পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা

জগৎ চাঁদ মালাকার

মানুষের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে সুষ্ঠু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা এই পাঁচটি উপাদান একান্তই দরকার। সামগ্রিকভাবে একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে সে দেশের মোট খাদ্যর প্রাপ্যতা, জনগণের খাদ্য ক্রয়-ক্ষমতা এবং খাবার গ্রহণের ওপর (সুষম বণ্টন)। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশে^র মধ্যে ধান ও শাকসবজির উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনে দশম স্থান অধিকার করে কৃষি উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমান উৎপাদন পরিস্থিতিতে ধান বাদে অন্যান্য ফসল গম, তেলবীজ ও ডাল উৎপাদন আমাদের চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। তাছাড়া প্রাপ্যতা থাকলেও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে জনগণ কিনতে পারবে না।

আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার ৫৩% আমরা পাই দানাদার খাদ্যশস্য থেকে যা দৈনিক ২১২২ কিলো-ক্যালোরির ৭৫% ভাগ। বাকি ২৫ ভাগ কিলো-ক্যালোরি আসে ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও তেল থেকে। আমাদের প্রতিদিন ৮৫ গ্রাম ফল এবং অন্যান্য শাকসবজি খাওয়া উচিত ২৫০ গ্রামের বেশি। আমরা খেয়ে থাকি পাতা জাতীয় ২৩ গ্রাম, পাতা জাতীয় ছাড়া ৮৯ গ্রাম এবং আলুসহ শাকসবজি ১১০ গ্রামের মত যার মধ্যে প্রায় ৭০ গ্রাম আলু, ফল ১৪ গ্রাম। আমাদের খাদ্য তালিকায় ফল ও শাকসবজি খুবই কম থাকে।

স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন মাথাপিছু ২৫০ গ্রামেরও বেশি সবজি খাওয়া প্রয়োজন। সারা বছর টাটকা ফল, শাকসবজি ও মসলা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। শাকসবজি থেকে প্রাপ্ত পর্যাপ্ত ভিটামিন ও খনিজ লবণ পাওয়া যায়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি অভাব হচ্ছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, লৌহ, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন। বাংলাদেশে শতকরা ৪২ ভাগ শিশু অপুষ্টিতে ভূগছে। অপুষ্টিজনিত কারণে রক্তশূন্যতা, মুখের ঘা, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া, বেরিবেরি, গলগ- ইত্যাদি রোগ হয়। ভিটামিন ‘এ’র অভাবে শিশুর রাতকানা রোগ হয় এবং শিশু অন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাজার থেকে সংগৃহীত বেশিরভাগ সবজিতে লুকায়িত কীটনাশকের বিষক্রিয়া মানব স্বাস্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সবজি সবসময় টাটকা খেতে হবে। সবজি কাটার পর ধোয়া যাবে না। কাটার পূর্বে সবজি ধুয়ে নিতে হবে। সবজি কাটার পর ধুয়ে নিলে পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন-বি ও সি এবং খনিজ লবণ চলে যাবে। সবজিতে অবস্থিত ভিটামিন এ, ডি, ই, কে আমাদের শরীরের জন্য গ্রহণোপযোগী করতে হলে সবজিকে তেল দিয়ে রান্না করে খেতে হবে। রঙ্গিন সবজিতে উক্ত ভিটামিনগুলো প্রচুর পরিমাণে থাকে।

খাদ্যমান বজায় রাখার কৌশল : মাছ-মাংস (বড় টুকরা), ডাল অল্প তাপে একটু সময় নিয়ে রান্না করলে এগুলোর আমিষ জমাট বাঁধতে সুবিধা হয় এবং হজমে সুবিধা হয় তাড়াতাড়ি এবং বেশি সিদ্ধ করলে খাদ্যের পুষ্টিমান কমে যায়। মাছ ভাজার সময় তেলে ডুবে ভাজতে হবেÑ তা না পুষ্টিমান কমে যাবে। ডিম ভাজার সময় ঢেকে দিতে হবে তা না হলে ভিটামিন বি-২ নষ্ট হয়ে যাবে। দুধ সহজেই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় বিধায় কাঁচা দুধ বা একবার ফুটানো ঠা-া দুধ খেতে হলে আবার ১০ মিনিট ফুটিয়ে পান করুন। সূর্যের আলোতে দুধের ভিটামিন বি-২ নষ্ট হয়ে যায় বিধায় দুধ ছায়ায় সরংক্ষণ করুন। তাপে দুধের পুষ্টিমান নষ্ট হয় না।

যে সব সবজি কাঁচা খাওয়া যায় সেগুলো কাঁচা খাওয়ার অভ্যাস করুন পুষ্টিমান বজায় থাকবে।

রান্নার ফলে চর্বি-জাতীয় খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় থাকে। তবে ভাজা তেল বার বার ব্যবহার না করাই যুক্তিযুক্ত। কারণ উক্ত তেলে এক ধরনের বিষাক্ত দ্রব্য তৈরি হয়, যা পেটের পীড়ার কারণ হতে পারে।

গমের তৈরি আটা/ময়দাতে বেকিং পাউডার মিশিয়ে মচমচে খাবার তৈরির সময় ভিটামিন বি-নষ্ট হয়ে যায়। বিধায় বেকিং পাউডার ব্যবহার সীমিত করুন।

খাদ্যাভাস পরিবর্তন : খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার, সুষম খাদ্য ও টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনার স্বার্থে আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তন একান্তই জরুরি, আমরা খেতে পারি চালের বিকল্প হিসেবে গম, ভুট্টা, মিষ্টি আলু ইত্যাদি। কারণ বিশে^র বিভিন্ন দেশের উক্ত খাবার হিসেবে জনগণ গ্রহণ করে আসছে।

গম : ধানের পরে গমের অবস্থান। গম চাষে ধানের চেয়ে ৩-চারগুণ পানি কম লাগে। খরচ কম এবং রোগ বালাই কম হয়। বর্তমানে শহর ও গ্রামে সবার মধ্যে গমের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।

ভুট্টা : ভুট্টা চাষে ধানের তুলনায় পানি কম লাগে। ক্রমবর্ধমান পোলট্রি শিল্পে প্রচুর ব্যবহার হয়। শতকরা ৪০ ভাগ ভুট্টা+৬০ ভাগ আটা দিয়ে তৈরি রুটি উৎকৃষ্ট মানের হয়। ভুট্টা সহজেই এদেশে চাষ করা যায়। ক্রমবর্ধমান পোলট্রি শিল্পে এটি ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে।

আলু : ৪০টি দেশের প্রধান খাদ্য। আলু পুষ্টি সমৃদ্ধ প্রচুর পুষ্টি, ক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট, খনিজ ও ভিটামিন রয়েছে। আলু দিয়ে ফ্রেন্সফ্রাই, ম্যাশত, পটেটো, চিপস, আলুর ময়দা, পটেটো ফ্লেক্সা, আলু রুটি, লুচি, পুরি, আলু সবজি, খিচুড়ি, আলুর ডাল, চপ, সিঙ্গারা ইত্যাদি তৈরি করা যায়।

মিষ্টি আলু : পুষ্টিমান গোল আলুর চেয়ে কম নয়। এটা আমরা সবাই খাবার হিসেবে গ্রহণ করে গরিবের খাদ্য এই অপবাদ ঘুচাতে পারি।

শাকসবজি : আমাদের খাদ্য তালিকায় ভাত ও শাকসবজির অনুপাত ৫ঃ১। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে ২ঃ১। আমরা খাবারে শাকসবজি বেশি করে গ্রহণ করে, দানা জাতীয় খাদ্যের চাপ কমাতে পারি এবং সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারি।

দেশীয় ফল : আমরা যদি বেশি করে মৌসুমের ফল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি তবে সহজেই সুস্থ থাকতে পারব এবং এতে অন্যান্য খাদ্যের ওপরে চাপ কমে যাবে।

বাংলাদেশে একটি জনবহুল দেশ। এদেশে উৎপাদন বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। এই জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। নতুন কৃষি সম্প্রসারণ নীতির আলোকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং তার উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ধারণা নিতে হবে খাদ্য পুষ্টি সম্পর্কে এবং পরিবর্তন করতে হবে খাদ্যাভাস, তবেই সম্ভব হবে খাদ্যে নিরাপত্তা।

বসতবাড়িতে সবজি উৎপাদন আমাদের গ্রামগুলোতে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে কিন্তু সাম্প্রতিককালে মানুষের জীবযাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় অনেকেই বসতবাড়িতে আগের মতো সবজি আবাদ করছে না। সবজির ব্যাপক চাহিদার কারণে বাজারে এখন সবজির উচ্চমূল্য, যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলে যায় বলে বেশিরভাগ মানুষ সবজি বাজার থেকে কিনে খেতে পারে না। এই সমস্যা থেকে বের হয়ে গ্রামের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কৃষক/কৃষাণিদের সবজি, ফল ও মসলা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আমাদের দেশের আবহাওয়া ও মাটি ফল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এদেশে প্রায় ১৩০ প্রজাতির ফল উৎপাদিত হয়ে থাকে তার মধ্যে প্রায় ৯টি প্রধান। দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ২.৫% বর্তমানে ফল আবাদের আওতাধীন। দেশের মোট ফল উৎপাদনের প্রায় ৫২% উৎপাদিত হয় বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসে। বাকি ৪৮% ফল আবাদ হয় বছরের অবশিষ্ট ৮ মাসে এবং শীত মৌসুমে দেশে ফলের আবাদ সবচেয়ে কম। অথচ আমাদের দেশে এখনও বসতবাড়িতে পরিকল্পিতভাবে ফল আবাদ করে ১২ মাসই আমরা নিজেদের ফলের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি।

এতে করে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি, মসলা ও ফল পাওয়াসহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। উত্তম কৃষি পদ্ধতি সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম যা অনুসরণে নিরাপদ এবং মান সম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য, পরিবেশ সুরক্ষা, অর্থনীতি এবং সমাজ সুসংহত হবে। আহ্বান জানাচ্ছি সবাইকে, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা ফুড সিস্টেমকে নিরাপদ করতে হলে আমাদের দেশে এখনও বসতবাড়িতে পরিকল্পিতভাবে নিরাপদ মসলা, শাকসবজি ও ফল আবাদ করে ১২ মাসই আমরা নিজেদের মসলা, শাকসবজি ও ফলের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি।

আমাদের মাটি ও পরিবেশ ফল, শাকসবজি ও মসলা উৎপাদনের সহায়ক। বসতবাড়ির আঙিনায় হতে পারে সুন্দর সবজি বাগান। সেখানে চাষ করা যায় লালশাক, ঢেঁড়স, ডাঁটাশাক ইত্যাদি। ঘরের চালে, বেড়ায়, মাচায় করা যায় লাউ, সিম, বরবটি, কাঁকরোল, করল্লার ইত্যাদি চাষ। প্রতিটি বাড়িতে ২-৩টি পেঁপে গাছ, লেবু, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমলকি ইত্যাদি লাগানো যেতে পারবে। ফল ও সবজি চাষ করলে নিশ্চিত হবে সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিয়ামক পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার।

[লেখক: উপপরিচালক (এল. আর), সংযুক্ত-উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর]

সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১ , ৭ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৬ রবিউস সানি ১৪৪৩

পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা

জগৎ চাঁদ মালাকার

মানুষের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে সুষ্ঠু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা এই পাঁচটি উপাদান একান্তই দরকার। সামগ্রিকভাবে একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে সে দেশের মোট খাদ্যর প্রাপ্যতা, জনগণের খাদ্য ক্রয়-ক্ষমতা এবং খাবার গ্রহণের ওপর (সুষম বণ্টন)। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশে^র মধ্যে ধান ও শাকসবজির উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনে দশম স্থান অধিকার করে কৃষি উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমান উৎপাদন পরিস্থিতিতে ধান বাদে অন্যান্য ফসল গম, তেলবীজ ও ডাল উৎপাদন আমাদের চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। তাছাড়া প্রাপ্যতা থাকলেও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে জনগণ কিনতে পারবে না।

আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার ৫৩% আমরা পাই দানাদার খাদ্যশস্য থেকে যা দৈনিক ২১২২ কিলো-ক্যালোরির ৭৫% ভাগ। বাকি ২৫ ভাগ কিলো-ক্যালোরি আসে ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও তেল থেকে। আমাদের প্রতিদিন ৮৫ গ্রাম ফল এবং অন্যান্য শাকসবজি খাওয়া উচিত ২৫০ গ্রামের বেশি। আমরা খেয়ে থাকি পাতা জাতীয় ২৩ গ্রাম, পাতা জাতীয় ছাড়া ৮৯ গ্রাম এবং আলুসহ শাকসবজি ১১০ গ্রামের মত যার মধ্যে প্রায় ৭০ গ্রাম আলু, ফল ১৪ গ্রাম। আমাদের খাদ্য তালিকায় ফল ও শাকসবজি খুবই কম থাকে।

স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন মাথাপিছু ২৫০ গ্রামেরও বেশি সবজি খাওয়া প্রয়োজন। সারা বছর টাটকা ফল, শাকসবজি ও মসলা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। শাকসবজি থেকে প্রাপ্ত পর্যাপ্ত ভিটামিন ও খনিজ লবণ পাওয়া যায়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি অভাব হচ্ছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, লৌহ, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন। বাংলাদেশে শতকরা ৪২ ভাগ শিশু অপুষ্টিতে ভূগছে। অপুষ্টিজনিত কারণে রক্তশূন্যতা, মুখের ঘা, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়া, বেরিবেরি, গলগ- ইত্যাদি রোগ হয়। ভিটামিন ‘এ’র অভাবে শিশুর রাতকানা রোগ হয় এবং শিশু অন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাজার থেকে সংগৃহীত বেশিরভাগ সবজিতে লুকায়িত কীটনাশকের বিষক্রিয়া মানব স্বাস্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সবজি সবসময় টাটকা খেতে হবে। সবজি কাটার পর ধোয়া যাবে না। কাটার পূর্বে সবজি ধুয়ে নিতে হবে। সবজি কাটার পর ধুয়ে নিলে পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন-বি ও সি এবং খনিজ লবণ চলে যাবে। সবজিতে অবস্থিত ভিটামিন এ, ডি, ই, কে আমাদের শরীরের জন্য গ্রহণোপযোগী করতে হলে সবজিকে তেল দিয়ে রান্না করে খেতে হবে। রঙ্গিন সবজিতে উক্ত ভিটামিনগুলো প্রচুর পরিমাণে থাকে।

খাদ্যমান বজায় রাখার কৌশল : মাছ-মাংস (বড় টুকরা), ডাল অল্প তাপে একটু সময় নিয়ে রান্না করলে এগুলোর আমিষ জমাট বাঁধতে সুবিধা হয় এবং হজমে সুবিধা হয় তাড়াতাড়ি এবং বেশি সিদ্ধ করলে খাদ্যের পুষ্টিমান কমে যায়। মাছ ভাজার সময় তেলে ডুবে ভাজতে হবেÑ তা না পুষ্টিমান কমে যাবে। ডিম ভাজার সময় ঢেকে দিতে হবে তা না হলে ভিটামিন বি-২ নষ্ট হয়ে যাবে। দুধ সহজেই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় বিধায় কাঁচা দুধ বা একবার ফুটানো ঠা-া দুধ খেতে হলে আবার ১০ মিনিট ফুটিয়ে পান করুন। সূর্যের আলোতে দুধের ভিটামিন বি-২ নষ্ট হয়ে যায় বিধায় দুধ ছায়ায় সরংক্ষণ করুন। তাপে দুধের পুষ্টিমান নষ্ট হয় না।

যে সব সবজি কাঁচা খাওয়া যায় সেগুলো কাঁচা খাওয়ার অভ্যাস করুন পুষ্টিমান বজায় থাকবে।

রান্নার ফলে চর্বি-জাতীয় খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় থাকে। তবে ভাজা তেল বার বার ব্যবহার না করাই যুক্তিযুক্ত। কারণ উক্ত তেলে এক ধরনের বিষাক্ত দ্রব্য তৈরি হয়, যা পেটের পীড়ার কারণ হতে পারে।

গমের তৈরি আটা/ময়দাতে বেকিং পাউডার মিশিয়ে মচমচে খাবার তৈরির সময় ভিটামিন বি-নষ্ট হয়ে যায়। বিধায় বেকিং পাউডার ব্যবহার সীমিত করুন।

খাদ্যাভাস পরিবর্তন : খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার, সুষম খাদ্য ও টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনার স্বার্থে আমাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তন একান্তই জরুরি, আমরা খেতে পারি চালের বিকল্প হিসেবে গম, ভুট্টা, মিষ্টি আলু ইত্যাদি। কারণ বিশে^র বিভিন্ন দেশের উক্ত খাবার হিসেবে জনগণ গ্রহণ করে আসছে।

গম : ধানের পরে গমের অবস্থান। গম চাষে ধানের চেয়ে ৩-চারগুণ পানি কম লাগে। খরচ কম এবং রোগ বালাই কম হয়। বর্তমানে শহর ও গ্রামে সবার মধ্যে গমের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।

ভুট্টা : ভুট্টা চাষে ধানের তুলনায় পানি কম লাগে। ক্রমবর্ধমান পোলট্রি শিল্পে প্রচুর ব্যবহার হয়। শতকরা ৪০ ভাগ ভুট্টা+৬০ ভাগ আটা দিয়ে তৈরি রুটি উৎকৃষ্ট মানের হয়। ভুট্টা সহজেই এদেশে চাষ করা যায়। ক্রমবর্ধমান পোলট্রি শিল্পে এটি ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে।

আলু : ৪০টি দেশের প্রধান খাদ্য। আলু পুষ্টি সমৃদ্ধ প্রচুর পুষ্টি, ক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট, খনিজ ও ভিটামিন রয়েছে। আলু দিয়ে ফ্রেন্সফ্রাই, ম্যাশত, পটেটো, চিপস, আলুর ময়দা, পটেটো ফ্লেক্সা, আলু রুটি, লুচি, পুরি, আলু সবজি, খিচুড়ি, আলুর ডাল, চপ, সিঙ্গারা ইত্যাদি তৈরি করা যায়।

মিষ্টি আলু : পুষ্টিমান গোল আলুর চেয়ে কম নয়। এটা আমরা সবাই খাবার হিসেবে গ্রহণ করে গরিবের খাদ্য এই অপবাদ ঘুচাতে পারি।

শাকসবজি : আমাদের খাদ্য তালিকায় ভাত ও শাকসবজির অনুপাত ৫ঃ১। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে ২ঃ১। আমরা খাবারে শাকসবজি বেশি করে গ্রহণ করে, দানা জাতীয় খাদ্যের চাপ কমাতে পারি এবং সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারি।

দেশীয় ফল : আমরা যদি বেশি করে মৌসুমের ফল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি তবে সহজেই সুস্থ থাকতে পারব এবং এতে অন্যান্য খাদ্যের ওপরে চাপ কমে যাবে।

বাংলাদেশে একটি জনবহুল দেশ। এদেশে উৎপাদন বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। এই জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। নতুন কৃষি সম্প্রসারণ নীতির আলোকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং তার উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ধারণা নিতে হবে খাদ্য পুষ্টি সম্পর্কে এবং পরিবর্তন করতে হবে খাদ্যাভাস, তবেই সম্ভব হবে খাদ্যে নিরাপত্তা।

বসতবাড়িতে সবজি উৎপাদন আমাদের গ্রামগুলোতে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে কিন্তু সাম্প্রতিককালে মানুষের জীবযাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় অনেকেই বসতবাড়িতে আগের মতো সবজি আবাদ করছে না। সবজির ব্যাপক চাহিদার কারণে বাজারে এখন সবজির উচ্চমূল্য, যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলে যায় বলে বেশিরভাগ মানুষ সবজি বাজার থেকে কিনে খেতে পারে না। এই সমস্যা থেকে বের হয়ে গ্রামের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কৃষক/কৃষাণিদের সবজি, ফল ও মসলা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আমাদের দেশের আবহাওয়া ও মাটি ফল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এদেশে প্রায় ১৩০ প্রজাতির ফল উৎপাদিত হয়ে থাকে তার মধ্যে প্রায় ৯টি প্রধান। দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ২.৫% বর্তমানে ফল আবাদের আওতাধীন। দেশের মোট ফল উৎপাদনের প্রায় ৫২% উৎপাদিত হয় বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসে। বাকি ৪৮% ফল আবাদ হয় বছরের অবশিষ্ট ৮ মাসে এবং শীত মৌসুমে দেশে ফলের আবাদ সবচেয়ে কম। অথচ আমাদের দেশে এখনও বসতবাড়িতে পরিকল্পিতভাবে ফল আবাদ করে ১২ মাসই আমরা নিজেদের ফলের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি।

এতে করে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি, মসলা ও ফল পাওয়াসহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। উত্তম কৃষি পদ্ধতি সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম যা অনুসরণে নিরাপদ এবং মান সম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য, পরিবেশ সুরক্ষা, অর্থনীতি এবং সমাজ সুসংহত হবে। আহ্বান জানাচ্ছি সবাইকে, নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা ফুড সিস্টেমকে নিরাপদ করতে হলে আমাদের দেশে এখনও বসতবাড়িতে পরিকল্পিতভাবে নিরাপদ মসলা, শাকসবজি ও ফল আবাদ করে ১২ মাসই আমরা নিজেদের মসলা, শাকসবজি ও ফলের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারি।

আমাদের মাটি ও পরিবেশ ফল, শাকসবজি ও মসলা উৎপাদনের সহায়ক। বসতবাড়ির আঙিনায় হতে পারে সুন্দর সবজি বাগান। সেখানে চাষ করা যায় লালশাক, ঢেঁড়স, ডাঁটাশাক ইত্যাদি। ঘরের চালে, বেড়ায়, মাচায় করা যায় লাউ, সিম, বরবটি, কাঁকরোল, করল্লার ইত্যাদি চাষ। প্রতিটি বাড়িতে ২-৩টি পেঁপে গাছ, লেবু, আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমলকি ইত্যাদি লাগানো যেতে পারবে। ফল ও সবজি চাষ করলে নিশ্চিত হবে সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিয়ামক পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার।

[লেখক: উপপরিচালক (এল. আর), সংযুক্ত-উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর]