্ষিতে উন্নয়নের পরামর্শ দেন। শিক্ষকগণ (সহকারী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক) পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের জানার পরিধি বিস্তৃত করতে পারেন। পেশার প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হতে পারেন। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষকরা পেশা বিষয়ে আরও motivated হতে পারেন। শ্রেণীকাজ পরিচালনার বাইরে অতিরিক্ত সময়ে (সাধারণত বিদ্যালয় ছুটির পর) এই staff meeting পরিচালনা করবে বিদ্যালয় প্রশাসন। শ্রেণীকাজ পরিচালনায় উৎসাহ প্রদান, উন্নত শিখন-শেখানো কলা কৌশল আয়ত্বকরণ, শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা সম্বন্ধে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অপারগ শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের প্রতি কীভাবে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া যায়, কীভাবে নানা বর্ণের, ধর্মের, জাতির, গোষ্ঠীর ও পেশা থেকে আগত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রশাসক ও সহায়ক কর্মীদের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব বণ্টন করা যায় এবং সব কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা যায় সে উদ্দেশ্যে নিয়মিত staff meeting পরিচালনা করবে বিদ্যালয় প্রশাসন।

কীভাবে নিরাপদ শিখন-পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় সে বিষয়েও কাজ করতে পারে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন। ংঃধভভ এবং ম্যানেজমেন্ট কমিটি উভয়েই সমন্বিত উদ্যোগে এই নিরাপদ শিখন-পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। আমরা জানি ২০১১ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট Bangladesh Legal Aid and Services Trust (BLAST) Ges Ain O Salish Kendra (ASK) এর দায়েরকৃত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যালয়সমূহে সব ধরনের শারীরিক শাস্তি প্রদানকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দিয়েছে। তথাপি ২০১৩ সালে ১৫ জনের অধিক শিক্ষার্থী একজন সহকারী শিক্ষক কর্তৃক শারীরিক শাস্তিপ্রাপ্ত হয়। ঘটনাটি ঘটে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার গুলতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (The daily Star, dated May 13, 2014) বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের শারীরিক শাস্তি প্রদানের প্রবণতা নেই বললেই চলে। তবে শিশুদের “ঝরে পড়া” রোধে অপরাগতা, মানসম্মতভাবে শিক্ষাদানে অনীহা, পক্ষপাতিত্ব, নিজ সন্তান এবং বিদ্যালয়ের দরিদ্র ও নিরক্ষর অভিভাবকের সন্তানের পাঠের মানের মধ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে অভ্যস্ত না হওয়া, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর না নেয়া এসব শিক্ষার্থীর পক্ষে শারীরিক শাস্তি প্রদানের তুলনায় বেশিই বেদনাদায়ক। কবি জসিমউদ্দীন তার কবর কবিতায় যেমন বলেছেন- “হাতেতে যদি না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে”। শিক্ষকের কটাক্ষপাত ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষার্থীদের মানসিক মৃত্যু ঘটায়। কাজেই প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনকে শিক্ষার্থীর নিরাপদ শিখন-পরিবেশ নিশ্চিত করতেই হবে।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]

রবিবার, ২১ নভেম্বর ২০২১ , ৬ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন

সন্ধ্যা রানী সাহা

আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো প্রচলিত প্রশাসন ব্যবস্থার মতো top to bottom পদ্ধতিতে কাজ করতে অভ্যস্ত। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, বাজেটিং, স্টাফিং ইত্যাদি এভাবেই চলছে। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাগুলোও এই পদ্ধতিতে প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে bottom to topপদ্ধতির ব্যবহার নেই এমনটি বলা যাবে না। সরকার এ পদ্ধতিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহকে সিøপ পরিকল্পনা (SLIP: School Level Improvement Plan) এবং সিøপের বাজেট প্রণয়ন, ছোটখাটো মেরামতের কাজ, শিক্ষা কমিটি, নিলাম কমিটি তে বিদ্যালয় প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বাজেট প্রণয়ন ইত্যাদি কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছে। এই কাজগুলোকে যথাযথভাবে সম্পাদনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাপর প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ পালনেও বিদ্যালয়সমূহ সক্ষমতা অর্জন করে চলেছে। আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন যেসব কাজ করে থাকে তার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য হলো পরিকল্পনা প্রণয়ন। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আগামী এক বছরে কী কী কাজ করবে, কখন কখন করবে, কে বাস্তবায়ন করবে এসবের বিবরণ সংবলিত বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকে। পরিকল্পনা প্রণয়নকালে সর্তকতা অবলম্বন করা বাঞ্চনীয়। বাস্তবায়নযোগ্য নয় এমন কোন কাজের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে শুধু শুধু অফিস কক্ষে ঝুলিয়ে রাখা কাম্য নয়। অর্থাৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন কালে SMART বিষয়টি মনে রাখতে হবে। SMART বলতে S=Specific, M= Measurable, A= Achievable, R= Reliable, T= Time bound বুঝানো হয়েছে।

বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়নের মতো সিটিজেনস চার্টার তৈরি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিদ্যালয় থেকে কী ধরনের সেবা জনগণকে প্রদান করা হবে, কখন করা হবে, কে করবে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা সম্বলিত প্রদর্শন যোগ্য লিখিত বিবরণী হলো সিটিজেন চার্টার। এটি দৃশ্যমান স্থানে স্থাপন করতে হবে। মা-সমাবেশ, অভিভাবক- সমাবেশ, ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভা ইত্যাদিতে সিটিজেনস চার্টার বিষয়ে জনগণকে অবহিত করা প্রয়োজন। অভিভাবকদের অনেকে নিরক্ষর বিধায় বিদ্যালয় থেকে কখন কী ধরনের সেবা তারা পেতে পারেন তা তাদের অবশ্যই জানাতে হবে। কারণ শিক্ষার জন্য উপবৃত্তির অর্থ প্রাপ্তির বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে প্রতারকরা কৌশলে অভিভাবকদের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ আত্মসাৎ করতে পারে। অতএব সিটিজেন চার্টার বিষয়ে জনসাধারণকে অবহিত করার কাজটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনকে বাধ্যতামূলকভাবেই করতে হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনের পরিধি ব্যাপক। তাই এর গুরুত্ব আলাদাভাবে জনসাধারণকে অবগত করানো প্রয়োজন। শিক্ষকদের যথাসময়ে আগমন-প্রস্থান নিশ্চিতকরণ, যথাযথ পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা, নৈমিত্তিকসহ অন্যান্য ছুটির গ্রহণের প্রবণতা হ্রাসকরণ, বিদ্যালয় যথাসময়ে খোলা, বন্ধ করা, জাতীয় পতাকা উঠানো-নামানো, সময়মত ঘণ্টা বাজানো, দৈনিক সমাবেশ, বিভিন্ন জাতীয় দিবসসমূহ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন, শ্রেণীকাজ পরিচালনা করা; এ সবই প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ। একটি বিদ্যালয়ের সফলতা অনেকাংশেই উল্লেখিত কাজগুলোর যথানিয়মে করার ওপর নির্ভর করে। যেমন- দৈনিক সমাবেশ নিয়মিত করা হলে সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন সমবেতভাবে পড়ালেখা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা নৈতিকতা, সম্প্রীতি, শারীরিক কসরত, বিদ্যালয়ের নিয়ম শৃঙ্খলা, ইত্যাদি সমন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নত চরিত্র গঠনের মানসিকতা, গভীর মনসংযোগ, নান্দনিকতা, পরমতসহিষ্ণুতা অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যৌক্তিক চিন্তা, বিজ্ঞান মনস্কতা ইত্যাদি গুণাবলি বিকশিত হওয়ার সুযোগ এখান থেকেই শুরু হয়। সুতরাং বিদ্যালয়-প্রশাসন এসব কাজ নিয়মিতভাবে পরিচালনা করে সমাজের কাছে বিদ্যালয়কে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে। অনুরূপভাবে শিক্ষকদের যথাসময়ে আগমন-প্রস্থানও আদর্শ বিদ্যালয়ের জন্য জরুরি। অতএব প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনই শিক্ষার্থীদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এই প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে যে কোনো প্রকার অসঙ্গতি শিক্ষার্থীর জীবনে ঘোর অমানিশা নিয়ে আসতে পারে। এ বিষয়ে stake holder দের সতর্ক করাও বিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ।

... শিখন-শেখানোর উদ্দেশ্যেই মূলত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাই শিখন-শেখানো কাজ/শ্রেণী কাজ পরিচালনা বিদ্যালয় প্রশাসনের প্রধান কাজ। এছাড়াও শ্রেণীকক্ষে সব শিক্ষার্থীর প্রতি সমান মনোযোগ দিচ্ছেন কী না- সব শিক্ষার্থীর শিখনফল অর্জিত হচ্ছে কী না, শ্রেণীতে আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করছে কিনা, শ্রেণীকক্ষে সহজলভ্য উপকরণ এবং উপযুক্ত উদাহরণের সাহায্যে জীবন ঘনিষ্ঠ করে পাঠদান পরিচালনা করা হচ্ছে কী না, তা যাচাই করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনেরই অন্তর্ভুক্ত। এ সব কাজে কোন প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শন করলে বিদ্যালয় একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে।

অভিভাবকগণের সঙ্গে শিক্ষকদের সুসম্পর্ক শিখন অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। এই সম্পর্ক স্থাপন এবং বজায় রাখতে শিক্ষকবৃন্দকে হোমভিজিট, মা-সমাবেশ, অভিভাবক-সমাবেশ, জাতীয় দিবসমূহে যথার্থ ভূমিকা পালন, নিরপেক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি মূল্যায়ন, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রাখা, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট থাকা ইত্যাদি ভূমিকা পালন করতে হয়। বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন শিক্ষকের তদারকি এবং বাড়িতে অবস্থানকালে অভিভাবকদের দেখভাল উভয়ই সমানভাবে পরিচালিত হওয়া চাই। এ কাজে শিক্ষকগণকে নানাবিধ co-curricular activity তে পারদর্শী হতে হয়। যেমন- বিদ্যালয়ে একটি সচেতনতামূলক নাটকের আয়োজন করতে পারলে ভালো। কারণ পড়ালেখার পাশাপাশি নাটকের মহড়া/rehearsal কে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি শূন্যে রাখা সম্ভব। আর এ সব প্রক্রিয়া সফলভাবে পরিচালনা করাই হলো প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন। Staff meeting এবং বিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট কমিটির মিটিং বিদ্যালয় প্রশাসনের অত্যাবশ্যকীয় দুটি কাজ। বর্তমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থায় বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকগণ গাদাগাদি করে বসেন। এভাবে বসার ফলে অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আলাপ-সালাপে মগ্ন হয়ে পড়েন। এ অবস্থা বিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য সহায়ক নয়। শিক্ষকগণ আলাদা আলাদা কক্ষে অবস্থানের সুযোগ পেলে তারা শিখন শেখানো কলাকৌশল উদ্ভাবনে মনোযোগী হবেন। শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ মূল্যায়ন, পাঠ পরিকল্পনা তৈরি, উপকরণ তৈরি এবং সংরক্ষণ, শিক্ষার্থীদের শেখানো অনুশীলন, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য পৃথক প্রোফাইল তৈরি, অপারগ শিক্ষার্থীদের আলাদা করে নিজের কক্ষে এনে অতিরিক্ত সময় ধরে পাঠদান ইত্যাদি নানা কাজের প্রয়োজনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের ন্যায় পৃথক পৃথক কক্ষের ব্যবস্থাপনা এই বিশ্বায়নের যুগে যুক্তিযুক্ত।

কারণ শিক্ষকগণের যোগ্যতাবৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন। স্টাফ মিটিং যে কোন প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই মিটিংয়ে প্রধান শিক্ষক সহকারী শিক্ষকগণের পাঠদান পরিবীক্ষণের প্রেক্ষিতে উন্নয়নের পরামর্শ দেন। শিক্ষকগণ (সহকারী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক) পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের জানার পরিধি বিস্তৃত করতে পারেন। পেশার প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হতে পারেন। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষকরা পেশা বিষয়ে আরও motivated হতে পারেন। শ্রেণীকাজ পরিচালনার বাইরে অতিরিক্ত সময়ে (সাধারণত বিদ্যালয় ছুটির পর) এই staff meeting পরিচালনা করবে বিদ্যালয় প্রশাসন। শ্রেণীকাজ পরিচালনায় উৎসাহ প্রদান, উন্নত শিখন-শেখানো কলা কৌশল আয়ত্বকরণ, শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা সম্বন্ধে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অপারগ শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের প্রতি কীভাবে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া যায়, কীভাবে নানা বর্ণের, ধর্মের, জাতির, গোষ্ঠীর ও পেশা থেকে আগত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রশাসক ও সহায়ক কর্মীদের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব বণ্টন করা যায় এবং সব কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা যায় সে উদ্দেশ্যে নিয়মিত staff meeting পরিচালনা করবে বিদ্যালয় প্রশাসন।

কীভাবে নিরাপদ শিখন-পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় সে বিষয়েও কাজ করতে পারে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসন। ংঃধভভ এবং ম্যানেজমেন্ট কমিটি উভয়েই সমন্বিত উদ্যোগে এই নিরাপদ শিখন-পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। আমরা জানি ২০১১ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট Bangladesh Legal Aid and Services Trust (BLAST) Ges Ain O Salish Kendra (ASK) এর দায়েরকৃত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যালয়সমূহে সব ধরনের শারীরিক শাস্তি প্রদানকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দিয়েছে। তথাপি ২০১৩ সালে ১৫ জনের অধিক শিক্ষার্থী একজন সহকারী শিক্ষক কর্তৃক শারীরিক শাস্তিপ্রাপ্ত হয়। ঘটনাটি ঘটে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার গুলতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (The daily Star, dated May 13, 2014) বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের শারীরিক শাস্তি প্রদানের প্রবণতা নেই বললেই চলে। তবে শিশুদের “ঝরে পড়া” রোধে অপরাগতা, মানসম্মতভাবে শিক্ষাদানে অনীহা, পক্ষপাতিত্ব, নিজ সন্তান এবং বিদ্যালয়ের দরিদ্র ও নিরক্ষর অভিভাবকের সন্তানের পাঠের মানের মধ্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে অভ্যস্ত না হওয়া, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর না নেয়া এসব শিক্ষার্থীর পক্ষে শারীরিক শাস্তি প্রদানের তুলনায় বেশিই বেদনাদায়ক। কবি জসিমউদ্দীন তার কবর কবিতায় যেমন বলেছেন- “হাতেতে যদি না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে”। শিক্ষকের কটাক্ষপাত ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষার্থীদের মানসিক মৃত্যু ঘটায়। কাজেই প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রশাসনকে শিক্ষার্থীর নিরাপদ শিখন-পরিবেশ নিশ্চিত করতেই হবে।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]