মাটি-বালু খেকোরা বেপরোয়া শীতকালেও ভাঙছে নদীর পাড়

ঝালকাঠির সুগন্ধা, বিষখালী ও হলতা নদীর তীর এবং সংলগ্ন ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে সাবাড় করে ফেলছে সংঘবদ্ধ চক্র। অবাধে চলছে ড্রেজারে অবৈধ বালু উত্তোলন এবং এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ঝালকাঠিতে আসা গ্যাস সিলিন্ডার বোঝাই জাহাজের ঢেউয়ের চাপ। তাই শুকনো মৌসুমেও ঝালকাঠি ও নলছিটি এলাকায় নদী ভাঙন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ।

নদী পাড়ের বাসিন্দাদের কাছে ভাঙন এক আতঙ্কের নাম । ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি ইউনিয়নের সরই গ্রামটি প্রতিবছর ভাঙনের কারণে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। অর্থবিত্তরা অন্যত্র জমি কিনে নিজ ভিটা ত্যাগ করছে। আর নিম্নœবিত্তরা সব হারিয়ে অন্যের আশ্রয়ে থেকে ভিক্ষা বা অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছে। ইতোমধ্যেই রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসাসহ সরই গ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি বছর বর্ষায় নদী ভাঙন অব্যাহত থাকলেও শীতকালেও ভাঙছে সরই গ্রামের শেষাংশ। এ বছর তা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়ায় ধারণা করা হচ্ছে গ্রামটি নিশ্চহ্ন হয়ে যাবে।

এ বছর জুন মাস থেকেই জেলার সুগন্ধা, বিষখালী এবং হলতা নদীর ভাঙন বিগত বছরের তুলনায় অনেকটা বেশি। সুগন্ধা নদীর প্রবেশমুখ বিষখালীর তীরে থাকা একটি সাইক্লোন সেল্টার চলতি বছরের ২৬ আগস্ট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানায় বরিশাল-খুলনা নৌ রুটের ঝালকাঠি অংশে এলপি গ্যাস বহনকারী জাহাজের ঢেউয়ের তোড়ে শাখা নদীগুলোও ভেঙ্গে নিচ্ছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলের মাঠ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধভাবে রাতের আধারে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন এবং নৌযানের দ্রুত গতির কারনে নদী তীরের ভাঙনের তীব্রতা অব্যাহত আছে। জেলা প্রশাসন ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীকে বালু মহল ঘোষণা না করলেও দিনের বেলার বালু উত্তোলন বন্ধ করেছে ঠিকই। কিন্তু সিন্ডিকেটের রাতের বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি।

নদীপাড়ের বাসিন্দা সুখী বেগম বলেন, যাদের জমি ভেঙ্গেছে তারা ওই জমির মাটি ইট ভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে ভাঙন আরো বাড়ছে। এছাড়া প্রত্যেক রাতে ডেজারের বালু তোলার কারনে নদীর পাড় ধসে পড়ছে। একইসঙ্গে গ্যাস কোম্পানির জাহাজের তুফানে বাড়ির উঠানে পানি চলে আসে। ছোট বাচ্চা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখি। যাতে নদীতে পরে না যায়। কুলকাঠি ইউনিয়নের সরই গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক আব্দুল জব্বার তালুকদার বলেন, প্রতিবছর সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ পাড় ভাঙ্গতেছে। সরই এলাকার নদীর পাড় থেকে গত কয়েকবছরে প্রায় ৬০টি পরিবার স্থানান্তরিত হয়েছে। একই এলাকার নুর মোহাম্মদ বলেন, সরই গ্রামের ভাঙ্গনকুলের অনেকে নিজেদের সবটুকু ভিটে মাটি হরিয়ে রাস্তার পাশে সরকারি জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছে। আমার নিজের যতটুকু জমি আছে তা আগামী ১ বছরের মধ্যে নদীগর্ভে চলে যাবে। বিশেষ করে রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে এ ভঙন ক্রমান্ব^য়ে তীব্র হচ্ছে। আরেক ভুক্তভোগী শহিদুল ইসলাম বলেন, আমার জন্মস্থানের ঘরটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ৫০ বছরেও এই স্থানটি ভাঙন রোধে কোন সরকার উদ্যোগ নেয়নি। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। ভুক্তভোগী গৃহিনী মোসাম্মৎ নিপা বলেন, নদী এখন আমার ঘরের পাশে, নদীর পাড় ভাঙতেতো আছেই, সেই সঙ্গে রাতে বালু কাটার কারণে পাড় নদীতে ভেঙ্গে যায়। এছাড়াও ঝালকাঠি আসা এলপি গ্যাস কোম্পানির জাহাজের ঢেউয়ে নদির পাড় ভাঙ্গছে। কুলকাঠি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার বেল্লাল হোসেন মোল্লা বলেন, ভাঙনকুলে থাকা আমার অনেক স্বজনরা তাদের বাপ-দাদার বাড়ির চিহ্নটুকু রাখতে পারেনি। আমরা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে এবং আমাদের সংসদ সদস্যকে অবগত করেছি। কিন্তু হচ্ছে/হবে বলে আজ পর্যন্ত ভাঙন রোধে কোন সুরাহা পাইনি।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসেন বলেন, নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি ইউনিয়নের ভাঙন কবলিত এলাকা সরইসহ সব স্থান ইতোমধ্যে পরিদর্শন করেছি।

আমাদের প্রাথমিক জরিপ সম্পাদন করা হয়েছে। এরপর একটি ডিজাইন ডাটা প্রেরণ করব। ডিজাইন ডাটা পেলে ওখানে ডিপিপি কার্যক্রম শুরু করা হবে। ডিপিপি কার্যক্রম অনুমোদন পেলে আমরা ওখানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব।

মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর ২০২১ , ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৩

মাটি-বালু খেকোরা বেপরোয়া শীতকালেও ভাঙছে নদীর পাড়

জেলা বার্তা পরিবেশক, ঝালকাঠি

image

ঝালকাঠির সুগন্ধা, বিষখালী ও হলতা নদীর তীর এবং সংলগ্ন ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে সাবাড় করে ফেলছে সংঘবদ্ধ চক্র। অবাধে চলছে ড্রেজারে অবৈধ বালু উত্তোলন এবং এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ঝালকাঠিতে আসা গ্যাস সিলিন্ডার বোঝাই জাহাজের ঢেউয়ের চাপ। তাই শুকনো মৌসুমেও ঝালকাঠি ও নলছিটি এলাকায় নদী ভাঙন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ।

নদী পাড়ের বাসিন্দাদের কাছে ভাঙন এক আতঙ্কের নাম । ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি ইউনিয়নের সরই গ্রামটি প্রতিবছর ভাঙনের কারণে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। অর্থবিত্তরা অন্যত্র জমি কিনে নিজ ভিটা ত্যাগ করছে। আর নিম্নœবিত্তরা সব হারিয়ে অন্যের আশ্রয়ে থেকে ভিক্ষা বা অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছে। ইতোমধ্যেই রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসাসহ সরই গ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি বছর বর্ষায় নদী ভাঙন অব্যাহত থাকলেও শীতকালেও ভাঙছে সরই গ্রামের শেষাংশ। এ বছর তা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়ায় ধারণা করা হচ্ছে গ্রামটি নিশ্চহ্ন হয়ে যাবে।

এ বছর জুন মাস থেকেই জেলার সুগন্ধা, বিষখালী এবং হলতা নদীর ভাঙন বিগত বছরের তুলনায় অনেকটা বেশি। সুগন্ধা নদীর প্রবেশমুখ বিষখালীর তীরে থাকা একটি সাইক্লোন সেল্টার চলতি বছরের ২৬ আগস্ট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানায় বরিশাল-খুলনা নৌ রুটের ঝালকাঠি অংশে এলপি গ্যাস বহনকারী জাহাজের ঢেউয়ের তোড়ে শাখা নদীগুলোও ভেঙ্গে নিচ্ছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলের মাঠ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধভাবে রাতের আধারে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন এবং নৌযানের দ্রুত গতির কারনে নদী তীরের ভাঙনের তীব্রতা অব্যাহত আছে। জেলা প্রশাসন ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীকে বালু মহল ঘোষণা না করলেও দিনের বেলার বালু উত্তোলন বন্ধ করেছে ঠিকই। কিন্তু সিন্ডিকেটের রাতের বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি।

নদীপাড়ের বাসিন্দা সুখী বেগম বলেন, যাদের জমি ভেঙ্গেছে তারা ওই জমির মাটি ইট ভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে ভাঙন আরো বাড়ছে। এছাড়া প্রত্যেক রাতে ডেজারের বালু তোলার কারনে নদীর পাড় ধসে পড়ছে। একইসঙ্গে গ্যাস কোম্পানির জাহাজের তুফানে বাড়ির উঠানে পানি চলে আসে। ছোট বাচ্চা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখি। যাতে নদীতে পরে না যায়। কুলকাঠি ইউনিয়নের সরই গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক আব্দুল জব্বার তালুকদার বলেন, প্রতিবছর সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ পাড় ভাঙ্গতেছে। সরই এলাকার নদীর পাড় থেকে গত কয়েকবছরে প্রায় ৬০টি পরিবার স্থানান্তরিত হয়েছে। একই এলাকার নুর মোহাম্মদ বলেন, সরই গ্রামের ভাঙ্গনকুলের অনেকে নিজেদের সবটুকু ভিটে মাটি হরিয়ে রাস্তার পাশে সরকারি জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছে। আমার নিজের যতটুকু জমি আছে তা আগামী ১ বছরের মধ্যে নদীগর্ভে চলে যাবে। বিশেষ করে রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে এ ভঙন ক্রমান্ব^য়ে তীব্র হচ্ছে। আরেক ভুক্তভোগী শহিদুল ইসলাম বলেন, আমার জন্মস্থানের ঘরটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ৫০ বছরেও এই স্থানটি ভাঙন রোধে কোন সরকার উদ্যোগ নেয়নি। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। ভুক্তভোগী গৃহিনী মোসাম্মৎ নিপা বলেন, নদী এখন আমার ঘরের পাশে, নদীর পাড় ভাঙতেতো আছেই, সেই সঙ্গে রাতে বালু কাটার কারণে পাড় নদীতে ভেঙ্গে যায়। এছাড়াও ঝালকাঠি আসা এলপি গ্যাস কোম্পানির জাহাজের ঢেউয়ে নদির পাড় ভাঙ্গছে। কুলকাঠি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড মেম্বার বেল্লাল হোসেন মোল্লা বলেন, ভাঙনকুলে থাকা আমার অনেক স্বজনরা তাদের বাপ-দাদার বাড়ির চিহ্নটুকু রাখতে পারেনি। আমরা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে এবং আমাদের সংসদ সদস্যকে অবগত করেছি। কিন্তু হচ্ছে/হবে বলে আজ পর্যন্ত ভাঙন রোধে কোন সুরাহা পাইনি।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসেন বলেন, নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি ইউনিয়নের ভাঙন কবলিত এলাকা সরইসহ সব স্থান ইতোমধ্যে পরিদর্শন করেছি।

আমাদের প্রাথমিক জরিপ সম্পাদন করা হয়েছে। এরপর একটি ডিজাইন ডাটা প্রেরণ করব। ডিজাইন ডাটা পেলে ওখানে ডিপিপি কার্যক্রম শুরু করা হবে। ডিপিপি কার্যক্রম অনুমোদন পেলে আমরা ওখানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব।